ফুলদানি, আপেল ও কিন্ডেল

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

খুব জরুরি কোনো বিষয় ছাড়া আমি এখানে লিখি না। রেখেঢেকে কোনো কথাও বলতে পারি না। আবার বানিয়ে বানিয়ে একটা কিছু বলব, সে রকম ক্রিয়েটিভিটিও আমার নেই। বিশ্বাস না হলে আমার টাইমলাইন ঘেঁটে দেখতে পারেন। সুতরাং, আমার ফ্রেন্ডলিস্টে যারা আছেন, তারা ধরে নিতে পারেন যে আজও যা বলার সোজাসুজি বলব।

আমি একটা ই-বুক রিডার বিক্রি করতে চাই, ২০১৯ মডেলের একটা আমাজন কিন্ডেল ডিভাইস। জিনিসটার মালিক আমি নই। তাই বাজারদরের থেকে একটু কম দামে ছাড়ব। আপনারা আবার ভেবে বসবেন না যেন এটা চোরাই মাল। আসলে এটার মালিক আমার বউ। বউ না বলে এক্স বউও বলা যায়। সেটাই যুক্তিসংগত। তার সঙ্গে কাগজপত্রে আমার ডিভোর্স হয়নি, তবে প্রক্রিয়া চলছে। তিন মাস ধরে সেপারেশনে আছি আমরা।

সেপারেশনের জন্য তিন মাস একটু বেশি সময়, নাকি খুবই অল্প, তা বিচার করাটা আমার পক্ষে একটু মুশকিল। মাঝেমধ্যে এই তিন মাসকে মনে হয় অনন্তকাল। আবার কখনোবা মনে হয়, মুহূর্তে কেটে গেছে। পুরোটাই নির্ভর করে যেদিন বিষয়টা নিয়ে ভাবছি, সেদিন পেটে কয় পেগ পড়েছে, তার ওপর।

আমি একজন পেইন্টার। ধরা যাক, একটা ফুলদানির ছবি আঁকছি। তখন সেই ফুলদানির পাশে মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই একটা আপেলের ছবিও আঁকি। এখানে ফুলদানিটা সাবজেক্ট। আর আপেলটাকে বসিয়ে দিই তুলনার জন্য, ব্যাপারটা অনেকটা মাপকাঠির মতো। চালের একক যেমন কেজি, এখানে পয়েন্ট অব ভিউয়ের একক হলো আপেল।

এর মাধ্যমে ছবিটা যে দেখে, সে আপেলের সঙ্গে তুলনা করে ফুলদানিটার আসল সাইজ সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারে। সমস্যাটা হচ্ছে, আমার আঁকা আপেলটার কোনো সুনির্দিষ্ট আকার নেই। সেটা আমার পেটে পড়া মদের ওপর নির্ভর করে। আকারে বড় বা ছোট হয়। সুতরাং আমি সেই আপেলটা দিয়ে তুলনা করলে ফুলদানিটাও আকারে বড়-ছোট হতে থাকে। মাপকাঠি সঠিক ফলাফল দেয় না কখনো। তবে তিন মাস সময়টা বেশি হোক বা কম—এই কথাটা এখন আমি নিশ্চিত ভাবে জানি যে আমার এক্স বউ কখনোই আর তার কিন্ডেল ডিভাইসটা ফেরত নিতে আসবে না।

আর আমার বাসাটা কোনো জাদুঘর নয় যে আমি এখানে বসে বসে স্মৃতি পাহারা দেব। অন্যের একটা স্মৃতি তিন মাস ধরে যথেষ্ট কষ্ট করে দেখেশুনে রেখেছি। এবার এটা বেচে দিতে হবে। জিনিসটার বাজারমূল্য কত, সেটা জানি না। আপনাদের মধ্যে যার এ রকম একটা জিনিস দরকার, তিনি দয়া করে একটু নেট ঘেঁটে অরিজিনাল প্রাইসটা বের করবেন। সেই দামের অর্ধেক প্রাইসে আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি। যারা এত সব দাম খোঁজার ঝামেলা করতে চান না, তারা এক বোতল শিভাস নিয়ে সরাসরি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আমি খুশিমনে জিনিসটা আপনাদের দিয়ে দেব।

সুমন

১২ অক্টোবর ২০১৯

আবারও আমি আপনাদের বিরক্ত করছি। এবারের সমস্যাটা একটু ভিন্ন। খুলে না বললে আপনারা বুঝবেন না।

এক মাস আগে যে পোস্টটা দিয়েছিলাম, সেটা দেখে এক মেয়ে আমাকে ইনবক্স করে। সংগত কারণেই তার নামটা বলছি না। মেয়েটার কথাবার্তা একেবারে রসকষহীন। পুরোপুরি ব্যবসায়িক সুরে যন্ত্রের মতো মেসেজ লিখে সে একটা জায়গা ঠিক করল, যেখানে দেখা করে আমার কাছ থেকে কিন্ডেলটা কিনবে।

আমাদের দেখা হলো ধানমন্ডিতে। মেয়েটা বেশ লম্বা, সাধারণ বাঙালি মেয়েরা এত লম্বা হয় না। দেখতেও বেশ ভালো। তার বয়স কত হতে পারে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা আমি দিতে পারব না। ব্যাপারটা ওই ফুলদানির পাশে আঁকা আপেলটার মতো। কখনো ২৫ মনে হয়, কখনো ৩২। পোশাকে রুচির ছাপ স্পষ্ট। সেদিন সে জিনসের ওপর ফতুয়া পরেছিল।

এক সপ্তাহ পর আমি বসুন্ধরা শপিং মলের ছয়তলা থেকে একটা কিন্ডেল কেসিং কভার কিনলাম। পনেরো শ টাকা নেমে গেল। সেদিনই মেয়েটাকে ইনবক্সে নক করে বললাম, আমার বউ কিন্ডলের একটা কেসিংও ফেলে গেছে। সে ইচ্ছা করলে ওটা এমনিতেই নিয়ে যেতে পারে। পয়সা লাগবে না।

যেহেতু আমি টাকা নেব না, মেয়েটা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কফি অফার করল। পরদিন আমাদের দেখা হলো বেইলি রোডের একটা কফিশপে। এবার আমি তার নাম জানলাম। ফেসবুকে আইডিতে সে একটা ফেক নাম ব্যবহার করে। আসল নাম হলো...। না থাক, বলব না।

এক মাসের মধ্যে বেশ কয়েকবার দেখা করলাম আমরা। আমি মেয়েটাকে পটালাম, নাকি মেয়েটা নিজেই পটে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল—বলা মুশকিল। এটুকু বলতে পারি, অনিবার্য নিয়তির মতো ঘটে গেল ব্যাপারটা। সপ্তমবার কোনো রেস্টুরেন্ট বা কফিশপে না গিয়ে আমরা বাসায় সারা দিন কাটালাম। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বাসায় বসে আমরা দরজা বন্ধ করে রবীন্দ্রসংগীত শুনিনি। সময়টাকে আনন্দময় করার মতো যথেষ্ট উপকরণ আমাদের হাতে মজুত ছিল। সেগুলোর ডিটেইল করে আপনাদের ঈর্ষা বাড়ানোর কোনো কারণ দেখছি না।

অষ্টমবারে আমরা গেলাম গাজীপুরের একটা রিসোর্টে। দুদিন ছিলাম। সেবারই জানতে পারলাম যে তার হাজব্যান্ড আছে এবং আমাদের নবমবার দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরপর থেকে আমাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। সে তার ফোন নম্বর চেঞ্জ করে ফেলেছে। ফেসবুকেও আমাকে ব্লক করা। তার কোনো ঠিকানা আমি জানি না যে খুঁজে বের করব।

আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই, গাজীপুর রিসোর্টে মেয়েটা তার কিন্ডেল ডিভাইসটা ফেলে গেছে। সেটা নিয়ে আবার এক বিপদে পড়েছি আমি। স্মৃতি পাহারা দেওয়ার এক মহান দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়েছে আবার।

এই দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাই। কেউ একজন এক বোতল শিভাসসহ যোগাযোগ করে জিনিসটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যান। আমি কোনো মিউজিয়াম নই। স্মৃতি ব্যাপারটা নিয়ে সব সময় বেশ বিপাকে থাকি।

সুমন

১৯ ডিসেম্বর ২০১৯