ষোলো, ষাট, তেষট্টি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

একটি ষোলো বছরের তরুণীর হাত ধরে আমি একজন ষাট বছর বয়সী মহিলার খোঁজ করছি। পতেঙ্গার সমুদ্রসৈকত লোকারণ্য। করোনা এখনো বিদায় হয়নি, টিকা কখন আবিষ্কৃত হবে, তা বোধ হয় বিজ্ঞানীর চেয়ে জ্যোতিষীরা ভালো বলতে পারবে। কিন্তু মানুষের আচরণে একটা ‘মরলে মরছি’ ধরনের বেপরোয়া ভাব এসে পড়েছে। নইলে ঘরে বসে যাদের দিন গোনার কথা, তারা সমুদ্রের ঢেউ গুনতে এসেছে কেন! অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। আমি যাকে খুঁজছি, সে নিশ্চয় মাস্ক পরেছে। নইলে তাকে দেখছি না কেন? তা ছাড়া আমার চশমাটাও বোধ হয় এবার পাল্টানোর সময় হলো!

‘দেখতে কেমন বলো তো? ‘ষোলো বছরের তরুণী জানতে চাইল।

আমি চেহারা ও শরীর–কাঠামোর একটা ধারণা দিলাম।

হাসি-বিদ্রূপ মিশিয়ে বলল, ‘তুমি তো মনে হচ্ছে অপর্ণা সেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছ।’

‘আরে না, ওকে দেখতে যেমন তা–ই বললাম, নিজের চোখেই দেখিস।’

খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। অকেজো হয়ে আসা চশমার ভেতর দিয়ে দিব্যি দেখতে পেলাম, আমার দিকে এগিয়ে আসছে ষাট। হাঁটার দীপ্ত ভঙ্গিটি নেই, বাম পায়ের ওপর একটু বেশি জোর দিচ্ছে।

ষোলোকে বললাম, ‘এই যে এসে পড়েছে!’

‘হুম্, বর্ণনাটা পারফেক্ট। এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন ভদ্রমহিলা। তবে এখন চুল অনেকটা অ্যাশ কালার, থুতনিতে ডবল চিন...। স্বাভাবিক। আফটার অল অপর্ণা সেনেরও এখন সত্তর পেরিয়ে গেছে।’

ষাট এসে দাঁড়াল সামনে, বিরক্তিতে ভ্রু কুঞ্চিত, ‘তুমি ঠায় এখানে দাঁড়িয়ে আছ? একটু এদিক–ওদিক তাকিয়ে দেখবে না? হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম...।’ কথা বলতে বলতে ষাটের চোখ গেল ষোলোর দিকে, ‘এটা কে? হাতে একটা লাঠি না থাকলে চলতে পারো না, না? ‘

খুব রুক্ষ শোনাল কথাটা, ভেবেছিলাম ষোলো খেপবে, কিন্তু সে দিব্যি হাসিমুখে হাত তুলে সালাম দিল।

ষাট প্রসন্ন হলো, ‘চলো, ওদিকটায় গিয়ে বসি।’

আমরা পাশাপাশি বসলাম তিনজন। এতক্ষণে ঠান্ডা একটা হাওয়ার স্পর্শ পেলাম। দিগন্তরেখার কাছে আকাশ লাল হয়ে আছে, এখুনি ওই দিকটায় সূর্য মিলিয়ে যাবে।

ষাট বলল, ‘কত দিন পর দেখা! অন্তত দশ বছর তো হবেই, তাই না?’

সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ এত দূরে বসে শোনা যায় না, কিন্তু ‘কত দিন পর’ কথাটার মধ্যে কী একটা ছিল, তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরিতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, বললাম, ‘তুমি কেমন আছ লীলা?’

আবার আগের ফর্মে ফিরে গেল, ‘ন্যাকামি কোরো না, লীলা কে? আমি তো লুত্ফুন্নেসা, বড়জোর লুত্ফা ডাকা যেতে পারে।’

‘না, মানে আমি তো ওই নামেই ডাকতাম।’

‘তখন আমার বয়স এই মেয়েটার মতো ছিল, ওই বয়সে সবকিছুই ভালো লাগে, এটাও লাগত।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমাকে এখন থেকে তাহলে লুত্ফাই ডাকব লীলা। ‘

হেসে ফেলল, ‘থাক, লীলাই ডাকো।’

দিগন্তরেখার কাছে সূর্য ডুবে গেল।

আরও দু–একটি কথা হলো। সবই সংসারবিষয়ক। বিধবা হয়েছে চার বছর আগে। ওর তো একটাই মেয়ে, স্বামীর সঙ্গে কানাডায়। শহরের ওপর বড় বাড়ি, লুৎফুন্নেছা একা থাকে। দুজন পরিচারিকা আছে। আমার স্ত্রীও একটা ছেলে রেখে গেছেন। ছেলেটা সময়মতো বিয়ে করেছিল, তার মেয়ে বড় হয়েছে। এখন বউমাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। আমি আগের বউমা আর নাতনির সঙ্গে থাকি। এসব যাবতীয় তথ্য বিনিময়, আর দু–একটি অদরকারি কথা, দশ মিনিটের বেশি লাগল না।

লীলা বলল, ‘এবার উঠি।’

দশ বছর পর দেখা, দশ মিনিটে শেষ হয়ে গেল। বিমর্ষ চেহারায় তাকালাম। ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দিয়ে বলল, ‘এই আমার ঠিকানা, মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ো।’

আশ্চর্য, একই শহরে থাকি, বাড়িতে যেতে বলল না, চিঠি দিতে বলে! এখন কেউ চিঠি লেখে! ফোন করার অনুরোধও তো করতে পারত।

‘খুব সুন্দর চিঠি লিখতে তুমি, এখনো সব রেখে দিয়েছি, মাঝে মাঝে পড়ি।’—এতক্ষণে, এই কথাটা উচ্চারণের সময় গলাটা একটু ধরে এল যেন। কী জানি ধরে এল কি না, নাকি আমারই মনে হলো!

ফেরার পথে আমার নাতনি জানতে চাইল, ‘উনি তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলেন?’

আমি উত্তর না দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসি। যা বোঝার বুঝে নিক।

‘ভদ্রমহিলা কিন্তু খুব হার্শ, কেমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে।’

‘আগে এ রকম ছিল না। সংসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে বোধ হয় মনের ছাল-চামড়া উঠে গেছে।’

‘তো, এই অপর্ণা সেনকে বিয়ে করলে না কেন তুমি?’

আবার উত্তর না দিয়ে হাসলাম, যা বোঝার বুঝে নিক।

‘ক্লিনিক থেকে তোমার রিপোর্টগুলো নিতে হবে।’ আমার তরুণী বান্ধবী মনে করিয়ে দিল।

রিপোর্ট নিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখি ডায়াবেটিস, রক্তচাপ কিছুই নিয়ন্ত্রণে নেই। ডাক্তারের কাছে কিছু কড়া কথা তো শুনতে হবেই, তার ওপর একগাদা ওষুধও গিলতে হবে।

হঠাৎ মাথায় দারুণ একটা বুদ্ধি এল। লুত্ফুন্নেসা বলেছিল, চিঠি দিয়ো। আমি ক্লিনিক্যাল রিপোর্টগুলো খামে ভরে তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যৌবনে সুন্দর সব শব্দচয়ন করে চিঠি লিখেছি। এবার অন্য রকম একটা চিঠি পড়ে দেখুক।

আগে সহজে চিঠির উত্তর দিত না। চার-পাঁচটি চিঠির পর একটির উত্তর পাওয়া যেত হয়তো। কিন্তু এবার তিন দিনের মাথায় লীলার খাম এল। খুলে দেখি ঢিলের জবাবে পাটকেল। পাঠিয়েছে তার হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্ট—ডাকটাল কারসিনোমা। স্তব্ধ হয়ে রইলাম। এ রকম একটা উত্তর তো চাইনি!

‘কী দাদু, আজ মন খারাপ মনে হচ্ছে?’ ষোলো জানতে চাইল।

‘হুম্, অপর্ণা সেনের জন্য খুব খারাপ লাগছে।’

‘কেন, তার কী হলো?

‘ব্রেস্ট ক্যানসার।’

চমকে উঠল। তেষট্টির কাঁধে গভীর মমতার একটা হাত রাখল ষোলো।