আনা ফ্রাঙ্ক: ডায়েরির পেছনের মেয়েটির সত্য ঘটনা

আগামীকাল আনা ফ্রাঙ্কের জন্মদিন। এমন এক জন্মদিনেই একটি ডায়েরি উপহার পেয়েছিল সে। সেই ডায়েরিই এই পৃথিবীতে অমর করে রেখেছে আনা ফ্রাঙ্ককে। তবে নিজের ডায়েরি নিয়ে নিজেই দ্বিধায় ভুগত আনা। ভেবেছিল, ডায়েরিটি কেউ পড়বেই না। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তার বাবার উদ্যোগে প্রথমে প্রকাশিত হয় ডায়েরিটি। প্রকাশের পরই সারা দুনিয়ায় এটি সাড়া ফেলে। আনা ফ্রাঙ্ক ও তার ডায়েরি নিয়ে বার্ট ভন এস 'দ্য গার্ডিয়ান' পত্রিকায় এই লেখাটি লিখেছিলেন গেল বছরের ২৫ মে। আনার সহপাঠী আলবার্টের সঙ্গে কথপোকথনের সূত্রে এই লেখায় অন্তরালের আনা ফ্রাঙ্ককে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিচিত্রভাবে। দেখিয়েছেন আনা কেমন ছিল, তার চিন্তাভাবনা কেমন ছিল, যুদ্ধের সেই সময়টাতে কী ভেবেছিল সে। আনার জন্মদিন উপলক্ষে সেই লেখাটি অনুবাদ করেছেন ফাতেমা রিয়া
আনা ফ্রাঙ্ক
আনা ফ্রাঙ্ক

আলবার্ট ডে মেসকিটা সেসব জীবিত মানুষদের মধ্যে একজন, যাঁরা আনা ফ্রাঙ্ককে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। ইহুদি মহাবিদ্যালয়ের সহপাঠী হিসেবে তিনি আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিতে সংক্ষেপে হাজির হন। আনা লিখেছিল, 'আলবার্ট মেসকিটা মন্তেসরি স্কুল থেকে এসেই এক বছর লাফ মেরে এগিয়ে গিয়েছে, সে আসলেই বুদ্ধিমান।'

ডায়েরিতে আর কিছু নেই। সম্ভবত আলবার্ট তার স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। তবে আলবার্টের জন্য পরিস্থিতি অবশ্যই ভিন্ন। যত বছর গিয়েছে, তাঁর কাছে আনার স্মৃতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আনার জীবন ও কাজ নিয়ে হওয়া আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে ৮৯ বছর বয়সেও তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। আনা এক আশ্চর্য বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছে। আর আলবার্ট সেই জন্মদিনে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে আনাকে ডায়েরিটা উপহার দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আলবার্ট আমাদের কাছে সেই মুহূর্তের যোগসূত্র।

১৯৪২ সালের ১২ জুন ১৩তম জন্মদিনে পাওয়া ডায়েরিটা আনা দুবছরের বেশি সময় রেখেছিল, গোপন ডেরায় সপরিবারে লুকায়িত অবস্থায় নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত। আনার ডায়েরিটা ৬০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ৩০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। এটা পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে একটা।

লিন দে জাংয়ের সাবেক স্বামী আলবার্টকে (আমার বই 'দ্য কাট আউট গার্ল'-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র লিন দে জাং। যেখানে কীভাবে লিনকে আমার দাদা-দাদির সঙ্গে থাকতে পাঠানো হয়েছিল তা বর্ণনা করা হয়েছে এবং নেদারল্যান্ডসের একজন 'পলাতক শিশু' হিসেবে তার মানসিক বিপর্যয় বইটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে) জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আনার প্রকাশিত বইটা পড়ে প্রথমে তার কী মনে হয়েছিল, আর এখনই-বা সে কী ভাবে।

আলবার্ট বললেন, 'প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা তো আমি নিজেও লিখতে পারতাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, এটার বিশেষত্ব এখানে নয় যে ঘটনাগুলো থেকে কী অভিজ্ঞতা লাভ করেছে ( যদিও আমি একই ব্যাপারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি) বরং এটার বিশেষত্ব হলো, তার ব্যক্তিগত উপলব্ধির বিকাশ এখানে ফুটে উঠেছে।'

আলবার্টের পরিবার একই সময়ে, একইভাবে পালিয়েছিল। তারাও ধরা পড়েছিল। তবে তারা আশ্চর্যজনকভাবে ছাড়া পায়, ফ্রাঙ্কদের মতো পরিণতি তাদের হয়নি।

শুধু এক মাসের জন্য আনা ও আলবার্টের দৈনিক যোগাযোগ হয়েছিল। ছোট, লজ্জিত, দুর্বলাকায় বালক আলবার্টের কাছে আনাকে অবশ্য ত্রাস মনে হতো।

জীববিজ্ঞান ক্লাসে একবার তাদের শিক্ষক বললেন, গাধা ও ঘোড়ার মিলনে খচ্চর তৈরি হয়।

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির প্রচ্ছদ
আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির প্রচ্ছদ

এটা কীভাবে হয় জানতে চেয়ে আলবার্ট হাত তুলল, পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। পরে অবশ্য খেলার মাঠে আনাই প্রথম তার কাছে এল ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। আলবার্ট বিচলিতভাবে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করল।

'কালেক্টেড ওয়ার্কস' বইটির যে অংশটি ইংরেজি অনূদিত হয়েছে সেটা সম্পর্কে আলবার্ট বলেন, এটা সত্য এবং দরকারি বটে।

ডায়েরিটা পাঠককে লেখকের সাথে একটা ভ্রমণে নিয়ে যায়।

আনার পরিবার লুকাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত, প্রথম মাসে এই ডায়েরিটা কেবল একজন বুদ্ধিমতী, বহির্মুখী বালিকার গল্প ছিল। ক্রমবর্ধমান ইহুদিভীতি নিয়ে সে অনবহিত ছিল। যুদ্ধের পরিবর্তে সে নিজের চরিত্র ও সুনাম নিয়ে চিন্তিত ছিল।

আনা গর্বভরে লিখেছে, 'আমার দিওয়ানারা তো তাদের প্রেম প্রেম দৃষ্টি আমার থেকে সরাতেই পারে না। ক্লাসরুমে মাঝেমধ্যে তারা ছোট, ভাঙা আয়না দিয়ে আমাকে এক ঝলক দেখতে চায়।'

অবশ্য সেখানে তার স্কুলের সাথিদের নিয়ে কূট বর্ণনাও আছে। সে বিবরণ দেয়, শিক্ষকেরা তার বাচালতায় ক্রুদ্ধ ছিল। শাস্তিস্বরূপ তাকে কিছু রচনাও লিখতে দিয়েছিল। রচনাগুলোর নাম ছিল, বাচাল, শোধরানোর অযোগ্য বাচাল, বাচাল বলে 'কোয়াক কোয়াক'।

শাস্তি হিসেবে লিখতে দেওয়া শেষ রচনাটার উত্তরে আনা একটা প্রহসনমূলক কবিতা লেখে। এই কবিতায় দেখা যায় এক ক্রুদ্ধ রাজহাস হইচই করতে থাকা হংসশাবকদের ওপর হামলা করে।

আরও শাস্তি দেওয়ার বদলে তার শিক্ষক স্বীকার করে নেন কবিতাটা আসলেই ভালো হয়েছে। তাই এটা ক্লাসে পড়ে শোনানো হয়েছিল।

এই চঞ্চল মেয়েটি একদিন হুট করে মুরগির মতো খোপে ঢুকে গেল। অন্ধকার জানালার ছোট ছোট কামরাতে তাদের থাকতে হতো। অন্য একটি পরিবারের সাথে এই জায়গাটা আবার ভাগও করতে হতো এমন এক পরিবারের সাথে যারা তার অপরিচিত ছিল। এই পরিবেশ তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছিল।

আগের মতোই সে উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন ও সাহসী ছিল। তবে সাম্প্রদায়িক জীবনযাপনের সাথে সন্ত্রাস মিশে গিয়েছিল তখন। এটা যখন সে একটু করে বুঝতে আরম্ভ করল, তার ওপরে মারাত্মক প্রভাব পড়ল।

১৯৪৪ সালের ২২ জানুয়ারি আনা তার ২ নভেম্বর ১৯৪২-এর লেখাটা আবার পড়ে এবং সে সম্পর্কে লেখে: 'আমি হয়তো এভাবে আর লিখতে পারব না। এখানে যতটা সময় ধরে আছি পুরো সময়টাতেই আমি অচেতন এবং চেতনভাবে ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং শরীরী প্রেমের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেছি। এই প্রত্যাশার তীব্রতা হয়তো পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু এটা সব সময়ই আছে।'

আনা নিজেকে তার মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করতে থাকল এবং অন্য পরিবারের কর্ত্রী মিসেস ভ্যান পেলসের ওপর তার বিরক্তি জন্মাল।

আনাকে তার শয়নকক্ষ একজন মধ্যবয়সী লোকের সাথে ভাগ করতে হতো। তার ওপরও আনার বিরক্তি বাড়তে থাকে।

ডায়েরিতে সেই লোকের সাথে ছোট ছোট নীরব দ্বন্দ্বের কথা বর্ণনা করার সময় আনা তাকে 'অকর্মার ধাড়ি' বলে সম্বোধন করেছে।

সে পিটার ভ্যান পেলসের প্রেমে পড়ে, যদিও সম্পর্কটা এগোয়নি। একই সময়ে সে নিজের কিশোরী শরীরে পরিবর্তন টের পায়, যৌনতা অনুভব করে এবং হুটহাট অনুভূতিতে পরিবর্তন লক্ষ করতে থাকে, যা মাঝেমধ্যে তাকে কাঁদিয়ে ছাড়ে।

বছর চলে যায়। এত কিছুর মধ্যেও আনা ব্যাপকভাবে পড়াশোনা জারি রাখে। লেখালেখির প্রতি তার তীব্র আগ্রহ গড়ে ওঠে। সে ছোট গল্প, প্রহসনমূলক গল্প লেখে এবং উপন্যাস লেখায় হাত দেয়।

১৯৪০ সালের দিকে ডাচ সরকার রেডিওতে চাকরি দেওয়ার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করে। আনা তার ডায়েরি পুনঃনিরীক্ষা শুরু করে। সে আশা করছিল ডায়েরিটা হয়তো প্রকাশিত হবে। সে মূল পর্বগুলো বড় করে এবং বাকিগুলো মুছে ফেলে। এই সময়ে তার পূর্ববর্তী সত্তার প্রতিফলন ডায়েরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।

আনার ডায়েরির আশ্চর্যজনক ব্যাপারগুলোর মধ্যে একটি হলো, ছোট ও বড় আনার মধ্যে কথোপকথন।

১৯৪৪ সালের ২২ জানুয়ারি আনা তার ২ নভেম্বর ১৯৪২–এর লেখাটা আবার পড়ে এবং সে সম্পর্কে লেখে:

আনা ফ্রাঙ্কের হাতের লেখা
আনা ফ্রাঙ্কের হাতের লেখা

'আমি হয়তো এভাবে আর লিখতে পারব না। এখানে যতটা সময় ধরে আছি পুরো সময়টাতেই আমি অচেতন এবং চেতনভাবে ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং শরীরী প্রেমের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেছি। এই প্রত্যাশার তীব্রতা হয়তো পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু এটা সব সময়ই আছে।'

ডায়েরিটাকে দ্বিতীয় সংস্করণে আরও উন্নত করা হয়। নারীবাদ, ইহুদি পরিচয় এবং শেষ পর্যন্ত কে এই ডায়েরিটা পড়বে, সেটা নিয়ে তীব্র কৌতূহল লেখাগুলোয় ফুটে ওঠে।

১৯৪৪ সালের ২ আগস্ট, আনার শেষ লেখায় অন্তর্নিহিত এই দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়।

'আমি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছি', সে পাঠকদের বলে।

'আমার একটা অংশ প্রফুল্লতা, বাকমুখরতা এবং আনন্দে পরিপূর্ণ। আমি জীবনের ছোট ছোট ব্যাপারগুলোকে মূল্য দিতে পারি। এই দিকটা আমার অন্য দিকটাকে অতর্কিত আক্রমণ করার জন্য অপেক্ষা করে। সেই দিকটা পবিত্র, গভীর, সুন্দর। কেউ আনার ভালো দিক সম্পর্কে জানে না।'

তিন দিন বাদে জার্মান পুলিশ আনাদের গোপন ডেরায় হানা দেয়। বাসিন্দাদের গ্রেপ্তার করে। এক মাস পরে ওয়েস্টারবর্কের ডাচ ট্রানজিট ক্যাম্পে হানা দেওয়া হয় এবং বাসিন্দাদের অশউইজে পাঠানো হয়। ১৯৪৫ সালের মে মাসে আনার বাবা অটো ফ্রাঙ্ক ছাড়া আর সবাই ছিলেন মৃত।

'আনা ফ্রাঙ্ক: দ্য কালেক্টেড ওয়ার্কস' একটা শক্তিশালী বই বটে। এর মধ্যে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির তিনটা ভিন্ন রূপ আছে।

প্রথম পর্যায়ে আনার এলোমেলো, তারিখবিহীন অবান্তর লেখা পাওয়া যায়। এর ধরন বুঝতে, বাহ্যিক সৌন্দর্যের ওপর আনা যে নজর রাখত, সেই তালিকার উদাহরণ দেওয়া যায়:

 

'১. নীল চোখ, কালো চুল--নেই।

২. গালে টোল--আছে।

৩. থুতনিতে টোল--নেই।

৪. বিধবা শিখর ('ভি' আকৃতির চুলের স্টাইল, যেটা কপালের দিকে করা হয়)--নেই।

৫. শ্বেতশুভ্র ত্বক--আছে।

৬. সোজা দাঁত--নেই।

৭. ছোট মুখ--নেই।

৮. কোঁকড়ানো আঁখিপল্লব--নেই।

৯. সোজা নাক--আছে (যত দূর সম্ভব আরকি)।

১০. সুন্দর জামাকাপড়-মাঝেমধ্যে (যদিও আমার মনমতো না)।

১১. সুন্দর নখ--মাঝেমধ্যে।

১২. বুদ্ধিমতী--মাঝেমধ্যে।

প্রথম সংস্করণটি চার খণ্ডে বিভক্ত ছিল। জন্মদিনে উপহার পাওয়া ডায়েরিটায় প্রথম সংস্করণ লেখা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি খণ্ড হারিয়ে গেছে। এটায় সম্ভবত ২ মে ১৯৪৩ থেকে ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৩-এর মধ্যের সময়টা লেখা হয়েছিল।

দ্বিতীয় সংস্করণটা আনার নিজের পুনঃনিরীক্ষণ। এটা ব্যাপকভাবে কার্বনের আলগা কাগজে লেখা হয়েছিল। এই অংশটা ২০ জুন ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত একটানা চলে। এখান থেকে প্রথম সংস্করণের হারিয়ে যাওয়া খণ্ডটার ব্যাপারে ধারণা করা যায়। দ্বিতীয় সংস্করণ তার পূর্বেরটা থেকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ অবশ্যই। এখানে সুক্ষ্মভাবে যুদ্ধের অগ্রগতি এবং ক্ষণ-গণনার বর্ণনা পাওয়া যায়।

এখন যেটা তৃতীয় সংস্করণ বলে পরিচিত সেটা আনার বাবা ১৯৪৭ সালে 'দ্য হিডেন আনাক্স' নাম দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। এই অংশটা থেকে যৌনতার ব্যাপারগুলো বাদ দেওয়া হয়। পলাতক অবস্থায় আনা তার সঙ্গীসাথিদের নিয়ে যে সমালোচনা করেছিল তা-ও মুছে ফেলা হয়। অটো ফ্রাঙ্ক অবশ্য কিছু নান্দনিক পরিবর্তনও এনেছিলেন। তিনি লেখাগুলোকে সুসংগত করতে এবং সাহিত্যগুণ দিতে প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণকে মেশান।

ছোট একটা প্রস্তাবনাও যোগ করা হয়, 'আশা করি, আমি আপনাদের বিশ্বাস করে সব বলতে পারব।'

বইটা ডায়েরিরূপে শুরু হয়:

'আমি সেই মুহূর্ত থেকে শুরু করব যেই মুহূর্তে তোমাকে পেয়েছি। যখন তোমাকে আমার জন্মদিনের অন্যান্য উপহারসামগ্রীর সাথে দেখলাম। (অবশ্য তোমাকে যখন কেনা হয়েছিল তখন আমিও গিয়েছিলাম, তবে সেটা ধরা হবে না।)'

এই বিখ্যাত আরম্ভটা অবশ্য প্রথম সংস্করণ (যেটা জাঁকালো ছবি দিয়ে শুরু হয়) বা দ্বিতীয় সংস্করণ, কোথাও ছিল না। এখানে বেশ আত্মসচেতনতা দেখা যায়:

'আমার মতো কারও জন্য ডায়েরি রাখা অদ্ভুত ব্যাপার বটে। শুধু এই কারণেই নয় যে আগে ডায়েরি রাখিনি, আমার কাছে মনে হয় যে এটা আমার বা কারও জন্যই খুব একটা ব্যাপার না। কে-ই বা তেরো বছরের একজন স্কুলবালিকার বকবক পড়তে চাইবে।'

আনার এই বিখ্যাত বাক্যগুলো এখন শুরুতে আছে। কিন্তু এই বাক্যগুলো প্রথম সংস্করণে আবার আসে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

আজকের পাঠকেদের কাছে আনা ফ্রাঙ্কের যে ডায়েরিটা পরিচিত সেটা তৈরিতে অটো ফ্রাঙ্কের অবদান আছে।

বার্ট ভন এস
বার্ট ভন এস

'দ্য কালেক্টেড ওয়ার্কস' বইটার বিশেষ গুণ হলো এটা পাঠককে ডায়েরিটার ভিন্ন ভিন্ন পুনর্জন্মের মধ্যে দিয়ে বিবর্তনকে দেখার সুযোগ করে দেয়। এই সংগ্রহটায় ডায়েরিটার থেকেও বেশি কিছু আছে। এখানে সুন্দর এবং গতিশীল বর্ণনা আছে। পারিবারিক ছবি, নথিগুলোর সংযুক্তি, পৃষ্ঠাগুলোর অনুলিপি এবং গোপন ডেরার পরিকল্পনা—এসব কিছুই বইটিতে আছে।

আনার বিচিত্র লেখাগুলোও এখানে সংযুক্ত আছে। তার অসম্পূর্ণ উপন্যাস, রচনাসমগ্র, স্মৃতিচারণা, অপ্রকাশিত চিঠিগুলো, বন্ধুত্ব বইতে তার পঙক্তিমালা, 'দ্য ইজিপ্ট বুক' নামক একটি নোট বই, যেখানে ফারাওদের ভূমি নিয়ে সংগৃহীত তথ্যাদি আছে। এই নোট বইটা পলাতক অবস্থায় তার স্বশিক্ষা প্রকল্প ছিল। পরিশেষে সম্পাদকেরা প্রাসঙ্গিক ব্যাপারগুলো উল্লেখ করেছেন।

আনার পরিবারের ইতিহাস (মধ্যযুগ থেকে), ডায়েরির মুদ্রণ এবং নিবেদনের ইতিহাস (সর্বশেষ ২০০৭ সালে প্রকাশিত ফিলিপ রথের উপন্যাস 'এক্সজিট ঘোষ্ট'-এ ডায়েরিটার বর্ণনা আছে)

পুরো কাজটাই একটা সমৃদ্ধ দৃশ্যপট তুলে আনে। এটা পড়ে যে কেউ ভাবতে বাধ্য হবে আনা আসলে কী হতে পারত।

সে ডায়েরিতে সাংবাদিক হতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে লিখেছে:

'আমি লন্ডন ও প্যারিসে এক বছর কাটাতে চাই আর ভাষা শিখতে চাই। অবশ্য কলা-ইতিহাসও পড়তে চাই। তবে আমার জাঁকালো পোশাক এবং আকর্ষণীয় মানুষের ওপরও আগ্রহ আছে।'

এই অংশটায় যে বুদ্ধিদীপ্ত ছবি আঁকা হয়েছে তা পড়লে বোঝা যাবে সে কতটা সহজেই সবকিছু অর্জন করতে পারত।

হয়তো অপ্রাপ্তবয়স্ক আনার লক্ষ্য বিভ্রান্তিকর। তার ডায়েরিটা একজন কিংকর্তব্যবিমুঢ় মেয়ের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে।

সে জানত, এই দুর্যোগের কারণে সে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে কি বাঁচতে পেরেছিল?

সামনের বছর আলবার্ট তাঁর ৯০তম জন্মদিন পালন করবেন। বেঁচে থাকলে এই জুনে আনার সেই বয়স হতো। বেঁচে ফেরা মানুষ হিসেবে আলবার্ট এবং লিনের কাছে পুরোটা জীবন সময় ছিল, ১৯৪০-এর দুঃসহ স্মৃতির দিকে ঘুরে তাকানোর।

আলবার্ট শুধু আনাকেই মনে রাখেননি, সব সহপাঠীকেই মনে রেখেছেন। তাদের একজন হলো লিও স্লাগার। আলবার্টের পরেই যার কথা আনা তার ডায়েরিতে লিখেছিল।

সে লিখেছিল, 'আলবার্ট যে স্কুল থেকে এসেছে সেখান থেকেই এসেছে লিও, তবে অতটা বুদ্ধিমান নয় আরকি।'

আলবার্ট ও লিও একই বেঞ্চে বসত এবং সাইকেলে করে একসাথে স্কুলে আসত। (যত দিন পর্যন্ত ইহুদিদের সাইকেল রাখা নিষিদ্ধ ছিল না।)

একবার যখন তারা একসাথে সাইকেলে আসছিল, লিও হুট করে থেমে গেল, সে আর যেতে চাইল না। আসল কাহিনি হলো, আলবার্ট একটা জার্মান শব্দ ব্যবহার করেছিল। লিও জার্মান আনুগত্য মানতে পারেনি, সে অবশ্য যুদ্ধে বাঁচেওনি।

আলবার্টের জন্য এটা সামান্য হলেও স্বস্তির ব্যাপার যে সে তার পরিবারের সাথে বাঁচতে পেরেছিল। লিন ছিল একাকী বেঁচে যাওয়া একজন। মাথা ঠেকানোর মতো তার কেউ ছিল না। তার শৈশব স্মৃতি মিলিয়ে গিয়েছিল। আমাকে যে ব্যাপারগুলো ধাক্কা দিয়েছে এটা তার মধ্যে একটা। যেসব তুচ্ছ-নগণ্য ব্যাপার আনাকে পূর্ণ করে রেখেছিল (যেমন তার জামাকাপড়ের প্রতি আগ্রহ, ছেলে না মেয়ে আলুর খোসা হবে, এসব নিয়ে কুৎসিত পারিবারিক দ্বন্দ্ব)—এই ধরনের ব্যাপারগুলো লিনের স্মৃতিতে ছিল না। আমরা একসাথে কাজ করেছি, তাই আমাদের লিনের স্মৃতি পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে। ছোট ছোট বর্জিতাংশ থেকে ধাপে ধাপে লিনের স্মৃতিগুলো জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

সাহিত্যকর্ম হিসেবে আনার ডায়েরি ডাচদের জীবনধারণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। অবশ্য একজন পলাতক শিশু হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গি স্বীমাবদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক।

আনা জার্মানিতে জন্মেছিল। চার বছর বয়সে পরিবারের সাথে সে আমস্টারডাম চলে আসে ইহুদি নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য। তার কাছে ডাচদের সাহসী রক্ষাকর্তা মনে হয়েছিল।

যদিও ডাচ ইহুদিদের মধ্যে মৃত্যুহার ৭৫ ভাগ ছিল (সংখ্যাটা যেকোনো পশ্চিমা দেশের তুলনায় দ্বিগুণ), সুতরাং বোঝাই যায় তারা বেশ সহযোগিতাপ্রবণ জাতি ছিল।

সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার করেছে দেশীয় কর্মকর্তারা, জার্মানরা নয়। যারা এটা জানে তাদের কাছে আনার ডায়েরির এই লেখাটা বিদ্রুপাত্মক মনে হবে:

'এখন আমি মুক্তি পেয়েছি। আমার প্রথম ইচ্ছা ডাচ নাগরিক হওয়া। আমি ডাচদের ভালোবাসি। আমি এই ভাষাটাকে ভালোবাসি। আমি এখানেই কাজ করতে চাই। যদি এ জন্য আমাকে রানির কাছে চিঠি লিখতে হয়, লিখব। লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি হাল ছাড়ব না।'

আনা যেভাবে ভেবেছিল সেভাবে মুক্তি পায়নি। এই কথাগুলো লেখার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সে এবং তার বোন বারগেন-বালসেনে থাকা অবস্থায় টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

রক্ষাকর্তাদের এতটা সাহসিকতার পরেও তারা যে দেশটার ‍ওপরে ভরসা করেছিল, সেই দেশটা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই হয়েছিল।

 

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]