অনুবাদ প্রবন্ধ
ব্যঙ্গশিল্প কেন স্বৈরশাসকদের চোখের বিষ
কার্টুন, স্যাটায়ার, প্রহসন—এসব ব্যঙ্গশিল্প নিছক সুকুমার শিল্প নয়। এর রয়েছে এমন শক্তি, যা স্বৈরাচারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। সেই শক্তি নিয়ে লিখেছেন প্রখ্যাত মার্কিন লেখক ও চিন্তক ইয়ান বুরুমা। প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে নেওয়া লেখাটি অনুবাদ করেছেন সারফুদ্দিন আহমেদ
সব রাজনীতিকই যে নিজেদের নিয়ে আঁকা ব্যঙ্গচিত্রকে ঘৃণা করেন, তা নয়। কেউ কেউ বরং সেগুলো পছন্দ করেন, হাসিমুখে অফিসের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের মানবিক দুর্বলতাকে স্বীকার করার সাহস দেখান।
কিন্তু যাঁরা তা পারেন না, তাঁরাই আসলে স্বৈরশাসক। কারণ, স্বৈরশাসনের ভিত্তি হলো ব্যক্তিপূজা। এটি এমন এক মিথ, যা বলে—শাসক সর্বজ্ঞ, অজেয়, ভুলহীন। কিন্তু সেই মিথের একটিমাত্র ছিদ্র বা ফোকর; সেই মিথ নিয়ে একটিমাত্র বিদ্রূপই অনেক সময় স্বৈরশাসকের ক্ষমতার আসন কাঁপিয়ে দিতে যথেষ্ট হয়ে ওঠে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তাঁর মনের ভেতর আছে এক স্বৈরাচারের স্থায়ী ছায়া। ট্রাম্প ঠাট্টা সহ্য করতে পারেন না। বলা হয়, ২০১১ সালের এক রাতে হোয়াইট হাউস করেসপনডেন্টস ডিনারে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সবার সামনে তাঁকে নিয়ে রসিকতা করেছিলেন। সেদিন ট্রাম্পের ভেতরে যে অভিমান জমেছিল, তা থেকেই নাকি তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিজ্ঞা জন্ম নিয়েছিল।
ট্রাম্প তখন কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু আজ ক্ষমতার আসনে বসে তিনি তাঁদের স্তব্ধ করার চেষ্টা করতে পারেন, যাঁরা তাঁকে নিয়ে হাসেন, যাঁরা তাঁকে নিয়ে মশকরা করেন।
গত মাসেই ডিজনির মালিকানাধীন এবিসি নেটওয়ার্কের জনপ্রিয় রাতের অনুষ্ঠান থেকে উপস্থাপক জিমি কিমেলকে সরিয়ে দেওয়া হয়। শোনা যায়, ট্রাম্পের কড়া সমালোচক কিমেল এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পকে ব্যঙ্গ করার পর ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশনের চেয়ারম্যান এবিসিকে চাপ দেন। ফলে কিমেলকে বাদ দেওয়া হয়। ট্রাম্প তখন আনন্দে বলে ওঠেন, ‘এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দারুণ খবর।’
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ চুপ থাকেননি। জিমি কিমেলকে সরিয়ে দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ১৭ লাখ মানুষ ডিজনি+, হুলু, ইএসপিএনের সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে দেন।
জনমতের সেই প্রবল স্রোতে কিমেল আবার ফিরে আসেন পর্দায়। এবিসি তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। কিন্তু ট্রাম্প ততক্ষণে হুমকি ছুড়ে দিয়েছেন, যেসব নেটওয়ার্ক তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ বা হাস্যরস করে, তাদের সম্প্রচার লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
ট্রাম্প অবশ্য ভুল কিছু বলেনওনি। তিনি জানেন, ব্যঙ্গের শক্তি প্রবল, প্রায় বিপ্লবী।
স্বৈরশাসনের ভিত্তি হলো ব্যক্তিপূজা। এটি এমন এক মিথ, যা বলে—শাসক সর্বজ্ঞ, অজেয়, ভুলহীন। কিন্তু সেই মিথের একটিমাত্র ছিদ্র বা ফোকর; সেই মিথ নিয়ে একটিমাত্র বিদ্রূপই অনেক সময় স্বৈরশাসকের ক্ষমতার আসন কাঁপিয়ে দিতে যথেষ্ট হয়ে ওঠে।
ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার একবার বলেছিলেন, ‘আমি জীবনে একটিই প্রার্থনা করেছি, হে প্রভু, আমার শত্রুদের হাসির পাত্র বানিয়ে দাও।’
কারণ, ব্যঙ্গ বা কৌতুক নিছক আনন্দ নয়, এটি ক্ষমতার মুখোশ খুলে দেয়। ব্যঙ্গ, ঠাট্টা, কৌতুক—এগুলো ভণ্ডামি, আত্মগরিমা আর মিথ্যাচারের বর্ম ভেদ করে। আর এই তিন জিনিসই স্বৈরশাসকের প্রধান অস্ত্র।
একটা সময় ছিল, যখন রাজদরবারে থাকতেন ভাঁড়, বিদূষক বা জোকার। তাঁরা রাজাকে নিয়ে মজা করতেন, কিন্তু সীমা মেনে। রাজারা বুঝতেন, চাটুকারদের মধুর মিথ্যা থেকে মাঝেমধ্যে কিছু সত্যও শোনা দরকার। কিন্তু আধুনিক রাজারা, মানে স্বৈরশাসকেরা সেই ভাঁড়দেরও তাড়িয়ে দিয়েছেন।
রোমান সাম্রাজ্যের যুগ থেকেই ব্যঙ্গের নিশানা দুটি। একটি হলো ধারণা, অন্যটি ব্যক্তি। প্রথমটি ধর্ম বা মতবাদ। দ্বিতীয়টি সেই ক্ষমতাধর মানুষ, যে বিশ্বাস বা মতবাদটি ব্যবহার করে নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখে।
ভলতেয়ার প্রথম ধরনের ব্যঙ্গের মহাগুরু ছিলেন। তিনি ক্যাথলিক চার্চকে বিদ্রূপ করতেন। কারণ, চার্চ তাঁর চোখে ছিল কুসংস্কার ও দুর্নীতির জাল। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রথম প্রতারক যখন প্রথম বোকাটির দেখা পায়, তখনই ধর্মের শুরু।’
তবে ব্যঙ্গ সব সময় বামপন্থী বা উদার মানসিকতার কাজ নয়। ইতিহাসে বহু রক্ষণশীল ব্যঙ্গকার ছিলেন। গালিভারস ট্রাভেলস–এর লেখক জনাথন সুইফট তাঁদের একজন। তিনি অ্যাংলিকান চার্চের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। যে আদর্শবাদীরা সমাজ বদলের উন্মাদনায় রসবোধ হারিয়ে ফেলেন, সুইফটের মতো রক্ষণশীল ব্যঙ্গকারেরা তাঁদের নিয়ে স্যাটায়ার করতেন।
স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গের আরেক ধরন আছে। এটি সরাসরি ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের চরিত্র ও আচরণকে নিশানা করে। এ ধরনের ব্যঙ্গকারেরা সত্যিই সাহসী। কারণ, তাঁরা সেই সত্যই বলে দেন, যা সবাই জানে কিন্তু উচ্চারণ করতে ভয় পায়। ‘রাজা আসলে উলঙ্গ’—এই সত্য বলতে অন্যরা ভয় পায়, কিন্তু ব্যঙ্গকারেরা তা কৌতুকের মধ্য দিয়ে বলে দেন।
যেমন বব ডিলান একবার লিখেছিলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও কখনো কখনো ন্যাংটো হতে হয়।’
স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গের আরেক ধরন আছে। এটি সরাসরি ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের চরিত্র ও আচরণকে নিশানা করে। এ ধরনের ব্যঙ্গকারেরা সত্যিই সাহসী। কারণ, তাঁরা সেই সত্যই বলে দেন, যা সবাই জানে কিন্তু উচ্চারণ করতে ভয় পায়। কিন্তু ব্যঙ্গকারেরা তা কৌতুকের মধ্য দিয়ে বলে দেন।
এ ধরনের ব্যঙ্গ সাধারণ রাজনীতিকদের জন্য প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু রাজা, রানি ও স্বৈরশাসকদের জন্য তা বড় হুমকি। কারণ, তাঁদের ক্ষমতা নির্ভর করে একধরনের অলৌকিক ভাবমূর্তির ওপর। মানুষ তাদের বশ হয়ে থাকে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে—এঁরা অজেয়, অপরাজেয়। স্বৈরশাসকেরা বিশাল এক নাট্যমঞ্চের মতো পরিবেশ তৈরি করে নিজেদের চারপাশে এমন এক গৌরবময়, অজেয় ও দেবতুল্য আবহ সৃষ্টি করেন, যাতে সাধারণ মানুষ তাঁদের অপরাজেয় ও সর্বশক্তিমান বলে মনে করে।
কিন্তু যখন কৌতুক অভিনেতারা এই নাট্যমঞ্চে সুচ ফোটান এবং ব্যঙ্গের মাধ্যমে রাজা বা শাসককে হাস্যকর, ফাঁপা লোক হিসেবে প্রকাশ করে ফেলেন, তখন মূলত তাঁরা সরাসরি স্বৈরাচারের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দেন। ব্যঙ্গ, হাসি, ঠাট্টা—এ সামান্য জিনিসগুলোই রাজার বানানো কৃত্রিম জৌলুশভরা নাট্যমঞ্চের পর্দা ছিঁড়ে ফেলে।
১৯৪০ সালে চার্লি চ্যাপলিনের দ্য গ্রেট ডিক্টেটর সিনেমাটি দেখার পর হিটলার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। সে ছবিতে হিটলার বা মুসোলিনির হত্যাযজ্ঞ নয়, কেবল তাঁদের হাস্যকর ভাঁড় হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু সেটাই ছিল হিটলারের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত। কারণ, কোনো স্বৈরশাসকের কাছে এর চেয়ে বড় অপমান নেই, যখন মানুষ তাকে নিয়ে হাসতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এ ব্যঙ্গের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যঙ্গচিত্রকারেরা ছিলেন নির্মম। টমাস রোল্যান্ডসন ওয়েলসের রাজপুত্রকে মাতাল লোক হিসেবে এঁকেছিলেন। অনারে দোমিয়ে রাজা লুই ফিলিপকে অশালীন ভোজনরসিক হিসেবে তুলে এনেছিলেন ক্যানভাসে।
এই ব্যঙ্গ, যেমন হলুদ সাংবাদিকতা বা গসিপ ছিল আসলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মূল্য। আর যুক্তরাষ্ট্রে সেই স্বাধীনতা সংবিধানের ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টে সুরক্ষিত, যা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে শক্তিশালী। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে জননেতাদের সমালোচনা করা যায়। তাঁদের নিয়ে প্যারোডি করা যায়। এমনকি মানহানিকর রসিকতাও করা যায়—যতক্ষণ না তা ‘বাস্তব বিদ্বেষ’ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো চেকোস্লোভাকিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতা মিলোশ ফোরম্যান ১৯৯৬ সালে দ্য পিপল ভার্সেস ল্যারি ফ্লিন্ট নামের একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপশিল্প নিয়ে একটি আইনি লড়াই দেখিয়েছেন।
সিনেমায় দেখানো হয়, পর্নো ম্যাগাজিন হাসলার-এর মালিক ল্যারি ফ্লিন্ট একটি ব্যঙ্গাত্মক বিজ্ঞাপন ছাপেন। ওই বিজ্ঞাপনে জেরি ফালওয়েল নামের একজন ধর্মযাজককে নিজ মায়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের কথা স্মরণ করতে থাকা এক বিকৃত চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়। এরপর ফালওয়েল ‘মানসিক কষ্টের’ অভিযোগ এনে হাসলার ম্যাগাজিনের মালিক ফ্লিন্টের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। এ নিয়ে মামলা চলতে থাকে।
১৯৮৮ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে রায় দেন—কেবল মানসিক কষ্ট কারও ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত কারণ হতে পারে না। কেবল মানসিক কষ্ট কোনোভাবেই কারও বাক্স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না। জনসমালোচনা, ব্যঙ্গ ও প্যারোডির অধিকারই বড়।
কিন্তু ১৯৮৮ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে রায় দেন—কেবল মানসিক কষ্ট কারও ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত কারণ হতে পারে না। কেবল মানসিক কষ্ট কোনোভাবেই কারও বাক্স্বাধীনতা হরণ করতে পারে না। জনসমালোচনা, ব্যঙ্গ ও প্যারোডির অধিকারই বড়।
মিলোশ ফোরম্যান মূলত কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়া থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর কাছে যুক্তরাষ্ট্র ছিল এমন এক দেশ, যেখানে একজন অশালীন পর্নোগ্রাফারও একজন ধর্মযাজককে ব্যঙ্গ করার অধিকার রাখেন।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাইকে চুপ করিয়ে দিতে চাইছেন। ট্রাম্প যদি সফলভাবে তাঁর সমালোচকদের (বিশেষত যাঁরা তাঁকে নিয়ে প্রকাশ্যে হাসাহাসি করেন) স্তব্ধ করিয়ে দিতে পারেন, তাহলে সেটি আর সেই যুক্তরাষ্ট্র থাকবে না, যে যুক্তরাষ্ট্র একসময় মিলোশ ফোরম্যান ও লাখ লাখ মানুষের কাছে ছিল স্বাধীনতার প্রতীক, আশ্রয়ের ঠিকানা।