ভূমিকা
মেইস্টার এখার্ট (Meister Eckhart, ১২৬০–১৩২৮) জার্মান মরমিবাদের এক দীপ্তিমান পুরুষ। আনুমানিক ১২৬০ সালে জার্মানির থুরিঙ্গিয়ার হোখহাইমে তাঁর জন্ম। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ডমিনিকান সন্ন্যাস সংঘে প্রবেশ করেন। তাঁর সে পদক্ষেপ ছিল একাধারে আত্মত্যাগ ও আত্ম-আবিষ্কারের সূচনা।
এখার্ট ঈশ্বর, আত্মা ও প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে গভীর চিন্তার সূত্রপাত করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে জার্মান মরমিবাদ ও আধুনিক অস্তিত্ববাদী দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর মরমিবাদ কবিতারও এক আধ্যাত্মিক দিগন্ত উন্মোচন করে।
তাঁর এই প্রত্যক্ষ ঈশ্বর-সংলগ্নতা, প্রতিষ্ঠিত চার্চ–কাঠামোকে এড়িয়ে যাওয়ার সাহস এবং ব্যক্তিগত ঈশ্বরানুভূতির ওপর জোর—তাঁকে বিতর্কিত করে তোলে। তাঁর চিন্তাধারা তখনকার স্কলাস্টিক ধর্মতত্ত্বের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চার্চ কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধিতার অভিযোগ তোলে। কিন্তু এখার্ট দৃঢ়তার সঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তিনি বলেন, তিনি ঈশ্বরের অখণ্ড অবিভাজ্যতায় বিশ্বাস করেন এবং তিনি যা উচ্চারণ করছেন, তা তাঁর গভীর ধ্যানমগ্নতা থেকে উৎসারিত। এই দৃঢ়তায় তিনি বেঁচে থাকলেও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনেক রচনাকেই চার্চ দমন করে।
তিনি জানতেন, ভাষা সীমিত—কিন্তু প্রতীক ও রূপকের ভেতর দিয়ে ভাষার সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তিনি আশ্রয় নেন গভীর কাব্যিক আলংকারিকতায়, আত্মজিজ্ঞাসায়, নিঃসঙ্গ নীরবতায়।
‘নীরবতার মধ্যেই মানুষ তার পূর্ণ সত্যতা রক্ষা করতে পারে।’
তাঁর শিক্ষায় এক অন্তর্মুখী আহ্বান থাকে ঈশ্বরকে বাইরে নয়, নিজের ভেতরে খোঁজার জন্য:
‘ঈশ্বর তোমার মধ্যে প্রবেশ করেন
ঠিক যতটা তুমি নিজেকে সমস্ত জগৎ থেকে খালি করেছ।
এখান থেকেই শুরু করো,
যেকোনো মূল্যেই হোক—
কারণ এখানেই শান্তি, অন্য কোথাও নয়।’
মেইস্টার এখার্টের ঐতিহাসিক সম্মান বহুদিন পর ফিরিয়ে আনার প্রয়াস নিয়েছে তাঁরই সন্ন্যাস সংঘ ডমিনিকান অর্ডার। ১৯৮০ সাল থেকে তাঁরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে এখার্ট ছিলেন একজন মহান আধ্যাত্মিক পথিক ও নিঃসন্দেহে একজন খ্রিষ্টীয় সাধক।
মেইস্টার এখার্টের কবিতা • ঈশ্বর সব সময় প্রস্তুত থাকেন
ঈশ্বর সব সময় প্রস্তুত থাকেন
কিন্তু আমরাই প্রস্তুত নই।
ঈশ্বর আমাদের খুব কাছাকাছি,
তবু আমরা তাঁর থেকে দূরে।
ঈশ্বর আমাদের অন্তরে,
আর আমরা বাইরে।
ঈশ্বর তাঁর ঘরেই আছেন,
আর আমরা সেই ঘরের অচেনা অতিথি।
বাজি ধরেছিলাম ঈশ্বরের সাথে
বাজি ধরেছিলাম ঈশ্বরের সাথে
যদি তিনি আমার হাত ছেড়ে দেন,
তবে আমি এত জোরে কাঁদতাম,
এত আকুতি জানাতাম,
এত ঝামেলা করতাম
যে ঈশ্বরও বিবেচনায় ফিরে আসতেন,
আর কখনোই
হাত ছাড়তেন না।
মানুষ
মানুষ যতটা আকাঙ্ক্ষা করে,
তার চেয়ে অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষা করেন ঈশ্বর
একজন মানুষকে তাঁর কাছে টেনে আনতে,
যাতে মানুষ তাঁকে জানতে পারে।
নবী বলেছেন
নবী বলেছেন:
ঈশ্বর মুক্ত আত্মাদের
একটি সংকীর্ণ পথ দিয়ে
এক প্রশস্ত রাজপথে নিয়ে যান,
তাঁরা প্রবেশ করেন বিস্তৃত ও মুক্ত জায়গায়;
অর্থাৎ—
যখন একজন আত্মা হয়ে ওঠে ঈশ্বরের সঙ্গী,
তখনই সে পায় প্রকৃত আত্মিক স্বাধীনতা।
ভালোবাসার আশায়
কী আমাদের জীবিত রাখে,
কী আমাদের সহ্য করতে শেখায়?
আমার মনে হয়—
তা হলো ভালোবাসার আশা,
বা ভালোবাসা পাওয়ার আশা।
একটা গল্প শুনেছিলাম—
সূর্য একদিন বেরিয়ে পড়ল তার উৎস খুঁজতে,
আর চাঁদ তখন কাঁদছিল—
তার প্রেমিকের উষ্ণ দৃষ্টি না পেয়ে।
আমরাও কাঁদি, যখন আলো আমাদের হৃদয়ে পৌঁছায় না।
আমরা শুকিয়ে যাই খেতের মতো,
যদি কোনো প্রিয়জন
আমাদের হৃদয়ে
তাঁর দয়ার বৃষ্টি না বর্ষণ করেন।