ফিলিস্তিনের গল্প
ট্রেন
মাহমুদ রিমাভি ফিলিস্তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। জন্ম ১৯৪৮ সালে। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের পাশাপাশি কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। আরব দুনিয়ায় সমসাময়িক ছোটগল্পকার হিসেবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। নির্বাসনের বেদনাময় স্মৃতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তিনি সংবেদনশীল ও পরিমিত ভাষায় গল্পে রূপ দিয়েছেন। তাঁর বহুল আলোচিত গল্পগুলোর একটি ‘ট্রেন’—অনুবাদ করেছেন মনযূরুল হক
ট্রেনটি কেবল যাত্রী আর মালপত্রে ঠাসা ছিল না, ভরা ছিল উত্তেজনায়, আবেগে। এটি একটি পুরোনো ট্রেন, সেই সব ট্রেনের মতো যেগুলো সৈন্যদের বহন করে, আমরা যুদ্ধের সিনেমায় যেমন ট্রেনে দেখি।
‘যখন থেকে ট্রেনটা বানানো হয়েছে, তখন থেকে আমাদের নিয়ে ছুটছে,’ পাশে বসা পঞ্চাশোর্ধ্ব ডাক্তার প্রতিবেশী আমাকে বললেন। তার কথায় সন্দেহ করার কারণ ছিল না। ট্রেনে ওঠার আগের কিছুই আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না। ট্রেনের গর্জনের মধ্যে আমার জাগরণ, তার ঝংকারের মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। ছুটছে অবশ্য দ্রুতই, সময় যেন আমাদের পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
আমার পাশের সঙ্গীর সঙ্গে আমি খুব কমই কথা বলতাম। চামড়ার সিটে পাশাপাশি বসে আমরা কেবল তীব্র ঝাঁকুনির সময় দৃষ্টি বিনিময় করতাম। চারপাশের হট্টগোল, কথার গুঞ্জন আমার কথা বলার ইচ্ছাকে গ্রাস করে নিত। বেশ কয়েকবার বলতে গিয়েও দেখেছি আমার মুখ খোলার আগেই আলো নিভে যায়। অন্ধকারে কথা বলতে পারতাম, নিশ্চয়ই। জোরে কথা বললে তিনি শুনতেনও। কিন্তু অন্ধকারে কথার প্রভাব আলোর মতো হয় না। হঠাৎ অন্ধকার নেমে এলে আমার চিন্তা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তা ছাড়া এমন সময়ে কে বলতে পারে, কেউ কোনো অপরাধ ঘটাবে না?
সামনের দুই প্রতিবেশী—একজন খাটো মোটা, আরেকজন লম্বা টাকওয়ালা—তারা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। লাভ-ক্ষতি, ব্যবসার নীতি, হাতছাড়া না হওয়া সুযোগ, কী করা উচিত, কী উচিত নয়—এসব নিয়ে তাদের কথা থামে না। উচ্চৈঃস্বরে, উত্তপ্ত নিশ্বাসে তারা কথা বলে; পরস্পরের সমঝোতা দৃশ্যমান। তাদের কথায় ছেদ পড়ে না—না হঠাৎ অন্ধকারে, না হট্টগোলে।
তবু আমাকে কথা বলতে হতো। পাশের সঙ্গী ছিলেন সাধারণ ধরনের মানুষ, আমার নীরবতার জবাবে নীরবতা, কথার জবাবে কথা।
‘টানেল,’ তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘টানেলে ঢোকার সময় আলো নিভে যায়। এগুলো এত দীর্ঘ যে...’
‘আমি কি এমন সময়ই কথা বলার জন্য বেছে নিলাম?’ আমি বললাম।
‘না, তুমি বেছে নাওনি। এটাই ঘটে।’
প্রতিবার টানেলের কাছাকাছি এলে আমার কথা বলার তাগিদ বেড়ে যায়, যদিও জানতাম না আমরা টানেলের কাছে কি না। যদিও এগুলো টানেলমাত্র, যাত্রীরা তবু এটাকে সহজভাবে নিত না। প্রথমে গুঞ্জন, তারপর চিৎকার, তারপর আলো নিভে যাওয়ার প্রতিবাদ। আমিও সাহস পেয়ে কথা বলতাম। আর তেমনই চলতে লাগল।
ট্রেনটি ছিল বিশাল, একটি শহরের মানুষ ধরার মতো। দৃষ্টিসীমা যত দূর যায়, তত বড়। গ্রামের শীতের রাতের চেয়েও দীর্ঘ। বগি অসংখ্য। প্রতিটা বগি একটা আস্ত ট্রেনের মতো ভারী। যাত্রীরা একে অপরকে চিনত, আর যারা চিনত না—যেমন আমি আর ডাক্তার—তারাও এই যাত্রায় পরিচিত হয়েছে। এ এক কঠিন, দীর্ঘ যাত্রা, আমাদের কল্পনার চেয়েও দীর্ঘ। কখন পৌঁছাব, তা আমরা জানতাম না। শুধু জানতাম, আমাদের ট্রেন তার পথে চলছে। যতক্ষণ চলছে, ততক্ষণ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
এ একটি অদ্ভুত ব্যাপার। সাধারণ ট্রেনের মতো নির্দিষ্ট সময়সূচি, আগমন-প্রস্থানের নিয়ম এখানে নেই। কথাটা আমার সঙ্গীকে বললাম। বেশ কিছুদিন আমরা কথাই বলিনি। আমার প্রশ্নে তিনি অবাক হলেন না, তাঁর শান্ত, স্থির ভাবে কোনো ছেদ পড়ল না। মনে হলো, এই প্রশ্ন তিনি আগেও শুনেছেন, বারবার উত্তর দিয়েছেন।
‘আমাদের ট্রেন অন্য সব ট্রেনের মতো নয়,’ তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, একটু বিরক্তির ছোঁয়া তার কণ্ঠে। বললেন আমার দিকে না তাকিয়ে, যেন তিনি ট্রেন চালাচ্ছেন বা আমি ছাড়া অন্য কাউকে বলছেন বা কাউকেই বলছেন না।
‘কেন? কেন আমাদের ট্রেন অন্যদের মতো হবে না? কেন আমরা অন্য যাত্রীদের মতো হব না?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এবার তিনি একটু উত্তেজিত হলেন। ‘এর উত্তর আমি দেব না। আমি তোমার মতোই একজন যাত্রী।’
কিন্তু তিনি আমার মতো ছিলেন না। তিনি সব সময় পড়তেন—পুরোনো বই, খবরের কাগজ, মানচিত্র। নোট লিখতেন। কয়েক ঘণ্টার জন্য উধাও হয়ে যেতেন, রাতে ফিরতেন।
‘কত দিন হলো আমরা এই ট্রেনে উঠেছি?’ নিজেকেই বললাম, কিন্তু কণ্ঠস্বর বোধ হয় একটু জোরে শোনা গেল।
তিনি হেসে আমার প্রশ্নটাই ফিরিয়ে দিলেন, ‘কত দিন? যখন থেকে এটা তৈরি হয়েছে, তখন থেকে।’
এই নিয়ে আমি আর কখনো কথা বলিনি। চারপাশেও এমন কথা শুনিনি। এই কথা আমাদের ভেঙে দিত, আমাদের অতীতে ডুবিয়ে দিত। বয়স্করা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, মাথা নাড়তেন বিরক্তি আর ক্ষোভে। আর আমরা, তরুণেরা, দৃঢ় উচ্চারণে বলতাম, ‘কত সময় গেছে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, কত সময় বাকি।’
হঠাৎ হট্টগোল শুরু হলো। নারীরা ছোটাছুটি করছে, জানালার পর্দা নামানো হচ্ছে। একজন গর্ভবতী যাত্রী সন্তান প্রসব করলেন। আমার পাশের ডাক্তার ফিরে এসে বললেন, তিনিই প্রসবের কাজটি করিয়েছেন।
‘তার মানে, নতুন একটি যাত্রী আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে?’
‘হ্যাঁ,’ তিনি বললেন। ‘তুমি কি জানতে না? মেয়ে হয়েছে। একটি মেয়ে।’
‘নাম কী রেখেছে?’
‘ফিলিস্তিন।’
‘সত্যিই এই নাম?’
‘হ্যাঁ। যদি ছেলে হতো, মা–বাবা এই নাম রাখতে পারতেন না, যদিও তাঁরা নামটি খুব ভালোবাসেন।’
‘কী নাম দেখো!’ আমি বললাম। ‘যেন মেয়ের নাম রাখা হয়েছে “মেয়ে”।’ আমার কথা বলার ইচ্ছা বেড়ে গেল। ‘জানি, অনেকেই তাদের মেয়ের নাম ফিলিস্তিন রাখতে চায়, কিন্তু খুব কম লোকই তা করে। ফিলিস্তিনকে আমি চল্লিশ বছরের একজন নারী হিসেবে কল্পনা করি, নবজাতক শিশু নয়। মায়েরই এমন সুন্দর নাম থাকা উচিত।’
আমি বলে চললাম, ‘মানুষ জন্মায়, বড় হয়, মরে। যদি তার কিছু হয়ে যায়? আমরা কি বলব, সে...না, আল্লাহ না করুন!’
ডাক্তার আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আমার স্পষ্ট কথায় তিনি খুশি হলেন। থামতেই তিনি গম্ভীর, উষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘নামের ওপর কোনো শর্ত নেই। নামে অর্থ থাকতে পারে, প্রভাব থাকতে পারে বা তা উত্তরাধিকার হতে পারে। প্রতিটি যুগের নিজস্ব নাম আছে। আরবরা সাধারণত তাদের সন্তানদের নাম দেশের নামে রাখে না। কিন্তু আমাদের অবস্থা একটু ভিন্ন। নইলে আমরা এই ট্রেনে থাকতাম না।’
আমি তাঁকে ‘ডাক্তার’ বলে ডাকি, তাঁর নামের চেয়ে তার পেশাটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আমাকে কখনো ‘ভাই’, কখনো ‘প্রফেসর’ বলে ডাকেন। হয়তো আমরা নাম এড়িয়ে চলি, যাতে অতীতে ডুবে না যাই।
‘তাদের জন্য,’ তিনি বললেন, ‘অন্তত তারা তাকে সবচেয়ে প্রিয় নামে ডাকতে পারবে, বারবার।’
বললাম, ‘এদিক থেকে ঠিক।’ তারপর একটু ঠাট্টার সুরে বললাম, ‘তারা তাঁকে গালি দিতে পারবে না, শাসন করতে পারবে না। এই সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবে।’
কিন্তু শিশুটির কথা ভেবে আমার বিস্ময় কাটছিল না। তার জন্মস্থান কোথায়? বড় হয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে সে কী উত্তর দেবে? নিজের মনে বললাম, ‘এটা কোনো সমস্যা না। আমাদের সমস্যাগুলো ভিন্ন।’
চারপাশের যাত্রীরা—নারী-পুরুষ কেউ আমার বিস্ময়ে সায় দিল না। হট্টগোলের মধ্যে এক তরুণীর কণ্ঠ শুনলাম, ‘চার-পাঁচ ঘণ্টার বিমানযাত্রায়ও নারীরা সন্তান প্রসব করে। তাহলে ট্রেনে কেন হবে না?’
আমার সঙ্গীও কথাটি শুনলেন। তাঁকে বললাম, ‘ঠিকই, মাটিতে এটা কেন অদ্ভুত হবে? এই ট্রেনে আমরা যাত্রী হিসেবে উঠেছি, কিন্তু এখন যেন বাসিন্দা।’ বললাম উত্তেজিতভাবে, যেন নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। তিনি বললেন, ‘আমি আর গুনতে পারি না, কয়বার এই ট্রেনে গর্ভবতী নারীদের প্রসব করিয়েছি।’
‘আমি তো লক্ষ করিনি!’ আমি বললাম।
‘তুমি লক্ষ না করলে তা ঘটেনি, তা নয়,’ তিনি বললেন।
তাঁর মুখে হাসি ফুটল, কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত মুখে, সরু চোখে সহানুভূতি ঝরছিল। তিনি আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘যাত্রাপথে অনেক নারীর গর্ভ ফুলে উঠেছে।’
আমি অবাক হয়ে চারপাশে তাকালাম। ‘এমন ঘটনা এখানে ঘটে?’
‘কেন ঘটবে না?’ তিনি বললেন। আবার বলতে গিয়েছিলাম, ‘আমি তো লক্ষ করিনি,’ কিন্তু হাসি চেপে রাখলাম।
‘ট্রেন থামছে না বলে জীবন কি থেমে যাবে?’ তিনি আমার বিস্ময় বুঝতে পেরে বললেন, ‘তুমি আমার পরে ট্রেনে উঠেছ। আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়।’
এই বোঝাপড়ায় আমি নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ পেলাম, যেন আমার ওপর থেকে অজ্ঞতার অভিযোগ তুলে নেওয়া হলো। ‘তার মানে আমরা এই ট্রেনে জন্মাচ্ছি, মরছি?’
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘বিনা কারণে আমরা মাঝপথে থামি না।’
ট্রেন শুধু দূরবর্তী স্টেশনগুলোতে থামত। সেখানে চারদিকে দৃষ্টি যত দূর যায়, ক্ষীণ আলো জ্বলছে, বাড়িগুলো দূরে দূরে, নিঃসঙ্গ গাছগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যেন ভূত—দাঁড়িয়ে আছে না নড়ছে, কাছে আসছে না দূরে যাচ্ছে, বোঝা যায় না। এমন নির্জন স্টেশন, যেখানে খাবারের টুকরা, বিপথগামী বিড়াল বা কুকুরের চিহ্নও নেই। গভীর রাতে আমরা সেখানে থামি। স্টেশনগুলো ট্রেনের চেয়েও নির্জন, বন্ধ। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখি, উঁচু, নীরব আকাশের দিকে তাকাই, অচেনা মাটিতে পা ঠুকি। তখন আমাদের একটাই ইচ্ছা থাকে—ট্রেনটা আবার চলুক।
আমরা একে অপরের দিকে তাকাই শুধু দেখতে, ট্রেনের ভেতর আর বাইরে আমাদের চেহারা কতটা আলাদা। তাড়াতাড়িই আমরা ভেতরে ফিরি, একে অপরকে আবার দেখি। কে জানে, কেউ হয়তো সেখানে নেমে গেছে, অন্ধকারে পথ করে চলে গেছে; তার পরিবারকে ট্রেনে ফেলে গেছে জানিয়ে বা না জানিয়ে। ট্রেনের তীক্ষ্ণ বাঁশি বেজে ওঠে, চলবে বলে ঘোষণা দেয়। আমরা দূর থেকে গুলির শব্দ শুনি। নিশ্চিত হওয়ার আগেই ট্রেন ছুটে চলে তার ভারী ভর আর দমবন্ধ শব্দ নিয়ে।
প্রত্যেকে নিজ নিজ বগিতে ফেরে। অন্য বগিতে যাওয়া নিষিদ্ধ, যদি না প্রহরীদের ফাঁকি দেওয়া যায় বা তাদের সন্তুষ্ট করা যায়। আমার সঙ্গী শান্তভাবে বললেন, তিনি আমার পাশে বসে আছেন, কিন্তু তাঁর স্ত্রী আর তিন সন্তান অন্য বগিতে। যাত্রা শুরুর পর থেকে তিনি তাদের দেখেননি।
‘তারা কি একসঙ্গে ওঠেনি?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তখন এমন বিশৃঙ্খলা আর ট্রেন হঠাৎ ছাড়ার ভয় ছিল যে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’
‘তোমার পরিবারের ঘটনা কী?’ তিনি সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমার কোনো পরিবার নেই,’ আমি লজ্জায় সংক্ষেপে বললাম। তারপর পরিষ্কার করলাম, ‘আমার মা মারা গেছেন। বাবা ট্রেনে ওঠেননি।’
আমি মুখ ঘুরিয়ে বন্ধ উঁচু জানালার দিকে তাকালাম। বাইরের অন্ধকার, নির্জনতায় ভরা দৃশ্য দেখলাম। ‘মা মারা গেছেন, বাবা পাশে থাকতে চেয়েছিলেন। আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি থেকে গেছেন। আর এই ট্রেন আমার চল্লিশ বছরের জীবন ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম। তিনি বললেন, ‘এমনটাই আশঙ্কা করছিলাম আমি।’
‘কেন আশঙ্কা করলেন?’
‘খুব স্পষ্ট। তুমি নিঃসঙ্গ মানুষের মতো আচরণ করো।’
তার স্পষ্ট কথায় হতবাক হলাম। এত মানুষের ভিড়েও আমার একাকিত্ব এত প্রকট, ভাবিনি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, এত দেরি হওয়ার পরও এই ট্রেন আমাদের শেষ স্টেশনে পৌঁছে দেবে?’
তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘আমি তা-ই বিশ্বাস করি। কিন্তু কখন, তা জানি না।’
তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘ট্রেন হয়তো আমাদের পৌঁছে দেবে না, কিন্তু আমরা পৌঁছে যাব।’
‘কীভাবে?’
তিনি উত্তর দিলেন না। বারবার জিজ্ঞেস করার পর তিনি গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন আমাকে বিব্রত করতে চান। ‘কী হলো? আপনার এই রহস্যময় দৃষ্টির মানে কী?’
তিনি উত্তর দিলেন না। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট বের করলেন। ডাক্তার, অথচ ধূমপান করেন! এত দিন তাঁকে ধূমপান করতে দেখিনি। সিগারেট তিনি জ্বাললেন না, শুধু আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখলেন। তার দৃষ্টি আবার আমার ওপর স্থির হলো, যেন আমার ভেতরটা তন্ন তন্ন করে দেখতে চান।
‘এটা কি অদ্ভুত না?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘কী অদ্ভুত?’
‘তুমি থামার স্টেশনগুলো নিয়ে ভাবোনি।’
আমার হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাতে লাগল। আমরা একটি চলন্ত ট্রেনে আছি। থামার স্টেশনগুলো কেবল থামার জন্য, আমরা সেগুলো ছেড়ে চলে যাই। আমাদের হৃদয় সেখানে পড়ে থাকে, আমরা সেগুলো তুলে নিয়ে আবার বুকে জড়াই। সেখানে কাউকে পাই না যে আমাকে স্বাগত জানাবে, বিদায় দেবে বা কোনো বার্তা দেবে। শুধু সেখানকার মুক্ত বাতাসে খানিক শ্বাস নিই।
আমি বিনা চিন্তায় বলে ফেললাম, ‘থামার স্টেশন? হ্যাঁ, আমি সেগুলো নিয়ে ভাবি।’
তাঁর মুখে হাসি ফুটল, কিন্তু তাঁর স্বভাব-সংশয়ী ভাব পুরোপুরি যায়নি। তিনি আমার কাছে এসে ভাইয়ের মতো চুপিসারে বললেন, ‘পরের স্টেশনে তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নাও। বাকিগুলো রেখে দাও।’
আমি মাথা নাড়লাম। তিনি আবার ফিসফিস করলেন, ‘কোনো লাভ নেই। আমরা ফিরব না।’
আমি নিজের মনে ভাবলাম, ‘কেমন কথা! ট্রেনে ওঠা ছিল একটা স্বপ্ন, আর এখন এটা থেকে নামা, মুক্তি পাওয়া—আরেক স্বপ্ন। আমাদের ট্রেনে