লাতিন জাদুবাস্তবতা
হুয়ান রুলফো: স্মৃৃতিচারণ
এলেনা পোনিয়াতওস্কা (জন্ম ১৯৩২) মেক্সিকোর সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক ও সাংবাদিকদের একজন। লাতিন আমেরিকার বিশ শতকের সাহিত্যজগতের সুপরিচিত একটি নাম। তিনি ‘মিগেল দে সের্ভান্তেস’ শীর্ষক পুরস্কারে ভূষিত। ব্যক্তিগতভাবে হুয়ান রুলফোকে চিনতেন, তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। রুলফোর সাহিত্যকর্ম ও তাঁর ভূগোল সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ। রুলফোকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণা তাই পরবর্তীকালে রুলফোকে বোঝার জন্য রুলফোর পাঠক ও সমালোচকদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
• স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: আনিসুজ জামান
বাবা মারা যাওয়ার সময় আমার বয়স ছিল ছয়, মা মারা যান আটে। তখনো স্কুলের খাতায় ছোট ছোট গোল্লা আঁকতাম, শূন্যের মতো—আর কিছুই নয়। আমার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৬ মে, সাইয়ুলাতে। কিন্তু পরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় সান গ্যাব্রিয়েলে। আমি হুয়ান নেপোমুসেনো রুলফো ও মারিয়া ভিসকাইনোর ছেলে। আমার নামটা অনেক লম্বা—হুয়ান নেপোমুসেনো কার্লোস পেরেস রুলফো ভিসকাইনো। মায়ের পদবি ছিল ভিসকাইনো, আর স্পেনে ভিসকায়া নামের একটি প্রদেশ আছে, কিন্তু কাউকে ও নামে ডাকা হয় না। স্পেনে এ রকম কোনো পদবি নেই। তার মানে এটা মেক্সিকোতেই বানানো হয়েছে।
আমার মা–বাবা ছিল জমিদার। একজনের জমিদারত্বের নাম ছিল সান পেদ্রো তোসিন, আর আরেকজনের আপুলকো। আপুলকোতে আমরা ছুটি কাটাতে যেতাম। ওটা ছিল পাহাড়ের কিনারায়, আর সান পেদ্রো ছিল আরমেরিয়া নদীর তীরে। আমার গল্প ‘জ্বলন্ত প্রান্তর’-এ আমার সেই শৈশবের নদী ফিরে এসেছে। ওই নদীর ধারে দস্যুরা লুকিয়ে থাকত। সেখানকার একদল দস্যু আমার বাবাকে হত্যা করে। এলাকায় তখন প্রচুর ডাকাত ছিল। ওরা আগে বিপ্লবী। বিপ্লব শেষ হলে লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকে। বাবার জীবিত থাকা অবস্থাতেই সান পেদ্রো হাচিয়েন্দায় চারবার আগুন লাগানো হয়। ওরা আমার চাচাকে খুন করে, আর দাদাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে—শেষ পর্যন্ত তাঁর আঙুল দুটোই খসে পড়ে। প্রচুর সহিংসতার ঘটনা ঘটে এবং ৩৩ বছরে সবাই মারা যায়; যিশুখ্রিষ্টের মতো। তাই আমি সেই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, যারা বিপ্লবে সবকিছু হারিয়েছে…
ওই নদীর ধারে দস্যুরা লুকিয়ে থাকত। সেখানকার একদল দস্যু আমার বাবাকে হত্যা করে। এলাকায় তখন প্রচুর ডাকাত ছিল। ওরা আগে বিপ্লবী। বিপ্লব শেষ হলে লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকে। বাবার জীবিত থাকা অবস্থাতেই সান পেদ্রো হাচিয়েন্দায় চারবার আগুন লাগানো হয়।হুয়ান রুলফো
আমাদের গ্রামের পাদ্রে ক্রিস্টেরো বিপ্লবে লড়াই করতে যাওয়ার সময় তার লাইব্রেরি আমাদের বাড়িতে রেখে যায়। কারণ, আমরা রাস্তার ঠিক বিপরীতে থাকতাম। সেখানে অবস্থিত পাদ্রের বাসস্থানকে সেনাদের ব্যারাক বানানো হয়েছিল। যুদ্ধের আগ দিয়ে পাদ্রে তার সব বই সরিয়ে আমাদের বাড়িতে রেখে যায়। তার কাছে অনেক বই ছিল। কারণ, সে নিজেকে ফতোয়াবাজ হিসেবে ভাবত। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই সংগ্রহ করত। তার কাছে ক্যাথলিকদের নিষিদ্ধ বইয়ের একটি তালিকা ছিল। সেই তালিকা ধরে সে বিভিন্ন বই নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করত। কিন্তু আসলে সে সেগুলো নিজের সংগ্রহে রেখে দিত। সেই কারণে তার লাইব্রেরিতে ধর্মীয় বইয়ের তুলনায় অনেক বেশি অশ্লীল ও ধর্মের বাইরের বই ছিল।
আমি বসে সেসব বই পড়তাম—দুই মাস, ভিক্তর হুগো, ডাক তারপিনের উপন্যাস, বাফেলো বিল এবং সিটিং বুল সম্পর্কে বই। আমি এই সব পড়েছি মাত্র ১০ বছর বয়সে। সারাক্ষণই পড়তাম। কারণ, বাইরে গেলে গুলি লাগার ভয় ছিল। সারাক্ষণ গুলির শব্দ শোনা যেত। আর ক্রিস্টেরো ও সরকারপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হলেই আমরা দেখতাম—খুঁটির মাথায় ঝুলছে লোকজন।
ওরা আমার চাচাকে খুন করে, আর দাদাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে—শেষ পর্যন্ত তাঁর আঙুল দুটোই খসে পড়ে। প্রচুর সহিংসতার ঘটনা ঘটে এবং ৩৩ বছরে সবাই মারা যায়; যিশুখ্রিষ্টের মতো। তাই আমি সেই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, যারা বিপ্লবে সবকিছু হারিয়েছে।হুয়ান রুলফো
সরকারের লোকেরা ক্রিস্টেরোদের মতোই লুটপাট করত—এটা নিশ্চিত। খুব কম দিনই যেত, যেদিন আমরা আমাদের নিজেদের কাউকে কোনো না কোনো রাস্তার খুঁটিতে পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা দেখতে পাইনি। ওরা সেভাবেই ঝুলে থাকত, যতক্ষণ না দেহ শুকিয়ে শক্ত হয়ে যেত—কাঁচা চামড়া যেভাবে শুকিয়ে কুঁচকে যায়, ঠিক সেই রকম। শকুনরা ভেতরের সব মাংস খেয়ে ফেলত—খোলসটাই শুধু পড়ে থাকত।
আর ওদের এত উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা হতো যে তারা বাতাসে দুলতে থাকত—অনেক দিন, কখনো কখনো মাসের পর মাস। কখনো শুধু ওদের ছেঁড়া পায়জামাটাই বাতাসে উড়ে বেড়াত, যেন কেউ কাপড় শুকানোর জন্য টাঙিয়ে রেখেছে। আর তা দেখলে বুঝতে পারতে, পরিস্থিতি একদমই ভালো নয়…সত্যিই ভয়াবহ।
পেদ্রো পারামোতে পুরো একটি জনগোষ্ঠীর সব কণ্ঠ একে অন্যের ভেতর মিশে গেছে—সেখান থেকে নির্দিষ্ট কোনো স্বর আলাদা করা যায় না। কিন্তু তাতে কিছু যায়–আসে না। সব যুক্ত আত্মারা এক হয়ে আছে। জীবিত হোক বা মৃত—রুলফোর চরিত্ররা আমাদের নিজের আত্মার ভেতর ঢুকে পড়ে।
রুলফোকে দেখলে মনে হয় কোনো কিছু ওর ওপর আসর করে আছে। মাঝেমধ্যে ওর ভেতর দেখা যায় এমন এক তন্দ্রাচ্ছন্নতা, যা শুধু কেউ আসর করলেই সম্ভব। সে দিন কাটায় ঘুমন্ত মানুষের মতো, জেগে ওঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেহুদা কাজগুলো করে যাওয়ার জন্য। তার কান সব সময় সজাগ থাকে—দুনিয়ার কোলাহল সে এড়িয়ে গিয়ে অপেক্ষা করে সঠিক ডাকটার জন্য, যে ডাক তাকে আবার লিখতে বসাবে, যেমনটি একজন টেলিগ্রাফ অপারেটর বসে থাকে বার্তার অপেক্ষায়।
তার গল্পগুলোতে বহু একক আত্মা কথা বলেছে। কিন্তু পেদ্রো পারামোতে সে পুরো একটি জনগোষ্ঠীকে কথা বলিয়েছে। সব কণ্ঠ একে অন্যের ভেতর মিশে গেছে—সেখান থেকে নির্দিষ্ট কোনো স্বর আলাদা করা যায় না। কিন্তু তাতে কিছু যায়–আসে না। সব যুক্ত আত্মারা এক হয়ে আছে। জীবিত হোক বা মৃত—রুলফোর চরিত্ররা আমাদের নিজের আত্মার ভেতর ঢুকে পড়ে, যেন সেটাই তাদের নিজস্ব ঘর।
রুলফোর বাসিন্দারা বা বলা ভালো, তার অন্তর্বিচরণকারী আত্মারা—পুড়তে থাকা প্রান্তর পেরিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেই বাবার খোঁজে, যে তাদের জন্মের মুহূর্তেই অস্বীকার করে গিয়েছে। তারা কেবল একজন মায়ের সন্তান—যে মা তাদের পৃথিবীতে রেখে গেছে প্রতিশোধ নেওয়ার দায় তুলে দিয়ে।
এটা বলা ভুল হবে না যে হুয়ান রুলফোর সাহিত্য তৈরি হয়েছে ক্ষোভ থেকে—একটা ক্ষোভ নয়, অনেক ক্ষোভ থেকে, যা ওকে শুধু চামড়ার মতো শক্ত পৃষ্ঠটাই দেয়; রোদ যেটাকে আগুনের মতো পুড়িয়ে দেয়। খাঁ খাঁ বিরানভূমি, বিভ্রমে ঘুরতে থাকা মাথা, শিলপাটা ঘষতে ঘষতে হাত-পা পোড়া মহিলারা—পৃথিবীর উত্তাপে যাদের মাংস দ্রুত গরম হয়ে ওঠে।
রুলফোর বাসিন্দারা বা বলা ভালো, তার অন্তর্বিচরণকারী আত্মারা—পুড়তে থাকা প্রান্তর পেরিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেই বাবার খোঁজে, যে তাদের জন্মের মুহূর্তেই অস্বীকার করে গিয়েছে। তারা কেবল একজন মায়ের সন্তান—যে মা তাদের পৃথিবীতে রেখে গেছে প্রতিশোধ নেওয়ার দায় তুলে দিয়ে, আর সময়মতো মারা গেছে। কারণ, যদি না মারা যেত—ওদের নিয়ে হাসাহাসি হতো, পানশালায় যারা গাধার প্রস্রাবের মতো গরম বিয়ার খায়—তাদের কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে যেত।