স্মৃতিগদ্য
আমার বাবা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের স্মৃতি
পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ শুধু একটি দেশের কবি নন, তিনি মানবতার কবি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর উচ্চারণ বাংলাদেশের কাছে হয়ে উঠেছে এক আত্মীয়তার ভাষা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর নেমে আসা নির্মমতার সময়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন মানবতার পক্ষ।
ঘরের ভেতর তিনি ছিলেন শান্ত, সংযত, নিজের মতো করে বাঁচা মানুষ। সেই মানুষের ছোট ছোট স্মৃতি ধরে রেখেছেন তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা মুনিজা হাশমি। বিখ্যাত কবির অন্তরালে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ছিলেন একজন স্নেহশীল বাবা, সাধারণ জীবনযাপনের সঙ্গী।
• অনুবাদ: নাসিফ আমিন
আমার স্পষ্ট কোনো স্মৃতি নেই, আমরা পুরো ফয়েজ পরিবার প্রতিদিন একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে খেয়েছি কি না। এমন কোনো বিশেষ মুহূর্তও মনে পড়ে না যে আমরা সবাই পারিবারিক আবহে একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করেছি। এর কারণ সম্ভবত আমার বাবা, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, খুব কমই খাওয়ার সময় বাসায় থাকতেন। তার ওপর আমার মা, এলিস ফয়েজ, কর্মজীবী হওয়ায় তাঁকে অফিসের সময় মেনে চলতে হতো, আবার আমাদের, অর্থাৎ আমার বড় বোন সালিমা ও আমার—সময়মতো স্কুলে পৌঁছানোর বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হতো।
পঞ্চাশের দশকে আমার স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে। শীতের সময় প্রতিদিন আমাদের বাসা থেকে টিফিন বা লাঞ্চবক্স আসত। আমরা স্কুলের মাঠে বসে বন্ধুরা একসঙ্গে খাবার ভাগ করে নিতাম, আড্ডা দিতাম, আর একটানা হাসাহাসি খুনসুটি চলত। সেই লাঞ্চবক্সের খাবার ছিল খুবই সাধারণ। একটি রুটি আর এক পদের তরকারি, কখনো ডাল, কখনো সবজি।
বাড়িতে রাতের খাবারও বেশ ছিল সাদামাটা। হয়তো অমলেটের সঙ্গে টোস্ট বা শুকনো মাংসের স্যান্ডউইচ। কখনো ডাল-ভাত। মাঝেমধ্যে বিশেষ খাবার হিসেবে পাওয়া যেত আলু ও বাঁধাকপির তৈরি একধরনের প্যানকেক, যার ওপর একটি ভাজা ডিম থাকত। খাবারটা বেশ গরম-গরম থাকত, তাই অপেক্ষায় থাকতাম কখন খাবারটা বানানো হয়।
আমাদের ডাইনিং টেবিল চারজনের বসার উপযোগী ছিল। বাবা সব সময় টেবিলের অগ্রভাগে বসতেন, তার বাঁ পাশে মা, ডান পাশে আমি, আর অন্য পাশটায় বসত সালিমা। টেবিলটি খুব একটা বড় ছিল না, সস্তা কাঠের তৈরি, একটু নড়বড়ে, ওপরের অংশ পাতলা প্লাইউডের। চেয়ারগুলো ছিল পিঠসোজা ও ছিমছাম গোছের। টেবিলক্লথ ছিল সুতির, হাতে ছাপা ব্লক প্রিন্টের; কেনা হয়েছিল লাহোরের মোজং এলাকার বিখ্যাত ঝান্ডু খানের দোকান থেকে। রং ছিল ফিরোজা ও উজ্জ্বল নীল, সঙ্গে মানানসই ন্যাপকিন। আমরা সব সময় প্লেসম্যাট ব্যবহার করতাম, যদিও তার নকশা মনে নেই। প্লেট ছিল সাধারণ সাদা চিনামাটির, কাঁটা চামচ ও চামচও ছিল একেবারে সাধারণ। গ্লাসগুলোও ছিল একদম সোজা আকৃতির ও সাদামাটা।
ডাইনিং রুমসংলগ্ন ছিল প্যান্ট্রি, তাই আমাদের খানসামা অনায়াসে আসা-যাওয়া করতেন আর খাবার পরিবেশন করতে পারতেন। রান্নাঘর ছিল কয়েক ধাপ নিচে, কিন্তু তাতে খাবার যে ঠান্ডা হয়ে যেত, এমনও না। তখন মাইক্রোওয়েভ বা ওভেন ছিল না, তবে প্যান্ট্রিতে একটি টোস্টার ও সঙ্গে ছিল একটা কেটলি। ওটা বাবা-মায়ের চায়ের পানি গরম করতে ব্যবহৃত হতো।
আমার বাবা, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, খুব কমই খাওয়ার সময় বাসায় থাকতেন। তার ওপর আমার মা, এলিস ফয়েজ, কর্মজীবী হওয়ায় তাঁকে অফিসের সময় মেনে চলতে হতো, আবার আমার বড় বোন সালিমা ও আমার—সময়মতো স্কুলে পৌঁছানোর বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হতো।
রসুইঘর
খাওয়ার সময় তেমন কোনো কথাবার্তা হতো না। আমি মনে করতে পারি না, আমরা নিয়মিত একসঙ্গে খেয়েছি। দুপুরের খাবার বেশির ভাগ সময় আমার বোনের সঙ্গে অথবা স্কুলেই খেতাম; শীতকালে। রাতের খাবারও বেশির ভাগ সময় তিনজন মিলে খেতাম, কারণ বাবা অফিসেই থাকতেন। মাঝেমধ্যে রোববার সকালের নাশতা একসঙ্গে হতো। সেটাও যে খুব ঘন ঘন হতো, এমন নয়।
শৈশবে আমাদের দুজন পরিচারকের কথা স্পষ্ট মনে আছে। মোহাম্মদ আলী, আমাদের রাঁধুনি, ছিলেন পাঞ্জাবি এবং শুধু পাঞ্জাবি ভাষাতেই কথা বলতেন। আজও আশ্চর্য লাগে, কীভাবে আমার ব্রিটিশ মা এলিস ফয়েজ তাঁর সঙ্গে অনায়াসে কথা বলতেন! তিনি কেবল রান্নাঘরেই থাকতেন, অন্দরমহলে খুব একটা আসতেন না।
দ্বিতীয়জন ছিলেন আমাদের খানসামা, যিনি আজীবন এই পরিচয়েই পরিচিত ছিলেন। তিনি একটু বয়স্ক, একদম খাঁটি উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। কীভাবে তিনি ও রাঁধুনি একসঙ্গে কাজ করতেন, তা আজও বুঝতে পারি না, তবে কখনো কোনো ঝগড়া বা ভুল-বোঝাবুঝির কথা শুনিনি। খানসামা আমাদের কাছে ছিলেন একরকম পুরুষ ধাইমার মতোই। মা পত্রিকায় কাজ করতেন বলে তাঁর দীর্ঘ সময় কাজ করতে হতো, তাই আমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল এই মানুষটির ওপর। তিনি আমাদের খাবার, কাপড় ধোয়া, পড়াশোনা করানো, এমনকি মাঝেমধ্যে ঘুম পাড়ানোর কাজও করতেন। রাতে থালাবাসন ধুয়ে শুকানোর পর সাইকেলে বাড়ি ফিরতেন, আবার ভোরে এসে বাবার ‘বেড টি’ পরিবেশন করতেন ও আমাদের স্কুলের জন্য তৈরি করতেন। কত বছর তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন, ঠিক মনে নেই। তবে বাবা তাঁর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতেন, আর মা বাবাকে মাঝেমধ্যে বকাঝকা করতেন তাঁকে বেশি প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে।
মোহাম্মদ আলী, আমাদের রাঁধুনি, ছিলেন পাঞ্জাবি এবং শুধু পাঞ্জাবি ভাষাতেই কথা বলতেন। আজও আশ্চর্য লাগে, কীভাবে আমার ব্রিটিশ মা এলিস ফয়েজ তাঁর সঙ্গে অনায়াসে কথা বলতেন! তিনি কেবল রান্নাঘরেই থাকতেন, অন্দরমহলে খুব একটা আসতেন না।
পরিমিত জীবনাচার
আমার বাবার খাওয়ার অভ্যাসের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি সব সময় পুরো পোশাক পরে ব্রেকফাস্ট করতেন। তাঁর নাশতা ছিল ভাজা ডিম, টোস্ট ও চা। তিনি ছুরি-কাঁটা দিয়ে টোস্টের ওপর ডিম রেখে খেতেন এবং ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিতেন। দুপুরের খাবার, যদি বাসায় খেতেন, তা হতো একটি রুটি আর সঙ্গে হয়তো ডাল বা সবজি থাকত। আমরা তেমন মাংস খেতাম না, হয়তো আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণেই। ছোটবেলা থেকেই আমরা সাধারণ খাবার ও পোশাকে অভ্যস্ত ছিলাম, এখন বুঝতে পারি, এর কারণ ছিল বাবা-মায়ের আর্থিক টানাপোড়েন।
বাবা সব ধরনের শাক খেতে ভালোবাসতেন, বিশেষ করে দেশি পালংশাক ও শর্ষেশাক। তিনি মিসি রুটি খুব পছন্দ করতেন। দাদিমা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য আফগান রীতির কিছু মিষ্টান্ন পাঠাতেন, যা তিনি দাদার অন্য আফগান স্ত্রীদের কাছ থেকে শিখেছিলেন। আমি সেসব মিষ্টান্নের স্বাদ আজও মনে করতে পারি, তবে দুঃখের বিষয়, আমরা কেউ তাঁর কাছ থেকে সেই রেসিপি শিখিনি। দাদিমাকে আমরা বিবিজি ডাকতাম।
খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বাবা ছিলেন সংযমী। হয়তো ধূমপানের অভ্যাস তাঁর ক্ষুধা কমিয়ে দিত। খাওয়ার সময় তিনি ধীরে ধীরে, শান্তভাবে চিবিয়ে খেতেন এবং তাঁর প্লেট একেবারে পরিষ্কার করে খেতেন। শুনেছি, তিনি ঝোলসহ কোফতা পছন্দ করতেন, রুটি বেশি খেতেন, ধনে ও কাঁচা মরিচের চাটনি ভালোবাসতেন, তবে ঝাল তেমন সহ্য করতে পারতেন না। তিনি আমের আচার খুব পছন্দ করতেন এবং মাঝেমধ্যে ঘিয়ে ভাজা পরোটা খেতেন। এই পরোটা বেশ ভারী খাবার কিন্তু খেতে এত উপাদেয় যে, একদম মন ভরে যেত। শীতকালে আমরা এখনো ঘিয়ে ভাজা পরোটা খাই। কারণ, এই সময় পরোটা খেলে শরীর গরম থাকে আর পেট একদম ভরে যায়।
বাবা সব ধরনের শাক খেতে ভালোবাসতেন, বিশেষ করে দেশি পালংশাক ও শর্ষেশাক। তিনি মিসি রুটি খুব পছন্দ করতেন। দাদিমা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য আফগান রীতির কিছু মিষ্টান্ন পাঠাতেন, যা তিনি দাদার অন্য আফগান স্ত্রীদের কাছ থেকে শিখেছিলেন।
অনাড়ম্বর রুচি
তাঁর সকালের ও বিকেলের চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল মৃত্যুর আগপর্যন্ত। সকালে চায়ের সঙ্গে তাঁর হাতে থাকত পত্রিকা, বিকেলে থাকত শুধু এক কাপ চা, কোনো নাশতা ছাড়া। তিনি ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিতেন, হাতে থাকত একটি সিগারেট, আর বেশির ভাগ সময় থাকতেন নীরব।
১৯৬২ সালে আমরা যখন দুই বছরের জন্য লন্ডনে গেলাম, থাকতাম ফিঞ্চলের কর্নওয়াল অ্যাভিনিউতে, তখন বাবার পছন্দের তালিকায় স্টেক আর কিডনি পাই যোগ হয়। আমিও সেটা পছন্দ করতাম। সে সময় আমাদের রাতের খাবার খুবই সাধারণ ছিল—ভাজা ডিম ও টোস্ট, বেক করা বিন, কখনো চিকেন সসেজ। মা হয়তো বেশি বাসন মাজার ঝামেলা নিতে চাইতেন না, তাই তিনি খাবারদাবার যত অল্প আয়াসে সারা যায়, সেরে ফেলতে চাইতেন। কারণ, সেখানে কোনো কাজের লোক ছিল না। ঘরের সব কাজ তাঁকে একাই করতে হতো। তখনো আমি স্কুলেই পড়তাম আর আমার বড় বোন সালিমা পড়ত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আমরা ছিলাম এক অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত পরিবার। ছিমছাম খাবার আর সাদাসিধা চাহিদা। আমরা এখনো তা-ই আছি।
রেসিপি: শর্ষেশাক ও পালংশাক
উপকরণ
• ১.৫ কেজি শর্ষেশাক
• ১.৫ কেজি পালংশাক
• আধা কাপ তাজা মেথিপাতা
• ১৫-২০ কোয়া রসুন
• ২ টেবিল চামচ টক দই
• ১০-১২টি কাঁচা মরিচ
• ২ টেবিল চামচ ভুট্টার আটা
• ৫-৬টি শুকনো লাল মরিচ
• আধা কাপ ঘি
• ১.৫ টেবিল চামচ আদা-রসুনকুচি
• গার্নিশের জন্য কুচানো আদা ও ২ টেবিল চামচ মাখন
• স্বাদ অনুযায়ী লবণ
পদ্ধতি
১. বড় একটি হাঁড়িতে পানি গরম করুন। ফুটন্ত পানিতে শর্ষেশাক, পালংশাক ও মেথিপাতা দিন। এর সঙ্গে রসুন ও কাঁচা মরিচ যোগ করুন। শাক নরম হওয়া পর্যন্ত সেদ্ধ করুন, তারপর বাড়তি পানি ঝরিয়ে ফেলুন।
২. সেদ্ধ করা শাক ঠান্ডা হলে মিহি করে কেটে নিন। আমি ইলেকট্রিক চপার বা ফুড প্রসেসর ব্যবহার করি।
৩. একটি হাঁড়িতে ঘি গরম করে শুকনো লাল মরিচ ও আদা-রসুনকুচি ভেজে নিন। তারপর কাটা শাকের মিশ্রণ যোগ করুন।
৪. এতে টক দই ও ভুট্টার আটা মিশিয়ে দিন। ভালোভাবে নাড়াচাড়া করে ৩০ মিনিট হালকা আঁচে রেখে দিন। পানি শুকিয়ে এলে এবং শাক ঘন হয়ে এলে নামিয়ে নিন।
৫. গরম-গরম পরিবেশনের আগে ওপর থেকে কুচানো আদা ও মাখন দিয়ে গার্নিশ করুন।
৬. এটি মিসি রুটি (ভুট্টার রুটি) সঙ্গে খেতে দারুণ লাগে।