ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার গল্প
বরফ
জাপানি লেখক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ‘স্নো কান্ট্রি’, ‘থাউজ্যান্ড ক্রেনস’, ‘দ্য সাউন্ড অব দ্য মাউন্টেন’ উপন্যাসগুলোর জন্য বিখ্যাত হলেও কাওয়াবাতা নিজে বলতেন, তাঁর শিল্পকে সত্যিকারভাবে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর নানা ছোট ছোট গল্পে। ১৯২৩ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালে আত্মহত্যা করার কিছু আগে পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন হিরের কুচির মতো এমন অনেক গল্প। এই গল্পগুলো স্বপ্নের মতো, কুয়াশার মতো, সময়ের মতো, মৃত্যুর মতো...একাকিত্ব, ভালোবাসা আর অনুভূতির সূক্ষ্মতায় কবিতার মতো।
• অনুবাদ: কল্যাণী রমা
চার–পাঁচ বছর ধরে প্রতিটি নতুন বছরেই নোরা সাংকিচি নির্জনতায় ডুবে একা একা কাটাচ্ছে—টোকিওর এক বহুতলা হোটেলে নতুন বছরের সন্ধ্যা থেকে শুরু করে তিন দিন পর সেই ভোর না হওয়া পর্যন্ত। যদিও হোটেলটির একটা জমকালো নাম আছে, সাংকিচির কাছে তার নাম শুধুই ‘স্বপ্নবাড়ি’।
‘বাবা স্বপ্নবাড়িতে গেছেন,’ নতুন বছরে যারাই দেখা করতে আসত, সবাইকে এই একই কথা বলত সাংকিচির ছেলেমেয়েরা। অতিথিরা এই কথাকে ঠাট্টা হিসেবেই নিত। মনে করত, সাংকিচি ঠিক কোথায় আছে, তা সবাইকে জানাতে চায় না ওরা।
‘বাহ, খুব ভালো জায়গা তো। নিশ্চয়ই নতুন বছর চমৎকার কাটছে ওখানে,’ উওরে কেউ কেউ তখন এমনও বলত।
অথচ কেউ এটা জানত না যে সাংকিচি সত্যি সত্যি ওই স্বপ্নবাড়িতে স্বপ্ন দেখত; সাংকিচির বাড়ির লোকজনও না।
হোটেলের ঘরটা প্রতিবছর সেই একই হতো—‘বরফঘর’। অবশ্য একমাত্র সাংকিচিই জানত যে প্রতিবছর যেই ঘরই পাক না কেন, তাকে বরফঘর বলেই ডাকত সাংকিচি।
হোটেলে পৌঁছেই ঘরের সব পর্দা টেনে দিত ও। তারপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় ঢুকে চোখ বন্ধ করত সাংকিচি। দুই কি তিন ঘণ্টা সে ওখানে চুপচাপ শুয়ে থাকত। এ কথা সত্য যে সাংকিচি এক ব্যস্ত, অস্থির বছরের বিরক্তি আর ক্লান্তি থেকে একটু বিশ্রাম খুঁজতেই ওখানে যেত, কিন্তু যখন সব ছটফটানি আর অস্থিরতা দূর হয়ে যেত, ঠিক তখন আরও গভীরতর এক ক্লান্তি ফুলেফেঁপে উঠে সাংকিচির দেহ-মনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ত। এটা বুঝতে পারার পর থেকেই সাংকিচি অপেক্ষা করতে থাকত, কখন ওর ক্লান্তি সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতা পাবে। যখন ওর শরীর ক্লান্তির একদম শেষ তলানিতে গিয়ে ঠেকত, ওর মাথা প্রায় অবশ অসাড় হয়ে যেত, তখন ঠিক সেই স্বপ্নটা ধীরে ধীরে ডুবুরির মতো ওপরে ভেসে উঠত।
সাংকিচি অপেক্ষা করতে থাকত, কখন ওর ক্লান্তি সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতা পাবে। যখন ওর শরীর ক্লান্তির একদম শেষ তলানিতে গিয়ে ঠেকত, ওর মাথা প্রায় অবশ অসাড় হয়ে যেত, তখন ঠিক সেই স্বপ্নটা ধীরে ধীরে ডুবুরির মতো ওপরে ভেসে উঠত।
চোখের পাতার পেছনে, অন্ধকারে ছোট ছোট শস্যদানার মতো আলোর বিন্দু নাচতে নাচতে ভাসতে থাকত। ছোট শস্যদানাগুলোর রং বিবর্ণ, সোনালি, স্বচ্ছ। আর যখন তাদের সেই সোনালি রং ঠান্ডা হয়ে এক আবছা সাদা রঙে বদলে যেত, তা সাদা পেঁজা তুষারকণা হয়ে যেত। তারপর সব একই দিকে, একইভাবে আস্তে আস্তে ভেসে যেত। দূরে বহুদূরে ঝরে পড়ত গুঁড়া গুঁড়া তুষারকণা।
‘এই নতুন বছরেও তুষার ঝরছে।’
এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই ওই বরফ আর ওই তুষার সব সাংকিচির নিজের হয়ে যেত। আর তারপর সাংকিচির হৃৎপিণ্ডের ভেতরও তুষার ঝরে পড়ত।
এখন ওর বন্ধ চোখের অন্ধকারের ভেতর বরফ আর তুষার এগিয়ে আসছে। খুব বেশি, খুব দ্রুত আর খুব কাছে তুষার ঝরছে। সাদা পিওনি ফুলের মতো তুষারকণা। বড় বড় ফুলের পাপড়ির মতো তুষারকণা। গুঁড়া গুঁড়া তুষারকণার চেয়ে এই তুষারকণা অনেক বেশি ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে। সাংকিচি ওই নৈঃশব্দ্যের ভেতর, ওই শান্তির তুষার ঝড়ের ভেতর ডুবে যেতে থাকল।
চোখ খুললে আর কোনো ক্ষতি নেই এখন।
সাংকিচি চোখ খুলল, ওই ঘরের দেয়ালে তুষারের ছবি আঁকা হয়ে গেছে। এতক্ষণ নিজের চোখের পাতার ভেতরে কেবল তুষার ঝরে পড়তে দেখছিল সাংকিচি। কিন্তু দেয়ালের দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওখানে যেন অনেকক্ষণ ধরেই তুষার ঝরছে।
এক বিশাল মাঠের মাঝে মাত্র চার–পাঁচটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে—শূন্য ডাল। কিন্তু ঠিক সেখানেও পিওনি ফুলের পাপড়ির মতোই তুষার। বরফ ভেসে ভেসে, সরে সরে যত ওপরে উঠে যাচ্ছে, তত ঘাস বা মাটি কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে কোনো বাড়িঘর নেই, কোনো মানুষজনের চিহ্ন নেই। খুব একাকী এই দৃশ্য, তবু সাংকিচি হোটেলের কৃত্রিম গরম বিছানায় শুয়ে বরফ ঢাকা মাঠের ঠান্ডাটুকু কিছুতেই আর অনুভব করতে পারছে না। অথচ চারপাশে যা পড়ে আছে, তা কেবলই এক বরফে ঢাকা প্রকৃতি। শুধু সাংকিচি নিজে সেখানে নেই।
‘কোথায় যাব? কাকে ডাকব?’ যদিও এই চিন্তা ওর মনের ভেতর ঘোরাফেরা করতে থাকল, তবু ওই ভাবনা যেন ঠিক ওর নিজের না। তা যেন এক বরফছাওয়া পৃথিবীর গলার স্বর।
‘বাবা, এমন সুচালো, অমসৃণ, খাঁজকাটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বড় বিপজ্জনক। তোমার পায়ের পাতায় নিশ্চয়ই ব্যথা করছে।’ বিছানায় শুয়ে শুয়ে পঞ্চাশ বছরের সাংকিচি ওই বরফে ঢাকা পৃথিবীতে নিজের বাবার সঙ্গে কথা বলল।
বরফঢাকা প্রান্তর; সেখানে পড়ন্ত বরফ ছাড়া এখন আর অন্য কোনো নড়াচড়া নেই। প্রান্তরটি যেন নিজে নিজে সরে যাচ্ছে এক পাহাড়ি ঢালের দৃশ্যপটের দিকে। দূরে, বহুদূরে দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের পা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চলে গেছে এক নদী। দেখে যদিও মনে হচ্ছে যে ছোট নদীটা বুঝি বরফে বুজে আসছে, আসলে কিন্তু নদীটা কোনো ঢেউ না তুলেই বয়ে যাচ্ছে। বরফের একটা চাঁই তীর থেকে নদীতে পড়ে জলের ওপর ভাসছে। তারপর স্রোতের মুখে একটা বড় পাথরখণ্ডে ধাক্কা খেয়ে সেই বরফের চাঁই জলে গলে গলে পড়ছে।
ওই বড় পাথরখণ্ডটা ছিল এক কেলাসিত সবুজ পান্না। সেই নীলকান্তমণির কোয়ার্টজে ভরা পাথরের ওপরে সাংকিচির বাবা এসে দাঁড়ালেন। কোলে তিন কি চার বছর বয়সের সাংকিচি।
‘বাবা, এমন সুচালো, অমসৃণ, খাঁজকাটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বড় বিপজ্জনক, খুব বেশি বিপজ্জনক। তোমার পায়ের পাতায় নিশ্চয়ই ব্যথা করছে।’ বিছানায় শুয়ে শুয়ে পঞ্চাশ বছরের সাংকিচি ওই বরফে ঢাকা পৃথিবীতে নিজের বাবার সঙ্গে কথা বলল।
পাথরের চাঁইয়ের ওপরটা ধারালো কোয়ার্টজ ক্রিস্টালে ভরা। দেখে মনে হচ্ছে, সাংকিচির বাবার পা বুঝি এই এখনই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। সাংকিচির কথায় বাবা শরীরের ভার বদল করে দাঁড়াতে গেলেন। আর ঠিক তখন পাথরের চাঁইয়ের ওপর থেকে বরফ ঝুরঝুর করে ভেঙে নদীর ভেতর পড়ল। কী জানি হয়তো তাতেই ভয় পেয়ে সাংকিচির বাবা সাংকিচিকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন।
‘কী আশ্চর্য! এই সরু, ছোট নদীটা এত বরফে ডুবেও বুজে যাচ্ছে না,’ বাবা বললেন।
বাবার মাথায়, কাঁধে, হাতে সব জায়গায় বরফ। আর সেই বরফভর্তি হাতেই ধরে রেখেছেন সাংকিচিকে।
দেয়ালের গায়ে বরফের ছবি সরে সরে যাচ্ছে। কেমন যেন ওপরের দিকে ভেসে ভেসে যাচ্ছে সব। একটা হ্রদ চোখে পড়ল। পাহাড়ের অনেক নিচে এই ছোট হ্রদ। কিন্তু ওই নদীর উৎস ওই হ্রদ বলেই হয়তো হ্রদটাকে অনেক বেশি বড় মনে হচ্ছে। সাদা সাদা পিওনি ফুলের পাপড়ি। পাপড়িগুলো যত বেশি দূরে তত যেন তাদের গায়ে হালকা ছাই রঙের আভাস। দূরে ভেসে বেড়াচ্ছে একরাশ মেঘ। বহুদূরের তীরে পাহাড়গুলোকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
যখন সাংকিচি পাখিগুলোকে গুনতে গেল, দেখল সাতটা পাখি, এগারোটা পাখি...একসময় আর হিসাব রাখতে পারল না সাংকিচি। কিন্ত এই ধাঁধায় হতবিহ্বল না হয়ে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে গেল ওর মন।
তুষার ঝরছে অবিরাম। সাংকিচি কিছুক্ষণ সেই পিওনি ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে পড়া তুষারকণার দিকে তাকিয়ে থাকল। হ্রদের ওপর ঝরে পড়ে সেই তুষারকণার পাপড়ি গলে গলে যাচ্ছে। দূরের তীরে পাহাড়ের বুকে কিছু একটা যেন নড়ছে। ধূসর আকাশের মাঝ দিয়ে ক্রমশ তা কাছে এগিয়ে আসছে। একঝাঁক পাখি। সাদা বরফের রঙের ডানা ওদের। কিংবা যেন বরফ নিজেই ওদের পাখা। অথচ যখন ওরা সাংকিচির চোখের সীমানা পেরিয়ে গেল, তখনো ওদের ডানায় কোনো শব্দ হলো না। কী জানি ওদের পাখাগুলোও কি ধীরে ধীরে শান্ত, নীরব ঢেউয়ের মতো প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে? ঝরে পড়া বরফই কি পাখিগুলোকে বয়ে নিয়ে আসছে?
যখন সাংকিচি পাখিগুলোকে গুনতে গেল, দেখল সাতটা পাখি, এগারোটা পাখি...একসময় আর হিসাব রাখতে পারল না সাংকিচি। কিন্ত এই ধাঁধায় হতবিহ্বল না হয়ে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে গেল ওর মন।
‘কী পাখি? কার পাখা?’
‘আমরা পাখি না। দেখতে পাচ্ছ না ডানায় ভর দিয়ে কারা এগিয়ে আসছে?’ ওই বরফ পাখিদের মাঝ থেকে একটা স্বর ভেসে এল।
‘আহা, তাই তো,’ সাংকিচি বলে উঠল।
সব, সব নারী যারা সাংকিচিকে ভালোবেসেছিল, তারা সবাই আজ পাখির ডানায় ভর করে সাংকিচির কাছে নেমে এসেছে। ওদের মাঝে কে প্রথম কথা বলল?
স্বপ্নের ভেতর সাংকিচি বহু বহুদিন আগে যে মেয়েরা ওকে ভালোবেসেছিল, তাদের খুব সহজেই কাছে ডেকে নিতে পারল।
নতুন বছরের সন্ধ্যা থেকে শুরু করে তিন দিন পরের এক ভোরবেলা পর্যন্ত ওই ‘স্বপ্নবাড়ি’তে ‘বরফঘর’-এর ভেতর সব পর্দা টেনে দিয়ে, হোটেলের খাবার সব নিজ ঘরেই নিয়ে এসে, একবারও বিছানা ছেড়ে না উঠে গিয়ে তারপর সাংকিচি সেই সব নারীর আত্মার সঙ্গে কথা বলল।
(লেন ডানলপের ইংরেজি অনুবাদ থেকে)