নেলসন ম্যান্ডেলা কি আসলেই বিষণ্ন মানুষ ছিলেন?

নেলসন ম্যান্ডেলা ও উইনি মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলাকে নিয়ে মাত্র কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে ‘উইনি অ্যান্ড নেলসন: পোর্ট্রেট অব আ ম্যারেজ’ শিরোনামের গুরুত্বপূর্ণ এক বই। বইটির উপজীব্য দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি-আন্দোলনের দুই বিখ্যাত নেতার যুগল জীবন এবং তাঁদের ব্যক্তিগত যাপিত জীবনের প্রেমকাহিনি। নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর কাটিয়েছিলেন নিপীড়ক বর্ণবাদী শাসকের কারাগারে। আর শ্বেতাঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখায় লাগাতার নিপীড়নের শিকার হন উইনি। দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর এই দম্পতির বিচ্ছেদ ঘটে। খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও পুরস্কারজয়ী লেখক জনি স্টেইনবার্গ তাঁর এ বই নিয়ে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গণমাধ্যম ‘আউটলেট দ্য কনভারসেশন’কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এতে উঠে এসেছে ম্যান্ডেলা ও উইনির অনেক অজানা অধ্যায়। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন হাসান ইমাম

যৌবনে নেলসন ম্যান্ডেলা ও উইনি মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলা
ছবি: রয়টার্স
প্রশ্ন:

আপনার বইয়ের সারকথা কী?

উত্তর: উইনি ও নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন সুসম্পূর্ণ মানুষ। তাঁরা চাইতেন, তাঁদের বিবাহিত জীবনের গল্পের মাধ্যমে উঠে আসুক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিবৃত্ত। তাঁদের গাঁটছড়া বাঁধার কাহিনিতে সত্যিকার অর্থেই আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকা মূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু আদতে তাঁরা এমনটা চাইতেন না। আর সেটিই হলো এ বইয়ের সারকথা। সুতরাং মোদ্দাকথায় বইটি এক দম্পতিকে নিয়ে, একটি জাতির কাহিনি বিবৃত হয়েছে এখানে এবং একই সঙ্গে তা স্বাধীনতা, ক্ষমাশীলতা ও মধুর প্রতিশোধেরও গল্প।

প্রশ্ন:

বইটি লিখতে কী ধরনের গবেষণা করেছেন আপনি?

‘উইনি অ্যান্ড নেলসন: পোর্ট্রেট অব আ ম্যারেজ’ বইয়ের প্রচ্ছদ

উত্তর: ঠিক হিসাব করে দেখিনি। তবে প্রায় ১৫০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। শুরু করেছিলাম উইনির ছোট বোনদের দিয়ে। শেষ করেছি সেই সব মানুষকে দিয়ে, যাঁরা এই দম্পতির শেষের দিনগুলোয় তাঁদের কাছাকাছি ছিলেন। এরপর উইনি ও ম্যান্ডেলার একে অপরকে লেখা চিঠিপত্রের সহায়তা নিয়েছি। দীর্ঘ মেয়াদের একজন কারাবন্দী নিজের ভেতরটা প্রকাশ করতে চিঠি লেখা ছাড়া আর কীই–বা করতে পারেন! ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের অমূল্য সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় শব্দ ঢেলে, যা তাঁর সমগ্র সত্তার প্রতিফলন, যাতে তাঁর কিছুই অধরা থাকেনি।

এরপর বর্ণবাদী সরকারের শেষ আইনমন্ত্রী কোবি কোয়েটসির রেখে যাওয়া কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি। ম্যান্ডেলার কারাবাসের শেষ আট বছরে তাঁর সঙ্গে উইনি যতবার দেখা করেছেন, সেসব সাক্ষাতের সময় তাঁদের কথোপকথনের রেকর্ড রাখতেন কোবি। তবে এসব রেকর্ডে তেমন কিছু নেই। কারণ, উইনি ও ম্যান্ডেলা উভয়েই জানতেন, তাঁদের কথাবার্তা শোনার জন্য বহু কান খাড়া আছে।

তাঁর কাছের বন্ধু বারবারা মাসেকেলা আমাকে বলেছেন, তিনি ম্যান্ডেলার মতো এত গভীরতর বিষণ্ন কোনো মানুষের দেখা তাঁর জীবনে পাননি। বারবারা নব্বইয়ের দশকে ম্যান্ডেলার চিফ অব স্টাফও ছিলেন। তাঁর ভাষায়, কখনো কখনো তিনি অনুভব করতেন, ম্যান্ডেলা যেন ‘নিস্তব্ধতা, ভীষণ ভয়ংকর এক নিস্তব্ধতার’ প্রতিরূপ।
প্রশ্ন:

উইনি সম্পর্কে কী এমন তাৎপর্যপূর্ণ উদ্‌ঘাটন আছে এ বইয়ে?

উত্তর: অনন্য এক মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যে ছিল কৌতূহল, বুদ্ধিমত্তা ও কল্পনাশক্তি। আমি কেবল এর একটু নমুনা দিচ্ছি এখানে। রাজনীতিতে তাঁর বোঝাপড়া ছিল উচ্চমার্গীয়। তিনি তাঁর মতো করে বিষয়টিকে আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর উপলব্ধি ছিল, ম্যান্ডেলার সঙ্গে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের দক্ষিণ আফ্রিকার ভাবনা তাঁর কাছে মূর্ত হয়ে উঠেছিল; রূপকার্থে নয়, সত্যিকারভাবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে পুলিশ সদস্য তাঁকে নিপীড়ন করেছিলেন, তাঁর সম্পর্কে কথা তিনি বলেছেন। এরপরই তিনি বলেন, এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে মুক্ত করার লড়াইয়ে শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সংগ্রামের বয়ান, অন্যদিকে জাতিগত লড়াইয়ের বিস্তৃত ভাষ্য।

বইয়ের লেখক জনি স্টেইনবার্গ
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

ম্যান্ডেলার ভেতরের অপ্রকাশিত নতুন কোনো দিকের দেখা কি পেয়েছেন?

উত্তর: তাঁর কাছের বন্ধু বারবারা মাসেকেলা আমাকে বলেছেন, তিনি ম্যান্ডেলার মতো এত গভীরতর বিষণ্ন কোনো মানুষের দেখা তাঁর জীবনে পাননি। বারবারা নব্বইয়ের দশকে ম্যান্ডেলার চিফ অব স্টাফও ছিলেন। তাঁর ভাষায়, কখনো কখনো তিনি অনুভব করতেন, ম্যান্ডেলা যেন ‘নিস্তব্ধতা, ভীষণ ভয়ংকর এক নিস্তব্ধতার’ প্রতিরূপ।

ম্যান্ডেলার জীবনী নিয়ে চর্চায়, আমি মনে করি, এই নিদারুণ দুঃখময়তার একটা আভাস পেয়েছি। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, তাঁর জীবনের গল্প আসলে একটা ট্র্যাজেডি। তিনি এটা ভেবে পুলকিত বোধ করতেন যে তিনি পৃথিবীর জীবিত মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতিমান, যার সার্থকতার পেছনে ছিল রাজনৈতিক কারণ। কিন্তু তিনি কখনো একমুহূর্তের জন্যও মনে করেননি, এই যশ-খ্যাতি তাঁকে সুখ দিতে পারে অথবা যা তিনি হারিয়েছেন, তার বিকল্প হতে পারে।

প্রশ্ন:

দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জনবিদ্রোহের বৃহত্তর ছবিটি কীভাবে এঁকেছেন?

উত্তর: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে গোটা আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় কতটা ভয়াবহ সহিংসতার মধ্য দিয়ে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তার পরিমাপ-পরিসংখ্যান এখনো সম্ভব হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সেই পরিস্থিতির অবলোকন আসলে মৃত্যুবৎ ভয়ংকরতার মুখোমুখি হওয়া। তবে উইনির গল্পে, ম্যান্ডেলার গল্পে আপনি নিশ্চিতভাবেই তার আঁচ পাবেন।

যৌবনে নেলসন ম্যান্ডেলা ও উইনি মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলা
ছবি: এএফপি
প্রশ্ন:

এই বইয়ের মাধ্যমে আপনি কতটা কী অর্জনের আশা করেন, আর কেনই–বা এর গল্পকে ওজনদার মনে করেন?

উত্তর: আমি আসলে উইনি ও ম্যান্ডেলা—দুজনকেই জনশ্রুতি বা পুরাকথার আবহ থেকে মুক্ত করতে চাই এবং পুরাকথা যদি কিছু থেকেই থাকে, যা আমলযোগ্য, তাকে রক্ষা করতে চাই। দেখাতে চাই যে তাঁরা বাস্তব, ভুলত্রুটিযুক্ত মানুষ ছিলেন। তবে এ কথাও সত্য, তাঁদের জীবন ঘিরে রেখেছিল যেসব জনশ্রুতি, এক অর্থে তার জরুরতও ছিল। তাঁরা দুজনই জেনেবুঝে সংগ্রাম করে গেছেন বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য, কিন্তু তাঁদের কোনো একজন একই সঙ্গে দুজনকে বিশিষ্ট করতে তুলে পারেননি, সুখী হতে পারেননি। আমি সত্যিকার অর্থেই এটাই দেখাতে চেয়েছি।