সৌন্দর্যের বাহাস

মার্কিন লেখক সুসান সনট্যাগ (১৯৩৩-২০০৪) একাধারে দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবী। রাজনীতি, শিল্প-সাহিত‍্য, যুদ্ধ এমনকি অসুস্থতার মতো বিষয় নিয়ে তাঁর লেখা ভাবনার উদ্রেক করে। শিল্পের সাথে নন্দনের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর এই লেখাটি (অ্যান আর্গুমেন্ট এবাউট বিউটি) প্রথম ছাপা হয়েছিল ২০০২ সালে ডেডালাস জার্নালে। পরে সুসানের প্রথম প্রবন্ধ সংকলন ‘অ্যাট দ্য সেম টাইম: এসেজ অ্যান্ড স্পিচেস’ (২০০৭)–এ লেখাটি গ্রন্থিত হয়।

অনুবাদ: তানিয়া সুলতানা

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

১.

২০০২ সালের এপ্রিল মাস। পাদরিদের যৌন হেনস্তার অসংখ‍্য ঘটনা গোপন রাখার খবর এ সময় প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এই কেলেঙ্কারির পর পোপ দ্বিতীয় জন পল মার্কিন কার্ডিনালদের ডেকে পাঠান। তিনি বলেন, ‘মহৎ শিল্পকর্মে দাগ পড়লেও তার সৌন্দর্য নষ্ট হয় না। এই সত্যিটা যেকোনো বুদ্ধিমান এবং সৎ শিল্প সমঝদারমাত্রই স্বীকার করবেন।’

সুন্দর-মহৎ শিল্পকর্মের সঙ্গে ক্যাথলিক চার্চের এই তুলনা কি খুবই অদ্ভুত? হয়তো এটা পোপের জন্য ততটা অদ্ভুত নয়। তাঁর এই নির্বোধ তুলনা বিষয়টিকে এমন হালকা বা খেলো করে ফেলে যে আমরা তাকে উপেক্ষা করতে শিখি, ঠিক যেমন নির্বাক চলচ্চিত্রের পর্দায় কিংবা পুরোনো দিনের বিখ্যাত কোনো পেইনটিংয়ে দাগ বা ফাটল উপেক্ষা করি। উঁচু মানের ধারণা পোপ পছন্দ করেন। সৌন্দর্য কিংবা স্বাস্থ্য অনেকটা নির্দ্বিধায় শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন‍্য এগুলো চিরকালীন মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক দিন ধরে।

তবে সৌন্দর্য স্পষ্টতই নশ্বর, এর স্থায়িত্ব নেই। এটা কালজয়ী নয়। সমঝদার মানুষ যখন বিশেষ মনোযোগে সৌন্দর্যকে দেখেন, তখন হয়তো সেখানে তিনি বেদনাই উপলব্ধি করেন। শেক্‌সপিয়ার তাঁর সনেটে বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

জাপানে সৌন্দর্য উদ্‌যাপনের অন্যতম এক উপলক্ষ হলো বার্ষিক চেরি ফুল উৎসব। ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি জাপানে ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু এই উৎসব-আনন্দের মধ্যেই কোথায় যেন এক বিষণ্নতা লুকিয়ে থাকে। কারণ, সবচেয়ে সুন্দর সময় বা জিনিসগুলো খুব দ্রুত চলে যায়। তবু মানুষ সৌন্দর্যকে স্থায়ী বা শাশ্বত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে চলে। আর এই প্রচেষ্টা আমাদের ভাবনা-চিন্তার জগতে অনেক পরিবর্তন এনে দেয়। শাশ্বত সৌন্দর্যের এই ধারণা এতই প্রবল আর আকর্ষণীয় যে তা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের চরিত্র এবং প্রশংসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি।

এই প্রচেষ্টার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সৌন্দর্যের বিভিন্ন ধরন বা রকম তৈরি যেমন ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্য’ বা ‘আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের’ বিষয়টা। এগুলো সাধারণ সৌন্দর্য অর্থাৎ বাহ্যিক—যেগুলো ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি সম্ভব—সৌন্দর্যের থেকেও উচ্চতর। বিভিন্ন রকমের উদ্ভাবিত এই সব সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন স্তরে ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ডে সাজানো হতো। সব থেকে ওপরের স্তরে জায়গা পেত সব থেকে শাশ্বত এবং উচ্চমানের সৌন্দর্য।

সাধারণ মানুষ দৈহিক সৌন্দর্যকেই এখন পর্যন্ত সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি মনে করে, যেটা আসলে নিম্ন মানের। পোপ এখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত শিশুদের ওপর চলতে থাকা যৌন নিপীড়ন এবং গির্জার যাজকদের পক্ষে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। ওখানে তিনি নিশ্চয়ই নিম্ন মানের অর্থাৎ দৈহিক সৌন্দর্যের আলাপ তুলবেন না। তিনি তুলবেন উঁচু জাতের সৌন্দর্যের আলাপ, যেটা আমরা শিল্পকলা নিয়ে করে থাকি। শিল্পের যতই বাহ্যিক রূপ থাকুক না কেন, অর্থাৎ অবয়ব থাকলেও কিংবা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলেও, শিল্পের সৌন্দর্য ‘হৃদয়’ দিয়ে অনুভব করতে হয়, এমন একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এ কারণেই সৌন্দর্যের জগতে শিল্পের অবস্থান উঁচুতে। শিল্পের মধ্য দিয়ে যখন সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, তখন সেটা এক চিরকালীন মাত্রা পায়। কেননা, শিল্প এমন এক মাধ্যম, যেটা চিরন্তন সৌন্দর্যের ধারণা সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে পারে। উঁচু দরের সৌন্দর্য আসলে দীর্ঘস্থায়ী। সৌন্দর্য খেলো নয়; বরং গভীর। সৌন্দর্যের সূক্ষ্মতা গোপনে লুকিয়ে থাকে, প্রকট নয়। এই সৌন্দর্য মনকে প্রশান্ত করে, অশান্ত নয়। শিল্পে যেমন সৌন্দর্যের অবিনাশী রূপ ধরা পড়ে, প্রকৃতির সৌন্দর্যও তেমনি আমাদের মাঝে গভীর রেখাপাত করে।

যেসব সম্প্রদায়ের নেতারা নতুন চিন্তাভাবনাকে হুমকি হিসেবে দেখেন, তাঁরা সৌন্দর্যের প্রায়োগিক ধারণা এমনভাবে গড়ে তোলেন, যাতে তা সাধারণভাবে প্রশংসা ও সান্ত্বনার মাধ্যম হয় এবং তাঁরা আর সেটিকে বদলাতে চান না। ঠিক যেমনটা ‘মঙ্গলের’ ধারণা তাদেরকে স্বস্তি জোগায়।

২.

খোদ সৌন্দর্যের ইতিহাসটাই এর সেরা তত্ত্ব। এই ইতিহাসের দিকে তাকালে বা চিন্তা করলে আপনি দেখবেন নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণি বা সম্প্রদায় কীভাবে একে নিজেদের পক্ষে খাটিয়ে নিয়েছে বা ব্যবহার করেছে। অনেক নেতা বা চিন্তামুনি নিত্যনতুন চিন্তাভাবনাকে তাদের সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিকর বা হুমকি হিসেবে দেখেন। প্রায়ই তারা একধরনের প্রশংসা এবং প্রশান্তিদায়ক মাধ্যম হিসেবে সৌন্দর্যকে ব্যবহার করেন। আর এই জায়গা থেকে তাঁরা সরে আসতে চান না।

যেসব সম্প্রদায়ের নেতারা নতুন চিন্তাভাবনাকে হুমকি হিসেবে দেখেন, তাঁরা সৌন্দর্যের প্রায়োগিক ধারণা এমনভাবে গড়ে তোলেন, যাতে তা সাধারণভাবে প্রশংসা ও সান্ত্বনার মাধ্যম হয় এবং তাঁরা আর সেটিকে বদলাতে চান না। পোপ দ্বিতীয় জন পল আর তিনি যে রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানের হয়ে কথা বলেন, উভয়ই এ ধরনের সৌন্দর্যের ধারণার সঙ্গে নিরাপদ আর স্বচ্ছন্দ। ঠিক যেমনটা ‘মঙ্গলের’ ধারণা তাদেরকে স্বস্তি জোগায়।

প্রায় এক শ বছর আগে উঁচু দরের শিল্পকলা নিয়ে যে সম্প্রদায়গুলো কাজ করত, তারা তাদের প্রকল্পে যে নিরীক্ষা চালাচ্ছিল, সেখানে সৌন্দর্যকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। তাদের চোখে বিষয়টি এমন দাঁড়াল যে সৌন্দর্য ধারণাটি খারিজ করা দরকার। যাঁরা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চান আর যাঁরা এর সমঝদার, তাঁদের কাছে সৌন্দর্য হয়ে উঠল একটা রক্ষণশীলতার মানদণ্ড। গাট্রুড স্টাইল বলেছিলেন, কোনো শিল্পকর্মকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কেউ যদি সেটাকে সুন্দর বলে অভিহিত করে, তাহলে আদতে সেটাকে ‘মৃত’ বোঝায়। একেবারে সাধারণ কোনো সুন্দরকে বোঝাতেই এখন সুন্দর শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই প্রশংসা এখন ফাঁকা বুলির মতো, সংস্কৃতির সঙ্গে এর সম্পর্কের চিড় ধরেছে।

সৌন্দর্য নিয়ে এত তর্কবিতর্কের পরও কোথাও না কোথাও সৌন্দর্যের প্রতাপ আজও রয়ে গেছে, তাকে দমন করা সম্ভব হয়নি। (আর তা হবেই–না বা কেন!) সৌন্দর্যরসিক অস্কার ওয়াইল্ড তাঁর ‘দ্য ডিকে অব লাইং’–এ বলেন, ‘সত্যিকারের সংস্কৃতিপ্রেমী লোক কখনো সূর্যাস্তের সৌন্দর্য নিয়ে আলাপ তোলেন না। সূর্যাস্তের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলাটা এখন সাবেকি ধারণা। শুরুতে সূর্যাস্ত একটু ধাক্কা খেলেও তা এখন সামলে নিয়েছে।’ সময়ের পালাবদলে চারুশিল্প স্রোতে গা ভাসাতে পারেনি। তবে শিল্পের মানদণ্ড থেকে সৌন্দর্যের এই বাদ পড়ে যাওয়ার মানে এই না যে তাতে সৌন্দর্যের গুরুত্ব কমে গেছে; বরং শিল্পের প্রতিই মানুষের আস্থায় ভাটা পড়েছে।

৩.

যখন শিল্পের একটি গুণ হিসেবে সৌন্দর্যের অবস্থান প্রশ্নাতীত ছিল, তখন সৌন্দর্যকে সরাসরি সংজ্ঞায়িত করা হতো না; বরং অন্য কোনো গুণের উপস্থিতিকে বোঝানো হতো—অর্থাৎ সেই গুণ শিল্পের মধ্যে অপরিহার্যভাবে থাকলেই সেটাকে সৌন্দর্য ভাবা হতো। তাই বলা যেতে পারে, সৌন্দর্যের সংজ্ঞা হলো আদতে সৌন্দর্যের প্রশংসা। লেসিং যখন সৌন্দর্যকে সাদৃশ্যতার সঙ্গে তুলনা করেন, তখন তিনি আসলে সৌন্দর্যের একটি কাঙ্ক্ষিত গুণের কথাই তুলে ধরেন।

সৌন্দর্যের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা যখন ছিল না, সে সময় মনে করা হতো মানুষের মধ্যেই শিল্পের সৌন্দর্য অনুধাবনের বিশেষ ক্ষমতা বা উপলব্ধি রয়েছে। এই উপলব্ধির আরেক নাম রুচি। রুচিশীল লোকেরা জীবনে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট আনন্দকে সংবেদশীল মনন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে জানেন। তাঁরা শিল্পের সমঝদার, শিল্পের ভালোমন্দ বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারেন। তাঁদের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট একটি শিল্পের তালিকা তৈরি হয়; আর সেগুলোই সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়। যেহেতু শিল্পের সৌন্দর্য বাস্তবতা থেকে একদমই আলাদা, এ জন্য শিল্পে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য সাধারণ লোকের চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে না—এমন ধারণা গড়ে উঠেছে। এই রুচি নিয়ে কিছু সমস্যাও ছিল। অনেক সময় গড্ডলিকা প্রবাহের মতো শিল্পপ্রেমীদের মধ্যে একই ধরনের চিন্তাপ্রক্রিয়া দেখা যায়। অথচ এই রুচির বিষয়টি আদতে ব্যক্তিগত এবং সাময়িক; আবার একই সঙ্গে পরিবর্তনশীল প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে একই রকমের চিন্তাপদ্ধতি বা সহমত পোষণের বিষয়টি চোখে পড়ে, একটা নির্দিষ্ট গণ্ডি বা শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। সীমাবদ্ধতার এই সমস্যা হঠানোর সম্ভাবনা নিয়ে ইঙ্গিত দেন কান্ট। কান্ট সবকিছুকে সর্বজনীনতা দিয়ে দেখতে চাইতেন, তিনি ‘ভেদজ্ঞান’ বা বিচার-বিবেচনা বোধ বলে এক বিশেষ মানসিক ক্ষমতার আলাপ তোলেন। যার কাজ নির্দিষ্ট এবং চিরস্থায়ী নীতির ভিত্তিতে চলে। এই সর্বজনীন ভেদজ্ঞান সঠিকভাবে কাজ করলে এ থেকে উৎসারিত রুচি সবার মধ্যে বিরাজ করার কথা। কিন্তু এই ভেদজ্ঞান যেভাবে কাজ করার কথা ছিল, সে রকমটা দেখা যায়নি। এটা যেমন রুচিকে প্রভাবিত করতে পারেনি আবার গণতান্ত্রিকও হয়ে ওঠেনি। কারণ, রুচিকে শাশ্বত নীতির ভিত্তিতে বাস্তবিক অর্থে ব্যবহারের বিষয়টি প্রায় অসম্ভব। বাস্তবতা বলে যে শিল্পকর্মের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই দুর্বল ও ক্ষীণ। বরং অভিজ্ঞতা থেকেই রুচি গড়ে ওঠে, আগের এই ধারণা অনেক বেশি সহজ এবং প্রায়োগিক। তবে আজকের দিনে রুচি একটি পুরোনো ও দুর্বল ধারণা। এখন প্রশ্ন আসে, কার রুচি?

সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনার জগতে যখন আপেক্ষিকতার ধারণা স্পষ্ট হচ্ছিল, তখন সৌন্দর্য নিয়ে পুরোনো দিনের মূল্যায়নগুলো ভেঙে পড়ছিল। সৌন্দর্যকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা খেলো আর নিরর্থক হয়ে গেল। অর্থাৎ মূল বৈশিষ্ট্যগুলো কী, তা নির্ধারণ করা গেল না। এ সময়ে এসে সৌন্দর্যকে আর ‘সামঞ্জস্যতার’ মতো গুণ বলে ধরা গেল না। ভ্যালেরির ভাষায়, সৌন্দর্যের প্রকৃত স্বভাবই হলো একে সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না। আরও ঠিকঠাক করে বললে, বলতে হয় সৌন্দর্যকে বর্ণনা করা কঠিন।

সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করতে না পারার এই ব্যর্থতা যেন মানুষের ভেদজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতাকে এ রকম তাচ্ছিল্যই করে। একটা সময় আসলে ভাবা হতো যে মানুষের বিবেচনাবোধ নিরপেক্ষ। কিন্তু এখন ধারণা বদলেছে, এখন মনে করা হয় মানুষের বিচারবোধ ব্যক্তিস্বার্থ প্রভাবিত বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে পারে। এ ছাড়া এটা শিল্পে বাইনারি ডিসকোর্সকে প্রশ্নবিদ্ধ করারও একটা নজির। মানে আগের সেই সোজাসাপটা দুই ভাগে ভাগ করার বিষয়টি এখন আর নেই। সৌন্দর্য নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে কুৎসিত ধারণার বিপরীত (বাইনারি) জায়গা থেকে। নিশ্চিতভাবে, কোনো কিছুকে কুৎসিত না বলতে চাইলে আপনি কিন্তু অন্য কোনো কিছুকে সুন্দরও বলতে পারবেন না। যদিও আজকাল কোনো বিষয় বা ব্যক্তিকে কুৎসিত বলা নিয়ে নিষেধাজ্ঞার নানা ট্যাবু তৈরি হয়েছে, (এটা বুঝতে হলে, প্রথমেই রাজনৈতিক ন্যায্যতার দিকে নয়, তাকাতে হবে ভোগবাদী মানস তৈরি ও বিকাশের দিকে—তারপর এ দুইয়ের মধ্যে কীভাবে গোপন যোগসূত্রটা কাজ করে, তা জানতে হবে)।

মূল কথা হলো এই যে সৌন্দর্যের খোঁজ এমন জায়গায় করা, যেখানে এর আগে কেউ একে দেখেনি (অর্থাৎ কদর্যতার মধ্যে সৌন্দর্য অন্বেষণ)। একই সঙ্গে ‘ভালো রচি’ এই ধারণারও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। রুচির মধ্যে ভালো–খারাপের বাইনারি নিয়ে যে বিভাজন, তার বিরোধিতা হচ্ছে। আবার কিছু কিছু জায়গায় এই ধারণা টিকে যাচ্ছে, যখন কেউ কারও উন্নাসিকতাকে প্রশ্ন করছে এবং আগে খারাপ রুচি ভেবে যা কিছুকে তাচ্ছিল্য করত, এমন কিছুতে উল্লসিত হচ্ছে। আজকের দিনে ভালো রুচির ধারণাকে সেকেলে মনে করা হয়, অন্তত সৌন্দর্যের ধারণার চেয়ে তো বটেই, গম্ভীর, জটিল। ‘আধুনিক’ শিল্প এবং সাহিত্য এখন অনেকটাই পুরোনো এবং উন্নাসিক ষড়যন্ত্র বলে মনে হয়। এখন সৃষ্টিশীলতা মানে হলো সহজিয়া; আজকের ‘সহজ শিল্প’ চলার পথে সবার জন্য সবুজ সংকেত দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ব্যবহারকারীবান্ধব শিল্পকর্ম পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। সৌন্দর্য এখন খুব সাধারণ কিংবা নিশ্চিত হয়ে উঠেছে, তা না হলে সেটাকে খুব অহংকারী মনে হয়। আজকাল সৌন্দর্যের ওপর খড়্গ নেমে আসছে। একে হাস্যকর রকম সংস্কৃতি যুদ্ধ বলা যায়।

সৌন্দর্যের সংজ্ঞা হলো আদতে সৌন্দর্যের প্রশংসা। সৌন্দর্যের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা যখন ছিল না, সে সময় মনে করা হতো মানুষের মধ্যেই শিল্পের সৌন্দর্য অনুধাবনের বিশেষ ক্ষমতা বা উপলব্ধি রয়েছে। এই উপলব্ধির আরেক নাম রুচি। রুচিশীল লোকেরা জীবনে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট আনন্দকে সংবেদশীল মনন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে জানেন।

৪.

সৌন্দর্য কিছু জিনিসের জন্য প্রযোজ্য ছিল, আবার কিছু কিছু জিনিসের জন্য ছিল না। একসময় সৌন্দর্যের উপস্থিতি নিয়ে এই গুরুতর বিভেদ নীতিই ছিল এর সব থেকে শক্তি আর আবেদনের জায়গা। সৌন্দর্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এমন এক ধারণার অধীন ছিল। এটা এমন এক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, যেখানে শ্রেণি, অবস্থান, পদক্রম কিংবা বাদ দিয়ে দেওয়ার অধিকারকে স্বাভাবিক মনে করা হতো।

কিন্তু সৌন্দর্যের এই গুণই পরে আবার তার দায় হয়ে দাঁড়ায়। যে সৌন্দর্য একসময় খুব সাধারণ এবং খেলো মনে হতো—দেখা গেল তা অনেক কিছুকে বাদ দিয়ে দেয় বা বিযুক্ত করে। মূল‍্যায়ন করার দক্ষতা যেমন রুচিশীলতা, খুঁতখুঁতে মনোভাব এই বিষয়গুলো একসময় ভালো চোখে দেখা হতো। কিন্তু একসময় তা পক্ষপাত, সংকীর্ণতা বা ভিন্ন কিছু গ্রহণ করার অক্ষমতা হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করল। সৌন্দর্যের প্রতি সব থেকে কঠিন আঘাত এসেছে শিল্পজগৎ থেকে। এমন একটি ধারণা তৈরি হলো যে সৌন্দর্য এবং এর প্রতি আলাদা রকম যত্নশীল থাকাটা খুব গতানুগতিক বা উন্নাসিক জিনিস।

সুন্দর না বলে কোনো কিছু বরং ইন্টারেস্টিং বা কৌতূহলোদ্দীপক বললে, সেটা বরং কোনো বিশেষ বর্গের না হয়ে সর্বজনীন একটা রূপ পায়।

কোনো শিল্পকর্মকে কৌতূহলোদ্দীপক বলার মানে এই নয় যে সেটা বোদ্ধারা পছন্দ করেন। আর এটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না যে তারা শিল্পকর্মটি সুন্দর বলতে নারাজও। সাধারণত এ ধরনের কথা বলা মানে হলো, এটা তাদের পছন্দ করা উচিত বলে তাঁরা মনে করছেন। অথবা তাঁরা শিল্পটি হালকাপাতলা পছন্দ করলেও নিশ্চিত থাকেন যে সেটি সুন্দর নয়।

সুন্দর বলাটা এত সাধারণ আর খেলো হয়ে উঠেছে যে বোদ্ধারা এড়িয়ে যান, বদলে আকর্ষণীয়–জাতীয় কিছু একটা বলে বসেন। এই ‘আকর্ষণীয়’ শব্দটি সবার প্রথমে ব্যবহৃত হয়েছিল আলোকচিত্রে। শিল্পমাধ্যম হিসেবে আলোকচিত্র সবকিছুকে ক্যামেরার উপযুক্ত বিষয়বস্তু হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছিল। কেবল সৌন্দর্যের ওপর আটকে থাকলে এত আলোকচিত্রে এত বৈচিত্র্য তৈরি হতো না। বরং সময়ের ব্যবধানে সৌন্দর্য শব্দটাই স্কেল আর শীতলতার প্রতীক হয়ে উঠল। যেমন সূর্যাস্ত খুব সুন্দর—একটা সূর্যাস্তের ছবির দিকে তাকিয়ে একজন রুচিশীল মানুষ হয়তো বলতে চাইবে—হ্যাঁ, ছবিটা ‘ইন্টারেস্টিং’।

৫.

আকর্ষণীয় বলতে কী বোঝায়? যা কিছু আগে সুন্দর বা ইতিবাচক ভাবা হতো না, তাই আজ আকর্ষণীয়। নিটশে যেমনটা বলেছেন—অসুস্থ মানুষ আকর্ষণীয়, দুষ্টুরাও তাই। পুরোনো রুচি বা তারিফ করবার রীতিকে চ্যালেঞ্জ করার মধ্য দিয়েই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার মানে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টিতে একরকম আরোপিত ঔদ্ধত্য বা মেধার পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। যেসব সমঝদার ‘আকর্ষণীয়’–এর দলে—এখানে যার প্রতিশব্দের নাম একঘেয়ে—তারা সামঞ্জস্যতা নয় বরং সংঘাতকে পছন্দ করেন। ‘দ্য কনসেপ্ট অব পলিটিক্যাল’ বইয়ে কার্ল শামিট বলেছিলেন ‘উদারনীতি একঘেয়ে’। বইটি ১৯৩২ সালে বেরিয়েছিল আর ঠিক তার পরের বছর তিনি নাজি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ, উদারনৈতিক রাজনীতির মাঠে কোনো নাটক নেই, দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই, নেই কোনো স্বাদ-গন্ধ। অন্যদিকে কঠোর স্বৈরাচার—এমনকি যুদ্ধ—বেশ আকর্ষণীয়।

দীর্ঘদিন আকর্ষণীয় শব্দের অতি ব্যবহারের ফলে এই শব্দটায় যে বিদ্রোহ ছিল, তা যেন ক্রমে হারিয়ে গিয়েছে। এখনো যা অবশিষ্ট আছে, তা নিহিত রয়েছে শিল্পকর্ম বা শিল্প সমালোচনার গন্তব্য নিয়ে গা ছাড়া ভাবের মধ্যে। আর যা নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা, তা আদৌ সত্য কি না, সেটা ঘটনার বিষয়ই হয়ে ওঠে না। কোনো কিছুকে আকর্ষণীয় বলার সুবিধা হলো সেটাকে সুন্দর বা ভালো বলে স্পষ্ট কোনো বিচার করতে হয় না। ‘আকর্ষণীয়’ শব্দটি এখন ভোগবাদী ধারণার অংশ হয়ে উঠছে, যা এক সম্প্রসারিত ধারণা তৈরি করে। যত বেশি জিনিস আকর্ষণীয় বলে অভিহিত হবে, বাজার তত বড় হবে। একঘেয়েমি, একধরনের হাজির না থাকা বা শূন‍্যতা নির্দেশ করে—আর ছকে বাঁধা নিয়মের প্রতিষেধক হয়ে ওঠে নিয়মহীন আর অবাধে আকর্ষণীয় বলে বলে স্বীকৃতি দেওয়া।

এটা বাস্তবতা অনুভব করার এক অদ্ভুত যাপন, যেখান থেকে আপনি কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে পারবেন না। আর যাপনের এই ঘাটতি পূরণের একমাত্র পথ হলো একঘেয়েমি বা হতাশা কিংবা অবদমনকে প্রকৃত অর্থেই অনুভব করা। আর এটা সম্ভব হলেই কেবল প্রকৃত ‘আকর্ষণীয়র’ মানে নিয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু অনুভবের ভেতর দিয়ে এর মানে বুঝতে শিখলে পরে একে আদৌ ‘আকর্ষণীয়’ বলতে মন চাইবে কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।

‘দ্য কনসেপ্ট অব পলিটিক্যাল’ বইয়ে কার্ল শামিট বলেছিলেন ‘উদারনীতি একঘেয়ে’। বইটি ১৯৩২ সালে বেরিয়েছিল আর ঠিক তার পরের বছর তিনি নাজি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ, উদারনৈতিক রাজনীতির মাঠে কোনো নাটক নেই, দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই, নেই কোনো স্বাদ-গন্ধ। অন্যদিকে কঠোর স্বৈরাচার—এমনকি যুদ্ধ—বেশ আকর্ষণীয়।

৬.

আদর্শ বা পূর্ণতার স্বরূপ তুলে ধরে সৌন্দর্য। আর সৌন্দর্যের সঙ্গে নারীর আরও স্পষ্ট করে বললে নারীত্বের সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক করে তোলে। ফলে এটা নিয়ে একধরনের দ্বিধা বা সংকোচ লক্ষ করা করা যায়। এই পুরো বিষয়টি উঠে এসেছে প্রাচীনকাল থেকে নারীত্বকে খাটো করে দেখার মানসিকতা থেকে। সৌন্দর্যকে ছোট করে দেখার এই লিঙ্গীয় দৃষ্টিভঙ্গির বেশ গুরুত্বপূর্ণ দিকটি বোঝা জরুরি। সৌন্দর্যকে অনেক সময় উচ্চাঙ্গের প্রতীক বানানো হয়, এমন রূপক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যের ধারণা থেকে ‘মেয়েলি’ বা তুচ্ছ জিনিসগুলোকে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়। যার পেছনে একধরনের নারীবিদ্বেষ কাজ করতে পারে। নারীকে সৌন্দর্যের কারণে পূজা করার মধ্য দিয়ে আসলে তার অস্তিত্বকে সংকুচিত করে তোলা হয়। এর মধ্য দিয়ে নারী তার সৌন্দর্য রক্ষা এবং অর্জনের ক্ষেত্রে অধিক যত্নশীল, এমন ধারণা পুনঃ প্রতিষ্ঠা হয়।

সৌন্দর্য যেন প্রদর্শনের বস্তু, দেখার মতো জিনিস আর উপভোগ্য। আর প্রাকৃতিক বা শৈল্পিক সৌন্দর্যের চেয়ে এই শব্দটি মনে করিয়ে দেয় বিউটি পারলার, ম্যাগাজিন কিংবা প্রসাধনসামগ্রীর কথা। নারীদের সৌন্দর্য পরিচর্যার এক দেখনদারি জগৎ।

আর কীভাবে আসলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব সৌন্দর্য আর নারীর এই সম্পর্ক—বা নির্বুদ্ধিতার। কেউ তার সৌন্দর্য নিয়ে ভাবলে তা আত্মরতি বা তুচ্ছতার শামিল পর্যন্ত হতে পারে।

চোখ বুজে সৌন্দর্যের সব নামের (প্রতিশব্দ) লুতুপুতু ভাবের কথা একটু ভাবুন, ‘লাভলি’ বা ‘প্রিটি’ এই শব্দগুলো আরেকটু কঠিন হওয়ার দাবিতে যেন ক্রমাগত আওয়াজ তুলছে।

‘হ্যান্ডসাম তাই যা সে করে’ (কিন্তু সুন্দরী তাই যা সে করে—কখনোই বলা হয় না)। যদিও হ্যান্ডসাম সৌন্দর্যের মতনই বাইরের রূপটাই প্রকাশ করে অর্থাৎ সে দেখতে আদতে কেমন; কিন্তু এটা নারীদের সঙ্গে জুড়ে যায় না, যায় পুরুষদের সঙ্গে; ফলে শব্দটায় বেশ গভীরতা রয়েছে এবং আবেগতাড়িত শোনায় না। অন্যদিকে সৌন্দর্যের সঙ্গে গাম্ভীর্যটা বেশ বেমানান ঠেকে।

এ জন্যই হয়তো সম্প্রতি যুদ্ধ ও নৃশংসতার ছবি নিয়ে জন ম্যাক্কলিনের যে বইটি বের হয়েছে, তার ভূমিকায় আমি বইটিকে ‘হ্যান্ডসাম’ বলে উল্লেখ করেছি। অথচ বইটি খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু এটাকে যদি বলতাম ‘বিউটিফুল’, তাহলে কেন জানি মনে হয় ওই ভয়ংকর ছবিগুলোর গভীর তাৎপর্যে ভাটা পড়ত।

৭.

সৌন্দর্য একটি নান্দনিক বিষয়, এই সাধারণ বিশ্বাসটিকে প্রায় স্বতঃসিদ্ধভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে অনেকেরই সুন্দরের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্কটি সাংঘর্ষিক মনে হয়। কিন্তু সৌন্দর্যে যদি নীতির উপস্থিতি না–ও থাকে, সেটা কখনোই নগ্ন নয়। তাই সৌন্দর্যের মূল্যায়ন কখনোই নৈতিক মূল্যবোধ থেকে আলাদা করা সম্ভব না। কিয়েকেগার্ড ও তলস্তয় যেমনটা জোর দিয়ে বলেছিলেন, নান্দনিকতা ও নৈতিকতা একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে না; বরং বেশ খানিকটা একই রকম জিনিস। সুন্দর কোনো কিছুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আসলে কেমন হওয়া উচিত, এই প্রশ্নটি বেশ প্রাচীন, প্লেটোর সময় থেকেই উঠে এসেছে। আমরা ধারণা করে নিই যে এই সম্পর্কটি একেবারেই সৌন্দর্যের প্রকৃতিজাত।

সৌন্দর্যকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রবণতা রয়েছে, যেমন ভেতরের সৌন্দর্য ও বাইরের সৌন্দর্য, কিংবা সৌন্দর্যের উচ্চ বা নিম্ন মানের বিষয় রয়েছে। এভাবে ভাবনার অভ্যাস যেন চিরন্তন। এভাবে সৌন্দর্যকে বিচার করার প্রবণতা ধীরে ধীরে একসময় নৈতিক বিচারের ছায়াতলে নিয়ে আসে। নিৎশে বা অস্কার ওয়াইল্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বিষয় ভুল মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি প্রায় অনিবার্য মনে হয়।

আমার মনে হয়, নান্দনিক জগতে সুদীর্ঘ সময়জুড়ে গভীর সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে যে বোধ বা উপলব্ধি জন্মায়, আর কোনো উপায়েই তেমন করে ওই উপলব্ধির কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব না। প্রকৃতপক্ষে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা যেভাবে বাস্তব জীবনের নৈতিকতা বা মানবতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে, সেটা অনেক ক্ষেত্রে ভালোত্ব বা ন্যায়পরায়ণতাকে ব্যাখ্যা করার প্রচলিত সংজ্ঞাগুলোও ঠিকঠাকভাবে পারে না।

আমাদের মানস জগতে সৌন্দর্য এমন এক অংশ, যেখানে মানুষ সবকিছুর একটা আদর্শ প্রতিফলন প্রত্যাশা করে। কিন্তু সব সময় সৌন্দর্য শান্তি দেয়, এমনও না। অনেক সময় কারও মুখ বা দৈহিক সৌন্দর্য আমাদের প্রভাবিত বা দুর্বল করে তুলতে পারে। তার মানে সৌন্দর্যের একটা কর্তৃত্বপূর্ণ রূপ রয়েছে, যেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

৮.

আমাদের মানস জগতে সৌন্দর্য এমন এক অংশ, যেখানে মানুষ সবকিছুর একটা আদর্শ প্রতিফলন প্রত্যাশা করে। এই আদর্শ প্রতিফলন অনেক ক্ষেত্রেই শান্তি বা সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সব সময় সৌন্দর্য শান্তি দেয়, এমনও না। অনেক সময় কারও মুখ বা দৈহিক সৌন্দর্য আমাদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, আমাদের প্রভাবিত বা দুর্বল করে তুলতে পারে। তার মানে সৌন্দর্যের একটা কর্তৃত্বপূর্ণ রূপ রয়েছে, যেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

মানুষ বা শিল্পের সৌন্দর্য আমাদের মধ্যে তার মালিকানা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জাগায়। আমরা তা পেতে চাই বা ধরে রাখতে চাই। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন পাহাড়, বন, কিংবা রাতের তারাভরা আকাশ এই বিচিত্রতা, বিশালতা যেন দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেও একে একান্ত নিজের করে রাখা যায় না। প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাদের শেখায় কীভাবে সৌন্দর্যকে ভালোবাসা যায়। অধিকার না করে কীভাবে উপভোগ করা যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার তীব্র শীতে পাহারা দিতে গিয়ে এক জার্মান সৈন্য তাঁর জীবনের সব থেকে সুন্দর বড়দিন দেখেছিলেন। পরে তাঁর এক ব্যক্তিগত চিঠিতে উল্লেখ করেন কোনো প্রকার সাজসজ্জাহীন সেই রাতে প্রকৃতই তিনি প্রকৃতিকে অনুভব করেন। বিশাল তারাভরা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর গাল বেয়ে নেমেছিল হিমঠান্ডা অশ্রু। না কষ্টের, না আনন্দের বরং গভীর এক অনুভব থেকে ধেয়ে এসেছিল এই আবেগ।

সৌন্দর্য কখনো কখনো পলকা আর ভঙ্গুর, কিন্তু আমরা যে চোখ দিয়ে সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই, সেই অনুভবের ক্ষমতা অনেক দৃঢ়। এমনকি যুদ্ধ বা মৃত্যুচিন্তার মধ্যেও এই অনুভূতি টিকে থাকে।

৯.

হেগেলের মতে, প্রকৃতির চেয়ে শিল্প আরও সুন্দর আরও উচ্চতর। কারণ, মানুষ তার ভাবনা দিয়ে, মনন দিয়ে এটি তৈরি করে। অন্যদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে আমরা যেভাবে উপলব্ধি করি, তা আসে আমাদের সংস্কৃতি থেকে অভিজ্ঞতা থেকে; আর একে হেগেল বলেছেন ‘প্রাণ’।

শিল্প আর প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার পর আমরা তা কীভাবে প্রকাশ করব বা কী প্রতিক্রিয়া দেখাব, সবই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন যে শিল্প কেবল আমাদের প্রকৃতি উপভোগ করতে শেখায় না; বরং কোন উপায়ে উপভোগ করব বা কোন জিনিসগুলো উপভোগ করার মতো, সেটিও বলে দেয়। (তিনি কবিতা ও চিত্রকলার প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন ছবি বা আলোকচিত্র এখন প্রকৃতির সৌন্দর্যের সংজ্ঞায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে)। সুন্দর কিছু নজরে এলেই তা আমাদের প্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। অর্থাৎ সুন্দর হলো এমন কিছু, যেন সেটা মানুষের তৈরি নয়। এই বোধ আমাদের চারপাশের জীব ও জড়জগতের প্রতি আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে বলে।

আনন্দের বিষয় হলো, এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই সৌন্দর্য আবার তার দৃঢ়তা আর গুরুত্ব ফিরে পায়। যদি একে অন্তর থেকে উপলব্ধি করা যায়, তাহলে এটা এমন এক পাটাতন তৈরি করে দেয়, যার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের অনুভূতি, পছন্দ-অপছন্দের অর্থ বুঝতে পারি। আর যে জিনিসগুলো এই জায়গাটা নিয়ে নিতে চেয়েছিল, সেগুলোকে আমরা হেসে উড়িয়ে দিতে পারি।

ভাবুন তো কেউ বলছে—‘সেই সূর্যাস্তটা খুব ইন্টারেস্টিং!’