যুদ্ধবিধ্বস্ত সীমান্ত শহরে ভূগর্ভস্থ কবিতা উৎসব

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

রাশিয়ান সীমান্তের খুবই কাছে পূর্ব ইউক্রেনের বৃহত্তম শহর খারকিভের অবস্থান। শহরটি তাই সহজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবু নিজস্ব সাংস্কৃতিক জীবন যাপন বজায় রাখতে দৃঢ় সংকল্প রয়েছে এখানকার অধিবাসীদের। কদিন আগে আয়োজিত একটি কবিতা উৎসব খারকিভের মানুষের মানসিক দৃঢ়তা আর সৃজনশীলতারই প্রমাণ হাজির করে। 

রাশিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ মাইল দূরে অবস্থিত খারকিভ শহরটি এখন ভাঙা-পোড়ার এক বিরোধপূর্ণ মিশ্রণে প্রায় পরিত্যক্ত। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে রক্ষার জন্য শহরের ভাস্কর্যগুলো বালুর বস্তায় মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। পার্কে ফুলের বাগানগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। স্ট্রিট লাইফ একটি ইউরোপীয় দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকে যতটা আশা করা যায়, তার চেয়ে কয়েক গুণ শান্ত। তবু বইয়ের দোকান, কফিশপ আর রেস্তোরাঁগুলো খোলা আছে!

খারকিভ শহরটি এখন ভাঙা-পোড়ার এক বিরোধপূর্ণ মিশ্রণে প্রায় পরিত্যক্ত
ছবি: সংগৃহীত

সম্মুখযুদ্ধের শহরটিতে সর্বত্র দৃশ্যমান রাশিয়ার আক্রমণের নানা চিহ্ন। রাস্তাঘাটে চোখে পড়ে ধাতব ও কণ্টকাকীর্ণ ট্যাংক–প্রতিরোধীর সারি। ১৯২০-এর দশকে নির্মিত দুর্দান্ত গাজপ্রম (Gazprom) ভবনটি স্থাপত্যকলার এক মাস্টারপিস, বর্তমানে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শহরজুড়ে, রাতের বিস্ফোরণে ভবনগুলোর উড়ে যাওয়া জানালা—চিপবোর্ডের শিট দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি প্যানেলে দুটি ভাঁজ করা হাত ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, প্রিয় খারকিভ’ লেখা একটি কাগজের কাটআউট দিয়ে আটকানো হয়েছে। 

এমন ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যেও সাংস্কৃতিক জীবন টিকে আছে এখানে। কিন্তু এ জীবন মূলত মাটির নিচে চাপা পড়া—থিয়েটারের বেজমেন্টগুলো এখন তাদের প্রধান মঞ্চ; বইয়ের দোকানের অনুষ্ঠানস্থল ভূগর্ভস্থ। খারকিভের শিল্পী কোস্টিয়ানটিন জোরকিন এই ভূগর্ভস্থ বিশ্বকে পরিবেশের জন্য একটি উপযুক্ত রূপক হিসেবে তৈরি করেছেন। তাঁর কাজের একটি সিরিজ যুদ্ধকালীন খারকিভকে ঝোড়ো সমুদ্রে একাকী জাহাজ হিসেবে তুলে ধরে, যার বাসিন্দারা তুলনামূলক নিরাপদে, জাহাজের হোল্ডে আটকে ছিল।

খারকিভে বিমান হামলার সতর্কতা বাজতে না বাজতেই প্রায়ই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আঘাত হানে। এই পরিস্থিতিতে কবিতা উৎসবের মতো অন্তরঙ্গ এবং আবেগঘন কিছু সত্যিই অভাবনীয়। শহরের কেন্দ্রস্থলে মাটির নিচে অবস্থিত একটি স্থানে সম্প্রতি দুই দিনের এই অনুষ্ঠানটি অকল্পনীয় তাৎপর্য ও তীব্রতা অর্জন করেছে। 

খারকিভে বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়, বিমান হামলার সতর্কতা বাজতে না বাজতেই প্রায়ই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আঘাত হানে। এই পরিস্থিতিতে কবিতা উৎসবের মতো অন্তরঙ্গ এবং আবেগঘন কিছু সত্যিই অভাবনীয়। শহরের কেন্দ্রস্থলে মাটির নিচে অবস্থিত একটি স্থানে সম্প্রতি দুই দিনের এই অনুষ্ঠানটি অকল্পনীয় তাৎপর্য ও তীব্রতা অর্জন করেছে। 

সেখানে খারকিভের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি, ঔপন্যাসিক এবং সংগীতজ্ঞ সের্হি ঝাদান কবিতা পাঠ করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধকালীন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এ ধরনের উৎসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটির মাধ্যমে তাঁরা অনুভব করেন যে তাঁরা একা নন বা তাঁদেরকে পরিত্যক্ত করা হয়নি, চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা তাদের মূল্যবোধ ভাগ করে নেয়।

প্রকাশক ‘মেরিডিয়ান সেরনোভিটজ’ কর্তৃক আয়োজিত ভূগর্ভস্থ কবিতা উৎসব
সংগৃহীত

প্রকাশক ‘মেরিডিয়ান সেরনোভিটজ’ কর্তৃক আয়োজিত এই কবিতা উৎসব খারকিভে আয়োজিত এ ধরনের প্রথম কোনো অনুষ্ঠান। যদিও প্রকাশনাটি ২০২৩ সাল থেকে দক্ষিণের ফ্রন্টলাইন শহর ওডেসা, মাইকোলাইভ ও খেরসনে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছে। আয়োজক এভজেনিয়া লোপাটা বলেছেন, লোকেরা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছে এবং কবিতা শুনতে পারছে। ঘরে বসে ড্রোন গুনছে না বা ফেসবুক দেখছে না শুধু। এখানে থাকা মানে এমন একটি সম্প্রদায়ের অংশ হওয়া, যারা একে অপরকে সমর্থন করছে। 

রুশফোন (Russophone) ভাষাভাষীদের মধ্যে এটি এমন একটি সংযোগ স্থাপনের ঘটনা, যখন ২০২২ সালে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে ইউক্রেনীয় ভাষায় স্থানান্তরিত হয়েছেন এই শহরের বেশির ভাগ সৃজনশীল মানুষ। আয়োজক লোপাটা বলেন, অনেক মানুষ ভাষা পরিবর্তন করে ইউক্রেনীয় ভাষা বেছে নেওয়ার একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি জানান, পাঠক ইউক্রেনীয় সাহিত্য পড়তে চায়। খারকিভেই তাদের সমস্ত বই ছাপা হয়। ‘আমরা আমাদের বইগুলো প্রকাশ করতে পারছি; কারণ মুদ্রণ কারখানায় নিযুক্ত লোকেরা এখনো কাজ করছেন।’

তবে অনিশ্চয়তায় পড়েছে খারকিভের বিশাল মুদ্রণশিল্প। গত বছরের মে মাসে, বেশ কয়েকটি বোমা শহরের মুদ্রণ কারখানাগুলোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তখন ওই বোমা হামলায় কারখানার সাতজন কর্মীও নিহত হয়েছিলেন। 

খারকিভ কবিতা উৎসবে প্রথম কবিতা পাঠ করেন বিখ্যাত যুদ্ধ চিকিৎসক ইউলিয়া পাইভস্কা। ২০২২ সালের মার্চ মাসে মারিউপোলে একজন বেসামরিক নাগরিকের চিকিৎসা করার সময় বন্দী করা হয় তাঁকে। রাশিয়ায় বেশ কয়েক মাস বন্দী ছিলেন। ২০২২ সালের জুনে মুক্তি পাওয়ার আগপর্যন্ত তাঁকে ভয়াবহ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। 

পাইভস্কা বন্দী অবস্থায় কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, একটি ছোট্ট প্লাস্টারের টুকরা নিয়ে সেলের দেয়ালে শব্দ আঁচড়ানোর মাধ্যমে কবিতা লিখছিলেন তিনি। যদিও কাজটি নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, এটি আমাকে অতল গহ্বর থেকে টেনে এনেছিল। পরে তিনি সেই টুকরাগুলো স্পষ্টভাবে মনে রাখতে পারেননি, কেবল অনুভূতিগুলো যেমন ছিল, সেটা স্মরণ করে করে কবিতাগুলোর পুনর্নির্মাণ করেন।

‘কবিতা লেখার সেই প্রচেষ্টা ছিল মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার আর মনকে সংরক্ষণ করার একটি উপায়’—তিনি তাঁর কবিতা পাঠের পরে বন্দী থাকাকালীন দেয়াল-আঁচড়ে কবিতা লেখার স্মৃতিচারণা করেন। ‘আমি কে ছিলাম, তা মনে রাখার জন্যই লিখছিলাম…রাশিয়ান কারাগার ব্যবস্থার সবকিছুই আপনাকে নিশ্চিত করবে যে আপনি কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, তিনি যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন তা হলো, ‘কেবল আমার শ্বাসপ্রশ্বাস আর আমার কবিতা।’ 

বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, কবি ইরিনা সিলিক তাঁর ‘মাই ডে’ কবিতাটি পাঠ করেছেন। কবিতায় যুদ্ধকালীন কিয়েভে বিমান হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া, বাচ্চাদের নাশতা তৈরি, গোসলের সময় হঠাৎ কান্না পাওয়া, সুপারমার্কেটে ওয়াইন বেছে নেওয়া—এই সব পরস্পরবিরোধী অভিজ্ঞতাগুলো কী করে অস্বস্তিকরভাবে একসঙ্গে চাপা পড়ে যায়, তার বর্ণনা রয়েছে।

খারকিভে আয়োজিত ভূগর্ভস্থ কবিতা উৎসব
সংগৃহীত

তিনি ইউক্রেনের ক্রমবর্ধমান ব্যস্ততার কথাও বলেছেন: কীভাবে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ, যুদ্ধ এবং ট্রমার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মোকাবিলা করে, পারস্পরিক বোধগম্যতায় বিভক্ত। তিনি দর্শকশ্রোতাদের তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন—কীভাবে তাঁর স্বামী, ঔপন্যাসিক আর্টেম চেখ, ২০১৬ সালে ফ্রন্টলাইন থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। ২০২৩ সালে বাখমুতের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর তিনি এখন কিয়েভে কর্মরত।

‘ফিরে আসার সেই দিনটি এমন একটি তারিখ ছিল, যার জন্য আমি ছয় মাস ধরে অপেক্ষা করছিলাম। এত দিন পর কীভাবে একসঙ্গে থাকব, কীভাবে কথা বলব, আর কীভাবেই–বা ঘনিষ্ঠতা পুনর্নির্মাণ করতে পারব, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আমার মনে হয় অনেক দম্পতিই এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন। দুর্ভাগ্যবশত, কোনো কোনো দম্পতি এমন অবস্থায় আর টিকতে পারেননি শেষ পর্যন্ত।’

অনেক শ্রোতা সদস্য—যাঁদের বেশির ভাগেরই বয়স ২০ থেকে ৩০–এর কোঠায়—মধ্যাহ্নভোজ থেকে রাত ৮টা ৩০ পর্যন্ত কথোপকথন আর কবিতা পাঠের পুরো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দর্শকদের মধ্যে একজন আইটি কর্মী ওলেনা দোল্যা, শহরে থাকার ব্যাপারে এক নিয়তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, ‘আমার জানালা আর বারান্দা অক্ষত, আমি অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে বাড়িতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।’ নিয়মিত কিয়েভে ভ্রমণ করেন তিনি, পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক জীবন উপভোগ করার জন্য, ‘এমন জীবনই আমার প্রয়োজন। তবে মাঝেমধ্যে আমি খুব মিস করি এ-জীবন।’ তিনি এখন আগের চেয়ে বেশি পড়ছেন, ‘পড়া আমার সুস্থ থাকার উপায়, পড়া আমাকে শান্ত করে।’

কপিরাইটার আরসেনি ভ্যাসিলিভ বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সংস্কৃতির কর্মকাণ্ড থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সংস্কৃতি আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে আপনি মানুষ।’ তার বান্ধবী, সাবেক গ্রন্থাগারিক সোফিয়া কিশকোভারোভার মতে, ‘উৎসবটি খারকিভের এখনো বেঁচে থাকারই লক্ষণ।’ ঝাদানের মতে, ‘৫০ বা ১০০ বছরের মধ্যে, যদি মানবতা বেঁচে থাকে, যদি বই বেঁচে থাকে, তাহলে পরবর্তী শতাব্দীর মানুষেরা প্রধানত সাহিত্যের মাধ্যমেই এই যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে।’

(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত শার্লট হিগিন্সের নিবন্ধ অবলম্বনে)