মৃদুল মধুর সন্তরণ
মার্টিন লুথারের ‘হাতুড়ি’
জীবন এত ছোট কেন? এই আক্ষেপ নেই, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অথচ জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–উপভোগের উপকরণ কত বিপুল! স্বাভাবিক আয়ুর আরও হাজারটা জীবনেও সেসবের আস্বাদ গ্রহণ শেষ হওয়ার নয়। এই আক্ষেপ নিয়েই জীবন কাটাতে হয়। জানার–বোঝার, দেখার–শোনার, পড়ার–সক্ষমতার অপরিসীম সীমাবদ্ধতা নিয়েই চলে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ‘মৃদুল মধুর সন্তরণ’। জীবিকার অনিঃশেষ তাগিদ, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিকতার চাপ উজিয়ে চলে মনের ও মননের খোরাক মেটানোর প্রয়াস। এতে জোটে যে প্রসাদ, তার ভাগ দিতে ইচ্ছা করে অন্যদের। এমন অবশ্যই নয় যে এই ব্যক্তিগত যাত্রায় সবাই শামিল হতে চাইবেন কিংবা এসব উপাচারে সবার রুচি আছে। কিন্তু সহমর্মী কেউ যে নেই, তা তো নয়। অনুমান ও আশা করি, অনেকেই আছেন। আছেন বহু প্রাজ্ঞজন, অভিজ্ঞ পাঠক, আছে বহু কৌতূহলী, উৎসুক মন। আছেন তীক্ষ্ণধী সমালোচক। তাঁদের সঙ্গে নিজের পছন্দ ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করারই এক সামান্য আয়োজন এই ‘মৃদুল মধুর সন্তরণ’। অলমিতি বিস্তরেণ।
—জি এইচ হাবীব
ধর্মীয় ইতিহাসের অলিন্দজুড়ে আমরা একটা জোরালো ধাতব শব্দ শুনতে পাই: মার্টিন লুথার (১০ নভেম্বর ১৪৮৩—১৮ ফেব্রুয়ারি ১৫৪৬) নামের ৩৩ বছর বয়েসী এক টগবগে অগাস্টিনীয় ফ্রায়ার উইটেনবার্গের ক্যাসল চার্চের দরজায় তাঁর ৯৫টি বক্তব্য হাতুড়ি ঠুকে গেঁথে দিচ্ছেন। এর আওয়াজটা এমন, যে আওয়াজের ফলে শেষ অব্দি হাজার বছরের রোমান ক্যাথলিক চার্চ—দুটি চার্চে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে—একটি অনুগত থাকছে রোমের পোপের প্রতি, আর অন্যটি পোপের শাসনের প্রতিবাদ করে অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে প্রটেস্ট্যান্ট হিসেবে অভিহিত করছে।
১৯১৭ সালে লুথারের এই সর্বজনবিদিত কর্মের ৫০০তম বার্ষিকী উপলক্ষে কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়—অ্যালেক রাইরির ‘প্রটেস্ট্যান্ট’, এরিক মেটাক্স্যাসের ‘মার্টিন লুথার: দ্য ম্যান হু রিডিসকভারড গড অ্যান্ড চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’, লিন্ডাল রোপার রচিত ‘মার্টিন লুথার: রেনেগেড অ্যান্ড প্রফেট’ ইত্যাদি। এসব গ্রন্থে ছিল, স্বাভাবিকভাবেই, স্বনামধন্য মানুষটির আর তাঁর প্রভাবের পুনর্মূল্যায়ন। সেই পুনর্মূল্যায়নে নানা প্রসঙ্গেই লেখকেরা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তবে তাঁদের অধিকাংশই একটি বিষয়ে সুর মিলিয়েছেন, আর তা এই যে সেই হাতুড়ি ঠোকার ঘটনাটি—রূপক অর্থে যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক হলেও—কখনোই ঘটেনি।
ঘটনাটির যে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই, কেবল তা–ই নয়, লুথার নিজেও কখনোই সোজাসাপ্টাভাবে কোথাও বলেননি যে আসলে ঠিক কী ঘটেছিল, যদিও অন্য অনেক বিষয়েই নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বেশ নাটকীয় বর্ণনা দিতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি যে ৯৫টি বক্তব্যের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন, সে কথা মনে করতে পারলেও তারপর তা দিয়ে কী করেছিলেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কেবল এটুকুই জানা গেছে, তালিকাটা তিনি স্থানীয় এক আর্চবিশপকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর এ ছাড়া সেই ৯৫টি বক্তব্য এমন কোনো আপসহীন দাবি-দাওয়ার তালিকা ছিল না যে তারই আলোকে ব্রাদার মার্টিনের ঠিক করে দেওয়া মানদণ্ড অনুযায়ী চার্চকে নিজের সংস্কার সাধন করতে হবে, যেমনটা কিনা এত দিন সাধারণ মানুষ ভেবে এসেছেন। বরং সে সময়ের অন্য সব ‘বক্তব্যে’র মতোই সেগুলো ছিল জনসমক্ষে পেশ করা কিছু প্রসঙ্গ, যেগুলো নিয়ে লোকে তর্কবিতর্ক বাদানুবাদ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।
যা–ই হোক, সেই ৯৫টি বক্তব্য যে ‘রিফর্মেশন’ নামের যুগান্তকারী কাণ্ড ঘটাল, যার ফলে বিভক্ত হলো চার্চ আর তার ধর্মতত্ত্বে এল এক মৌলিক পরিবর্তন, সে বিষয়ে কমবেশি সবাই অবগত। লুথারের সংস্কার কালক্রমে আরও নানা সংস্কারের জন্ম দিয়েছিল, যেসব সংস্কারের অনেকগুলোই লুথারের পছন্দ হয়নি। এর পর থেকে চার্চ বিভক্ত হয়েই চলেছে। অ্যালেক রাইরি তাঁর ‘প্রটেস্ট্যান্ট’ গ্রন্থে প্রটেস্টান্টদের যতগুলো দল–উপদল বা ডিনোমিনেশন নিয়ে আলোচনা করেছেন, তা হয়ে উঠেছে রীতিমতো কৌতুকপ্রদ। মানবজাতির এক–অষ্টমাংশ আজ প্রটেস্ট্যান্ট।
‘রিফর্মেশন’ কেবল খ্রিস্টধর্মেরই সংস্কার সাধন করেনি, তা বদলে দিয়েছিল ইউরোপকেও। জার্মানভাষী অঞ্চলগুলো একে একে রোমের অধীনতা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করলে অন্য শক্তিগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দের নাইটদের বিদ্রোহ (২৭ আগস্ট ১৫২২—৬ মে ১৫২৩) আর এর পরের ‘জর্মান কৃষকদের যুদ্ধে’ (১৫২৪-১৫২৬) ছোটখাটো অভিজাত ভূস্বামী ও হতদরিদ্র কৃষিশ্রমিকের দল প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের মধ্যে সামাজিক দুঃখ-দুর্দশা দূর বা প্রশমিত করার একটা পথ দেখতে পায়। তবে এই দ্বিতীয় বিদ্রোহটি ব্যর্থ হলে অপর্যাপ্ত ও অনুন্নত অস্ত্রশস্ত্রধারী প্রায় ৮০ হাজার কৃষককে হত্যা করা হয়। এই রিফর্মেশনের জেরেই ৩০ বছরের যুদ্ধে (১৬১৮-১৬৪৮) মূলত ইউরোপের রোমক ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্টরা একে–অপরকে নির্বিচারে হত্যা করে। যদিও ঘটনাটি তাঁর মৃত্যুর বেশ কয়েক দশক পরে ঘটে, কিন্তু ঘটার কারণ সম্ভবত এই, লুথার যে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রতি অনাস্থা দেখিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন, তাঁর বদলে তিনি কোনো কাঠামো দাঁড় করাননি। তাঁর সংস্কার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধানত তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। আর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইবেল পড়ানো। এ কাজকেই তিনি তাঁর জীবনের প্রধান কাজ বলে মনে করতেন। অন্যদিকে রিফর্মেশনে আসলে নেতৃত্ব দেওয়ার সেই অর্থে কিছু ছিল না। সেটা স্রেফ ছড়িয়ে পড়েছিল।
এর বড় কারণ, ইউরোপ সে জন্য তৈরি হয়েই ছিল। শাসকগোষ্ঠী আর জনসাধারণের মধ্যে সম্পর্ক ছিল যারপরনাই খারাপ। হোলি রোমান এমপায়ারের সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলান তখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, যেখানেই ভ্রমণে যেতেন, সঙ্গে থাকত তাঁর কফিন। তবে মরি মরি করেও তিনি মরছিলেন না। তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি স্পেনের রাজা প্রথম চার্লসকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখা হতো। স্পেন আর নেদারল্যান্ডস এরই মধ্যে তাঁর করতলগতই ছিল। এর সঙ্গে আবার হোলি রোমান এমপায়ার কেন প্রয়োজন তাঁর? এ ছাড়া লুথার যখন তাঁর ৯৫টি বক্তব্য লিখেছেন, তখন চার্লসের বয়স মাত্র ১৭। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল অর্থ-কড়িসংক্রান্ত। চার্চের খরচের বহর তখন বড্ড বেশি। অটোমান সাম্রাজ্যের ভিয়েনা অবরোধের কারণে চার্চ তখন যুদ্ধ করছে তুর্কিদের সঙ্গে। অন্যদিকে রোমে সেন্ট পিটারের ব্যাসিলিকা তৈরিসহ আরও নানা ধরনের নির্মাণের রাজসূয় যজ্ঞ চলছে। এসবের ব্যয়ভার মেটাতে ইউরোপের ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থঋণ নিতে হয়েছে চার্চকে, আর সেই ঋণের কিস্তি মেটাতে জনগণের গলায় পাড়া দিয়ে কর আদায় করতে হচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে, মার্টিন লুথার ইউরোপীয়দের প্রধানত যা দিয়েছেন, তা হচ্ছে ‘আধুনিকতা’। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত এরিক মেটাক্স্যাসের ‘মার্টিন লুথার: দ্য ম্যান হু রিডিসকভারড গড অ্যান্ড চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’ বই এই দাবিকে আরও বিশদ ও সাড়ম্বরে তুলে ধরেছে। লেখক বলেছেন, ‘ব্যক্তিবিশেষ বা ইনডিভিজ্যুয়ালের যথার্থভাবে আধুনিক ধারণাটি লুথারের আগে অকল্পনীয় ছিল, ঠিক যেমন রঙের ধারণা কেবল সাদা আর কালোর জগতে অভাবনীয় থাকে। বহুত্ববাদ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, আত্মশাসন ও স্বাধীনতার মতো আরও সাম্প্রতিক ধারণাগুলো লুথারের খুলে দেওয়া দরজা দিয়েই ইতিহাসে প্রবেশ করেছে।’ অন্য গ্রন্থগুলো অবশ্য এ বিষয়ে ততটা দরাজ নয়। সেগুলো বরং বলছে, লুথার বহুত্ববাদ চাননি মোটেই, এমনকি জীবনের একটা পর্যায়ে তিনি ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও মৃত্যুর তিন বছর আগে লেখা ‘অন দ্য জ্যুইস অ্যান্ড দেয়ার লাইস’ (১৫৪৩) নামের প্রায় ৬৫ হাজার শব্দের রচনায় তিনি ইহুদিদের প্রার্থনাগ্রন্থ ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান এবং রাবাইদের মৃত্যু অব্দি কামনা করেন। একে আর যা-ই হোক, বহুত্ববাদ বা ব্যক্তিবিশেষের স্বাতন্ত্র্যের জয়গান বলা যায় না।
আগে চার্চের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিবাদ হয়েছিল, সেগুলো রিফর্মেশন ঘটাতে পারেনি; অথচ লুথারের প্রতিবাদ পেরেছিল, তার সম্ভাব্য একটি বড় কারণ, মার্টিন লুথারের প্রবল ব্যক্তিত্ব। ভীষণ ক্যারিশমেটিক আর অসুরের মতো পরিশ্রমী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সর্বোপরি ছিলেন একরোখা, আপসবিমুখ। বিরোধিতা করার মধ্যে একটা আনন্দ খুঁজে পেতেন তিনি। যদিও তাঁর ভেতর মাঝেমধ্যেই আত্মোৎসর্গের প্রতি একটা লোলুপতা লক্ষ করা যায়, যে লোলুপতা আমরা কিছু ধর্মীয় ব্যক্তির মধ্যে বিতৃষ্ণাভরে শনাক্ত করতে পারি। এমনিতে বেশির ভাগ সময় তাঁর জীবন ছিল সাদামাটা, গৎবাঁধা: সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের কাজে লেগে পড়তেন। এ ছাড়া আর যে কাজটা তিনি করেছিলেন, তা হলো ১১ সপ্তাহের মধ্যে গ্রিক থেকে জার্মান ভাষায় ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ তরজমা করেছিলেন।
(জোয়ান আকোচেল্লার ‘দ্য হ্যামার: হাউ মার্টিন লুথার চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’ অবলম্বনে)