আদি অস্ট্রেলীয়দের অধিকার আদায়ের কবিতা

আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের জীবন সহজ নয়। প্রতিদিন তাদের বর্ণবাদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এবং প্রচলিত বিশ্বাস ও নিজস্ব ধ্যানধারণার কারণে তারা সমাজে প্রান্তিকতার শিকার হয়। তবে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান কবিরা তাঁদের লেখার মাধ্যমে এই ইতিহাস, সংগ্রাম ও গভীর অনুভূতিগুলো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছেন। এই সব কবির লেখা একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বরকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে। সংক্ষিপ্ত ভূমিকাসহ আদি অস্ট্রেলীয়দের অধিকার আদায়ের এমনই কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেছেন চন্দন চৌধুরী

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

একসময় ছিল, যখন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। প্রায় ৬৫ হাজার বছর আগের কথা, সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে একদল মানুষ সমুদ্রের ঢেউ পেরিয়ে আর ভূসেতু ধরে এই বিশাল, রহস্যময় ভূমিতে এসে পৌঁছেছিল। আর্নহেম ল্যান্ডের এক প্রাচীন গুহা, মাজেদবেবে, আজও সেই প্রথম আগন্তুকদের নীরব সাক্ষী। আর লেক মুঙ্গোতে পাওয়া ৪১ হাজার বছরের পুরোনো কঙ্কালগুলো যেন আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের পূর্বপুরুষের গল্প শোনায়। তাদের সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীনতম সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে একটি। শিকার আর সংগ্রহের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল তাদের জীবনযাত্রা, প্রকৃতির সঙ্গে ছিল এক নিবিড় সম্পর্ক। মাটির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল গভীর। এই বিশাল মহাদেশে প্রায় সাড়ে সাত লাখ আদিবাসী বাস করত, নিজেদের প্রাচীন সমাজব্যবস্থা আর প্রচলিত ঐতিহ্যের মাধ্যমে তারা তাদের জ্ঞান আর গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে গেছে। টরেস প্রণালির দ্বীপবাসীরা ছিল মেলানেশীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, যারা সমুদ্রের দান আর মৌসুমি চাষবাসের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত। কখনো কখনো সুদূর ইন্দোনেশিয়ার মাকাসান জেলেরা বাণিজ্য করতে আসত উত্তর উপকূলে, যা ছিল আদিবাসীদের সঙ্গে বাইরের বিশ্বের একমাত্র সীমিত যোগাযোগ। 

তারপর এল সেই সময়, যখন ইউরোপীয়দের চোখ পড়ল এই বিশাল অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ডের ওপর। ১৬০৬ সালের এক সকালে ওলন্দাজ নাবিক উইলিয়াম জ্যানসন তাঁর জাহাজ ‘ডুইফকেন’ নিয়ে কেপ ইয়র্কের উপকূলে পা রাখলেন। তিনিই প্রথম ইউরোপীয়, যিনি অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে অবতরণ করলেন। তার কিছুদিন পরই টরেস প্রণালি দিয়ে যাত্রা করলেন স্পেনীয় অভিযাত্রী লুইস ভাজ দে টরেস। ১৭০০ শতকে ওলন্দাজরা অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম ও উত্তর উপকূলের মানচিত্র তৈরি করে এর নাম দিল ‘নিউ হল্যান্ড’। যদিও তখনো কোনো স্থায়ী বসতি স্থাপিত হয়নি, ১৬২৯ সালে এক জাহাজডুবি এবং কয়েদিদের বিদ্রোহের কারণে কিছু ইউরোপীয় এখানে আটকা পড়ল, আর তাদের মাধ্যমেই এই মহাদেশে প্রথম স্থায়ী ইউরোপীয় বসবাসের সূত্রপাত হলো।

কিন্তু আসল পরিবর্তন এল ১৭৭০ সালে, যখন ক্যাপ্টেন জেমস কুক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতাকা নিয়ে পূর্ব উপকূলে পৌঁছালেন। তিনি এই অংশের নাম দিলেন ‘নিউ সাউথ ওয়েলস’ এবং একে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্পত্তি বলে দাবি করলেন। এর কয়েক বছর পরে ১৭৮৩ সালে আমেরিকা হাতছাড়া হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে নিউ সাউথ ওয়েলসে এক নতুন ‘পেনাল কলোনি’ বা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উপনিবেশ গড়ে তুলবে। ১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারি, ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে একদল জাহাজ পোর্ট জ্যাকসনের সিডনি কোভে ইউনিয়ন জ্যাক উত্তোলন করে। সেই দিনটিই এখন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

শুরুতে ছোটখাটো অপরাধের জন্যও মানুষকে অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত করা হতো। তাঁরা এখানে শ্রমিক বা দাস হিসেবে কাজ করতেন। যদিও অনেকেই মুক্তি পেয়ে সমাজে মিশে গিয়েছিলেন, কিন্তু কিছু বিদ্রোহও হয়েছিল, যা কঠোর হাতে দমন করা হয়। ১৮০৮ সালের ‘রম বিদ্রোহ’ ছিল অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে একমাত্র সফল সামরিক অভ্যুত্থান, যা দুই বছরের সামরিক শাসনের সূচনা করে। কিন্তু তারপর এলেন গভর্নর ল্যাচলান ম্যাককুয়ারি। তাঁর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো নিউ সাউথ ওয়েলসকে কঠোর পেনাল কলোনি থেকে একটি সুশীল সমাজে রূপান্তর করল। মজার ব্যাপার হলো, এই উপনিবেশে সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা বেশি ছিল। এমনকি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টকেও নাকি এখানে এক ছোট্ট কুঠুরিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল!

কিন্তু ইউরোপীয়দের এই আগমনের এক ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছিল আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের। প্রায় দেড় শ বছর ধরে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের কারণে তাদের জনসংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেল। বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে ক্রমাগত সংঘর্ষে হাজার হাজার আদিবাসী প্রাণ হারাল। তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি আর সামাজিক কাঠামো যেন একনিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এদিকে, ১৯০০ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো সমুদ্রতীর থেকে মহাদেশের অভ্যন্তরে আরও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ১৮০৩ সালে তাসমানিয়ায় বসতি স্থাপন করা হলো। ১৮১৩ সালে গ্রেগরি ব্ল্যাক্সল্যান্ড, উইলিয়াম লসন আর উইলিয়াম ওয়েন্টওয়ার্থ সিডনির পশ্চিমে ব্লু পর্বতমালা অতিক্রম করার পর ইউরোপীয়দের বসতি ভেতরের দিকে আরও প্রসারিত হলো। ১৮২৭ সালে মেজর এডমন্ড লকিয়ার কিং জর্জ সাউন্ডে (বর্তমানে আলবানি) একটি বসতি স্থাপন করে পুরো অস্ট্রেলিয়া মহাদেশকে ব্রিটিশ সম্পত্তি বলে দাবি করলেন। ১৮২৯ সালে সোয়ান রিভার কলোনি (বর্তমান পার্থ) প্রতিষ্ঠিত হলো, যা পরবর্তীকালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম উপনিবেশে পরিণত হলো।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে নতুন নতুন উপনিবেশ তৈরি হতে থাকল। ১৮২৫ সালে তাসমানিয়া, ১৮৩৬ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, ১৮৪১ সালে নিউজিল্যান্ড, ১৮৫১ সালে ভিক্টোরিয়া এবং ১৮৫৯ সালে কুইন্সল্যান্ড আলাদা উপনিবেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া ছিল একটি ‘মুক্ত প্রদেশ’, যা কখনো অপরাধীদের উপনিবেশ ছিল না। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াও প্রথমে মুক্ত প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে সেখানে অপরাধীদের নিয়ে আসা হয়, আর ১৮৬৮ সালে সেখানে শেষ অপরাধী পাঠানো হয়।

১৮২৩ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নর একটি আইন পরিষদ ও একটি নতুন সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করেন, যা ঔপনিবেশিক গভর্নরদের ক্ষমতাকে কিছুটা সীমিত করল। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে ছয়টি উপনিবেশই নিজেদের দায়িত্বশীল সরকার গঠন করে নিল। তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হয়েও নিজেদের বেশির ভাগ বিষয় নিজেরাই পরিচালনা করতে শুরু করল। আর এভাবে তারা এক নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে লাগল। তবে বৈদেশিক সম্পর্ক ওপ্রতিরক্ষার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তখনো লন্ডনের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।

১৯০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, বার্ক ও উইলসের মতো অনুসন্ধানকারীরা মহাদেশের আরও ভেতরের অংশে ভ্রমণ করতে লাগলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল কৃষি সম্ভাবনা খুঁজে বের করা আর বৈজ্ঞানিক নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। ১৮৫০-এর দশকে সোনার আবিষ্কার যেন এক নতুন উন্মাদনা নিয়ে এল। চীন, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নতুন অভিবাসীরা দলে দলে অস্ট্রেলিয়ায় আসতে শুরু করল। এ সময় ‘বুশরাঙ্গিং’(অপরাধীদের দ্বারা সৃষ্ট অরাজকতা) আর নাগরিক অস্থিরতাও বাড়তে লাগল। ১৮৫৪ সালে যখন ব্যালারাট খনির শ্রমিকেরা সোনার লাইসেন্স ফির বিরুদ্ধে ‘ইউরেকা বিদ্রোহ’ শুরু করল, তখন এই সোনার অভিযানের উত্তেজনা যেন চরমে পৌঁছাল।

অস্ট্রেলিয়ার এই গল্প আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ সমৃদ্ধ অতীত ও ইউরোপীয় উপনিবেশের আকস্মিক আগমনের এক জটিল মিশ্রণ। এই দুই ধারা পরস্পরকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে, যা একদিকে আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার ভিত্তি স্থাপন করেছে, অন্যদিকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনে এনেছে সীমাহীন দুঃখ আর সংগ্রাম। এটি কেবল ইতিহাস নয়, এটি সংগ্রাম, প্রতিরোধ এবং আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার বহু সংস্কৃতির পরিচয়ের উৎস।

আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানরা পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত মানবগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম, যাদের উৎস আফ্রিকার বাইরের অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাচীনতর। এই দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও বিশ্বাসকে এক অনন্য গভীরতা দিয়েছে, যা আধুনিক বিশ্বের কাছে অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। তবে এই গৌরবময় অতীত ও আকর্ষণীয় সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের জীবন সহজ নয়। প্রতিদিন তাদের বর্ণবাদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এবং প্রচলিত বিশ্বাস ও নিজস্ব ধ্যানধারণার কারণে তারা সমাজে প্রান্তিকতার শিকার হয়, যা তাদের মৌলিক অধিকার ও সম্মানকে ক্ষুণ্ণ করে। এই অবিচার তাদের দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তোলে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে নিয়ে যেতে হয় এক গভীর যন্ত্রণার ভার।

তবে এই সংগ্রামের মধ্যেও আশার আলো নিভে যায়নি। আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান কবিরা তাঁদের লেখার মাধ্যমে এই ইতিহাস, সংগ্রাম ও গভীর অনুভূতিগুলো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছেন। তাঁদের কবিতাগুলো কেবল অতীতের দুঃখ-কষ্টের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা ও আশার বার্তা বহন করে। এসব কবিতায় ফুটে ওঠে তাঁদের হারানো ঐতিহ্য, বাস্তুচ্যুতির বেদনা এবং পরিচয়ের সংকট। একই সঙ্গে, তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের সহনশীলতা, প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ এবং তাঁদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

এই সব কবির লেখা একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বরকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে। তাঁদের কবিতাগুলো আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দেয়, যা প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং অস্ট্রেলিয়ার বহুস্তরীয় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে তুলে ধরে। এটি কেবল আদিবাসীদের ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, বরং একটি জাতির সম্মিলিত চেতনা ও সম্মিলিত স্বপ্নের প্রতিফলন। কবিতাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানবতা, সম্মান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করা কতটা জরুরি। এভাবেই আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের কবিতাগুলো একটি উন্নত ও ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগিয়ে তোলে, যেখানে প্রতিটি সংস্কৃতির নিজস্ব সম্মান ও স্থান থাকবে।

আশার গান • ওডেগেরো নুনুকাল (ক্যাথ ওয়াকার)

আমার আপনজনেরা, তোমরা আকাশের দিকে তাকাও,

ভোর হয়ে আসছে।

পৃথিবী যেন নতুন করে জেগে উঠছে,

একটি নতুন ঝলমলে দিনের দিকে।

এমন একটা দিন আসবে, যখন কেউ আমাদের খারাপ বলবে না,

কোনো নিয়ম আমাদের আটকে রাখতে পারবে না।

আমাদের গায়ের রঙের জন্য কেউ আমাদের লজ্জা দেবে না,

আর কেউ তাচ্ছিল্য করে আমাদের মন খারাপ করিয়ে দেবে না।

পেছনের বছরগুলোর কথা ভেবে আর মন খারাপ কোরো না,

তোমাদের জন্য যে আশা আছে,

তা অতীতের সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে।

যখন সত্যিকারের সুবিচার আসবে,

যা আরও বুদ্ধিমান আর শক্তিশালী হবে।

তখন আর কোনো কালো রঙের মানুষকে দেখে

কেউ বাজে কথা বলবে না বা আঙুল তুলবে না।

আমরা অনেক দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেছি,

বন্দী আর হতাশ হয়ে ছিলাম।

যতক্ষণ না সবাই ঘৃণা করাকে খারাপ মনে করে,

আর জাতপাতের ভেদাভেদ দূর হয়ে যায়।

এখন আলো আমাদের পথ দেখাবে,

আমাদের কোনো স্বপ্ন অধরা থাকবে না।

আর যেসব দরজা এত দিন বন্ধ ছিল,

সেগুলো সব খুলে যাবে।

দেখো, সেই সুন্দর ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,

হে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা মানুষ!

রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে,

যদিও পথটা অনেক লম্বা।

নতুন অধিকারগুলো আমাদের স্বাগত জানাবে,

নতুন বন্ধুরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে।

আর আমাদের নতুন স্বপ্নের সময়ে

আমরা পুরোপুরি আনন্দে ভরে উঠব।

আমাদের পূর্বপুরুষদের পূর্বপুরুষদের জন্য

ছিল বেদনা, দুঃখ;

আমাদের সন্তানদের সন্তানদের জন্য

এক আনন্দময় আগামীকাল।

ওডেগেরো নুনুকাল (ক্যাথ ওয়াকার) তাঁর সময়ের সবচেয়ে সম্মানিত কবিদের একজন ছিলেন। তাঁর বাবা নুনুকাল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা ঐতিহ্যগতভাবে কুইন্সল্যান্ডের নর্থ স্ট্র্যাডব্রোক দ্বীপের (মিনজেরিবাহ) উত্তরাংশে বসবাস করতেন। ১৯৬০-এর দশকে ক্যাথ ওয়াকার ‘আশার গান’ কবিতাটি লেখেন। ইংরেজ বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে আদিবাসীদের প্রতি বর্ণবাদের মাত্রা কমে আসতে দেখে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে একটি ভাঙা জগতেও আসলে আশা রয়েছে।

এসো, মারি • লায়োনেল ফগার্টি

আমার শুধু মারিদের কথা মনে পড়ে,

তোমরা শুধু জেলে বা খারাপ পরিস্থিতিতেও মরো না।

অন্যান্য দেশেও তারা মরছে এবং বেঁচে থাকার জন্য কারারুদ্ধ হচ্ছে,

যেমন লাতিন আমেরিকা,

যেখানে শ্বেতাঙ্গরা এখনো বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে চলেছে

হত্যা, ধর্ষণ ও শোষণের মাধ্যমে।

আমরাই একমাত্র ভুক্তভোগী নই।

আমরাই শুধু ভূমি ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য লড়ছি না।

বিদেশে অন্য ভূমিতেও তারা একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে,

যা হলো পুঁজিবাদী বা ভুল পথে যাওয়া কমিউনিস্টরা।

আমরা একই পৃথিবীতে আছি,

কিন্তু অন্য আদিবাসী জনগণের সংগ্রাম ভুলে যাচ্ছি।

আমাদের এখানকার দিকে তাকাতে হবে

অন্যান্য দেশের প্রয়োজনীয় সংগ্রামকে সমর্থন করতে হবে,

কারণ, তাদের লড়াই আমাদের লড়াইকে প্রভাবিত করে।

দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের এখানে আনলে

আমরা একই ধরনের বর্ণবাদী জিনিস খুঁজে পাব।

কানাডার রেড পিপল, তারা এখনো অধিকারের জন্য লড়ছে।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় আদিবাসী,

তারা এখনো তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য সংগ্রাম করছে।

এবং বিদেশের শ্বেতাঙ্গ, তারাও লড়ছে,

ওহ, যেমন আইরিশরা, যারা ব্রিটেনকে বিতাড়ন করতে চায়।

সুতরাং মারি, আমাদের বিদেশের সব অধিকারহীন

আদিবাসী জনগণের জন্য অনুভূতি, চিন্তা এবং সক্রিয় থাকতে হবে।

তাহলেই আমরা বিশ্বব্যাপী বোঝাপড়া ও ঐক্য পাব

এমনকি একে অপরের সংস্কৃতির ভালোবাসা পাব।

শুধু মনে রেখো, তারাও মরে, মারি; তারাও লড়াই করে।

অন্য দেশগুলো এখন অপেক্ষা করছে তোমাদের সমর্থন ও লড়াইয়ের জন্য।

লায়োনেল জর্জ ফগার্টি কুইন্সল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের সাউথ বার্নেট অঞ্চলের বারাম্বায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আদিবাসী জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাঁর প্রথম কবিতার সংকলন ‘কারগুন’ ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়, যা অস্ট্রেলিয়ার জীবন বাস্তবতা তুলে ধরে, যেখানে অপরাধবোধ, হতাশা, নিরাশা ও দুঃখের সব আবেগ চিত্রিত হয়েছে।

অস্ট্রেলীয় আদিবাসী • জ্যাক ডেভিস

তোমাদের প্রতি

যারা একদিন বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসেছিলে,

বলেছিলে, আমরা নাকি পরস্পরের আত্মীয়।

ছলনার আশ্রয় নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য

সেজেছিলে আমার ভাই।

তারপর তোমরা আমার আনন্দ কেড়ে নিলে,

আমার সন্তানদের আমার পাশ থেকে ছিনিয়ে নিলে,

আইনের বই বন্ধ করে দিলে, হায় আমার দুঃখ,

যখন ইয়িরাকালার আবেদনও অগ্রাহ্য হলো।

তাই আমার মনে পড়ে লেক জর্জের পাহাড়,

মানুষের কঙ্কালসার দেহ।

হঠাৎ মৃত্যু আর সেই লোভ, যা সবকিছু কেড়ে নেয়,

আর তোমাদের এনে দিল গির্জা আর উঁচু মিনার।

আবার আমি ওয়ারারার পুরুষদের জন্য কাঁদি,

যারা আত্মীয়স্বজন ছেড়ে চলে গেছে।

আর আমি ভাবছিলাম কবে—

আমি একটি কলম খুঁজে পাব,

তোমার ছোপ ছোপ মনকে গভীরে বোঝার জন্য।

আবার আমি মারি উপজাতির জন্য শোক করি,

যারা চিহ্নবিহীনভাবে হারিয়ে গেছে।

আমি সৈনিকের কড়া মন্তব্যগুলোর কথা ভাবি,

গভর্নরের মুখে সেই হাসি।

তোমরা আমাকে হত্যা করেছ দড়ি দিয়ে, বন্দুক দিয়ে,

আমার বসতির গণহত্যা ঘটিয়েছ।

আমাকে ম্যাকলার্টির চারণভূমিতে গভীর কবরে পুঁতেছ,

সাধারণ এক গণকবরে ছুড়ে ফেলেছ।

তোমরা আমাকে খ্রিষ্ট, লাল ফিতা,

তামাক, মদ আর ভয় দিয়ে দাঁড় করিয়েছ।

তারপর রোগ আর প্রভুসুলভ ধর্ষণ

চলেছে বর্বর বছরগুলো ধরে।

এখন তোমরা ভান করে বলো, তোমরা ন্যায্য,

আর একটি জাতির গৌরবের গান গাও।

কিন্তু আমি ভাবি এক ক্রুশবিদ্ধ মানুষের কথা—

এটাই আসল অস্ট্রেলিয়ার গল্প।

জ্যাক ডেভিস পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পিলবারার উত্তরে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তাঁকে মুর রিভার নেটিভ সেটেলমেন্টে পাঠানো হয় কৃষিকাজ শেখার জন্য। তিনি তাঁর জনগণের ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাঁর সক্রিয়তার জন্য দেশব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেন। জ্যাক ১৯৭৮ সালে ‘অ্যাবরিজিনাল অস্ট্রেলিয়া’ লিখেছিলেন, যা একজন আদিবাসী ব্যক্তির শহুরে জীবনের একটি সত্য ও অস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।

লজ্জা • কেভিন গিলবার্ট

আর কেউ কেউ বলে, আমরা যখন কথা বলি সেটা ‘লজ্জা’

আর আমাদের জীবনধারণ ‘লজ্জা’

আর কারণ আমাদের একটা বড় ঝকঝকে বাড়ি নেই, সেটা ‘লজ্জা’

অথবা একটা স্থায়ী চাকরি আর গাড়ি নেই।

ঠান্ডা লেগে বা নিছক অবহেলায়

আমাদের শিশুরা যখন মারা যায়, কেউ কেউ এটাকেও ‘লজ্জা’ বলে

যখন আমরা নদীর তীরে বাস করি, ‘লজ্জা’।

আর আমরা যখন কল্যাণ ভাতা তুলে জীবন চালাই।

‘লজ্জা’, যখন আমরা চোখের ট্রাকোমায় অন্ধ হয়ে যাই

‘লজ্জা’, যখন দুর্ভিক্ষে পঙ্গু হয়ে যাই

কিন্তু আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় লজ্জা তোমাদেরই

তোমরা অস্বীকার করো আমাদের মানবিক অধিকার।

কেভিন গিলবার্ট প্রথম আদিবাসী নাট্যকার ও প্রিন্টমেকার। যিনি নিউ সাউথ ওয়েলসের ল্যাচলান নদীতীরের উইরাডজুরি জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর কবিতার সুর প্রায়ই অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। আদিবাসী সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা না-থাকার বিষয়টি দ্বন্দ্বপূর্ণ।

চাও না, আমি বলি • শারমেইন পেপারটক গ্রিন

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

খননকাজ আর দেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে।

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

‘শ্বেতত্ব’র ধারণা ও গঠন নিয়ে

সমাজে এর আধিপত্য ও ক্ষমতা নিয়ে।

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

এখানকার আর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা শিল্প–শকুনদের নিয়ে,

আধুনিক যুগের ধর্মপ্রচারক-শিল্প জগতের

আমাদের রক্ষা করছে মহান সাদা ক্যানভাসে।

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

এই ভূমি দখলের ইতিহাস বা কোনো একটি চুক্তি নিয়ে

এটা একটা যৌথ সত্যিকারের ইতিহাস; চলো নিরাময় করি।

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

অতীতের অন্যায়, সাংস্কৃতিক নিষ্ঠুরতা, সাংস্কৃতিক গণহত্যা নিয়ে

এবং যে সাংস্কৃতিক বেদনা অবশিষ্ট আছে তা নিয়ে,

এটা একটা যৌথ সত্যিকারের ইতিহাস; চলো নিরাময় করি।

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

কীভাবে পুনর্মিলন একটি ভুল শব্দ হতে পারে

যদি তার সঙ্গে সত্য না থাকে।

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

শ্বেতাঙ্গদের জন্য নেটিভ টাইটেল প্রক্রিয়া নিয়ে।

তুমি মোটেও চাও না, আমি কথা বলি

বেশির ভাগ সময়—তোমার আছে তোমার ‘বিদেশি’ পোষা প্রাণী।

তুমি চাও, আমি মাথা নাড়ি, হাসি এবং তোমার কথা শুনি।

আর আমি তোমার কথা না শুনলেও তাতে কিছু যায়–আসে না।

তুমি চাও না, আমি কথা বলি

যে আমারও কিছু বলার আছে,

আর তুমি সেটা শোনো না।

শারমেইন পেপারটক গ্রিন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মিডওয়েস্টের ওয়াজারি, বাদিমায়া এবং সাউদার্ন ইয়ামাজি জনগোষ্ঠীর একজন মানুষ। কবিতাটি একটি নির্বাক কণ্ঠস্বর এবং কীভাবে আদিবাসী মানুষ তাদের সংগ্রামের কথা বলছে, কিন্তু কেউ শুনছে না, তা নিয়ে লেখা। শারমেইন জোর দিয়ে বলেন যে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী মানুষের অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জাতিসত্তা কারা, তা স্বীকার করা উচিত।

আদিবাসীর আত্মিক গান • হিলাস মেরিস

আমি ড্রিমটাইম জাতির সন্তান

এই ভূমির অংশ, গাঁটযুক্ত গামগাছের মতো

আমি নদী, নরম সুরে গান গাইছি

সমুদ্রের পথে আমাদের গান গেয়ে চলি।

আমার আত্মা হলো ধুলার ঝড়

মরীচিকা, যা সমভূমিতে নাচে।

আমি বরফ, বাতাস এবং ঝরন্ত বৃষ্টি

আমি পাথর, আমি লাল মরুভূমির মাটি

লাল, যেমন রক্ত বইছে শিরায়।

আমি ইগল, কাক আর নিঃশব্দে চলা সাপ

বৃষ্টি–অরণ্যের মধ্য দিয়ে যা পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে।

আমি এখানে জেগে উঠেছিলাম, যখন পৃথিবী নতুন ছিল

ছিল ইমু, ওমব্যাট, ক্যাঙারু

অন্য কোনো ভিন্ন বর্ণের মানুষ ছিল না।

আমি এই ভূমি

আর এই ভূমিই আমি।

আমিই অস্ট্রেলিয়া।

হিলাস মেরিস ১৯৩৪ সালে কামেরাগুঞ্জায় জন্মগ্রহণ করেন। আদিবাসী মানুষ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সম্পর্ক জনসাধারণকে জানাতে ও বোঝাতে তিনি ‘স্পিরিচুয়াল সং অব দ্য অ্যাবরিজিনি’ কবিতাটি লেখেন। আদিবাসী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অনুভূতি কেমন, তা তুলে ধরতেই কবিতাটি রচনা করেন।