আমরা যেটাকে স্বাভাবিক অবস্থা ভাবছি, তা আসলে মেকি স্বাভাবিকতা

কোলাজ: আমিনুল ইসলাম
শুরু থেকেই লেখালেখির মাধ্যমে সরব আছেন এই সময়ের জনপ্রিয় লেখক ও চিন্তক স্লাভোয় জিজেক। একটি ভাইরাস কীভাবে বিশ্বব্যাপী মানুষের চিন্তাধারা বদলে দিচ্ছে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। ইউরোপে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে জিজেক তাঁর ভাবনার কথা লেখেন গত আগস্টের শেষের দিকে। বাংলাদেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর প্রেক্ষাপটে জিজেকের সেই লেখাটি পত্রস্থ করা হলো। দ্য ফিলোসফিক্যাল সেলুন থেকে এটির সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম।

এখন অবধি আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দৃঢ়ভাবে মনে করছেন যে মহামারি ঘটানোর জন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোরই দায় বেশি। আমার মনে হয়, চীনের মতো ক্ষমতাধর সমাজতান্ত্রিক দেশ কিংবা ভিয়েতনাম ও কিউবার মতো দেশগুলোই শুধু নয়, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী সামাজিক-গণতান্ত্রিক দেশগুলোরও দায় রয়েছে।

এদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দেশ নিউজিল্যান্ড। আমি একজন কঠোর সনাতনী মার্ক্সবাদী হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত নিউজিল্যান্ডের দিকে চোখ রাখি এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি যে সেখানে কোভিড সংক্রমণের নতুন কোনো ঘটনা নেই বললেই চলে। তবে নিউজিল্যান্ডে কোভিড-১৯ শনাক্তের ১০২ দিন পর গত ১১ আগস্ট নতুন চারজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তার মানে এটি স্পষ্ট যে আমাদের স্বপ্নের নিউজিল্যান্ডও করোনা থেকে নিরাপদ নয়।

যখনই মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, তখনই নতুন নতুন শনাক্তের ঘটনা ঘটছে। আমরা যেটাকে স্বাভাবিক অবস্থা ভাবছি, তা আসলে মেকি স্বাভাবিকতা। আমরা যতই ভাবি না কেন পরিস্থিতি আতঙ্কজনক নয়; আসলে মহামারিটি আতঙ্কজনক অবস্থাতেই বিরাজ করছে। কোভিডে আক্রান্ত দেশগুলোয় আর্থসামাজিক চাপের কারণে মানুষের মধ্যে কোভিডের আতঙ্ক অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কত দিন আর আতঙ্কগ্রস্ত থাকা যায়? মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এই ক্লান্তি আমরা বড় বড় গণমাধ্যমের প্রথম পৃষ্ঠায় এবং টেলিভিশনের খবরগুলোতেও দেখতে পাচ্ছি। সেখানে কোভিডের বাইরে অন্য খবরগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে।

মনোযোগের এই পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু ভ্রান্তি রয়েছে। সেটি হচ্ছে, আমরা যেন সত্যিকার অর্থে ট্রমাটি প্রাণপণে এড়িয়ে যেতে চাইছি।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জার্মানির নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বার্লিনে জড়ো হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার মানুষ, ১ আগস্ট ২০২০
ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু আমি মনে করি, এখন আমাদের চারপাশে যে ধরনের ব্যক্তিক ও সামাজিক বিক্ষোভ-সহিংসতা দেখতে পাচ্ছি, তার সঙ্গে এই অদ্ভুত ক্লান্তির সম্পর্ক রয়েছে। দ্য গার্ডিয়ানের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের শিরোনাম ও উপশিরোনামগুলো দেখলেই এসব বিষয় পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘কোভিড সৃষ্ট অশান্তির কারণে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভের পূর্বাভাস’। নতুন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোভিডের কারণে যে অর্থনৈতিক ধাক্কা সৃষ্টি হয়েছে, সেই ধাক্কা জনগণের অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলছে। অন্যদিকে, কোভিড-পরবর্তী অভিবাসনের কারণে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছে রেডক্রস। সম্প্রতি পত্রিকাটি আরেকটি খবর প্রকাশ করছে, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। খবরটির শিরোনাম হচ্ছে, অপারেশন এমটি প্লেট বা অপারেশন খালি থালা। এটি কোভিড–পরবর্তী সময়ে সি চিন পিংয়ের খাদ্যসংকট মোকাবিলার চ্যালেঞ্জকেই নির্দেশ করে। সারা পৃথিবীতেই ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, পঙ্গপাল ও ইঁদুরের আক্রমণে কৃষিজাত পণ্য ও ফসলের মাঠ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং এই ধ্বংসযজ্ঞ ভারত-পাকিস্তান-ফ্রান্স ও জার্মানির মাঠ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর একটি দুর্দান্ত উদাহরণ হচ্ছে, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ধনী সরকারগুলোর নামে অনেক বিদেশি সংস্থা মামলা-মোকদ্দমা করেছে এই বলে যে মহামারির কারণে তাদের লাভের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু তারা ক্ষতিগ্রস্ত, সুতরাং রাষ্ট্রগুলোর উচিত তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

আমরা এমনিতেই নানা ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছি। তার মধ্যে এই মহামারি যে নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তা কি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে না? আমাদের এখন দরকার সামগ্রিক গতিশীলতা। নাৎসি বাহিনী যে গতিশীলতাকে বলত ‘টোটালে মোবিলমেচাং’, ইংরেজিতে টোটাল মবিলাইজেশন। যদিও বর্তমান অবস্থা পুরোপুরি নাৎসিদের বিপরীত। জে জি ফিৎচ সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি, যিনি তাঁর ‘দ্য ক্লোজড কমার্শিয়াল স্টেট’ বইয়ে এ সম্পর্কে নির্দেশনা দেন। বইটিতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সর্বগ্রাসী একনায়কত্বকে খারিজ করা হয়েছে। আর সে জন্যই সম্ভবত কার্ল পপার ফিৎচকে মুক্ত সমাজের শত্রু হিসেবে গণ্য করেছেন।

দিয়েগো ফুসারো ফিৎচের বই সম্পর্কে বলেছেন যে এই বই একদিকে উদার স্বাধীনতার কথা বলে, আবার অন্যদিকে নয়া উদারতাবাদের সমালোচনাও করে।

সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, ফিৎচের রাষ্ট্রটি কেবল বাজার করে আর তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য একের পর এক শর্ত দেয়। ফিৎচের সমালোচনা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতামতের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং আদর্শবাদ এবং গোঁড়ামিবাদের মধ্যে তিনি যে দার্শনিকতাবিরোধী ছিলেন, সে সম্পর্কে সরাসরি সমালোচনা। ফিৎচের বইয়ে আরও আছে বৈষম্যপূর্ণ উদার স্বাধীনতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাধীনতাহীনতা এবং বিশ্বের মোড়লরাষ্ট্রদের নৃশংস প্রতিযোগিতা। ফিৎচ তাঁর বইয়ে যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, সেগুলোর সঙ্গে আমরা একমত না-ও হতে পারি, কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সমস্যা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই আমলযোগ্য।

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর একটি দুর্দান্ত উদাহরণ হচ্ছে, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ধনী সরকারগুলোর নামে অনেক বিদেশি সংস্থা মামলা-মোকদ্দমা করেছে এই বলে যে মহামারির কারণে তাদের লাভের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু তারা ক্ষতিগ্রস্ত, সুতরাং রাষ্ট্রগুলোর উচিত তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

স্লাভয় জিজেক মনে করেন, কোভিড ১৯ আমাদের আদর্শ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সামাজিকতা ইত্যাদি ধারণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

কোভিড-১৯ শুধু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাপ ‍সৃষ্টি করেছে এমন নয়, বরং চাপ আছে আরও নানাবিধ। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জার্মানি যে নীতিমালা তৈরি করেছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গত ১ আগস্ট জার্মানির বার্লিনে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল। অনেক মানুষের মুখে মুখোশ পরা ছিল না। অনেকেই সামাজিক দূরত্বকে তিরস্কার করছিল। অনেকেই স্লোগান দিচ্ছিল এই বলে, ‘সরকার আমাদের স্বাধীনতা চুরি করেছে’, ‘করোনা বলে কিছু নেই, সব ভুয়া’, ‘আমাদের গোলকধাঁধায় ফেলে রেখেছে’, ‘টিকার দরকার নেই, প্রকৃতিই প্রতিরক্ষা’, ‘আমরাই দ্বিতীয় তরঙ্গ’ ইত্যাদি।

এ প্রসঙ্গে নিকোল ব্যারিয়া অ্যাসেঞ্জোর কথা একটু বলি। তিনি তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘নতুন স্বাভাবিকত্ব নির্মাণ’। বইটি এখনো প্রকাশিত হয়নি। এমন নামকরণের পেছনে কারণ হচ্ছে, কোভিড-১৯ মহামারি শুধু স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক বন্ধই নষ্ট করেনি, আমাদের মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট করেছে। সারা পৃথিবীতেই একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এক নতুন স্বাভাবিকতার মুখোমুখি আমরা। এই নতুন স্বাভাবিকতার কারণে আমাদের ‘স্বাভাবিকতা’ সম্পর্কে ধারণাটাই হুমকির মুখে।

স্বাভাবিকতা কী? লাকা বলছেন, স্বাভাবিকতা হচ্ছে ‘অন্য রকম বিশাল কিছু’। আমাদের চারপাশে এখন যা ঘটছে, তা নিঃসন্দেহে বিশাল ঘটনা এবং অন্য রকম তো বটেই।

কোভিড-১৯ মহামারি শুধু স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক বন্ধই নষ্ট করেনি, আমাদের মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট করেছে। সারা পৃথিবীতেই একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এক নতুন স্বাভাবিকতার মুখোমুখি আমরা। এই নতুন স্বাভাবিকতার কারণে আমাদের ‘স্বাভাবিকতা’ সম্পর্কে ধারণাটাই হুমকির মুখে।

এরপর জর্জ লুকাসের কথা স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন, প্রকৃতি নিজেই একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করলে দেখা যায়, ১৭ শতাব্দীতে প্রকৃতিজগতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এর পরের পরিবর্তনটা লক্ষ করা যায় উনিশ শতাব্দীতে। উনিশ শতকের পর থেকে পুঁজিবাদের উল্লম্ফনের কারণে প্রকৃতিকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে বেশ লড়াই করে।

সে যা হোক, মানুষের মানসিক ভারসাম্যের কথা বলছিলাম। বিষয়টি মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেন? মহামারিটি ব্যাপক মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে বলেই কি? না। এটি শুধু মনোজগতেই পরিবর্তন ঘটায়নি, বরং বাস্তব জগতেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফ্রয়েড যে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছেন (মানসিক অবসাদ, অবদমিত কামনা ইত্যাদি), তার সঙ্গে এই মহামারির যেন একটি সম্পর্ক রয়েছে। আমার অনুমান, করোনা হচ্ছে প্রকাশিত স্বপ্নের পাঠ। এটি একই সঙ্গে স্বপ্ন এবং ভয়। ক্লদ ম্যাগরিস যেমন বলেছেন ‘চিন্তার অত্যাচারী’, তেমনভাবে বলা যায়, এটিও আমাদের চিন্তাকে অত্যাচারিত করে।

জে জি ফিৎচের বই ‘দ্য ক্লোজড কমার্শিয়াল স্টেট

ক্যাথলিক চার্চের ঐতিহ্যবাহী একটি অংশ ছিল, যারা বলত, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতই উত্থান হোক না কেন, কিছু জিনিস না জানাই ভালো। বিশিষ্ট দার্শনিক কান্টের কথাতেও আমরা এ ধরনের প্রতিধ্বনি পেয়েছি। এমনকি হ্যাবারমাসের অনেক লেখাতেও আমরা এমন দর্শনের দেখা পেয়েছি। কোভিড সম্পর্কে অনেক মানুষের মধ্যে ঠিক একই ধরনের চিন্তা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদেরও বিশ্বাস, কিছু জিনিস না জানাই ভালো।

হ্যাবারমাস আরও বলেছেন, যেহেতু বিজ্ঞানের ফলগুলো আমাদের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অতএব বিজ্ঞান প্রতিরোধ করাই উচিত! কী সাংঘাতিক কথা! হ্যাবারমাসের যুক্তি হচ্ছে, বিজ্ঞানের জন্য আমরা যে মূল্য দিচ্ছি, তা হচ্ছে বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে।

অতএব আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে, কোভিড-১৯ মহামারিটি শুধু স্বাস্থ্যগত সমস্যাই নয়। এটি আমাদের মানবিকতা, আদর্শ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সামাজিকতা ইত্যাদি ধারণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা ‘নতুন স্বাভাবিক’ আচরণ করব, নাকি ‘অপ্রাকৃত’ আচরণ করব, সেটাও ভেবে দেখা উচিত।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]