ধর্ষণ ও পুরুষের সম্মানহানি

সমসাময়িক কালে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে নারী অবমাননার ঘটনায় প্রতিবাদমুখর এখন সবাই। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে অনেকেই সরব হয়েছেন এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। গেল ৭ অক্টোবর ২০২০ ব্রিটিশ–পাকিস্তানি লেখক মুহাম্মদ হানিফও কলম ধরেছেন ধর্ষণের বিরুদ্ধে। বিবিসিতে প্রকাশিত তাঁর এই লেখা অনুবাদ করেছেন সালেহ ফুয়াদ

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

পাকিস্তানের একজন খ্যাতনামা গায়ক সম্প্রতি আটজনের নামে মানহানির মামলা দায়ের করেছেন। এই গায়কের বিরুদ্ধে এর আগে একজন পরিচিত গায়িকা শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। তারপর আরও কিছু স্বল্প পরিচিত নারী অভিযোগ আনেন যে পাকিস্তানের সেই বিখ্যাত গায়ক নানা সময়ে তাঁদেরও যৌন হয়রানি করেছেন।

পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত আমির মুনাওয়ার হাসান একবার বলেছিলেন, কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর তাঁর কাছে চারজন সাক্ষী না থাকলে তাঁর উচিত চুপ থাকা। পাকিস্তানে ধর্ষণের প্রমাণের জন্য আগে চারজন সাক্ষীকে হাজির করা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ধর্ষণের চারজন চাক্ষুষ সাক্ষীর সাক্ষ্যদানের মানেটা কী? প্রথমত তারা কাউকে ধর্ষণ করতে দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে কেন, পরবর্তীতে যেন আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারে এ জন্য? যে ধর্ষণের চারজন সাক্ষী থাকে তা হয় গণধর্ষণ।

যখন দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে ধর্ষণের ভয়ংকর খবর আসছে—কখনো বাসে ধর্ষণ, কখনো নির্জন গ্রামে ধর্ষণ, কখনো ড্রাইভারের হাতে ধর্ষণ, কখনো পুলিশের হাতে ধর্ষণ এবং প্রায়ই আত্মীয়দের হাতে ধর্ষণের খবর যখন আসছে চারদিক থেকে, তখন আমাদের ডান-বাম ও মধ্যপন্থী পুরুষেরা চটজলদি দুটি সমাধান বের করে ফেললেন।
সমাধান নম্বর এক—ধর্ষককে অমানুষ বলে স্বীকৃতি দাও এবং জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝোলাও। এতে ধর্ষণ হয়তো থেমে যাবে না কিন্তু এ কথা অন্তত প্রমাণিত হবে যে সব পুরুষ ধর্ষকদের মতো নয়।

দ্বিতীয় ও সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হলো নারীকে কোথাও দেখা না গেলে ধর্ষণ হবে না, এ কথা মেনে নেওয়া। ঘর থেকে বের হলো কেন নারী? বিজ্ঞাপনে নাচল কেন? কেন গাড়ি চালাতে গেল? জিনস পরল কেন? কেন নারী হয়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলল? অনাত্মীয় ছেলেদের কেন ফোন নম্বর দিল?

এই সমাধান যাঁরা দিলেন তাঁরা বুঝতে চান না, অধিকাংশ নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার জন্য ঘরের বাইরে যেতে হয় না। চাকরিও করতে হয় না। ঘরে বসে থাকলেও তাঁদের সঙ্গে এই জুলুম হয়। এ কথা মানলে যে আমাদের নারীদের তাঁদের পরিবারের পুরুষদের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিতে হবে। এটা তো আমাদের সামাজিক নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ কাজ। আমাদের সামাজিক নীতি অনুযায়ী নারীর ধর্ষণ সহ্য করা যায়, পুরুষের অপমান মানা যায় না।

অধিকাংশ নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার জন্য ঘরের বাইরে যেতে হয় না। চাকরিও করতে হয় না। ঘরে বসে থাকলেও তাঁদের সঙ্গে এই জুলুমটি হয়। এ কথা মানলে যে আমাদের নারীদের তাঁদের পরিবারের পুরুষদের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিতে হবে। এটা তো আমাদের সামাজিক নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ কাজ। আমাদের সামাজিক নীতি অনুযায়ী নারীর ধর্ষণ সহ্য করা যায়, পুরুষের অপমান মানা যায় না।
আমাদের সমাজে ধর্ষণ এড়ানোর জন্য নারীকে এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না—না বলে একমাত্র উপায়টি বলে দেওয়াই বরং ভালো: সেটি হলো নারীর জন্মগ্রহণই না করা।

আমাদের সমাজে ধর্ষণ এড়ানোর জন্য নারীকে এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না—না বলে একমাত্র উপায়টি বলে দেওয়াই বরং ভালো: সেটি হলো নারীর জন্মগ্রহণই না করা। নয়তো কী, পুরুষের হাতে আছে সেই পুরোনো গীত—আনো চারজন সাক্ষী। সাক্ষী না মিললে এই সব অভিযোগ আমার জন্য সম্মানহানিকর। কেউ যদি বলে এই নাও আটজন সাক্ষী, তবে সেসব সাক্ষী নিশ্চিত মিথ্যা! যে সমাজ এক মাস খুঁজেও মহাসড়কে ধর্ষণকারী ধর্ষকের সন্ধান পায়নি, একজন পুরুষের সম্মান রক্ষার্থে সেই সমাজ তৎপর হয়ে উঠবে।

মুহাম্মদ হানিফ

বিখ্যাত গায়ক পুরুষটির মানহানির মামলা দেশের সব পুরুষের মানহানির মামলা। আমাদের সব পুরুষই নিজেদের সাধু সাব্যস্ত করতে বলেন—নাহ্‌, আমি তো আর এ কাজ করিনি। আপনার কি আমাকে অমন পুরুষ মনে হয়? আমার নিজের বোন আছে। ছোট ছোট বাচ্চা আছে। আমি কীভাবে এসব করতে পারি? দেখো ভাই, আমি ওমরাহ করে এসেছি। এই তো দেখো, কাবা শরিফে আমার সেলফি। আমি এমনটা করতে পারি? আপনিই বলুন!

সৈয়দ কাশিফ রেজার উপন্যাস ‘চার দরবেশ ও একটি কচ্ছপ’–এ একটি ভয়ানক দৃশ্য রয়েছে। দৃশ্যটিতে একজন পুরুষ কয়েকজন নারীকে জিম্মি করে আটকে রাখে। দৃশ্যটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হতে থাকে। অপহরণকারী হুমকি দেয় সে একে একে সব নারীকে ধর্ষণ করবে। টেলিভিশনের উপস্থাপক অপহরণকারীর কাছে জানতে চান তার দাবিটি কী? অপহরণকারীর উত্তর: দেশে দ্রুত শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করা।

আমরা পুরুষেরাও খুব দ্রুত ধর্ষকদের ফাঁসি দিতে চাই বা ধর্ষকের কল্লা কেটে নিতে খাড়া আমরা। কিন্তু কোনো নারী যখন রুখে দাঁড়িয়ে বলেন,‘ন্যায়বিচার চাই, তামাশা নয়!’ তখন আপনিই তাঁকে ধর্ষণের হুমকি দেন। কারণ, পুরুষের সম্মানহানি আমাদের সহ্যের বাইরে।


অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]