ধীরে চলা

অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী

২৬

ভেরা ঘুমোচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি জানালায়। দেখতে পাচ্ছি দুজন মানুষ চাঁদের আলোয় প্রাসাদ-হোটেলের বাগানে হাঁটছে।

হঠাৎ করে আমি শুনি, ভেরা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আমি তার বিছানার দিকে ঘুরে তাকাই। আমার মনে হয়, আরেকটু হলেই সে চিৎকার করে উঠবে। আমি কখনো দেখিনি যে ভেরার ঘুমে হানা দেয় দুঃস্বপ্ন? নিশ্চয়ই এই প্রাসাদের কোনো সমস্যা আছে!

আমি তাকে জাগিয়ে তুলি। সে আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। তার চোখে ভয়। সে এলোমেলো গলায় বলে, ‘স্বপ্নে দেখলাম, আমি এই হোটেলের একটা লম্বা করিডরে। আমার দিকে একটা লোক দৌড়ে আসছে। আমার দশ মিটারের মধ্যে চলে আসে। সে চিৎকার করতে থাকে। চিন্তা করো সে কথা বলে ওঠে চেক ভাষায়। সে বলে, ‘মিকিউইজ চেক নয়। মিকিউউজ পোলিশ।’ সে আমার আরও কাছে আসে। আমাকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। তখনই তুমি আমাকে জাগিয়ে তুলেছ।’

‘আমাকে ক্ষমা করো। তুমি আমার পাগলামোভরা কল্পনার শিকার হয়েছ।’

‘তার মানে কী?’

‘যেন তুমি হচ্ছো সেই ময়লা কাগজের ঝুড়ি, যেখানে আমি আমার লেখার বাতিল পাতাগুলো ছুড়ে ফেলি।’

‘তুমি কী বানাচ্ছ? উপন্যাস?’ সে ব্যথাদীর্ণ কণ্ঠে জিগ্যেস করে।

আমি আমার মাথা নত করি।

‘তুমি আমাকে অনেকবার বলেছ তুমি একটা উপন্যাস লিখতে চাও, যাতে তুমি একটাও গুরুগম্ভীর শব্দ লিখবে না। একটা বড় ননসেন্স লেখা, যা তুমি লিখবে তোমার নিজের আনন্দের জন্য। আমার ভয় হচ্ছে, সেই সময়টা এসে গেছে। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, খুব সতর্ক থাকবে।’

আমি আমার মাথা আরও বেশি নত করি।

‘তোমার কি মনে আছে, তোমার মা তোমাকে কী বলতেন? আমি তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, যেন মাত্র গতকাল তিনি এটা বলছেন, “মিলানকু, ঠাট্টা কোরো না। তোমার রসিকতা কেউ বোঝে না। তুমি সবাইকে আহত করবে। এবং শেষে সবাই তোমাকে ঘৃণা করবে।” তোমার মনে আছে?’

‘হ্যাঁ। মনে আছে?’

‘আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। গুরুগাম্ভীর্য তোমাকে রক্ষা করে আসছে। তুমি যদি গাম্ভীর্য কমিয়ে দাও, তা তোমাকে ক্ষুধার্ত নেকড়েদের সামনে উন্মুক্ত করে দেবে। তুমি জানো, তারা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নেকড়েরা।’

এই ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী করে ভেরা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

[প্রিয় পাঠক।
আপনাদের অনুবাদক আনিসুল হক বলছি।
আমার স্ত্রী এবং কন্যা আমাকে প্রায়ই এই কথা বলেন। তাঁরা বলেন যে, তুমি যেসব রসিকতা করো, মানুষ তা ধরতে পারে না। রসিকতা কোরো না। আমার কতগুলো তৈরি রসিকতা আছে। এর মধ্যে একটা হলো, কেউ যদি আমাকে বলেন যে আমি আপনার একটা বই কিনেছি। তখন আমি বলি, ‘ধন্যবাদ, আপনি আমার বইয়ের প্রচারসংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন। এর আগে আমি নিজে আমার বই একটা কিনেছিলাম।’ যাকে বলি, তিনি শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিংবা যখন কেউ আমাকে খাওয়ান, আমি বলি, ‘কত দিন পর ভালোমন্দ খেলাম!’ আমার বন্ধুরা এটা শুনেই হইহই করে ওঠেন, ‘নতুন কিছু বলো।’ কিন্তু যাঁরা নতুন, তাঁরা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেন। একজন যেমন আমাদের এক কবিবন্ধুকে বলেছিলেন, '‘যারা খেতে পায় না, তাদের খাওয়াতে আমার খুব ভালো লাগে!’ যা–ই হোক, ভেরা তার স্বামীর উদ্দেশে যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছে এবং মিলান কুন্ডেরার মা ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন, এটা আমি আমার জন্যও শিরোধার্য মনে করছি। আমার খুবই সিরিয়াস থাকা উচিত। কারণ, হালকা কিছু লিখলে ক্ষুধার্ত নেকড়েরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। আমি তাই এই ‘স্লোনেস’ উপন্যাসটির অনুবাদ অনলাইনে দেওয়া এখানেই শেষ করছি। আমি পুরোটাই শেষ করব এবং বই হিসেবে প্রকাশ করব। কারণ, বইয়ের দুই মলাটে যা থাকে, তা সবার জন্য না। যিনি এটা কিনবেন, শুধু তাঁর জন্য। কিন্তু অনলাইনের জিনিস থাকে সবার জন্য। এই বইয়ের বাকি গল্পটা সবার জন্য না। এটা কেবল পরিণতদের জন্য এবং সাহিত্যের পাঠকদের জন্য। কাজেই এটা অন্য আলো ডট কমে দেওয়া ঠিক হবে না। যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা বই থেকে পড়ে নিতে পারবেন। আমার বলার কথা ছিল, উপন্যাস নানা রকমের এটা উপলব্ধি করার জন্য আমি এই উপন্যাস অনুবাদ করছি। আমার ধারণা, আমার সে উদ্দেশ্য এরই মধ্যে চরিতার্থ হয়েছে। আপনারা বুঝে গেছেন, কেন্দ্রীয় চরিত্র না থাকলেও এবং ঘনবদ্ধ প্লট না থাকলেও উপন্যাস হয়। কাজেই এই উপন‌্যাসের অনুবাদের অনলাইন প্রকাশনা এখানেই সমাপ্ত। আমি জানি, আপনি-তুমিতে মিশ্রণ ঘটে গেছে, বাক্যে ভুল ছিল। বইয়ে প্রকাশের সময় এগুলো সংশোধন করা হবে। ফরাসি শব্দের উচ্চারণও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দেখিয়ে নেওয়া হবে। আপনাদের ধন্যবাদ]