বাংলাদেশে যৌন সহিংসতা মোকাবিলার জন্য চাই ভিকটিমের ওপর দায় চাপানোর সংস্কৃতির বিলুপ্তি

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের একটি ভিডিও ৪ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তৈরি হয় ক্ষোভ। গড়ে ওঠে বিভিন্ন সংগঠন। ফেমিনিস্টস অ্যাক্রস জেনারেশন তেমনই একটি সংগঠন। সংগঠনটির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দাবিদাওয়া নিয়ে একটি মতামত ১৯ অক্টোবর প্রকাশিত হয় ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়। যুগ্মভাবে এটি লিখেছেন নারী অধিকার সংস্থা নারীপক্ষের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক ও শি ডিসাইডস আন্দোলনের কর্মী সৈয়দা সামারা মোর্তজা। সেই লেখাটি অনুবাদ করেছেন নাজিফা তাসনিম খানম তিশা

এখনো এমন মানুষ আছেন যাঁরা হরহামেশা প্রশ্ন তোলেন, ‘মেয়েটা কী পরে ছিল?’ বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র এবং সম্মতির ওপর বিশদ আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
মিডিয়ায় উঠে আসা একটি জঘন্য গণধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। নিপীড়িত নারী সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, এই আশঙ্কার পাশাপাশি উদ্বেগ আছে প্রচলিত সংস্কার নিয়েও; যে সংস্কার বিশ্বাস করে একজন নারী ধর্ষিত হওয়ামাত্র নিজের সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলেন, পরিবারকেও করেন কলঙ্কিত।

নারী কি আদৌ চাপিয়ে দেওয়া এই ‘সম্ভ্রম’-এর বোঝা কখনো বহন করতে চেয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। নারীর সম্মান কি তাঁর শরীরে থাকে? নিপীড়নের শিকার মানুষকে আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫ জন নারীকে পুরুষেরা ধর্ষণ করেছে, ৪৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে এবং আরও ২০৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে। এটি ধর্ষণের ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা নয়। নথিভুক্ত হয়নি এমন ঘটনার সংখ্যা অনেক অনেক বেশি।

তাই গত সপ্তাহে একদল নারী একত্র হয়ে ‘ফেমিনিস্টস অ্যাক্রস জেনারেশনস’ (বিভিন্ন প্রজন্মের নারীবাদীবৃন্দ) নামে একটি জোট গঠন করেন। আমরা শ্রেণি, পেশা বা যেকোনো পরিচয়ের ঊর্ধ্বে সব নারীর ওপর সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাই। নারী পরিবার দ্বারা নিগৃহীত হোক, অপরিচিত মানুষের দ্বারা হোক, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা সেনাসদস্যদের আগ্রাসনের শিকার হোক, আমরা প্রতিবাদ করব।

আমরা ক্ষুব্ধ। আমরা ক্ষুব্ধ পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের ওপর। কারণ তারা অপরাধের শিকার মানুষটির ওপর দায় চাপায়। তারা অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করার বদলে ভিকটিমের জীবনাচরণে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে বেশি জোর দেয়।

আমরা ক্ষুব্ধ তাঁদের ওপর, যাঁরা সর্বক্ষণ প্রশ্ন করতে থাকেন ভিকটিম কি পরে ছিল, কেন গিয়েছিল, কার সঙ্গে গিয়েছিল, তখন সময় কত ছিল; যাঁরা বারবার বারবার বলতেই থাকেন, ভিকটিম নিজের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধটিকে ‘ডেকে এনেছেন’, তাঁদের প্রতি ক্ষুব্ধ আমরা।

শুধু দু-একটি অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বা অপরাধীর শাস্তি নিয়ে সোচ্চার হওয়া ‘ফেমিনিস্টস অ্যাক্রস জেনারেশন’-এর উদ্দেশ্য নয়। বরং যেসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা সমাজে সহিংসতার পথ প্রশস্ত করে দেয়; নারীর বিরুদ্ধে যেসব কাঠামোগত বৈষম্য কাগজে-কলমে এবং দৈনন্দিন জীবনে বর্তমান; যেসব অসাম্য আমাদের শাসন ও বিচারিক কাঠামোকে প্রশ্রয় দেয়, সেগুলোকে প্রশ্ন করাও সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

আমরা ক্ষুব্ধ তাঁদের ওপর, যাঁরা সর্বক্ষণ প্রশ্ন করতে থাকেন ভিকটিম কী পরে ছিল, কেন গিয়েছিল, কার সঙ্গে গিয়েছিল, তখন সময় কত ছিল; যাঁরা বারবার বারবার বলতেই থাকেন, ভিকটিম নিজের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধটিকে ‘ডেকে এনেছেন’, তাঁদের প্রতি ক্ষুব্ধ আমরা।

জোটবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্য এখন বিস্তৃত করতে হবে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতের বাইরেও বিষাক্ত পুরুষতন্ত্রকে আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে। ধর্ষণের সংস্কৃতি ও যৌন নিপীড়ন বন্ধের উপায় অনুসন্ধান করতে হবে।

বাংলাদেশের সুপ্রাচীন আইনগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। ‘চারিত্রিক সাক্ষ্য আইন’-এর মতো ধারা যেটি আদালতে নিপীড়িত নারীর দিকে তার ‘চরিত্র’ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার সুযোগ রাখে, এমন আইন সংস্কার করতে হবে। সমাজ, সমাজের মানুষের পোকায় খাওয়া মগজ আর অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ধরে ধরে মেরামত করার সময় এখন এসে গেছে। সময় এসে গেছে সব স্তরের মানুষের একই কাতারে এসে আওয়াজ তোলার, নারীর স্বাধীনতা চাই, সুরক্ষা নয়। দিন বা রাতে, বাসে বা রাস্তায়, শিক্ষায়তনে, কর্মক্ষেত্রে, ঘরে—সব জায়গায় আমরা নারীর নিরাপত্তা দাবি করি।

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বাংলাদেশের জাতীয় সংকট। এটিকে জাতীয় সংকট হিসেবেই ঘোষণা করা উচিত। কোনো ধরনের সহিংসতা কখনো স্বাভাবিক বলে গণ্য হতে পারে না, কোনো সংস্কৃতির অংশ হিসেবেও গৃহীত হতে পারে না। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নারী-পুরুষ একসঙ্গে মিলে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

সমাজের সব স্তরে ভিকটিমকে দোষারোপ করার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দাবি করি আমরা (কাঠামোগত, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত)। আমরা চাই কোনো ধর্ষক ঘরে, শিক্ষায়তনে, কর্মক্ষেত্রে—কোথাও আশ্রয় পাবে না; পরিবারগুলো ছেলেদের, পুরুষদের যেকোনো অপরাধের জন্য প্রশ্ন আর শাস্তির মুখোমুখি করবে। আমরা যেকোনো সময়ে যেকোনো প্রয়োজনে সব উন্মুক্ত স্থানে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারার অধিকার চাই।

সম্মতির পরিষ্কার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ শিক্ষায়তনগুলোতে ব্যাপকভাবে যৌন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা জরুরি। আমরা সাইবার স্পেসে নারীকে হেনস্তা করতে ব্যবহৃত সব রকম কৌশল ও পদ্ধতির ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই । স্বামী বা স্ত্রীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার মানুষটির বয়স বিবেচনার বাইরে রেখে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে আইন সংস্কারের জন্য অনুরোধও জানাই আমরা।

আমরা মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। এটি কোনো সমাধান নয়। মৃত্যুদণ্ডের বিধান নুসরাত জাহান রাফি, কল্পনা চাকমা, ইয়াসমিন আক্তার, সোহাগী তনুর মতো আরও অনেক নারী—বাংলাদেশ যাঁদের হারিয়েছে—তাঁদের বিচার এনে দেয়নি। আরও অগণিত নারী বেঁচে আছে আতঙ্ক নিয়ে।

আমরা ধর্ষণের সংস্কৃতির বিনাশ দেখতে চাই।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]