মির্জা গালিবের সরকারি চাকরি

সাদত হাসান মান্টো

ভূমিকা ও অনুবাদ: জাভেদ হুসেন

মির্জা গালিব (২৭ ডিসেম্বর ১৭৯৭—১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯)

মরহুম হাকিম মাহমুদ খানের বৈঠকখানার কাছে মসজিদের পেছনে যে একটা বাড়ি, সেটা মির্জা গালিবের। এ বিষয়ে মির্জা একবার বলেছিলেন, মসজিদের ছায়ার নিচে ঘর বানিয়েছি। এই অধম বান্দা খোদার প্রতিবেশী। আসুন! এবার আপনাদের মির্জা সাহেবের বৈঠকখানায় নিয়ে যাই। অসুবিধা নেই, রাত হয়েছে তো কী, মির্জা সাহেবের ওখানে নিশ্চয়ই এখনো আলো ঝলমল করছে…সে যাক, আলো খুব বেশি না হলেও মুনশি শিবনারায়ন উপস্থিত আছেন।

(মির্জা সাহেবের হাত থেকে কাগজ নিয়ে)

মুনশি শিবনারায়ণ: এই গজল তাহলে আসলেও আপনার লেখা নয়?

গালিব: (বিরক্ত হয়ে) আরে না রে ভাই, কখনোই না। এমন কবিতা আমার! এখানেই তো শেষ না। সেদিন একজন আমার সামনে এই কবির একটা পঙ্​ক্তি পড়লেন। আমি তাঁকে বাধ্য হয়ে বললাম, ভাই! এ যদি আমার কবিতা হয় তো আমার ওপর অভিসম্পাত! আসল কথা হলো, কে এক লোক আসাদ নামে কবিতা লেখা শুরু করেছে। আর এ হলো সেই শ্রীমানের অসাধারণ কবিতার নমুনা! মুনশি শিবনারায়ণ, তুমি কি লেখার ধরনের দিকে একটুও নজর দাও না?

মুনশি শিবনারায়ণ: (কাগজ ভাঁজ করে পকেটে রেখে) না না, মির্জা সাহেব, এ আমারই ভুল!

(মির্জা গালিবের পরিচারক কাল্লুর প্রবেশ)

কাল্লু: হুজুর, মুনশি গুলাম রসুল সাহেব এসেছেন।

গালিব: নিয়ে এসো।

(কাল্লু ঘরের বাইরে যায়। মুনশি গুলাম রসুল ঘরে ঢোকেন)

গুলাম রসুল: অভিবাদন গ্রহণ গ্রহণ করুন মির্জা সাহেব।

গালিব: অভিবাদন, তো মুনশি সাহেব, বলুন কী সেবা করতে পারি?

গুলাম রসুল: সেক্রেটারি বাহাদুর টমসন সাহেব আপনার সেবায় সালাম পাঠিয়েছেন। বলেছেন, উনি আপনাকে কলেজে ফারসির শিক্ষক নিয়োগের কথা ভাবছেন।

শিবনারায়ণ: অভিনন্দন মির্জা সাহেব।

গালিব: আগে পুরো কথাটা তো শুনি…হ্যাঁ, এরপর মুনশি সাহেব?

গুলাম রসুল: উনি কাল সকাল দশটার সময় আপনার সাক্ষাৎ চেয়েছেন।

গালিব: বেশ, আমার পক্ষ থেকে ওনাকে সালাম দেবেন। বলবেন যে এই অধমকে নির্বাচন করায় আমার কৃতজ্ঞতা যেন গ্রহণ করেন।

গুলাম রসুল: ঠিক আছে। তাহলে আমি সেক্রেটারি সাহেবের কুঠির বাইরে বাগানে হাজির থাকব। আপনি পৌঁছালেই ভেতরে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করব।

গালিব: আপনার কৃপা। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।

গুলাম রসুল: ঠিক আছে, তাহলে অনুমতি দিন।

(মুনশি গুলাম রসুল ঘর থেকে বের হয়ে যান)

শিবনারায়ণ: (হাসতে হাসতে) এবার তো অনুমতি দিন, অভিনন্দন জানাই।

গালিব: (হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ান) উঁহু, আগে বেগম সাহেবার অভিনন্দন নিতে দাও।

(মির্জা গালিব খুশি মনে জেনানামহলে ঢোকেন। দেখেন যে উমরাও বেগম বসে ওজু করছেন। মির্জাকে দেখে মুখ ভারী করে বলতে থাকেন…)

উমরাও বেগম: আজ দুই দিন ধরে বলছি একটু আমার পাশে বসে ঠান্ডা মাথায় দুটো কথা শোনো। তোমার আর অবসর কোথায়?

গালিব: (পাশে চৌকিতে বসে) বেগম! বুঝেছি তুমি এই সব বলে এরপর উপদেশের ঝাঁপি খুলে বসবে। বলো, কী বলবে?

উমরাও বেগম: (রেগে) আবার ঠাট্টা–তামাশা শুরু করলে?

গালিব: (চাপা হেসে) আচ্ছা আচ্ছা, বলো!

উমরাও বেগম: আচ্ছা বলো তো, আর কয় দিন ঘরের জিনিসপত্র বেচে সংসার চলবে? এত যে ধারদেনা, সেটা শোধ হবে কী করে? আর দেনা শোধ জাহান্নামে যাক, কাল থেকে ঘরের চুলা জ্বলবে কীভাবে? সব যে শিকেয় উঠেছে।

গালিব: (রহস্যভরা গলায়) ভয় পেয়ো না। খোদা তোমার কথা শুনেছেন শেষ পর্যন্ত।

(গালিব চৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়ান)

উমরাও বেগম: কী? কী শুনেছেন?

সাদত হাসান মান্টো

গালিব: আপনার দোয়ার গুণে টমসন সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কলেজে ফারসির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে চান। সন্দেহ নেই যে আমার কোনো একটা গুণ আছে, যা সাহেবদের কাজে লাগবে।

উমরাও বেগম: সত্যি!

গালিব: হ্যাঁ, আর না হোক অন্তত মাসে দুই শ টাকা তো পাওয়া যাবেই। তো, এবার খুশি?

উমরাও বেগম: (পানির পাত্র নিয়ে উঠে দাঁড়ান) হ্যাঁ, খুশি।

গালিব: এবার তো একটু হাসো তো দেখি!

উমরাও বেগম: থাক! আর তামাশা করতে হবে না।

গালিব: (খুশি মনে) না, সত্যি! তোমাকে হাসতে দেখলে আমার মন শান্ত হবে।

(উমরাও বেগম এবার খিলখিল করে হেসে ওঠেন)

গালিব: খোদা আমার উমরাওয়ের মুখের হাসি যেন এমনই থাকে। উমরাও আমার প্রাণ।

উমরাও বেগম: রাখো তোমার কবিতা। সাহেবের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও।

এর পরদিন সাহেবের কাছে যাওয়ার জন্য মির্জা গালিব তৈরি হচ্ছেন।

(কাল্লু ভেতরে ঢোকে)

গালিব: ভাই কাল্লু, সারা দিন কোথায় থাকো বলো তো?

কাল্লু: জি, কী হুকুম হুজুর?

গালিব: আমার দরবারি জামাগুলো বের করো তো। দশটার মধ্যে টমসন সাহেবের ওখানে থাকতে হবে।

কাল্লু: (যেতে যেতে ফিরে) ওই রেশমের জোব্বা আর পাগড়ি তো বের করব। চাদর কোনটা বের করব?

গালিব: জামদানির চাদরটা। আর সেলিমশাহি জুতাজোড়াও নিয়ে এসো।

দরবারি সাজে তৈরি হয়ে মির্জা গালিব পালকি চড়ে টমসন সাহেবের কুঠিতে পৌঁছালেন। মুনশি গুলাম রসুল আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। বেহারাদের গলার আওয়াজ শুনে ভেতরে খবর দিতে গেলেন।

গুলাম রসুল: হুজুর, মির্জা গালিব হাজির হয়েছেন। বলছেন আপনার হুকুম হলে ভেতরে আসতে চান।

টমসন: (ঘড়ি দেখে) একদম ঠিক সময়ে এসে গেছেন দেখছি। আচ্ছা, বলো যে আমি অপেক্ষা করছি।

গুলাম রসুল বাইরে এলেন। গালিব বাইরে পায়চারি করছিলেন।

গুলাম রসুল: হুজুর ভেতরে চলুন। সাহেব বাহাদুর অপেক্ষা করছেন।

গালিব: (বিস্মিত হয়ে) কী বলছেন আপনি?

গুলাম রসুল: আপনাকে ডেকেছেন হুজুর।

গালিব: ডেকেছেন! নিয়মমাফিক তো সেক্রেটারি সাহেব এই অধমকে নিতে এলে আমি তাঁর সঙ্গে যাব।

গুলাম রসুল: আচ্ছা। আমি সাহেবকে গিয়ে তাই জানাচ্ছি।

(গুলাম রসুল আবার ভেতরে গিয়ে সাহেবকে বললেন)

গুলাম রসুল: হুজুর, মির্জা সাহেব বলে পাঠালেন যে নিয়মমাফিক আপনি তাঁকে নিতে গেলে তিনি ভেতরে আসবেন।

টমসন: (হেসে) খুব খেপেছেন বোধ হয় উনি? চলো, আমি গিয়ে কথা বলছি।

টমসন সাহেব কুঠির বাইরে এসে মির্জা গালিবের সঙ্গে হাত মেলালেন।

টমসন: অভিবাদন মির্জা!

মির্জা গালিব: অভিবাদন জনাব!

টমসন: আপনি ভেতরে এলেন না যে?

গালিব: নিয়মমাফিক আপনি এই অধমকে নিতে এলেই আমি হাজির হতাম।

টমসন (হেসে): মির্জা সাহেব, আপনি দরবারে আমন্ত্রণ পেয়ে গেলে এমন করে স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু এখন তো আপনি চাকরিপ্রার্থী হয়ে এসেছেন। এখন তো সে নিয়ম খাটবে না।

গালিব: জনাব, গভর্নমেন্টের চাকরি আশা করে এসেছি যে সে চাকরিতে সম্মান বাড়বে। ভাবিনি যেটুকু সম্মান বাকি আছে, তা–ও যাবে।

টমসন: আমি নিয়মের কাছে অসহায়।

গালিব: (পালকির দিকে যেতে যেতে) তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। অভিবাদন।

টমসন: চলে যাচ্ছেন…?

গালিব পালকিতে উঠে বেহারাদের বাড়ি ফিরতে বললেন। বাড়ির বাইরে পঙ্গু, অন্ধ, ভিখারিদের ভিড়। কাল্লু তাদের খয়রাত বিলি করছে। মির্জা অবাক হয়ে দ্রুত ভেতরে এলেন। দেখেন উমরাও বেগম প্রার্থনায় মগ্ন। প্রার্থনা সেরেই মির্জাকে দেখে বললেন—

উমরাও বেগম: খোদার রহম। বলুন, সব ঠিক আছে তো?

গালিব: (আসনে বসে) হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।

উমরাও বেগম: (অবাক হয়ে) মানে?

গালিব: মানে এই যে সম্মান ধুলোয় মিশতে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।

উমরাও বেগম: হায় হায়! কী বলছেন আপনি!

গালিব: (উঠে অহংকারি গলায়) বেগম! আত্মসম্মানের জন্য মোগলরা মরতেও রাজি। আমি সরকারি চাকরির জন্য গেলাম যে এতে সম্মান বাড়বে। কিন্তু গিয়ে দেখি সেক্রেটারি সাহেব আমাকে স্বাগত জানাতে বাইরেও এলেন না। ভাবো একবার, এমন অসম্মান কী করে সহ্য করা যায়!

বন্দনার সময়ও সেই স্বভিমান আর আত্মাভিমান

প্রার্থনারা ফিরে আসে যদি কাবার দরজা বন্ধ থাকে।

আচ্ছা, ভালো কথা, বাইরে দান–খয়রাত হচ্ছে কেন?

উমরাও বেগম: (চিন্তিত হয়ে) না, কিছু না।

গালিব: কিছু না মানে? কালকেই তো বললে যে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে আর কত দিন সংসার চলবে?

উমরাও বেগম হেসে ফেলেন।

গালিব: আরে ভাই, কিছু বলো?

উমরাও বেগম: কী বলবো…শহরজুড়ে আপনার চাকরির খবর সবার মুখে মুখে। বাড়ির সামনে তাই ভিখারিরা জমা হয়েছে দান-খয়রাতের আশায়। জরোয়া হারখানা বন্ধক রেখে কিছু টাকার ব্যবস্থা করলাম। সে টাকা কাল্লু মিয়ার হাতে দিয়ে বললাম,‘যাও, ভিখারিদের দিয়ে এসো।’

গালিব হা হা করে হেসে ওঠেন। উমরাও বেগম গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে যান।

অনুবাদ প্রসঙ্গে

প্রখ্যাত উর্দু, ফারসি কবি ও গদ্যকার মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯)। ইংরেজদের হাতে শাসনক্ষমতা যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনের বিশাল ধাক্কা ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা পাল্টে দিয়েছিল। গালিব সেই সময়ের সূক্ষ্মতম লিপিকার। সদ্য জন্ম নেওয়া আধুনিক সমাজে গালিবের আর্থিক ধস নামে। কিন্তু নতুন সমাজে কেবল টাকার জন্য ব্যক্তিসত্তাকে বিক্রি করার নতুন পদ্ধতিটি কবি মেনে নেননি। এই ঘটনা আলোড়িত করেছিল মির্জা গালিবের একনিষ্ঠ অনুরাগী উর্দু গল্পকার সাদত হাসান মান্টোকে (১৯১২-১৯৫৫)। মান্টো বলতেন, গালিবের পর ইতিহাস কবিতা লেখার অধিকার মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। বিখ্যাত ছবি মির্জা গালিব (১৯৫৫)-এর কাহিনিও লিখেছেন মান্টো। তিনি নিজেও ছিলেন গালিবের মতো আরেক অস্থির সময়ের লিপিকার। গালিবের জীবনের একটি ঘটনা নিয়ে সাদত হাসান মান্টো উর্দুতে এই নাটক লিখেছিলেন রেডিওর জন্য। ২৭ ডিসেম্বর মির্জা গালিবের জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত হলো সেই নাটকের অনুবাদ। উর্দু ভাষায় লেখা গালিব অউর মান্টো বই থেকে অনুবাদটি নেওয়া হয়েছে।