একজন রবি কবি

মাকে নিয়ে অনেক দূরে যাচ্ছে শিশুটি। মা যাচ্ছেন পালকিতে, ছেলে রাঙা ঘোড়ায় চড়ে। এ সময় ‘হারে রে রে রে রে’ বলতে বলতে একদল ডাকাত এসে হাজির। ডাকাত মানেই তো ভয়ংকর ব্যাপার। সবকিছু কেড়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু ওইটুকুন ছেলেটা ডাকাতদের দেখে খেপে গেল। শুরু হলো লড়াই। ডাকাত দলের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করল সে—ভয়ে পিঠটান দিল ডাকাতের দল। মা বললেন, ‘ভাগ্যে, খোকা সঙ্গে ছিল, কী দুর্দশাই হতো তা না হলে।’
ছোট্ট শিশুটির কল্পনা এটি। রোজ কত কিছু ঘটে, কিন্তু এমন ঘটনা কেন ঘটে না—এই আক্ষেপ রেখে শিশুটি ওর গল্প শেষ করে।
তোমাদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের এই ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি পড়েছ। অন্তত আবৃত্তিকারদের কল্যাণে শুনেছ। রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের অনেক কবিতা আর গল্প লিখেছেন তোমাদের জন্য। এগুলো পড়লে বোঝা যায়, শিশুদের স্বভাব কতটাই না বুঝতেন তিনি।
‘ছুটি’ নামে একটা গল্প আছে তাঁর। ফটিক নামের এক গ্রামের দুরন্ত ছেলের কাহিনি সেটা। ডানপিটে বলে মামা তাকে নিয়ে যায় শহরে নিজের বাড়িতে। কিন্তু গাঁয়ে বেড়ে ওঠা ফটিকের কি আর এ রকম কৃত্রিম জীবন ভালো লাগে? নিজেকে বন্দী বন্দী বলে মনে হয়। তারপর এই দুরন্ত ছেলেটির কী পরিণতি হয়, সেটা জানার জন্য পড়তে হবে গল্পটি।
প্রায় একই রকম একটি কবিতা আছে রবীন্দ্রনাথের, ‘দুই পাখি’ নামে। তার কয়েকটি পঙ্ক্তি এ রকম,
‘বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
বনেতে যাই দোঁহে মিলে।
খাঁচার পাখি বলে—বনের পাখি, আয়
খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’
বনের পাখি বলে—‘না,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।’
খাঁচার পাখি বলে—‘হায়,
আমি কেমনে বনে বাহিরিব!’
কথাগুলো একটু ভেবে দেখো, ঘর ও বাইরের জীবন যে দুই রকম, তা স্পষ্ট হয়েছে দুই পাখির কাহিনিতে।
তোমাদের জন্য অসংখ্য লেখা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করেননি তিনি। তোমরা যেগুলো বুঝতে পারো, সে ভাষাতেই লেখা।
কণিকা বলে এক অসামান্য সৃষ্টি আছে রবীন্দ্রনাথের। তাতে ছোট ছোট কবিতায় জীবনের সেরা সত্যগুলোকে তুলে ধরেছেন তিনি। তেমনই একটি:
‘ভিমরুলে মৌমাছিতে হল রেষারেষি,
দুজনায় মহাতর্ক শক্তি কার বেশি।
ভিমরুল কহে, আছে সহস্র প্রমাণ
তোমার দংশন নহে আমার সমান।
মধুকর নিরুত্তর ছলছল—আঁখি-
বনদেবী কহে তারে কানে কানে ডাকি,
কেন বাছা, নতশির! এ কথা নিশ্চিত
বিষে তুমি হার মানো, মধুতে যে জিত।’
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গল্প বলে তাঁর জন্মদিনের এই লেখাটা শেষ করব। ‘বলাই’ গল্পটা তো পড়েছ? গাছ বা প্রাণীদের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন ছিল, তা জানা যায় ছোট্ট একটি ঘটনায়।
এদিন মৈত্রেয়ী দেবীর ছেলে মিঠু এসে উপস্থিত খানিকটা ছেঁড়া ফুল পাতা নিয়ে।
তা দেখে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘কি গো, তোমার বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু হয়নি? গাছের পাতা ছিঁড়লে যে ওদের ব্যথা লাগে, তা জানো?’
‘সত্যিই লাগে নাকি দাদু?’
‘আমি যখন ছোটো ছিলুম, এই ধর ১০/১২ বছর বয়স, তখন কাউকে গাছের পাতা ছিঁড়তে দেখলে ভারি কষ্ট পেতুম। অনেকের অভ্যাস আছে চলতে চলতে হঠাৎ এক মুঠো পাতা ছিঁড়ে নিল, আমার ভারি খারাপ লাগত দেখতে। মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠত। আরো খারাপ লাগত যদি কেউ পোকা কি কুকুর বেড়ালকে বিরক্ত করত, কষ্ট দিত। অসহায় প্রাণী, ওদের নির্বাক বেদনা মনে লাগে বড়।’
রবীন্দ্রনাথকে একটু হলেও তো বুঝতে পারলে? আরও বুঝতে হলে আরও আরও বেশি বেশি পড়তে হবে রবীন্দ্রনাথের বই। এখন তো ইন্টারনেটেই রবীন্দ্রনাথের সব বই পড়া যায়, তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি তোমরা নিজেরাই কিনে ফেলো রবীন্দ্র রচনাবলি। নিশ্চিত বলে দিতে পারি, বইগুলো কিনলে জিতবে তুমি। মধুতেই জিত!