তোলপাড়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘মা মা, দেখে যাও মামা কেমন লাফাচ্ছে!’
গলার সবটুকু জোর দিয়ে চেঁচায় মুন। মা বসার ঘরে চা খেতে খেতে আয়েশ করে পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছিলেন। চায়ের কাপে সবে ঠোঁট লাগিয়েছেন, এ সময় আচমকা মেয়ের চিৎকার। চমকে ওঠায় হাত কেঁপে গেল তাঁর। জিভে সেঁকা খেলেন, খানিকটা চা ছলকে পড়ল নতুন পোশাকে।
সেদিকে খেয়াল না করে মা ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে। তাঁর ছোট ভাই পিপুল এক পা গলানো প্যান্ট ধরে লাফাচ্ছে। আর চিৎকার।
ভাইকে এভাবে লাফাতে দেখে মুনের মা দিশেহারা। একটু আগেও তো ভালো ছিল সে। রাতেই পাঁচ হাজার টাকার চেকটা দিয়ে রেখেছেন। এখন সেটা ভাঙাতে ব্যাংকে যাওয়ার কথা তঁার। এর মধ্যে কী হলো? মুনের মা ব্যাকুল হয়ে জানতে চান, ‘হঠাৎ কী হলো রে? এমন করছিস কেন?’
চোঙা প্যান্টটা পা থেকে খসাতে মরিয়া পিপুল। বলল, ‘আমাকে বাঁচাও আপা! হেল্প মি!’
‘কী হয়েছে—বলবি তো।’
প্যান্টটা শেষ পর্যন্ত খসাতে পারল পিপুল। লম্বা দম টেনে হাঁপাচ্ছে সে। মুন বলল, ‘মামা, তোমাকে না সুমো পালোয়ানের মতো লাগছে!’
পিপুলর একটু ভুঁড়ি আছে। কাজেই এ অবস্থায় তাঁকে দেখে কেউ সুমো পালোয়ান বলতেই পারে।
ঢাউস তোয়ালেটা কোনোমতে টেনে শরীরে পেঁচায় পিপুল। মুনের মা বলেন, ‘হ্যাঁ, এখন বল, লাফাচ্ছিলি কেন?’
মেঝেতে পড়ে থাকা প্যান্টের দিকে আঙুল তাক করে পিপুল। সভয়ে বলে, ‘ওটার ডান পকেটে ইঁদুরের বাচ্চা!’
‘এ্যাঁ, বলিস কী!’
‘হ্যাঁ, প্যান্টে ডান পা গলাতেই পকেট থেকে একটা নেংটি ইঁদুর লাফিয়ে নেমে ঝেড়ে দৌড় দিল।’
‘তারপর কী হলো, মামা?’ জানতে উৎসুক মুন।
পিপুল বলল, ‘দেখি পকেটে কী যেন নড়েচড়ে! হাত ঢোকাতেই তুলতুলে লাগল। আপা রে, আমি আর নেই!’
পিপুল চোখ বুজে এমন ভাব করল, তার আপার গায়েও কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি জানতে চাইলেন, ‘চেকটা কোথায়?’
থ বনে যায় পিপুল। চোখ দুটো গোল গোল। বেসুরো গলায় বলল, ‘চেকটা তো মনে হয় গেছে রে, আপা!’
‘মানে?’
‘প্যান্টের ডান পকেটেই রেখেছিলাম ওটা। চেক পাইনি। কুঁচি করা কাগজ পেয়েছি। চেকটা শেষ! চেকটা কেটে ছানাগুলো আরামের বিছানা বানিয়েছে।’
মুনের মা বলেন, ‘বাহ্, ইঁদুর ছানার পাঁচ হাজার টাকার বিছানা! এক রাতেই কত কী কাণ্ড! চেক না হয় আরেকটা দেওয়া যাবে, কিন্তু ওই ছানাগুলোকে বের করবে কে?’
মুন এবার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। ইরা মিস বলেন, ওর বুদ্ধি নাকি পাকা ডালিমের মতো। মুন বলল, ‘ইঁদুর ছানাকে কেউ ভয় পায়! এই দেখো বের করে আনছি।’
এই বলে পা বাড়ায় মুন। পিপুল মরিয়া হয়ে বলে, ‘আপা, ওকে ঠেকাও!’
দৌড়ে বসার ঘরে চলে যায় পিপুল। মা গিয়ে মুনকে থামান। ধমকের সুরে বলেন, ‘এটা কী!’
‘ছানাগুলোকে বের করে আনি। আমাদের ক্লাসের অর্পিতা দুটো খরগোশের ছানা পুষে। আমিও ইঁদুর ছানা পুষব।’
‘মা গো, কী বলে মেয়ে! তোমাকে এত মাতব্বরি করতে হবে না। বুয়াকে বলছি, সে বের করে আনবে।’
‘বের করে কী করবে, মা?’
‘ময়লার বালতিতে ফেলবে।’
‘তাহলে তো ওগুলো মরে যাবে, মা!’
‘মরুক। ইঁদুর মরলেই তো ভালো। দেখো না কেমন কাটাকুটি করে ওরা। আমার দামি শালটার অবস্থা দেখোনি?’
মুন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘তাই বলে ছানাগুলোকে মেরে ফেলবে! তুমি না বলো বেবিদের কোনো দোষ নেই?’
মা বলেন, ‘আমি তো মানুষের বেবির কথা বলেছি। মানুষ আর ইঁদুরের বেবি এক হলো?’
মুন জেদের সুরে বলে, ‘না, মা। সব বেবিই এক। ওদের মারতে দেব না।’
‘আচ্ছা, দিস না। বসে বসে মামার প্যান্ট পাহারা দে।’
এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মা। মুন সত্যিই বসে থাকে পাহারায়।
এই ফাঁকে মা গিয়ে জালালের মাকে বলেন, ‘যাও তো বুয়া, পিপুলের প্যান্ট থেকে ইঁদুরের বাচ্চগুলো বের করে ফেলে দাও।’
‘কী কন আম্মা! ফ্যান্টের ফকেটে ইন্দুরের বাচ্চা আইল কোত্থাইকা?’
‘এত কথার দরকার নেই। তুমি স্রেফ প্যান্টটা বালতির ওপর ধরে ঝাঁকি দিয়ে ছানাগুলোকে ফেলে দেবে। ব্যস!’
জালালের মা বলে, ‘জান গেলেও এই কাম পারতাম না আম্মা। ইন্দুরের বাচ্চা দেখলে আমার ঘিন্না লাগে। ডরে জান যায়!’
শেষে শুকুর আলীর কাঁধে চাপে এ ঝামেলা। বাজার থেকে এই মাত্র ফিরেছে সে।
ময়লার বালতির ওপর প্যান্টের পকেটটা কায়দা করে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে শুকুর। ঝুর ঝুর করে কাগজের গুঁড়ো ঝরে। ইঁদুর ছানার বালাই নেই।
হে হে করে হাসে শুকুর। রসিয়ে বলে, ‘মামা হুদা ডরাইছে!’
এমন সময় মুনের বুলা ফুফু আসেন। কাল রাতে তাঁর বাসায় মোরগ-পোলাও হয়েছে। মুনের জন্য নিয়ে এসেছেন। ভাইঝি বলতে তিনি অজ্ঞান। মুন তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগটা বগলদাবা করে নিয়ে যায়। বুলা ফুফুর ব্যাগে ওর জন্য ক্যাডবেরি থাকবেই।
বুলাকে দেখে তোয়ালে জড়ানো পিপুল লাজে জড়সড়। বুলাও বেশ অবাক। মুনের মাকে বলেন, ‘ভাবি, ওর এই অবস্থা কেন? হাইজ্যাকারের পাল্লায় পড়েছিল? আজকাল ওদের উৎপাত যা বেড়েছে!’
জালালের মা বলে, ‘তাইনে ইন্দুরের বাচ্চার ডরে ফ্যান্ট...’
এটুকু বলে মুখে আঁচল চাপা দেয় জালালের মা। বুলা নাক কুঁচকে বলেন, ‘এত বড় ছেলে, ইঁদুর ছানাকে ভয় পাবে কেন? ইঁদুর ছানা ভয় পাওয়ার কিছু হলো?’
জরুরি কাজ থাকায় মুনকে ডেকে টপাটপ চুমু খেয়ে চলে যান বুলা। মুনের মা পিপুলকে চেপে ধরেন, ‘না দেখেই ক্যাঙারুর মতো লাফালে কী হয়, দেখেছিস তো! কোথায় ইঁদুর ছানা বের কর।’
মামার দুরবস্থা দেখে মায়া হয় মুনের। সে আসল কথা বলে, ‘ইঁদুরের ছানা ছিল তো মা।’
মা বলেন, ‘বলিস কী! কই সেগুলো?’
‘প্রথমে টিস্যুবক্সে রেখেছিলাম। এ জন্যই তো শুকুর ভাই পায়নি।’
‘তারপর?’
কিছুতেই আর মুখ খোলে না মুন।
এদিকে জরুরি কাজে এক জায়গায় গেছেন বুলা। রিকশা ভাড়া দিতে যেই ব্যাগ খুলেছেন, অমনি হাঁ হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর পিলে চমকানো চিৎকারে পথচারীরা ছুটে এল।