‘প্রাগৈতিহাসিক’ জার্নি টু মানিকখালী: উইথ অর উইদাউট মানিক

‘প্রাগৌতিহাসিক’ এক যাত্রা। কথাশিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের এক নির্জন রেলস্টেশনের কাকতালীয় যোগ! কী হলো এরপর?

গেল মঙ্গলবারে (৩০ মে ২০২৩) একটা জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে যেতে হলো। ট্রেনে দুলে দুলে অলস যাত্রা। ঘর ছেড়ে বেরোবার পথে চট করে শেলফ থেকে একটা বই টেনে নিলাম, মানিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’। ‘প্রাগৈতিহাসিক’সহ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৯টি ছোটগল্প একমলাটে, এই শিরোনামে।

প্রায় প্রাগৈতিহাসিক এগারো সিন্ধুর এক্সপ্রেসে চড়ে বসে মনে হলো, কিছু না ভেবেই ব্যাগে পোর মলাটসঙ্গীটিই এ যাত্রার জন্য মোক্ষম। ডানে-বাঁয়ে দুলতে দুলতে জানালার ওপাশের ল্যান্ডস্কেপে যখন একটু ক্লান্তি এসেছে, বইটা খুললাম।

মানিকখালী রেলস্টেশনে স্টেশন মাস্টারের ছোট্ট কামরা
ছবি: লেখক

বনের ভেতর মাচা বেঁধে লুকিয়ে থাকা ভিখুর দগদগে ঘায়ের বর্ণনা শেষে ফাঁকা বাড়িতে পেহ্লাদের বউয়ের হাত চেপে ধরার অংশ আসতে না আসতেই পতপত করে পাতা উড়িয়ে, হাত ফসকে ট্রেনের জানালা গলে উড়ে গেল আমার নিমকহারাম যাত্রাসঙ্গী!
উড়তে উড়তে কি কোনো আলপথে গিয়ে পড়ল? কেউ কি খুঁজে পেল কালো-সবুজ মলাটের বইটাকে? এমন কোনো পড়ার টেবিলে কি জায়গা হবে ওর, যেখানে লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যাগুলোয় এখনো হারিকেন জ্বলে! ভাবতে ভাবতে গন্তব্য স্টেশনে এসে ট্রেন থামল।

কিছু স্টেশন থাকে না, শুধু ট্রেনের জানালায় বসে দেখার! যেখানে বড় ট্রেনগুলো থামে না, কেউ নামে না। ঠিক তেমন দেখতে মানিকখালী স্টেশন। চালচুলোহীন। মন খারাপ করা। আমরা এখানেই নামব।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রতিকৃতি মাসুক হেলাল

এক মানিক উড়ে গেলেও আরেক মানিকের (পড়ুন: মানিকখালী) দেখা মিলল। মানিকখালী রেলস্টেশনে পৌঁছেও উড়ে যাওয়া মানিককে (বন্দ্যোপাধ্যায়) কিন্তু মাথা থেকে উড়িয়ে দিতে পারছি না। চোখের সীমানার সবকিছুই কেমন ‘প্রাগৈতিহাসিক’ ঠেকছে। নদীর ধারের গঞ্জের বদলে কোনো স্টেশনে ভিখু-পাঁচীর আস্তানা হলে, নির্দ্বিধায় এই স্টেশন সেই জায়গা নিতে পারত। মুখে বলেও ফেললাম, কয়েকবার, ‘প্ল্যাটফর্মটা তো প্রাগৈতিহাসিক!’

এক মানিক উড়ে গেলেও আরেক মানিকের (পড়ুন: মানিকখালী) দেখা মিলল। মানিকখালী রেলস্টেশনে পৌঁছেও উড়ে যাওয়া মানিককে (বন্দ্যোপাধ্যায়) কিন্তু মাথা থেকে উড়িয়ে দিতে পারছি না। চোখের সীমানার সবকিছুই কেমন ‘প্রাগৈতিহাসিক’ ঠেকছে।

আমরা যেখানে যাব, সেই মূল গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তখন খোঁজ করা হচ্ছে বাহনের। আর এই অবসরে আমিও কিছু খুঁজছি মনে মনে। কোনো ডিস্ট্রাকশন—মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার উপায় আরকি। পেয়েও গেলাম ঠিক! ঝকঝকে রোদের সকালেও প্রায় অন্ধকার, লাল দেয়ালের স্টেশন মাস্টারের কামরা, এটাও দেখতে প্রায়-প্রাগৈতিহাসিকই!

ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির লাইনম্যানস সিগন্যাল বাতি, এখনো সচল
ছবি: লেখক

বাকি যাত্রার ঠিকানা বুঝে নিতে আমার বড় ভাই এর মধ্যেই সেই অফিসে দাঁড়িয়েছেন। ইতস্ততভাবে একটু পর আমিও  ঢুকলাম সেখানে। বুঝিনি, দরজার এই পাশে আসলে ভিন্ন টাইমজোন ছিল! আর সেখানেই ঢুকে পড়েছি আমি!

আমার চোখ ঘুরছে নানা যন্ত্রপাতিতে ঠাসা ছোট ‘প্রাগৈতিহাসিক’ ঘরটায়। ছোঁক ছোঁক সেই চাউনি আর তাতে সেঁটে থাকা কৌতূহল টের পেয়ে ভালো মানুষ স্টেশন মাস্টার ডান পাশের তাকে রাখা কাচ আর লোহার খোপের সিগন্যাল বাতির দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘এইটা ব্রিটিশ রেলওয়ের সম্পত্তি! এখনো এটাই ব্যবহার করি আমরা। এই ঘরের সব যন্ত্রপাতিই ব্রিটিশ আমলের। ১৫০ বছরের ওপর বয়স এইগুলার!’
বলে কী লোকটা! প্রায় ২০০ বছর আগের ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির (ইআইআর) যন্ত্রপাতি এই গণ্ডগ্রামে পড়ে আছে!

মানিকখালী স্টেশনের টিকিট কাউন্টার
ছবি: লেখক

তারপর স্টেশন মাস্টার সাহেব তাঁর পেছনের টেবিলে রাখা জমজ যন্ত্রগুলোর পরিচয় জানালেন। নাম সিগন্যাল ব্লকিং সিস্টেম। পুরোনো ‘স্টারওয়ার্স’ সিনেমার মাথামোটা রোবটগুলোর মাথার মতো দেখতে একদম! মানিকখালীর সঙ্গে এর আগের ও পরের দুটি স্টেশনের সংযোগ, লাইন, রেলগাড়ির এন্ট্রি আর একজিট নিয়ন্ত্রণ করা হয় এগুলোর নব ঘুরিয়ে। পুরো পদ্ধতিটাই ভেঙে বললেন তিনি। কোন নব, কোন সুইচ, কোন প্যানেলের কী কাজ। মন দিয়ে শুনিনি। চোখ আর মন যে শুধু ঘুরছে;এখানে-সেখানে।

সিগন্যাল ব্লকিং সিস্টেম। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া রেলওয়ের সম্পত্তি
ছবি: লেখক

স্টেশন মাস্টারের ছোট ঘরটাতেই একপাশে জানালা কেটে টিকিটঘর। একের ভেতর দুই! ঢাকা-চট্টগ্রামের বড় স্টেশনগুলোর মতো আলাদা ঘরের বড়লোকির সুযোগ নেই। স্টেশন মাস্টারের পাশেই তাই চেয়ার পেতে বসেন এখানকার (টিকিট) বুকিং ক্লার্ক। এবার তিনি মেলে দিলেন তাঁর শতবর্ষী বা তার চেয়েও পুরোনো টিকিট ক্যাবিনেট। পুরোটাই চকলেটরঙা কাঠের। বড় গ্রান্ডফাদার ক্লকের সঙ্গে আকারে মিল আছে। একটা টান দিতেই পাল্লাটার তিনটি ভাঁজ খুলে গেল। ভেতরে ছোট ছোট খোপে টিকিট রাখা; লোকাল ট্রেনের। এই স্টেশনে শনশন শব্দে প্রিন্টারের পেট থেকে বের হয়ে আসা টিকিটের বালাই নেই বোধ হয়। টিকিট ক্যাবিনেটে টোকা দিয়ে বললেন, ‘যেই কাঠ, আরও ১০০ বছরেও কিছু হবে না।’

আরও কী কী যেন বললেন দুজন মিলে। আমি ঠিক শুনতে পাইনি। আসলে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না খুব। মনে মনে তখন চাঁদের পাহাড়ের শংকরের ঘরে পৌঁছে গেছি যে! আফ্রিকার সেই প্রাগৈতিহাসিক স্টেশনঘরে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের এই মানিকখালীর খুব মিল!