লারনাকা শহরে এসে নেমেছি গতরাতে। লারনাকা সাইপ্রাসের রাজধানী নয়। তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এদের প্রথম বৃহত্তম শহর হলো নিকোশিয়া। দ্বিতীয়টি লিমাসল।
আমার হোটেলটি এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র মিনিট দশেক দূরে। একটা হ্রদের ধারে। ওরা বলে—লবণ হ্রদ। সমুদ্র থেকে একটা খাড়ির মাধ্যমে এ-হ্রদে জল এসে ঢোকে বলে এমন নাম। হ্রদের এধারে নিচু ভূমি, সর্ষে ফুলের মতো হলদে ফুলে সে জায়গাটি পূর্ণ। আর ওধারে পাহাড়। সেখানে বিশাল কিছু বায়ুকল। বিদ্যুৎ তৈরির চাহিদায় তারা অনবরত পাখা ঘুরিয়ে চলেছে। হ্রদটির জল নিথর। নিরুত্তাল। যেন থমকে আছে। সে জলে পড়েছে বায়ুকলের প্রতিবিম্ব।
আজ সকালে যাচ্ছি নিকোশিয়ায়। ঠিক কোন বাসটিতে উঠতে হবে, সেটি বলে দিয়েছিলেন হোটেলের ম্যানেজার। লোকটি সিরিয়ান। আলেপপো শহরের। কথা বলেন আরবি একসেনটে। বয়স ষাটের কোঠায়। সকালের হালকা ঠান্ডায় পরে ছিলেন জলপাই রঙের উলের সোয়েটার আর মাফলার। আমি যখন বাসের হদিস জানার জন্যে তাকে খুঁজছি, তিনি তখন বাইরের রাস্তায় একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলেন। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বললেন, হাউ ওয়াজ দ্যা ব্রেকফাস্ট, স্যার?
এ হোটেলের ব্রেকফাস্ট দেবার দায়িত্বে আছে এক ইউক্রেনিয়ান ভদ্রমহিলা। মুখে হাসি নেই। তবে মহিলা কাজ করেন ঝটপট। ডিমের ওমলেট খেতে চাইলে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ভেজে এনে টেবিলে রেখেছিলেন। তার সাথে আরও বেশ কয়েক পদের ফলমূল আর পানীয় তো ছিলই। তাই ব্রেকফাস্ট নিয়ে অভিযোগ জানাবার কোনো সুযোগ নেই। আমি নিকোশিয়ায় যেতে চাই শুনে বাসের নম্বর, ভাড়া ইত্যাদি পইপই করে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ছোট দেশ স্যার। চাইলে এ দেশের এক মাথা থেকে অপর মাথায় একবেলার মাঝেই চলে যাওয়া সম্ভব।
পাড়ার বাসস্ট্যান্ডে বাস—প্রতি ত্রিশ মিনিটে একটি। যাত্রী ছাউনিতে কোনো সময়সূচি টানানো নেই। তাই পরের বাসটি ঠিক কতক্ষণ পর এসে পৌঁছুবে, অনুমান করা মুশকিল। সে চেষ্টায় না গিয়ে আমি বরং মানুষ দেখি, আশেপাশের ভবন দেখি। একটি ছেলে হয়তো রাতের শিফটে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছে। ক্লান্ত অবয়ব। দেখে মনে হয়, ভারতীয়। হাতে থাকা ফোনে বাজছে গান। চোখদুটো পথে নিবদ্ধ নয়; ফোনের স্ক্রিনে। নেপালি চেহারার এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা এসে পাশে দাঁড়ালেন। হাতে নাইলনের ব্যাগ। উল্টোদিকের ভবনে বিশাল করে ফোন নম্বর লেখা। এই ফ্ল্যাট বিক্রি হবে—এমন কিছু বিজ্ঞাপন। আশেপাশে বেশ কিছু ফ্ল্যাটবাড়ি হচ্ছে। শ্রমিকরা কাজ করছে। ঠুকঠাক শব্দ ভেসে আসছে মাঝে-মাঝে। ওধারে কিছুটা দূরেই সমুদ্র। থাকবার জন্যে খাসা জায়গা। এদের মূল খদ্দের হয়তো ঠিক সাইপ্রাসের মানুষ নয়। বরং বিভিন্ন দেশের ধনী কিংবা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্যেই এত নির্মাণ। সাইপ্রাস এই কদিন আগেও টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব বিক্রি করত। তখন বাংলাদেশের মতো বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কালো টাকার মালিকরা কিংবা লেবানন-সিরিয়ার মতো যুদ্ধপীড়িত দেশের লোকেরা সে সুযোগ লুফে নেয়। সেই সাথে নিজেকে শরণার্থী দাবি করা লোকের ঢল তো আছেই। সে জন্যেই এই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটিতে আবাসনখাতের প্রবৃদ্ধি থেমে নেই।
কিছুটা দূরেই সমুদ্র। থাকবার জন্যে খাসা জায়গা। এদের মূল খদ্দের হয়তো ঠিক সাইপ্রাসের মানুষ নয়। বরং বিভিন্ন দেশের ধনী কিংবা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্যেই এত নির্মাণ। সাইপ্রাস এই কদিন আগেও টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব বিক্রি করত। তখন বাংলাদেশের মতো বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কালো টাকার মালিকরা কিংবা লেবানন-সিরিয়ার মতো যুদ্ধপীড়িত দেশের লোকেরা সে সুযোগ লুফে নেয়
বেশ কিছুটা সময় ওই ছাউনিতে অপেক্ষার পর যে বাসটি আমায় তুলে নিল, সেটি কিন্তু নিকোশিয়া অবধি যাবে না। ওটির শেষ দৌড় শহরের শেষমাথার সৈকত পর্যন্ত। আর আমাকে নেমে যেতে হবে ওল্ড হসপিটাল নামক স্টপেজে। ভাড়া দেড় ইউরো। ভাংতি দিলে ভালো। দেড় ইউরোর জন্যে দশ ইউরোর নোট বার করে দিলে ড্রাইভার খুব বেজার মুখে তাকায়।
ওল্ড হসপিটাল স্টপেজের অপর দিকে দু একটি মনিহারী দোকান। দোকানের সামনে ঝোলানো সামিয়ানার নিচে একদল নেপালি রমণী। অপেক্ষাকৃত কম বয়েসীদের চড়া মেকআপ। সাথে দলনেতাটাইপ একটি লোক। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে অনুমান করি, এই নেপালি মেয়েরা হয়তো এসেছে কম পয়সার কাজের সন্ধানে, আর সাথের লোকটি সেই কাজের দালাল টাইপ কিছু একটা।
এখানে আরও আধ ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর নিকোশিয়া যাবার বাস এসে দাঁড়ায়। সবুজ রঙের বাস। ভেতরে ঠাসাঠাসি অবস্থা। ড্রাইভার নিজেই ভাড়া বুঝে নিয়ে যাত্রী তুলছে। সেই নেপালি মেয়েদের দলটিও খলবল করতে করতে বাসে উঠে গেল। সিটে বসেই তাদের কয়েকজন শুরু করে দিল ভিডিও কলে কথোপকথন। কারো কথা হচ্ছে বহু দূরে ফেলা আসা মাতৃস্থানীয় কারো সাথে, আবার কেউবা ব্যস্ত ছেলেবন্ধুর সাথে রোমান্টিক আলাপে। আশেপাশের মানুষ কী ভাবছে, সে নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
দু লেনের মসৃণ হাইওয়ে। গাড়ির জটলা নেই। আধিক্য নেই। ফলে বাস চলেছে তুফানের বেগে। দুপাশে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে সাইপ্রেস গাছ। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রাম। অল্প কিছু বাড়িঘর। প্রতিটি বাড়ির ছাদে জলের ট্যাংক।
নিকোশিয়ার প্রধান বাসস্ট্যান্ডটি তেমন কোনো ব্যস্ত এলাকা নয়। বাসের জন্যে প্রতীক্ষারত যারা, একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়—সবাই বিদেশি। হয়তো আশেপাশের শহরে যাবে বলে অপেক্ষা করছে। মূল আদি শহরটা এই বাসস্ট্যান্ডের একপাশে। সেখানে ঢোকার আগে একটা বেকারিতে যাই। চালু দোকান। প্রচুর বিক্রি। চারদিকে জিনিসপত্র ছড়ানো। দাঁড়াবার তেমন জায়গা নেই। যে দুটো নেপালি মেয়ে কাজ করছে, খদ্দের সামলে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এই বেকারির পাশ দিয়ে পুরনো শহরে যাবার গলি। সেখানে অসংখ্য দোকানপাট। রেস্তোরাঁ। ক্যাফে। গায়ে গা লাগানো দোতলা সব বাড়ি। উপরের তলে কাঠের ব্যালকনি। খড়খড়ি জানালা। ছুটির দিন বলে এ পাড়ায় আজ ভিড় কিছুটা কম। শুধু একটি জায়গায় এর ব্যতিক্রম। টাউন হলের সামনে। ওখানে বাঁধানো সিঁড়ি। আশেপাশের ক্যাফেগুলো হলের সামনের চত্বরটাকে ব্যবহার করছে নিজেদের চেয়ার-টেবিল বসাবার স্থান হিসেবে। লোকে রোদের তলে বসে কফি খাচ্ছে, গপ্পো করছে, কবুতরের ওড়াউড়ি দেখছে। তাদের আলাপের ধ্বনিতে জায়গাটা মৃদু গমগমে। সেই ছোট্ট চত্বরের একেবারে মাঝখানে কাঠের একটি ফ্রেম। তাতে সুতো দিয়ে লটকানো সাদা ক্যানভাসের কাপড়। আশেপাশে কিছু মার্কার কলম। এগুলো রাখা হয়েছে যাতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত পথিকেরা নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু একটা লিখে যেতে পারে।
একজন প্রশ্ন রেখে গেছে—জীবনের প্রথম চুম্বনটা কোথায় কীভাবে করেছিলে? উত্তরে একজন লিখেছে—ইস্তাম্বুলে। আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে। আবার কেউ লিখেছে, স্কুলের এক পার্টিতে। সেদিন বান্ধবীকে নিয়ে লুকিয়ে ঢুকেছিলাম স্কুলের রান্নাঘরে। সেখানেই লুকিয়ে সেরে ফেলা প্রথম চুম্বন। তৃতীয়জন লিখেছে, লিথুয়ানিয়ায় আমাদের স্কুলের স্কাউট গ্রুপের একটা ক্যাম্পে। গহিন বনের মাঝে ছিল সেই ক্যাম্প। এভাবেই নানা মানুষ অকপটে রেখে গেছে নানা প্রশ্ন, স্পষ্ট স্বীকারোক্তি কিংবা জীবন সম্পর্কে জেগে ওঠা নানা অভিমত। এগুলো পড়তে ভালো লাগে একারণে যে, এখানে কোনো ভনিতা, ভণ্ডামি, লুকোছাপা নেই। আছে অগাধ অকপটতা।
একজন প্রশ্ন রেখে গেছে—জীবনের প্রথম চুম্বনটা কোথায় কীভাবে করেছিলে? উত্তরে একজন লিখেছে—ইস্তাম্বুলে। আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে। আবার কেউ লিখেছে, স্কুলের এক পার্টিতে। সেদিন বান্ধবীকে নিয়ে লুকিয়ে ঢুকেছিলাম স্কুলের রান্নাঘরে। সেখানেই লুকিয়ে সেরে ফেলা প্রথম চুম্বন। তৃতীয়জন লিখেছে, লিথুয়ানিয়ায় আমাদের স্কুলের স্কাউট গ্রুপের একটা ক্যাম্পে। গহিন বনের মাঝে ছিল সেই ক্যাম্প
এমন নানা অলি-গলি, বন্ধ শাটারের দোকান পেরিয়ে হঠাৎ দেখি—সীমান্ত। একটু বিচিত্র এ সীমান্ত। এককালে বার্লিন দেয়াল যেভাবে একটা শহরকে দুভাগ করে রচে দিয়েছিল দু দেশের সীমারেখা, অনেকটা সেভাবেই এখানে তৈরি হয়েছে অযাচিত এক সীমান্ত। শূন্যরেখায় থাকা ভূতুড়ে বাড়িগুলোর সিল করে দেওয়া দরজা-জানালা দেখলেই বোঝা যায়, কোনো এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দমকা হাওয়ায় হুটহাট উঠে গেছে এ দেয়াল। একই উঠোনে থাকা দু ভাই যেমন অনেক সময়ে ঝগড়া করে রাতারাতি তুলে দেয় সীমানার বেড়া, বুঝে নেয় নিজেদের ন্যায্য হিস্যা, এ যেন অনেকটা তেমন।
কাঠের লম্বাটে কাঠামো। সুড়ঙ্গের মতো। দু মাথায় দু পক্ষের লোক। বসে আছে ছোট্ট ঘরে। যারা আসছে, তাদের পাসপোর্ট স্ক্যান করে দ্রুত ছেড়ে দিচ্ছে। কেন এলেন, কী নিয়ে এলেন, কত দিন থাকবেন—এ জাতীয় প্রশ্ন কিংবা সিলছাপ্পড়ের ঝামেলা নেই।
অদূরের মসজিদে নির্মাণ কাজ চলছে। কংক্রিটবাহী ট্রাক, নির্মাণ শ্রমিকের ধুলোমাখা বুটজুতো আর ট্রাকের চাকার ঘর্ষণে উড়ে যাওয়া ধুলো—মসজিদমুখী সড়কটিকে আগলে রাখে। আমি ধুলোর হাত থেকে বাঁচতে জলদি পালাই পাশের এক ছোট গলিতে। সেখানে পা দিয়েই বুঝি—একেবারে মোক্ষম জায়গায় চলে এসেছি। এটা রেস্তোরাঁ পাড়া। ভাজাভুজির গন্ধ, উচ্ছিষ্টলোভী বেড়ালদের আনাগোনা, মেন্যুকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বয়-বেয়ারা একেবারে যেন পথ আগলে দাঁড়ায়। নিজের জন্যে হালকা রোদে পিঠ পাতা যায়, এমন একটা চেয়ার বেছে নিয়ে বসি। মেন্যুকার্ডটায় চোখ বুলাবার সময়ে খেয়াল করি, পাশের সরকারি ভবনে টাঙানো ব্যানার—সবাইকে পবিত্র রমজানের শুভেচ্ছা।
সেই একই বাসে করে ফিরে আসি—নিকোশিয়া থেকে লারনাকায়। এবারে নামি বাসটির শেষ স্টপে। এখানে পাশেই সমুদ্র। আন্দাজে বুঝি, এখান থেকে হোটেলে ফেরার জন্যে সকালে যেই লোকাল বাসটি ধরে এসেছিলাম, তার প্রয়োজন নেই। হাতে মেলা সময়। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চলা সড়কটি ধরে হেঁটে গেলেই মিনিট ত্রিশেক পরেই হয়তো পৌঁছে যাব।
অপরাহ্ণেও ঝকমকে রোদ। কেমন যেন ঢিলেঢালা দিন। সমুদ্রের উপর মাশরুমের মতো সাদা মেঘের ভেলা। একটু দূরে মালবাহী জাহাজ থেকে মাল নামাবার ক্রেন। সমুদ্রের ঢেউ থেকে উপকূলভাগকে রক্ষার জন্যে পাথরের স্তূপ। হোটেলে ফেরার রাস্তায় সরাসরি না নেমে লারনাকা শহরের এই পুরনো অংশের অলিগলিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে একটু ঘুরে বেড়াই। সেখানে চোখে পড়ে—ছোট্ট সেলুন। খদ্দের নেই। ফাঁকা চেয়ার। দোকান খোলা রেখেই নরসুন্দর চলে গেছে অন্য কোনো দোকানে আড্ডা মারতে। উল্টোদিকে ছাপাখানা। পুরনো আমলের মেশিনে ছাপা হচ্ছে হ্যান্ডবিল। কিছু স্যুভেনিরের দোকান। শামুক-শঙ্খে ভরপুর। এসব পেরিয়ে সাধু লাজারাসের চার্চ। বেলেপাথরে তৈরি কাঠামো। বাইরে থেকে দেখলে আন্দাজ করার উপায় নেই, এ চার্চের বয়স হাজার বছরের বেশি। আর সাধু লাজারাস—বাইবেল অনুযায়ী যাকে যীশু মৃত্যুর চারদিন পর দৈববলে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, এখানেই নাকি নিয়েছিলেন শেষ শয্যা। আয়তনে বিশাল আর ধর্মগত কারণে বেশ জাগ্রত পীঠ হলেও ভেতরে তেমন কোনো পুণার্থী নেই। দু একজন যারা আছেন, তারা পর্যটক। সাধু লাজারাসের আশীর্বাদ সঞ্চয়ী নন।
সাধু লাজারেসের চার্চের উল্টোদিকে একটা টংঘর। টুকিটাকি জিনিসের সাথে বিক্রি হচ্ছে সেদিনের সংবাদপত্র। গ্রিক ভাষার কয়েক পদের সংবাদপত্রের সাথে একমাত্র যে ইংরেজি পত্রিকা আছে, তার নাম সাইপ্রাস মেইল। দাম চাইল এক ইউরো ত্রিশ সেন্ট। বহুদিন এভাবে পত্রিকা স্ট্যান্ড থেকে নগদ টাকায় পত্রিকা কেনা হয় না। দীর্ঘ অনভ্যস্ততা ভাঙতে সেদিনের একটি সাইপাস মেইল কিনে দু কদম দূরের খাবারের দোকানে গিয়ে বসি। এখানেও আরেক নেপালি মহিলা দোকানের সামনের জায়গাটি ঝাড় দিচ্ছেন। আমাকে দেখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে—মাই বস, আউট সাইড—বলে রাস্তার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। বুঝলাম মহিলা বোঝাতে চাইছেন, যিনি অর্ডার নেবেন, তিনি একটু বাইরে গেছেন। আমি তাকে ঠিক আছে বলে সামনের টেবিলে সেই পত্রিকাটি ছড়িয়ে বসি। ভেতরের পাতাগুলো খুলতেই তৃতীয় পাতার মাঝামাঝি স্থানে একটা খবর পড়ে চমকে যাই। রিপোর্টে লেখা হয়েছে—সাইপ্রাসের পুলিশ এক মানবপাচারকারী চক্রকে সম্প্রতি ধরেছে। এরা নেপালি মহিলাদের গৃহকর্মীর কাজ দেবে বলে সাইপ্রাসে এনে পাচার করে দেয় পর্তুগালে। সেখানে গিয়ে এমন বেশ কিছু মেয়ে বিপদে পড়েছে। তারপর থেকেই পুলিশ ব্যাপারটি নিয়ে অনুসন্ধানে নামে।
দোকান-মালিকের ফিরে আসার অপেক্ষমাণ সময়টিতে ভাবতে থাকি, তবে কি আজ সকালে বাসে যে মেয়েগুলোকে দেখলাম, তারাও এমন কোনো দালালের খপ্পরে পড়া দল? মেয়েগুলো হয়তো বিরাট আশা নিয়ে এসেছে—এদেশে দুটো পয়সা আয় করে বাড়িতে পাঠাবে, কিন্তু শেষ অবধি যে ওদের ভাগ্যে কী আছে, সে শুধু ঈশ্বরই জানেন!