স্যুর ল্য বাংলাদেশ
শেষ বিন্দুতে
চলতি বছরের ৭ থেকে ১২ এপ্রিল প্যারিসে পালিত হয়েছে বাংলাদেশ সপ্তাহ ‘স্যুর ল্য বাংলাদেশ’। অনুষ্ঠানটি ফরাসি সরকারের তিনটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে আয়োজন করে। বাংলাদেশ সপ্তাহের শেষ দিন ছিল সাহিত্য অনুষ্ঠান। এতে অনেকের সঙ্গে অংশ নেন— লেখক। সে সময় প্যারিসের প্রখ্যাত কবরস্থান ‘পেরে লাসেজ’ দর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এ লেখা।
প্যারিসের রোদে ভাসা জমজমাট বিকেল। স্কয়ার, ক্যাফে আর বুলেভারের টেবিল-চেয়ার থেকে লাগাতার কথার বুদ্বুদ আর হাসির ফোয়ারা ছুটছে। গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি, সদ্য ফোটা রঙিন ফুল। আর এর উল্টো স্রোতের সওয়ারি আমি পায়ে পায়ে চলেছি বড় বড় গাছে ছাওয়া ছায়াপথে, পেরে লাসেজ কবরস্থানের দিকে।
গত মধ্যরাতে (৫ এপ্রিল) প্যারিস পৌঁছে আজ কবরখানা ভিজিট! আগে তো ল্যুভর, শঁজেলিজে বা রঁদ্যার খোলা-আকাশ মিউজিয়াম হবে! হোটেলে ফিরে বেডসাইড টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ডায়েরি খুলে ভাবছিলাম—এসব জায়গা থাকতে গোরস্তান কেন? কখনো কি ভেবেছি সবার আগে পেরে লাসেজ যাব? আদৌ যাব? সেদিন দুপুরে বাঙালি কুকের ব্রাউন রাইস আর মুরগির ঝোলের লাঞ্চ খেয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল আমাদের হোস্ট, থিয়েটার ন্যাশনাল ডি লা কলিনের ডিরেক্টর প্যাট্রিশিয়া। সে মধ্যদুপুরের আলোছায়া আলপনা আঁকা, নাক বরাবর রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, ‘এর পরেই পেরে লাসেজ। একদিন দেখে আসতে পারো।’ কথাটা শোনামাত্র আমার অস্থিরতা শুরু হয়। কে যেন কানের কাছে ভেঁপু বাজায়। জাহাজ ছাড়ার বাঁশি। আজই! এখনই! সেই বিকেলে ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ডিরেক্টর ফ্রাঁসোয়া হোটেল লাউঞ্জে বসে হাতমোছার কাগজে বড় করে লিখে দেন—পেরে লাসেজ! তখনই পুরোনো এক বন্ধু দেখা করতে আসে। খানিক বাদে ফ্রাঁসোয়া আর কবি কায়সার হক ভাইকে ‘বাই’ বলে কফিটেবিল ছেড়ে আমরা কবরস্থানের রাস্তা ধরি।
আগে তো ল্যুভর, শঁজেলিজে বা রঁদ্যার খোলা-আকাশ মিউজিয়াম হবে! হোটেলে ফিরে বেডসাইড টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ডায়েরি খুলে ভাবছিলাম—এসব জায়গা থাকতে গোরস্তান কেন? কখনো কি ভেবেছি সবার আগে পেরে লাসেজ যাব?
২.
তোমাকে আজিমপুর রেখে কত শত মাইল দূরের কবরখানায় খুঁজছি, অঞ্জন! বাহুতে ওজুর এপিটাফের উল্কি এঁকে কবরে শুয়ে আছ তুমি।
একদিন ইন্টারনেট থেকে আমাদের প্রিয় ফিল্ম ডিরেক্টর ইয়াসুজিরো ওজুর কবরফলক নামিয়ে দেখাল আমার জীবনসঙ্গী জাহিদুর রহিম অঞ্জন। একটা চৌকো গ্রানাইট পাথরে জাপানি বর্ণমালা (mu), যার অর্থ নাথিং। এই নাথিং বা নাথিংনেসের নিচে কংক্রিটের স্ল্যাবের এক পাশে সাজানো ফুলের তোড়া, আরেক দিকে বিয়ার, সাকেভর্তি নানা আকৃতির শিশি-বোতল।
তারপর, প্রায় দুই বছর আগে আমরা কুইন্সল্যান্ডের একটি আদিবাসী আইল্যান্ড দেখে ফিরছি। দিন শেষের ফেরি ধরার ভীষণ তাড়া। আমরা ছুটতে ছুটতে একটা কবরস্থান আড়াআড়ি পার হচ্ছিলাম, হঠাৎ একটি কবরে চোখ গেঁথে গেল। ফলকের নিচে নানা ব্র্যান্ডের মদের বোতল। ফারাওদের কবর যেমন রাজকীয় ঐশ্বর্যে বোঝাই হতো, এখন আর উপায় কী, কবরের ওপরেই তাই সাজিয়ে রাখা হয়েছে মৃতের সবচেয়ে প্রিয় আইটেম—মদের খালি শিশি-বোতল। অঞ্জন বলল—‘আমার কবরটা এভাবে সাজালে হয়।’ (যেন নিজেই নিজের কবর সাজাবে! বেঁচে থাকতে ঘর সাজানোর পুরো এখতিয়ার ছিল তো ওর।) কিন্তু অঞ্জনের মুখে মদ শব্দ শোনাটা আমার বহুদিনের অ্যালার্জি। লিভার সিরোসিসের পেশেন্ট তো ও। সেদিন ওকে কী বলেছিলাম মনে নেই, আমার মুখ ছিল কঠিন পাথর, চোখেও নিশ্চয় ভয়ানক কিছু ছিল!
একদিন ইন্টারনেট থেকে আমাদের প্রিয় ফিল্ম ডিরেক্টর ইয়াসুজিরো ওজুর কবরফলক নামিয়ে দেখাল আমার জীবনসঙ্গী জাহিদুর রহিম অঞ্জন। একটা চৌকো গ্রানাইট পাথরে জাপানি বর্ণমালা (mu), যার অর্থ নাথিং।
এর দুই বছর বাদে আজ ঘটা করে কবরখানায় ঢুকছি। নির্দিষ্ট কোনো কবর দেখতে নয়। মানুষের শেষ বিন্দুই আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শরীরটা আমার ভেসে বেড়ালেও অন্তরটা যে বিদ্ধ হয়ে আছে শেষ বিন্দুতে! সেখান থেকে অবিরল রক্ত ঝরছে।
৩.
পেরে লাসেজের সমাধিগুলো কত কিছুতে ভর্তি! ফুল, চুম্বন, টুকরো কবিতা, গানের কলি, গ্রাফিতি। পরলোকগত বিখ্যাত লোকদের প্রতি ভক্তকুলের তুমুল ভালোবাসার, সীমাহীন মশকরার মাথা খারাপ একেকটা প্রদর্শনী। খোয়া বাঁধানো পথে আচম্বিতে লাভলেনের মতো বাঁক। তবে এত ঘেঁষাঘেঁষি কবর যে ঘাস ও মাটির দেখা মেলে না। রাস্তার দুধারে শুধু উঁচু উঁচু গাছের সারি। আর গাছের সারির পেছনে নানা ডিজাইনের ছোট ছোট ঘর। এগুলোই আসলে কবর।
বাইরে নববসন্তের কোলাহল। ঝলমলে কোমল রোদ, নাতিশীতোষ্ণ বায়ু। দিকে দিকে শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠার চরম উচ্ছ্বাস। তা থেকে পেরে লাসেজে পা দিয়ে মনে হলো জীবনের অপর পারে এসে পড়েছি। সব রং মুছে গেছে। এ এক করাল বর্ণের পৃথিবী। মানে দৃশ্যপট পুরোই পাল্টে গেছে আরকি। এখানে রোদ পড়লেও বাতাস ঢোকে না। শেষ বিন্দু তো, সবকিছুই তাই স্থির, নিরানন্দ। বেশ কিছু ট্যুরিস্ট একা একাই ঘুরছে। দল বেঁধে এলেও কবরের ভেতরের মানুষগুলোর মতো একা। এ মৃত্যুপুরীতে প্রিয় কারও কবরফলক তালাশ করতে করতে কখন সঙ্গীহারা হয়ে গেছে, নিজেও হয়তো জানে না। বা কবর–দর্শনের জার্নিটাই হয়তো এমন, একা একাই করতে হয়। তার মধ্যে যতটুকু চাপা স্বর, ক্ষীণ আওয়াজ—তা শুধু মানুষের। অ্যামবিয়েন্ট সাউন্ড গভীর নৈঃশব্দ্যে যেন হারিয়ে গেছে। গ্রাফিতিই শুধু মৃতের হয়ে নানা ভাষায় কথা বলে...
লাইট মাই ফায়ার, দ্য লিজার্ড কিং, স্ট্রেইঞ্জ ডে—বিখ্যাত রক মিউজিশিয়ান জিম মরিসনের কবরের পাশের দেয়ালে চিত্রিত গানের কলি, রঙিন কালিতে অ্যালবামের নাম লেখা গ্রাফিতি। কবরজুড়ে বাসি আর তাজা ফুলের স্তূপ, ওলটানো ফুলদানি, হেলানো ওয়াইন বোতল। এসবের মধ্যে আগে নাকি কোকেনও রাখা হতো। বলা হয়, অতিরিক্ত কোকেন সেবনে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে জিম মরিসন মারা যান। প্যারিসের বাসার বাথটাবে তাঁকে মৃত পাওয়া গিয়েছিল। সেই একই বছর মানে ১৯৭১ সালে আমেরিকা ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমান মরিসন। তাঁর মৃত্যুর কারণ আর নিজের মতো বেঁচে থাকার জন্য দেশান্তর, এসবের অনুরণনই হয়তো তাঁর এপিটাফে—‘ট্রু টু হিজ ওন স্পিরিট’।
ঝলমলে কোমল রোদ, নাতিশীতোষ্ণ বায়ু। দিকে দিকে শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠার চরম উচ্ছ্বাস। তা থেকে পেরে লাসেজে পা দিয়ে মনে হলো জীবনের অপর পারে এসে পড়েছি। সব রং মুছে গেছে। এ এক করাল বর্ণের পৃথিবী।
অস্কার ওয়াইল্ডের সমাধিফলক চুম্বন-প্রতিরোধী কাচে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। লিপস্টিক-রাঙা চুম্বন। আর লিপস্টিকে আছে পশুর চর্বি, যা পাথরের গভীরে ঢুকে যায়। ঘষে ঘষে এর গ্রিজ সরাতে গেলে পাথরটাই ছিদ্রযুক্ত হয়ে পড়ে। তাই এই ব্যবস্থা। কাচের দেয়াল ছাপিয়ে বিশাল ডানাওয়ালা স্ফিংস মাথা তুলে আছে। উড়ন্ত সে। রানওয়েতে দৌড়ানো উড়োজাহাজের মতো খানিকটা আনুভূমিক তার উড়াল। প্রিয় অস্কার ওয়াইল্ড ডানাওয়ালা অ্যাঞ্জেলই বটে। দ্য পিকচার অব ডোরিয়েল গ্রে উপন্যাসে কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই কবি ও ঔপন্যাসিক?
ডোরিয়েল গ্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার (বেসিলের) মনে হয়েছিল—সামনে অনিবর্চনীয় দুঃখ আর অবর্ণনীয় আনন্দ অপেক্ষা করছে, যা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। বেসিল খুন হন ডোরিয়েল গ্রের হাতে। অস্কার ওয়াইল্ড খুন না হলেও লাঞ্ছিত হন, ফাটকে যান, নির্বাসিত হন নিজ দেশ থেকে। কয়েক বছর পর নির্বাসনে থাকাকালে প্যারিসে তাঁর মৃত্যু ঘটে। একসময়ের পার্টনার রবার্ট রস অস্কার ওয়াইল্ডকে ভোলেননি। এই সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ অ্যাসাইন করেন। অর্থেরও জোগান দেন। নিচে একটা চেম্বার রাখেন, যেখানে রবার্ট রসের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর দেহাবশেষ রয়েছে।
অ্যাঞ্জেলরূপী অস্কার ওয়াইল্ডের ওষ্ঠ, গাত্র থেকে লিপস্টিকের দাগ সরিয়ে ফেললেও এর স্মৃতি রোমন্থন এখনো জারি আছে। আছে কিছু ব্যথাতুর হৃদয়ের আকুতি—মৃত্যুর সময়ও যিনি ভেবেছেন ভবিষ্যতের মানুষ সমকামী, ‘বিকৃতমনা’ ভেবে তাঁর প্রতি ঘৃণা উগরাবে, এখন তাদের ভালোবাসা, পাথর-ক্ষয় করা চুমো দেখতে পাঁচ মিনিটের জন্যও যদি প্রিয় অস্কার ওয়াইল্ডকে মর্ত্যে ফিরিয়ে আনা যেত! তারপর না হয় তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন! চিরনিদ্রার রাজ্যে ফিরে যেতেন!
কবি, শিল্প সমালোচক গিয়ম অ্যাপলিনেয়ারের কবরের কী বিশদ বর্ণনা অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতা ‘অ্যাপলিনেয়ারের সমাধিতে’! সুনীল কবিতাটির দুর্দান্ত অনুবাদ করেছেন। অ্যালেন গিনসবার্গের নিউইয়র্কের বাসায় কবির সকাশে সেই ষাটের দশকে অনুবাদকর্মটি করা হয়, যা ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটিতে বলে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
‘অসমাপ্ত লিঙ্গের মতো এক খণ্ড পাতলা গ্রানাইট
পাথরে একটি ক্রুশ মিলিয়ে যাচ্ছে, পাথরে দুটি কবিতা একটি ওল্টানো হৃদয়।’
হ্যাঁ, একদম তাই। এখনো আচারের বয়ামে ফুল। ফুলের নৈবেদ্য।
সাপের মতো গাছের যে গুঁড়িতে গিনসবার্গ কাব্যগ্রন্থ অ্যালকুনস হাতে বসেছিলেন, সেই গুঁড়িটা মনে হয় পাশের কবরের আড়ালে চলে গেছে।
প্রিয়জন বা কাছের মানুষের কবরের কাছে গেলে নিশ্চিত মনে হয়—আমিও একদিন মারা যাব। খানিক কবরের পাশে বসে থাকলে বা চেয়ে থাকলে কবরের দিকে, তখন মনে হয়—
‘এখানে আমার কবর হয়েছে এবং আমার কবরের পাশে গাছের নিচে বসে আছি।’
৪.
সবকিছুর পর পেরে লাসেজের বিশাল ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়াতেই হয়। হ্যাঁ, এটি সব মানুষের কবরফলক ‘মৃতদের মনুমেন্ট’। বেদনা, সৌন্দর্য, আর স্পষ্টতই গভীর আতঙ্কের প্রতীক। ব্যক্তিমানুষের কবরগাত্রের বিচ্ছিন্ন শোকসন্তাপ, ভালোবাসা-তর্পণ বা অবহেলা চাক্ষুষ করার পর এটি যেন দেহমনে অকস্মাৎ মৃত্যুর আগ্রাসী ছোবল। ‘সকলকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে’, আমাদের কবরস্থানের দেয়াললিখন এই অমোঘ বাণীর মতো।
আলবার্ট বার্থোলোমের বিশাল দ্বিতল ভাস্কর্য (নির্মাণকাল ১৮৯৫-১৮৯৯) ‘মৃতদের মনুমেন্ট’। এর উপরিতলে আছে শেষযাত্রার চিত্রায়ণ। মৃত্যু যে যবনিকা টেনে দেয়, তার আগমুহূর্তটি যেন ধরা হয়েছে ওপরতলায়। এক জোড়া নারী-পুরুষ সবে মর্ত্যের দরজা পেরিয়ে যাচ্ছে চির আঁধারের রাজ্যে। দরজার দুধারে সাতটি করে ফিগার। মাটিতে লুটিয়ে কী বিলাপ করছে ওরা? বেদনায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেউ? মৃত্যু–আতঙ্কে নিজেকে লুকাতে চাইছে? শোকে-বেদনায় জড়িয়ে ধরছে একে-অপরকে? গভীর মমতায় বুকে টেনে নিচ্ছে শোকার্ত ভালোবাসার মানুষটিকে?
মৃত্যুকে ঘিরে ফিগারগুলোর মানবীয় অভিব্যক্তি, ভঙ্গিমায় কী অপার বেদনা, নিঃশব্দ হাহাকার!
নাকি ওরা বিপন্ন আত্মারই প্রতীক? যে আত্মারা নশ্বরতার বিরুদ্ধে বিধাতার কাছে খেদ জানায়!
সব মানুষের কবরফলক ‘মৃতদের মনুমেন্ট’। বেদনা, সৌন্দর্য, আর স্পষ্টতই গভীর আতঙ্কের প্রতীক। ব্যক্তিমানুষের কবরগাত্রের বিচ্ছিন্ন শোকসন্তাপ, ভালোবাসা-তর্পণ বা অবহেলা চাক্ষুষ করার পর এটি যেন দেহমনে অকস্মাৎ মৃত্যুর আগ্রাসী ছোবল।
তবে ওপরতলার ভাস্কর্য যে মাত্রায় ভয়ার্ত করে, সে তুলনায় নিচেরটা আধ্যাত্মিক চেতনাসঞ্চারী। হ্যাঁ, এখানেও শিশুসন্তানসহ মা–বাবা কবরে শায়িত। কিন্তু তাদের পাশে উপবিষ্ট যে নারী, তাঁর হাত দুটি ডানার মতো ছড়ানো। তিনি আশীর্বাদ করছেন বা পুনরুত্থানের মন্ত্রপাঠ করছেন সম্ভবত। অন্ধকারে মৃতদের একা ছেড়ে যাচ্ছেন না। জীবনের অপর পারে তিনি যেন আশ্বাস হয়ে আছেন।
তাজমহলের সৌন্দর্য, ইতিহাস যেভাবে মৃত্যুভয়, মৃত্যুচেতনাকে আড়াল করে রাখে, আমরা মমতাজ মহলকে সালংকারা, মিনার আকৃতির মুকুটে সজ্জিত ভাবতে থাকি, এ সে রকম নয় মোটেও। বরং সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কিছু, যা মৃত্যু-যন্ত্রণা, শোক, হাহাকার আর আতঙ্কের ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করায়।
৫.
পরিশ্রান্ত আমি মনে মনে একটুখানি বসার জায়গা খুঁজছিলাম। পেরে লাসেজের মেইন গেট দিয়ে বেরোনোর আগে সবুজ ঘাস, রঙিন ঘাসফুলের একটি পরিপাটি চাতাল। মনে হলো এখানে বাতাস অবমুক্ত হয়েছে। জীবনের সুর লেগেছে এর মৃদু গুঞ্জনে। আমি চাতালের শানের বেদিতে বসে পড়ি। সামনে বাঁকা খিলানযুক্ত একটা লম্বা বাড়ি, যার সামনের দেয়ালে ছোট ছোট কবুতরের খোপ। পুরোনো বন্ধুটি ফিরে এসে জানাল—এই খোপগুলোতে লেখা একেকজনের নাম-ঠিকানা-পরিচয়, যাদের দেহাবশেষ খোপযুক্ত দেয়ালের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত আছে।
আমরা এখনো মৃত্যুপুরীতে! তা বলে জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার কোনো চাড় নেই আমার। স্নিগ্ধ ঘেসো জমি আর রঙিন ফুলবাগানে দিন শেষের সোনারঙা রোদ মেখে বসে থাকি। এটি জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে, পেরে লাসেজের প্রবেশদ্বার। এখানে অনন্তকাল বসে থাকা যায়।