পেরুর ইনকা ট্রেইলের প্রাইভেট এই ক্যাম্পসাইট আদিবাসী কেচোয়া কৌমের গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে, গাছপালায় সমাচ্ছন্ন বনানীতে। গোত্রপতি গোছের মানুষজন এখানে তাঁবু প্রভৃতি খাটানোর বন্দোবস্ত করে দেন বটে, তবে তাঁরা চান না, পর্যটকেরা তাঁদের গ্রামে আওয়ারা ঘুরে বেড়াক, কিংবা কারণে-অকারণে সেলফি তুলে আমোদ পাক। সাইটটি ইনারা চালাচ্ছেন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে। মুসাফিরদের নিরাপত্তা এঁরা বিধান করেন বটে, তবে পোর্টার মারফত বয়ে আনা তাঁবু যেমন খাটানো যায় না, তেমনি নিজ উদ্যোগে রান্নাবান্না করাটাও সম্পূর্ণ নিষেধ। সুতরাং তাদের খাটানো তাঁবু ভাড়া করে বিশ্রাম করতে করতে ইনতেজার করতে হয়, কখন আদিবাসীদের হেঁশেল থেকে জোগান দেওয়া হবে খানাপিনার।
আজও আমরা প্রত্যাশিত যাত্রাপথের অর্ধেকটা অতিক্রম করেছি। বনানীর আবডালে আবরু করা তাঁবুতে তাঁবুতে, সাফসুতরো বিছানাপত্তর দেখতে পেয়ে আমার সহযাত্রীরা ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। ভ্রমণসঙ্গী কেভিনের টেন্ট থেকে শোনা যাচ্ছে, অনুনাসিক স্বরে নাক ডাকানোর অনুচ্চ শব্দ। অন্য ভ্রমণসাথি গ্রেইসও পদ্মাসনে বসে বোধ করি মেডিটেশনের পুষ্পকরথে পাড়ি দিচ্ছে, মহাশূন্যের অলীক কোনো তেপান্তরে।
না, বিশ্রাম নিতে পারি না আমি। সত্তাজুড়ে জলবিছুটির প্রদাহের মতো অজানা এক অস্থিরতা আমাকে উত্ত্যক্ত করলে, চুপিসারে বেরিয়ে আসি টেন্টের বাইরে। চরাচরে হালকা রোদ, আকাশে মৃদুলয়ে ভেসে যাচ্ছে নীলচে-সাদা মেঘদল, তাতে ঝোপঝাড়ে চলমান ছায়া যেন বোলাচ্ছে কালচে-ধূসর চামর; সন্ধ্যার এখনো ঢের বাকি।
অপরাহ্ণের তামা ঝলসানো রুশনিতে ছুটির ঘণ্টা পড়া বালক-বালিকাদের মতো কলকল করে ফুটে উঠছে চারদিকে, মিরাবিলিস জালাপা নামে একধরনের বর্ণিল ফুল। পাশ্চাত্যের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এ পুষ্পের আদি নিবাস হিসেবে পেরুকে শনাক্ত করে উনিশ শতকের পয়লা দিকে এর নামকরণ করেছিলেন ‘মার্ভেল অব পেরু’ বলে, ঠিক বুঝতে পারি না—কোন প্রক্রিয়ায়, কার জাহাজে চড়ে এটি আমার স্বদেশে এসে রূপান্তরিত হলো সন্ধ্যামালতীতে।
একসঙ্গে হাজারখানেক সন্ধ্যামালতীর কোরক বিস্ফোরিত হয়ে ফুটে ওঠার সম্মোহনে আমার তব্দা লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়! দেখতে দেখতে এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে আসা বিপ্লবী গেরিলাদের মতো একঝাঁক প্রজাপতি। এরা অ্যাগ্রেসিভভাবে হুল ফুটিয়ে সংগ্রহ করছে মধুরিম নেক্টার। একাকী বসে বসে হুলভারে প্রকম্পিত ফুলদলের দিকে খামোকা চেয়ে থাকতে ভালো লাগে না। ইচ্ছা হয় পুরো এলাকাটা ঘুরেফিরে চষে ফেলতে। আমার অস্থিমজ্জা ও পেশিতে চনমনে এনার্জির অনুরণন টের পেয়ে সচেতন হই যে, ঘণ্টাখানেক আগে কেভিনের দেওয়া ডেকসিড্রিন ড্রাগটি শোণিতে তৎপর হয়ে উঠেছে, অর্থাৎ আপাতত বিশ্রাম নেওয়া যাবে না, আই মাস্ট বি ডুয়িং সামথিং।
ভাবি, খানিকটা সামনে হেঁটে গিয়ে স্প্যানিশ নারী এল-নোরাকে হ্যালো বলা যায়। এ ক্যাম্পসাইটে ঢোকার মুখে তাকে তাঁবুর দোরগোড়ায় বসে থাকতে দেখেছি, তার ডার্ক চকলেটের সাপ্লাই ফুরিয়েছে, কয়েকটি চকলেটবার নিয়ে গেলে সম্পর্ক মজবুত হয়।
ওর সঙ্গে মিলেঝুলে আমি লিমা নগরীতে ওয়ারি গোত্রের নির্মিত একটি পিরামিড দেখতে গিয়েছিলাম। তখন কথাবার্তায় জানতে পারি, এল-নোরা মাদ্রিদ পুলিশের ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে স্কেচ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করছে। অপরাধীদের বর্ণনা শুনে সে কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলতে পারে তাদের মুখচ্ছবি।
এ ধরনের চাকরিতে ঝুঁকি অনেক এবং স্ট্রেসও প্রচুর। চাপ প্রবল হলে এল-নোরা কোনো না কোনো দেশে বেড়াতে যায়। আজকাল ঘুরে বেড়ানোর বিবরণ দিয়ে সে ট্রাভেল এথনোগ্রাফি ধাঁচের গবেষণাভিত্তিক ভ্রমণগদ্যও লিখতে শুরু করেছে। তুরস্কের কাপাডোকিয়া অঞ্চলে ভ্রমণ নিয়ে সে একটি লেখার ড্রাফট আমাকে পড়তে দিয়েছে। আমি ব্যাকপ্যাকে তা পুরে নিয়ে উঠে পড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে আমি এল-নোরার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও তার পরিবারের আদি নিবাস নিয়ে ভাবি। সাংস্কৃতিক পরিচয়ে এল-নোরা স্পেনের বাস্ক্ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। ইউরোপের বাস্ক্ নৃগোষ্ঠীর মানুষজন বসবাস করে, স্পেন ও ফ্রান্সে বিস্তৃত পিরোনিজ পর্বতমালার পাদদেশে। এল-নোরার প্রপিতামহের পারিবারিক বাড়িটি ছিল ‘গোয়ের্নিকা’ নামক একটি ছোট্ট শহরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার বছর দুয়েক আগে, স্পেন দেশে স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্র্যাংকোর বিরুদ্ধে দানা বেঁধেছিল তুমুল প্রতিরোধ। এ গৃহযুদ্ধে ফ্র্যাংকোর সহায়তায় এগিয়ে আসে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। তারা প্রতিরোধে শরিক হওয়া, স্বাধিকারপ্রিয় বাস্ক্দের ‘সমুচিত শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য বেসামরিক শহর গোয়ের্নিকায় বর্ষণ করে বেধড়ক হারে বোমা, তাতে নিহত হয়েছিল ১ হাজার ৬৪৫ এবং আহত হয়েছিল ৮৮৯ জন। এদের অন্তর্ভুক্ত ছিল এল-নোরার পরিবারে তার পিতামহসহ মোট তিনজন নিকটাত্মীয় ও তাদের পাড়ার ৫৭ জন বাস্ক্ মানুষ।
যুদ্ধ-বিরোধিতার আইকন হিসেবে পরিচিত পাবলো পিকাসোর (১৮৮১-১৯৭৩) আঁকা চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকার’ সঙ্গে অনেক বছর ধরে আমার পরিচয়। এ নামে বাস্ক্ জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত একটি শহরের কথাও শুনেছিলাম, ওখানকার কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবে, তা কখনো কল্পনাও করিনি।
লিমা নগরীর গেস্টহাউসে এল-নোরার সঙ্গে সাক্ষাতের পয়লা প্রহরে, তরুণীটি গোয়ের্নিকা নামের চিত্রকর্ম সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে আমাকে ইমপ্রেস করে। বোমা বর্ষণে ম্যাসাকারের রিপোর্ট নাকি বেরিয়েছিল, ব্রিটিশ সাংবাদিক জর্জ স্টিয়ারের বিবরণীতে দ্য টাইমস পত্রিকায়। চিত্রকর পিকাসো রিপোর্টটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, ‘গোয়ের্নিকা’ শীর্ষক অসামান্য চিত্রটির অঙ্কনে। কফির পেয়ালা খালাস হওয়ার আগেই, এল-নোরা মাদ্রিদ বেড়াতে গেলে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাকে উদ্দীপ্তও করেছিল। মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্ক জারি রাখার প্রয়োজন আমার আছে।
এল-নোরার তাঁবু অব্দি পৌঁছে দম নিতেই অনুভব করি, অপরাহ্ণের রোদ মৃদু হয়ে প্রান্তর ভরে উঠছে সোনালি আভায়। দখিনা হাওয়াও বয়ে আনে ঝরা জেসমিনের সুরভি। তাঁবুর চেইন খুলে, ‘এনকানতাদো ডে ভেরতে’, বা ‘লাভলি টু সি ইউ’ বলতে বলতে বেরিয়ে আসে এল-নোরা। সিসল্ট ও কাজুবাদামের মিশেল দেওয়া কয়েকটি চকলেট-বার পেয়ে, রোদ-পড়া চারাগাছটির মতো চোখমুখে খুশির প্রচ্ছন্ন ছটা ছড়িয়ে সে ইসপানিক কেতায় সামাজিক চুমোর জন্য বাড়িয়ে দেয় তার গণ্ডদেশ; এবং অন্তরঙ্গতা শেষ হওয়ার আগেই প্রশ্ন করে, লেখায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় প্রতিফলন?
অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, ‘এই যে চুমো খেলাম, মনে হলো অন্য একজনকে প্রতারিত করেছি... ইউ মে অ্যাড দিস কাইন্ড অব অনেস্ট ফিলিং ইন ইয়োর রিফ্লেকটিভ রাইটিং।’
প্রতিক্রিয়া জানায় সে দ্রুত, ‘লিসেন... কেয়ারফুলি... এ অব্দি যাকে যাকে আমি চুমো খেয়েছি, তারা সকলে আমাকে প্রতারিত করেছে... অ্যান্ড ইট ইজ নট দ্যাট ইজি টু রাইট অ্যাবাউট দিস।’
আলোচনার মোড় ফেরানোর জন্য কাপাডোকিয়া নিয়ে লেখা তাঁর ভ্রমণ রচনাটির প্রিন্ট আউট খুলে, মার্জিনে প্রশংসাসহ আমার হাতে হাইলাইট করা একটি প্যারাগ্রাফ দেখাই, যেখানে কাপাডোকিয়া সফরে দেখা হওয়া একটি তুর্কি তরুণীর জীবনের ট্র্যাজিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে—প্রতিতুলনায় এল-নোরা নিজ জীবনের কিছু তথ্য শেয়ার করেছে।
ষোলো বছর বয়সে ডেট-রেপের শিকার হয়েছিল এল-নোরা। কিন্তু তথাকথিত বয়ফ্রেন্ডের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সাহস পায়নি, ফলে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছিল, সে যুগের স্পেনে গর্ভপাত শুধু অবৈধ না, ক্রাইমও। কারারুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কার কথা জানতে পেরে, তাকে পালিয়ে প্যারিস গিয়ে অ্যাবরশনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
মন্তব্য করি, ‘মাত্র কয়েক লাইনে তুমি শুধু তোমার জীবন নিয়ে প্রতিফলন করোনি, তুর্কি একটি তরুণীর জীবনের ট্র্যাজিডির সঙ্গে আজানা এক পাঠকের চিন্তাভাবনার সংযোগও ঘটিয়ে দিয়েছ।’
এ পর্যন্ত বলে আমি একটু দম নিই, তারপর সাতপাঁচ ভেবে বলে ফেলি, ‘তোমার কথা তো ফ্র্যাংকলি বললে এল-নোরা, এবার তুমি যদি একটু সাহসী হও, আর তোমার পিতা-মাতা সম্পর্কে সামান্য একটু বলো, তোমার পাঠককে তুমি পূর্ণাঙ্গ একটি পিকচার দিতে পারবে।’
নিমেষে উজ্জ্বলতা মুছে গিয়ে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডল। সামান্য সময় নীরব থেকে চোখে ক্রোধের বিদ্যুৎ ফুটিয়ে সে বলে, ‘বাবার সঙ্গে বালিকা বয়স থেকেই আমার যোগাযোগ নেই। পেশা হিসেবে সে পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরি করে। আর মা মরক্কোর টানজিয়ার্স থেকে হাশিশের চালান নিয়ে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ঘানি টানছে।’
এ পর্যন্ত বলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে কী যেন ভাবে, তারপর প্রশ্ন করে, ‘হোয়াট ফাক শ্যুড আই রাইট অ্যাবাউট দেম, জাস্ট টেল মি সুলতান?’
জবাব দিই, ‘যদি চাও, যতটা আমাকে বললে, তা লিখতে পারো... আবার না লিখতে চাইলে—নাই-বা লিখলে, অপশন ইজ ইয়োর্স, এল-নোরা।’
‘আই নিড টু থিঙ্ক অ্যাবাউট দিস, সুলতান’, বলে আলোচনার সমাপ্তি ঘটিয়ে সে মুখে পোরে ডার্ক চকলেটের একটি টুকরা।
‘আস্তা লা ভিস্তা’, বা ‘সি ইউ লেটার’, বলে উঠে পড়লে, এল-নোরা আমাকে কাছাকাছি গোসলের একটি ফেসিলিটি সম্পর্কে ডিটেইলস কিছু তথ্য দেয়। কেচোয়া পুরুষের সঙ্গে বিবাহিত এক মার্কিন দেশীয় নারী, আদিবাসীদের গ্রাম থেকে সামান্য দূরে গড়ে তুলেছে ফার্মহাউসের মতো একটি বাড়ি। ওখানে পয়সার বিনিময়ে শুধু উষ্ণ জলে স্নান নয়, সেলফোন প্রভৃতি চার্জ-আপ করারও ব্যবস্থা আছে। আমি রওনা হই ওই দিকে।
হেঁটে যেতে যেতে এল-নোরার সঙ্গে আমার চেনা-জানার পয়লা দিককার ঘটনা নিয়ে ভাবি। লিমা নগরীর পর্যটক উপদ্রুত বারাংকো এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় বেশ রাত করে আমরা ডিনার সারতে গিয়েছিলাম। এল-নোরা ডে-ট্রিপে লিমা নগরীর বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। আমি ডেজার্ট-ওয়েসিস নামে পরিচিত মরুপল্লি ওয়াকাচিনার নাম সুপারিশ করেছিলাম।
ইনস্টাগ্রামের অসিলায় পিকচারাস্ক গ্রামটির অসামান্য নৈসর্গিক শোভা সম্পর্কে এল-নোরা ওয়াকিবহাল ছিল। আমার প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে মেয়েটি চিজ-কেকের স্বাদ চাখতে চাখতে সেলফোনে কেটেছিল, ‘পেরু হপ’ কোম্পানির দুটি বাস টিকিট। টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়ে কাঁটায় কাঁটায় সকাল ছয়টায়। এল-নোরা কোনো এক অ্যাপের মারফত ট্যাক্সিও বুকিং করে ফেলে দ্রুত।
পরদিন কাকভোরে ট্যাক্সির জন্য মিনিট বিশেক অপেক্ষা করে, বিকল্প হিসেবে চটজলদি উবারের বন্দোবস্ত করতে না পেরে, আমাদের অতঃপর বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে ধরতে হয়েছিল ইয়েলো ক্যাব। টিপসের প্রণোদনায় ড্রাইভার প্রবল গতিতে ক্যাব চালিয়ে আমাদের টার্মিনালের তোরণ অব্দি পৌঁছেও দিয়েছিল, কিন্তু পেরু হপের ঝাঁ-চকচকে কোচখানা ততক্ষণে টার্মিনাল ছেড়ে এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা।
মরুপল্লি ওয়াকাচিনার বাসটি মিস করে মুড খারাপ হয়ে ওঠে এল-নোরার। ‘এসটয় মলেসতো’, বলে আমার বোঝার সুবিধার জন্য ইংরেজি তরজমায়, ‘ম্যান, আই অ্যাম স্ক্রুড, টোটালি স্ক্রুড,’ বলে কাতরস্বরে আওয়াজ দিয়ে সে বসে পড়ে টার্মিনালের একটি বেঞ্চে।
আমি প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ‘ড্যাম ইট, আই নিড সাম পারসোনাল টাইম,’ বলে এল-নোরা মুখে পুরে ডার্ক চকলেটের একটি টুকরো, তারপর সেলফোনের স্ক্রিন দিয়ে আড়াল করে তার ক্রোধে তপ্ত মুখমণ্ডল।
সরে এসে ফুটপাতে হাঁটাহাঁটি করে উপায় খুঁজি স্ট্রেস ম্যানেজ করার। হঠাৎ করে সড়কে পার্ক করা এক জোড়া বেবিট্যাক্সি দেখতে পেয়ে মেজাজ প্রসন্ন হয়ে ওঠে। বালক বয়সের প্রিয় এ বাহনটিতে সর্বশেষ কবে কোথায় সওয়ার হয়েছি, তা ভাবার চেষ্টা করি। বাবলগাম চিবুতে চিবুতে বয়স্ক বেবিট্যাক্সিওয়ালা নেমে এসে আমার সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দেন। সারা দিনের কড়ারে তুলনামূলকভাবে অল্প পয়সায় তাঁকে ভাড়া করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
ততক্ষণে উঠে এসে সড়কে আমাকে খুঁজছে এল-নোরা। বলি, ‘ডু মি আ ফেভার ইয়াং লেডি, অনুগ্রহ করে কিঞ্চিৎ কোম্পানি দাও আমাকে, আমি তোমাকে কমসে কম দেড় হাজার বছরের পুরোনো একটি পিরামিড দেখাতে নিয়ে যেতে চাই।’
বিস্মিত হয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় সে, ‘হোয়াট স্টুপিড পিরামিড আর ইউ টকিং অ্যাবাউট, সুলতান?’
জবাব দিই, ‘পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনাটি পরিচিত হুয়াকা পুকইয়ানা নামে। ইমাজিন আ হিউজ বিগ পিরামিড ইন দ্য ডেড স্ম্যাক সেন্টার অব দিস মেট্রোপলিটন সিটি!’
বেবিট্যাক্সিওয়ালা স্বয়ং এগিয়ে এসে, তাকে এসপানিওলে বাহনে আসন গ্রহণ করে বাধিত করতে আহ্বান জানালে, মেয়েটির বিষণ্ণতা বিবর্তিত হয় কৌতূহলে।
প্রৌঢ় বেবিট্যাক্সিওয়ালা পিরামিডের পথটি সম্পূর্ণ এভোয়েড করে আমাদের নিয়ে আসেন, দিশি মদের দোকানের মতো বেজায় ক্যাওস-ক্যাচালে পরিপূর্ণ একটি রেস্তোরাঁয়। ওখানে হাঁকডাকে একটি টেবিলের বন্দোবস্ত করে জানান, পিরামিডের স্থাপনার আশপাশের দোকানপাট-জাদুঘর প্রভৃতি খুলতে এখনো ঢের বাকি, আর নাশতা-টাস্তা না সেরে এমন ভোরবিহানে ওখানে গিয়ে হাজির হওয়াটাও রীতিমতো বেআকলামিও।
ততক্ষণে রবীন্দ্র ছোটগল্পের সমঝদারদের প্রিয় চরিত্র বলাইয়ের মামাবাবুর মতো দেখতে, কাঁচাপাকা গোঁফের সুদর্শন বেবিট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে এল-নোরার ভাব হয়ে গেছে। সে একটি চকলেটবার তাঁকে অফার করে এসপানিওলে জোরেশোরে বাতচিত শুরু করে। খেয়াল করি, মেয়েটি কথা বলতে বলতে সিরিয়াস মুখে নোটবুকেও টুকে নিচ্ছে ভ্রমণবিষয়ক জরুরি তথ্য।
আমি ব্রেকফাস্টের অর্ডার করার চেষ্টা করি, দুহাত তুলে আমাকে অস্থির না হতে উপদেশ দিয়ে, কিছুক্ষণ পর, গলায় তোয়ালে প্যাঁচানো ওয়েটার নিয়ে আসেন, পার্পেল কর্নের প্যানকেইকের সঙ্গে প্রকাণ্ড দুটি অমলেট, যার ওপরে শোভা পাচ্ছে, ফালি ফালি করে কাটা আবাকাডো।
বেবিট্যাক্সিওয়ালা তাদের চেনা ব্যক্তি, আন্ডা-ভক্ষণে তাঁর অ্যালার্জি আছে, সুতরাং তাঁকে পরিবেশন করা হয়, জবাই করা মুরগির রক্তে প্রস্তুত সাংগ্রেসিতা নামে একধরনের খাবার। ওয়েটার সবার প্লেটে গুঁড়ো-চিজ ছড়িয়ে দিয়ে ফের উপদেশ দেন, ভালো করে চিবিয়ে খেতে, খানিকটা হজম হলে পর তিনি মগভর্তি কফি সরবরাহ করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। খাবারের নলা মুখে তোলার আগে, আমার পাতে রক্তাক্ত সাংগ্রেসিতা পরিবেশন না করার জন্য নীরবে স্রষ্টার দরবারে শুকরিয়া জানাই।
উদ্দিষ্ট পিরামিডটির অবস্থান মিরাফ্লোরেস নামক লিমা নগরীর আপস্কেইল এক নেইভারহুডে। ওদিকে এসে বেবিট্যাক্সিওয়ালা বাহনখানা দাঁড়া করান, চকমিলান এক ক্যাথেড্রালের সামনে। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, পিরামিড চত্বরের গেটে তালা ঝুলিয়ে, ওখানে পুরাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় চলছে সংরক্ষণের মেরামতকাজ, পর্যটকদের আপাতত ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে ও নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, লাঞ্চ আওয়ারে খুলবে পিরামিডের একদম দেয়ালঘেঁষা একটি রেস্তোরাঁ, ওটিতে বসতে পারলে ক্লিয়ার ভিউ পাওয়া যাবে, ছবিটবি তুলতেও কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের তিনি এ সুযোগে ক্যাথেড্রালটি দেখে নিতে উৎসাহিত করে আশ্বস্ত করেন, এ ফাঁকে তিনি মোবাইলে পপুলার রেস্তোরাঁটিতে একটি টেবিল বুকিং দিয়ে রাখবেন।
ঔপনিবেশিক স্থপত্যকলায় নির্মিত ক্যাথেড্রালটি শুধু বিরাটই না, দৃষ্টিনন্দনও। আমরা বোধ করি হাঁ করে ওটির মিনারমতো বেলটাওয়ারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেলফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে বেবিট্যাক্সিওয়ালা মন্তব্য করেন, ‘ধর্মীয় স্থাপনাটির প্রধান পাদরির বিরুদ্ধে বালককামিতার অভিযোগ আছে। সুতরাং এখানে প্রার্থনা করাটা অপ্রয়োজনীয়, কবুল হওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে তোমরা যখন বেড়াতে এসেছ, একটু মনোযোগ দিয়ে দেখো, স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চল থেকে আসা মুর মিস্ত্রিদের হাতে বানানো, কাঠের দেয়ালগিরি ও দরজা-জানালার ফ্রেমের কারুকাজগুলো সত্যিই অসামান্য।’
ক্যাথেড্রালের ভেতরে ঢুকি আমরা। আন্দালুসিয়ার মুর সম্প্রদায়ের মিস্ত্রিদের কারুকাজকে লা-জওয়াব বললে অত্যুক্তি হয় না। তবে প্রথমেই যা চোখে পড়ে, তা হচ্ছে, পামগাছের আকৃতিতে তৈরি এক সারি স্তম্ভের ওপর দাঁড় করানো চিত্রিত সুপরিসর ছাদ।
এল-নোরা একটি দেয়ালগিরিতে মোমবাতি জ্বালতে গেলে, বেঞ্চে বসে দেয়ালে অঙ্কিত বাইবেলে বর্ণিত ঘটনাবলির ফ্রেস্কোর দিকে আমি চোখ রাখি। মেঝে থেকে ছাদ অব্দি প্রসারিত রঙিন কাচের বিরাট সব জানালা রোদে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, আর আমার মনে ফিরে আসে, কৈশোরে অজস্রবার পড়া শেষের কবিতার নির্বাচিত তিনটি শব্দ ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি...।’
সাইড-চ্যাপেলে প্রার্থনারত মানুষজনের ভেতর দিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি, বাঁ দিকে—পরপর অনেকগুলো খিলানে ঢাকা সুপ্রশস্ত বারান্দায়। নাম না–জানা কোনো এক খ্রিষ্টীয়-সন্তের মূর্তিতলে প্রার্থনারত এক বান্দা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের ‘বিয়েন বেনিদো’ বলে ওয়েলকাম করেন।
মনে হয় মশাইয়ের কিছু একটা বলার আছে। আমি প্রশ্রয়ের হাসি হাসলে, তিনি সেলফোনের স্ক্রিনে, যিশুখ্রিষ্টের লাস্ট সাপারকে বিষয়বস্তু করে তাঁর আঁকা একটি তৈলচিত্রের ফটোগ্রাফ দেখিয়ে বলেন, আসলটি দামে অতি সস্তা এবং পণ্যটি তার ব্যাকপ্যাকে বিক্রির জন্য মজুত আছে।
একটু অবাক হই, ওই চিত্রে যিশুখ্রিষ্টকে কেচোয়া গোত্রের কোনো সরদারদের মতো করে আঁকা হয়েছে দেখে! অন্তিম ভোজের খাবার হিসেবেও পরিবেশন করা হয়েছে, প্রচুর পরিমাণে পোড়া আলু ও বারবিকিউ করা গিনিপিগ।
১৪৯৫ সালে, ইউরোপীয় চিত্রকলার ধ্রুপদি জামানায়, খোদ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির হাতে আঁকা ‘লাস্ট সাপার’ শীর্ষক চিত্রকর্মের সঙ্গে আমার যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় আছে, সুতরাং পেরুতে এসে, যিশুখ্রিষ্ট যে কেচোয়া সরদারের চেহারায় ইনকাদের বেশভূষা পরে হাজির হয়েছেন এবং তাঁর মেন্যুতে যে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় ফুড ডেলিকেসি তথা ঝলসানো গিনিপিগও, এই বিষয়টি আমাদের কৌতূহল জাগায়। প্রচুর কৌশলে চিত্রকর্মটি খরিদ করা থেকে বিরত থাকি এবং আমার কঞ্জুস সুনামটিওকে বহাল রাখতে সমর্থ হই।
ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে গিয়ে খেয়াল করি, একটি পাথরের ফোয়ারাকে ঘিরে জমে উঠেছে ছোটখাটো ভিড়। খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা হাতে ‘রিটাবলো’ নিয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন। রিটাবলো হচ্ছে, সিডার কাঠে তৈরি মিনিয়েচার আলমারির মতো দেখতে একটি বাক্স। এর ভেতরে আছে, যিশুখ্রিষ্ট ও জননী মেরিসহ একাধিক খ্রিষ্টীয় সন্তের ছোট ছোট মূর্তি। প্রতিমাগুলো নির্মিত হয়েছে আলু পিষে তৈরি ময়দা দিয়ে। সন্তদের পায়ের তলায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে, পরিবারের সদ্য প্রয়াত সদস্যদের প্রতিমূর্তিও।
রিটাবলো-বিষয়ক রিচুয়ালটি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইন্টারেস্টিং, সুতরাং আমি ও এল-নোরা জটলা ঘেঁষে কী ঘটছে, তা হদিস করার চেষ্টা করি। একটু উঁকিঝুঁকি দিতেই ঘটনা স্পষ্ট হয়। বাঁকানো আর্চের তলায় দাঁড়িয়ে একজন বেজায় মোটা, কালোকোলা চেহারার পাদরি। এ ধর্মযাজকের মেদবহুলতা, গতরের ওজন ও আকারের বিরাটত্ব বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি হাঁসফাঁস করতে করতে, একের পর এক রিটাবলোতে চামচ দিয়ে একফোঁটা ফোয়ারাজল ছিটিয়ে, অতঃপর তাতে ক্রুশকাঠটি ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করছেন। আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফের ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে পড়ার উপায় খুঁজি।
একটি খিলানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাদের কান্ডারি–কাম–বেবিট্যাক্সিওয়ালা। পথ দেখিয়ে দিয়ে, মোটাতাজা পাদরির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে তিনি নির্লিপ্ত স্বরে জানান, ‘আমার ভাগনে, বড় বোনের এ ছেলেটি বড্ড ধর্মপ্রাণ, তবে খাবারে বাছবিছার করতে জানে না, আগড়মবাগড়ম—যা পায়, তাই চিবিয়ে হজম করে। ভুগছে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়বিটিজে...।’
এল-নোরা শরীরে শর্করা বৃদ্ধির সাথে সঠিক খাবারের সম্পর্ক নিয়ে কিছু একটা বলতে যায়। তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বেবিট্যাক্সিওয়ালা ফের কথা বলেন, ‘অপদার্থটা রোমান ক্যাথলিক কলেজে পাশ দিয়ে এন্ট্রি লেভেলের পাদরি হয়েছে বটে, তবে তার বোধবুদ্ধি বিশেষ একটা হয়নি। আর হবেই-বা কীভাবে, বাইবেলে তো দৈহিক স্থূলতা নিয়ে যেমন নেই কোনো সতর্কবাণী, তেমনি পুষ্টি ও রক্তচাপ কিংবা শর্করাধিক্য নিয়েও নেই উল্লেখযোগ্য কোনো উপদেশ।’
মিরাফ্লোরেস এলাকার এদিক-ওদিক ঘুরে, সমুদ্রের নীলজল অব্দি দেখিয়ে, ফুটপাতের ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সস্তায় আধডজন বাবলগাম খরিদ করে, অতঃপর আমাদের যখন বেবিট্যাক্সিওয়ালা উদ্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দেন, সূর্য তখন অভীষ্ট পিরামিডটির চাঁদিতে চড়ে ছড়াচ্ছে এমন চনমনে রোদ যে সানগ্লাস চোখেও সবকিছু কেমন যেন ধাঁধিয়ে যায়।
পিরামিডের চাতালে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁর বারান্দায় উঠে, আমরা বাঁ পাশে—ধূসর ফিকে সুরমা রঙের ইটে গড়া পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনাটির কেবল একটি দেয়াল দেখতে পাই। এল-নোরা ছবি তুলতে গিয়ে অস্ফুটে আওয়াজ দেয়, ‘ইট ইজ হিউজ, সো হিউজ সো ইমেন্স...ম্যান, উই আর স্ট্যান্ডিং রাইট নেক্সট টু আ পিরামিড...জাস্ট থিংক অ্যাবাউট দিস!’
ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া দেয়ালের বিরাটত্ব আমাকে কাবু করে কিঞ্চিৎ। এথনিক মোটিফের ড্রেস পরা পেরুভিয়ান এক তরুণী এসে আমাদের শুভেচ্ছা জানায়। তার বিভাজিকাজুড়ে ঝুলছে, ইনকা সম্রাটদের সূর্য উপাসনার প্রতীক ছোট্ট একটি সম্পূর্ণ সোনালি সান-ডিস্ক। মেয়েটি থিয়েটারে অডিশন দেওয়ার মতো বেজায় সেজেগুজে চেষ্টা করে দৃষ্টি কাড়ার, প্রচুর দ্বিধা নিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে সে জানতে চায়, ‘উড ইউ লাইক সাম ইনফরমেশন অ্যাবাউট দিস পিরামিড?’ সম্মতিতে মাথা হেলানোমাত্র মেয়েটি কথা বলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তোতাপাখির কায়দায়।
ওয়ারি গোত্রের মানুষজন এ এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছিল, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দুই শ বছর পর। ‘হয়াকা পুকইয়ানা’ নামক এ পিরামিডটি তৈরি হয়েছিল ৪০০ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। স্পেন থেকে আসা ঔপনিবেশিক সেটেলাররা এর বেশ কিছু ইট খুলে নিয়ে নগরীর এখানে–ওখানে গড়েছিল একাধিক গির্জা ও প্রশাসনিক ইমারত প্রভৃতি। পিরামিডের বাদবাকি অংশ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল নগরীর বর্জ্য আবর্জনার তলায়। ভূমিকম্পে টিলা-টক্কর ধসে পুরো পিরামিড চাতালও চাপ চাপ মাটির তলায় এমনভাবে সেঁধিয়ে গিয়েছিল যে তার ওপর নাকি কালে কালে গাছপালা গজিয়ে তৈরি হয়েছিল ছোটখাটো জঙ্গল। সাতটি স্বতন্ত্র ধাপে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে যাওয়া এ স্ট্রাকচারটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয় ১৯৮১ সালে।
রেস্তোরাঁর হোস্টেস মেয়েটি এবার আমাদের নিয়ে আসে, খোলামেলা পারলারের আরামদায়ক সোফায় সজ্জিত এক নিরিবিলি পরিসরে। জানতে চাই, পিরামিড-সংলগ্ন বিখ্যাত এ রেস্তোরাঁতে পর্যটক গোছের মানুষজন কেউ আসেনি কেন?
জবাবে থতমত খেয়ে মেয়েটি ঠোঁট কামড়ায়, তার গণ্ডদেশ ভরে ওঠে ব্লাশের রক্তিম আভায়। ব্রীড়াবনত বালিকাকে আমি বিব্রত করতে চাই না, তাই প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাই বেবিট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে। বাবলগামের বিস্ফোরিত গোলক সামলাতে সামলাতে তিনি জবাব দেন, ‘লিমা নগরীতে ট্যুরিস্ট-সাইট তো একটা না, শতাধিক, আজকের আবহাওয়া চমৎকার, তাই অনেকে সমুদ্রসৈকতেও গেছে।’
ইতিমধ্যে হোস্টেস মেয়েটি ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। একটু দূরে রাখা পোড়ামাটিতে তৈরি পেল্লায় একটি জালা বা মটকা দেখিয়ে সে ব্যাখ্যা করে; পুরাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় খননে নাকি পাওয়া গিয়েছিল প্রচুর পরিমাণে তৈজসপত্রের ভাঙা টুকরাটাকরা। একজন মৃৎশিল্পী এগুলো জড়ো করে, জোড়াতালি দিয়ে রিকন্সট্রাকশন পদ্ধতিতে তৈরি করেছেন প্রকাণ্ড এ মটকাটি। পুনরায় নির্মাণে আমি আপত্তির কিছু দেখি না, তবে একটি সহজ-সরল সওয়াল না করে স্বস্তি পাই না; জিনিসটি জাদুঘরে ডিসপ্লে না করে, রেস্তোরাঁর মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে কেন? জবাব না দিয়ে মেয়েটি ফের ব্রীড়াবনত হয়।
ওয়েটার ট্রলিতে করে ওয়েলকামিং ড্রিংকস নিয়ে আসলে, হোস্টেস মেয়েটি পরিবেশনের দায়িত্ব পেয়ে ফের হাসিখুশি হয়ে ওঠে। পানপাত্র সেন্টার টেবিলে রেখে কনফিডেন্টলি সে জানায়, ককটেলটি ‘দুলচিন’ নামে পরিচিত, এতে পিসকোর সঙ্গে অ্যাপ্রিকট ব্র্যান্ডি, লাইম ও আনারের রস মেশানো হয়েছে, ‘ইট ইজ অন দি হাউস, এনজয় সিনিওরেস’, বলে চোখে ঝিলিক তুলে সে হাসে। আমি দুলচিন প্রস্তুতের প্রক্রিয়া নিয়ে একটি ফলোআপ প্রশ্ন করি, মেয়েটি ফের নির্বাক হয়ে তার বর্ণিল নখে জড়ায় কটিদেশে পেঁচিয়ে পরা সিল্কের স্যাশ।
মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিতে এবার জবাবের হাল ধরেন স্বয়ং বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার। দুলচিন নামক ককটেলটি যে ডিপ্রেশনের প্রতিষেধক হিসেবে কার্যকরী, তা জানিয়ে চর্বিত বাবলগাম ন্যাপকিনে মুড়ে রেখে, হাতের তালুতে পানপাত্র নিয়ে তিনি নেড়েচেড়ে তা শোঁকেন। ইত্যবসরে আমি প্রায় নিশ্চিত হই যে হোস্টেস মেয়েটি পর্যটকদের সামাল দেওয়ার জন্য নির্বাচিত কয়েকটি ইংরেজি বাক্য মুখস্থ করে নিয়েছে, তাই গণ্ডির বাইরে গিয়ে জবাব দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
তো আবার শরণাপন্ন হই ড্রাইভারের, তিনি কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে ব্যাখ্যা করেন, এই রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী হচ্ছে পেরুর সবচেয়ে নামজাদা আলভারেজ পরিবার। ষোড়শ শতাব্দীর লিমায়, স্প্যানিশ সেটেলারদের শাসন শুরু হওয়ার ডে-ওয়ান থেকে আলভারেজরা প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। পিরামিড চত্বরের পুরোটাই ছিল তাদের প্রাইভেট প্রোপার্টির অংশ। এখানকার জাদুঘরে নামকাওয়াস্তে খননে-প্রাপ্ত কিছু দ্রব্যের প্রদর্শনী হলেও সবচেয়ে বাছা বাছা আইটেমগুলো সাজানো আছে তাদের আবাসিক ভিলায়।
ককটেল পানে চনমনে হয়ে ওঠামাত্র হোস্টেস মেয়েটি আমাদের নিয়ে আসে হল-কামরায়। এখানকার জানালাজুড়ে ফের ভেসে ওঠে পিরামিড-ওয়ালের স্তরবিশিষ্ট বিন্যাস। বিরাট একটি মটকা ঘিরে দাঁড়িয়ে ওয়ারি গোত্রের দুই শ্যামান বা ধর্মযাজক। পুরাতাত্ত্বিক সাইটে প্রাপ্ত মূর্তি ও তৈজসপত্রের ভাঙারোঙ্গা টুকরাটাকরা জোড়া দিয়ে এ শ্যামান দুজনকেও নাকি পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে।
টেবিলে পরিবেশন করা হয় লাঞ্চ। আমাদের খাবারটির নাম ‘কাউসা লামিনা’, আহার্যটি তৈরি করা হয়েছে সেদ্ধ আলুর তিনটি স্তরের ভেতর চিংড়ি মাছ, আবাকাডো ও পার্পেল কর্নের পেষা প্রলেপ মিশিয়ে। বেবিট্যাক্সিওয়ালার ফুড হেবিট সম্পর্কে এখানকার রেস্তোরাঁ-স্টাফরা মনে হয় রীতিমতো ওয়াকিবহাল। আমাদের আলুভিত্তিক খাবার জোগান দেওয়া হলেও তাঁকে লালসালু দিয়ে ঢাকা রুমালে করে সরবরাহ করা হয় ‘সদিচে’ বা লেবুর রসে জারিত, কাঁচা মরিচ ও ধনেপাতা পাতা মেশানো তাজা মাছে প্রস্তুত আহার্য।
রেস্তোরাঁর পাট ভালোমতো চুকলেও বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে সহজে কাটানো যায় না। তিনি আলভারেজ পরিবারের ম্যানশনের সামনে বাহনটি পার্ক করে, আমাদের ঢুকে পড়ে, পিরামিড চত্বরে প্রাপ্ত জিনিসপত্রে একনজর চোখ বোলাতে অনুরোধ করেন।
সিঁড়ি বেয়ে ইমারতে ঢোকার মুখে এল-নোরা, ‘দিস ইজ মাই ট্রিট টু ইউ ফর ফাইন্ডিং আ পিরামিড ফর মি,’ বললে বিষয়টি খোলাসা হয়। যেহেতু রেস্তোরাঁর বিল আমি পরিশোধ করেছি, এল-নোরা আলভারেজ ম্যানশনে ঢুকে পড়ে প্রাইভেট কালেকশন দেখার টিকিট কেটে আমার সহায়তার প্রতিদান দিচ্ছে।
ম্যানশনের দুয়ার খুলে উর্দি পরা একজন ডমিস্টিক এমপ্লয়ি আমাদের নিয়ে আসেন, বেজায় প্রশস্ত পরিসরের এক করিডরে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ভেতরের মার্বেল-মোজেকে বাঁধানো ছককাটা আঙিনা। তার ওপাশে এ ইমারতের একটি কানেক্টিং উইং। ওখানকার এনট্রান্সের দুয়ারে আন্দালুসিয়ার মুর মিস্ত্রিদের কাঠের কাজ চেয়ে দেখার মতো, পাশে দাঁড় করানো আলভারেজ পরিবারের পূর্বপুরুষ এক কনকিস্তাদোর বা স্প্যানিশ-বিজেতার শ্বেতপাথরের মূর্তিও। সব দেখেশুনে অবাক বিস্ময়ে এল-নোরা মন্তব্য করে, ‘দিস ম্যানশন লুকস সো মাচ লাইক আ হিস্টোরিক ভিলা অব অ্যান আপার ক্লাশ অ্যারিস্ট্রোকেট ইন মাদ্রিদ!’
পুরো একটি হলকামরাজুড়ে ডিসপ্লে করা হয়েছে, ‘হয়াকা পুকইয়ানা’ নামক পিরামিডের ধ্বংসস্তূপের তলায় আবিষ্কৃত তৈজসপত্র ও মূর্তিরাজির আধভাঙা খণ্ডাংশ। আমি ওয়াকিবহাল যে এ দ্রব্যগুলোর পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব অসামান্য, তারপরও কেন জানি আগ্রহ হারাই, কেবলই মনে হতে থাকে, স্প্যানিশ কনকিস্তাদোর বা আদিবাসীদের যুদ্ধে হারানো ঔপনিবেশিক জামানার তথাকথিত বীরদের উত্তরসূরি আলভারেজরা দেশটি শুধু শাসন-শোষণ করে সন্তুষ্ট হয়নি, তাদের ঐতিহ্য, তাদের বিশ্বাসের প্রতীকগুলোকেও বাণিজ্যিক পণ্য করে ছেড়েছে।
আমার ফিলিংয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে এল-নোরাও মন্তব্য করে, ‘আলভারেজ ফ্যামিলি ওয়ারি জনগোষ্ঠীকে এমনভাবে ডিহিউমেনাজড করে তুলেছে যে এদের প্রাইভেট কালেকশন দেখতে আসার অভিজ্ঞতাকেও মনে হচ্ছে অত্যন্ত ভালগার।’
অতৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে আসি আমরা ম্যানশনের বাইরে। সড়কের ওপারে আলভারেজদের বাণিজ্যিক ভবন, মুর কাঠমিস্ত্রিদের হাতে গড়া দৃষ্টিনন্দন এক ব্যালকনির তলায় পার্ক করা আমাদের বেবিট্যাক্সি। এল-নোরা এগিয়ে যায় ওদিকে। আমার পায়ে পেঁচানো ব্রেইস লুজ হয়ে পড়েছে, সুতরাং তা অ্যাডজাস্ট করার জন্য বসে পড়ি ম্যানশনের সিঁড়িতে।
সামান্য দূরে, বেবিট্যাক্সিতে বসে ড্রাইভার সেলফোনের স্ক্রিনে মশগুল হয়ে কিছু দেখছেন। তার কাছাকাছি হয়ে, কিছু একটা দেখতে পেয়ে যেন কালকেউটের মুখে পা পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে অ্যাবাউট টার্ন হয়ে ফিরে আসে এল-নোরা। জানতে চাই,‘ হোয়াটস রং?’
অত্যন্ত আপসেট-মুখে সে জানায়, ‘দ্য ফাকিং ড্রাইভার ইজ ওয়াচিং পর্নোগ্রাফি ইন হিজ সেল।’
ইনার চরিত্র সংশোধনের কোনো দায়িত্ব আমার নেই, তাই বলি, ‘প্লিজ ইগনোর ইট এল-নোরা, জাস্ট লেট ইট গো।’
বেবিট্যাক্সিতে ফিরে আসতেই তা স্টার্ট করে ড্রাইভার প্রস্তাব করেন, কিছু কড়িপাতির বিনিময়ে তিনি আমাদের ব্যাকডোর দিয়ে একটি মিউজিয়ামে নিয়ে যেতে চান, যেখানে ডিসপ্লে করা আছে, পিরামিডে প্রাপ্ত দুটি মমি।
কেন জানি খেপে উঠে এল-নোরা প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। তো আমরা ফিরে আসি গেস্টহাউসে। লাউঞ্জে ঢোকার মুখে মন্তব্য করি, ‘সামথিং মেড ইউ ভেরি আনকম্ফোর্টেবল এল-নোরা, রাইট?’
উষ্মাকে গোপন না করে সে জবাব দেয়, ‘ড্যাম রাইট, ইয়েস।’ তারপর ক্রোধ সামলে বলে, ‘ড্রাইভার এমন একটি পর্নোগ্রাফিক ভিডিও দেখছিল, যা আমার বায়োলজিক্যাল ফাদার তৈরি করেন, যখন আমার বয়স ছিল মাত্র দুই, শ্যুড আই টেল ইউ মোর?’
আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে চাই, কিন্তু বেজায় বিব্রতবোধ করে লজ্জায় মাথাটি নত হয়ে আসে।