আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখার মন্ত্রটা যখন পেয়েছি, তত দিনে রুদ্র ঘর বেঁধে ফেলেছে আকাশেরই ঠিকানায়। আর আমি মাত্র রাঙা কৈশোরের দিকে হাঁটছি, পথ পুরোটা ফুরোয়নি। কেবল ‘খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ’ লুকানো শিখে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেই তখন থেকেই ‘ভালো আছি বা ভালো থেকো’ বলার জন্য আকাশকেই বেছে নিয়েছিলাম একমাত্র ঠিকানা হিসেবে। আর এখন এই চটজলদি বার্তার যুগে তো সবার সঙ্গে সম্পর্কগুলোই হয় খুব পানসে; নয় অকারণে জটিল। সম্পর্কগুলোই যেখানে অস্থির, চিঠি লেখা সেখানে পুরোটাই এক বাহুল্য অথবা সংকোচ। ঠিকানাই–বা জানি কজনের? আর ডাকপিয়নই–বা কই যে পরম মমতায় এই চিঠি পৌঁছে দেবে কারও গন্তব্যে? তারপরেও একটা চিঠি লিখতে মন চাইল। কী আশ্চর্য চিঠি লেখার মতো কেউ কোথাও নেই। কারও আর সময় নেই, একটা চিঠির অপেক্ষায় থাকবে। যত্ন করে হলুদ খামটা ছিঁড়ে আস্তে আস্তে ভাঁজ খুলে মেলে ধরবে কারও কথার মালায় সাজানো এক টুকরো কাগুজে বায়োস্কোপ।
যে একটি নগরে দুজন থাকাটাই ছিল একটিমাত্র সুখ। সেই সুখের খঞ্জনা ছেড়ে এত দূরে এসে দেখি, বহু কিছুর ভিড়ে সুখ এখানে কেবলই শূন্য। এ এক শূন্য সুখের শহর।
সে বাস্তবে কেউ থাকুক বা না থাকুক, আমার কল্পনার রুদ্রকে লিখতে বাধা কই? সে পড়ুক বা না পড়ুক, এই উদয়পদ্মের শহর থেকে না হয় একদিন এই চিঠি পৌঁছে যাবে তার আকাশের ঠিকানায়। যে শহরে এত দিন কাছাকাছি থেকেও ‘কত দিন দেখা হয়নি’ আমাদের প্রধানতম আক্ষেপ। সে শহর ছেড়ে হাজার মাইল দূরে আসার পর মনে হলো, চাক্ষুস না হোক, কাগজে–কলমে অন্তত দেখাটা হোক। ফুল, পাখি আর মিষ্টি বকুলের জন্য ‘ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ রাখা শুভকামনা পৌঁছে যাক আমাদের অঞ্জনা নদীতীরের খঞ্জনা গ্রামের মতো নগরে। যে একটি নগরে দুজন থাকাটাই ছিল একটিমাত্র সুখ। সেই সুখের খঞ্জনা ছেড়ে এত দূরে এসে দেখি, বহু কিছুর ভিড়ে সুখ এখানে কেবলই শূন্য। এ এক শূন্য সুখের শহর।
এই শহরে প্রথমবার এসেছিলাম ঠিক বছর দশেক আগে। সারা দিনের জন্য। সেদিন একঝলক দেখে মনে হয়েছিল একে উদয়পদ্মের শহর। সেদিন যে এসেছিলাম, আসার কথা ছিল তারও বছর দুয়েক আগে একটু লম্বা সময়ের জন্য, একটা ফেলোশিপ নিয়ে। কিন্তু ওই যে, মায়া, খঞ্জনার সুখ। শেষ মুহূর্তে মায়ায় পড়ে আর আগানো হলো না। তবে মনে রয়ে গিয়েছিল। সে সময় এলে কোথায় আবাস হতো, কোথায় অফিস হতো, সে ছবিগুলো মনের ভেতর রয়ে গিয়েছিল বলেই সেবার দিন ভ্রমণে আসা।
এ এক বিশাল দেশের রাজধানী শহর। অথচ কী নীরব, শান্ত স্নিগ্ধ। শহরের বুকের ওপর রয়েছে প্রায় পাহাড়ের মতো দেখতে, যেখানে ঝরনা আছে, ছোট ছোট ঝিরি আছে, গা জুড়ে আছে হাজার হাজার শতবর্ষী গাছ।
এবার যখন এলাম, শরীরটা এল বটে, মনটা রয়ে গেল আমার সেই মায়া জড়ানো, স্মৃতি মাখানো ছোট্ট বসতঘরেই। যে ঘরের পরতে পরতে জমা ধূলিও আমার চেনা, আপন। যে ঘরের জানালার পর্দাটা, দরজার চৌকাঠটা, বেসিনের আয়নাটাতেও গল্প লেগে আছে। আমাদের নিজস্ব গল্প। সেই সব অজস্র গল্পকে তালাবন্ধ করে যখন এ শহরে পৌঁছালাম, তখন শহরজুড়ে ফুটে আছে রংবেরঙের টিউলিপ। আর টিউলিপ থেকে চোখ তুলে তাকালেই সাদা গোলাপি চেরিতে তখন মোহনীয় বসন্ত। যেন ফুলের শহর। চেরি ঝরার সময় দ্রুতই চলে এল, চেরি যখন যাই যাই করছে, তখন দেখি লাল ইটের বাড়িগুলোর ফ্রন্ট ইয়ার্ডে মানুষসমান উঁচু ঝোপে ঢেলে ফুটে আছে বাগানবিলাসের মতো একটা লাল গোলাপি ফুল। কোথাও–বা লম্বা গাছে ফুটেছে সাদা ঝিরঝিরে ফুল, যার গন্ধে মনে পড়ে হাস্নাহেনার কথা। অথচ এদের কারও নাম জানি না। এদের সঙ্গে দেখাই যে হলো প্রথমবার। ঘরের কাছে পার্কে হাঁটতে গেলে দেখি বকুল ফুলের মতো ফুল ফুটেছে। সে-ও আমার অচেনা। তবে চেনা ফুলও পেয়েছি, যার নাম গোলাপ। চেরি আর টিউলিপ যেই না উধাও হলো, সেই একেবারে উজাড় করে ফুটে উঠল গোলাপ। এখানে, সেখানে, যেখানে যেভাবে পারল। এখন গোলাপও বলছে যাই। আর সপ্তাহখানেক ধরে মাথা উঁচু করে জাগছে উদয়পদ্মরা।
এ এক বিশাল দেশের রাজধানী শহর। অথচ কী নীরব, শান্ত স্নিগ্ধ। শহরের বুকের ওপর রয়েছে প্রায় পাহাড়ের মতো দেখতে, যেখানে ঝরনা আছে, ছোট ছোট ঝিরি আছে, গা জুড়ে আছে হাজার হাজার শতবর্ষী গাছ। পাহাড়ও বলা যায়, বনও বলা যায় আবার হয়তো কিছুই বলা যায় না, হয়তো অন্য কোনো নাম আছে এর। তবে পুরো এলাকাটাকে মানুষ আর পোষা প্রাণীদের হাঁটাচলা আর ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে নাম রেখেছে ‘রক ক্রিক পার্ক’। শহরের ভূগোলের বড় অংশ জুড়েই আছে রক ক্রিক।
এই শহরে প্রথমবার এসেছিলাম ঠিক বছর দশেক আগে। সারা দিনের জন্য। সেদিন একঝলক দেখে মনে হয়েছিল একে উদয়পদ্মের শহর। সে সময় এলে কোথায় আবাস হতো, কোথায় অফিস হতো, ভেবে দিন ভ্রমণে আসা।
হেঁটে চলার সরু পথ থেকে ঢালু হয়ে পাহাড়ি ঢাল নেমেছে নিচের গাড়ি চলা রাস্তায়। ছোটবেলায় রূপপুরে গেলে যেমন দেখা যেত রেলের উঁচু লাইন, অনেকটা তেমন। সেই পাহাড়ি ঢালে কত রকম যে গাছগাছালি, তরুলতা। নজরে পড়ে মালবেরির থোকায় রং ধরেছে। হালকা গোলাপি, লাল থেকে কালচে লাল। ঠিক এভাবেই নিশ্চয়ই জ্যৈষ্ঠ মাসে রং খেলে যাচ্ছে এখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা দেশের লিচুগাছগুলোতেও।
জানো, এই সরু পথে হাঁটতে গেলেই নাকে বুনোফুলের গন্ধ এসে জড়ায়। কত দিন পরে যে এমন বুনোফুলের গন্ধ পেলাম! ফুল নয় যেন এক ঝটকায় ছোটবেলাটা তার গন্ধ নিয়ে সামনে চলে আসে। সেই যে হাঁটার পথে ভাঁটফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। এখানকার ফুলগুলো তো অচেনা, তবে ঝোপের ভেতর জড়িয়ে মড়িয়ে থাকা একটা লতা দেখে চিনতে পারি আমরা একালে যাকে বলি অ্যারোমেটিক জুঁই, সে। যার আসল নাম তারাঝরা। একদম যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে অজস্র অগুনতি তারা।
এই সুগন্ধি বুনোফুলের ঝোপের পাশেই দেখা পাই আরও কিছু ঝোপের। পাতাগুলো কাটা কাটা সুন্দর। ছোটবেলায় আমাদের রুহিয়ার সেই লাল বাড়িটার পেছনে ছিল এদের আনাগোনা। সেই শৈশবে কে যেন বলেছিল, নাম শিখিয়েছিল এ গাছের। এখনো দেখলে চিনতে পারি, মনেও করতে পারি, এ যে গঞ্জিকা!
নজরে পড়ে মালবেরির থোকায় রং ধরেছে। হালকা গোলাপি, লাল থেকে কালচে লাল। ঠিক এভাবেই নিশ্চয়ই জ্যৈষ্ঠ মাসে রং খেলে যাচ্ছে এখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা দেশের লিচুগাছগুলোতেও।
আরেকটা চেনা গাছ দেখি জুনের শুরুতে ফুল ফোটার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। শৈশবে যাকে আমরা চেরি বলে চিনেছি, সেই গোলাপি, সাদা বরফকুচির মতো ফুলগুলো। বড় হয়ে জেনেছি যার নাম ফুরুস। সে ফুটে উঠল জুনের শুরুতে। যেন আমার এক টুকরো চেনা পৃথিবী ছড়িয়ে পড়ল, বহুদূরের অচেনা এই উদয়পদ্মের শহরে, আমার আর আমাদের শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতির জানালা খুলে।
এই ফুলের শহরে, আমাদের অচেনা শহরে আমরা নতুন করে পথ চিনছি, ঘর খুঁজছি। আমাদের সঙ্গে আছে ছোট্ট আরশিল। ওর সঙ্গে এই ফুলেল পথ ধরে বিকেলে হাঁটতে বের হই। বিশাল পার্কের এক কোনায় শিশুদের প্লে-গ্রাউন্ড। একেক দিন একেক দলের সঙ্গে দেখা হয়। একেকজন একেক দেশের মানুষ। কারও কারও সঙ্গে পরিচয় হয়। একদিনে মনে হয় কত আপন হয়ে গেল। অথচ পরে আর কোনো দিন দেখা হয় না। পরের দিন বা দুদিন পর গেলে আরশিল আগের দিনের বন্ধুদের খোঁজে। একটু মন খারাপ করে। আবার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশে যায়।
মেমোরিয়াল ডের আগের দিন দেখা হলো ম্যাডক্স আর ওর মায়ের সঙ্গে। ওরা ম্যাসাচুসেসটস থেকে এসেছে। তিন দিনের জন্য। ম্যাডক্সের মামা শুয়ে আছে আরলিংটন ওয়ার সিমেট্রিতে। তাকে বার্ষিক শ্রদ্ধা জানাতেই মা–ছেলের আগমন। ইরাকের কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছিলেন ম্যাডক্সের মামা। আমেরিকান সৈনিক। বয়স তখন তার মাত্র ২৩! একটা তরতাজা তরুণের কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফেরার মতো ট্র্যাজেডি শুনতে এত কষ্ট লাগে। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু অথবা শহীদ হওয়াকে যত গ্লোরিফাই করা হোক না কেন, সত্যটা হলো এক বা একাধিক পাষণ্ড শাসকের ভুলের মাশুল হলো এসব তরতাজা জীবনদান। যে জীবন দান করতে বাধ্য হয়েছে আমাদের তরুণেরা ৭১-এ এবং ২৪-এ। এই যে সারা পৃথিবীজুড়ে যত তরুণ অরুণ যায় অস্তাচলে। তারা প্রায় সবাই নিষ্ঠুর শাসকদের নিষ্ঠুরতার বলি। যুদ্ধ, সংঘাত, অভ্যুত্থান—সবকিছুই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ত, যদি শাসকেরা তাদের লোভ আর ক্ষোভ সংবরণ করতে পারত। পৃথিবীটা তবে কতই–না শান্তিময় হয়ে উঠত! শাসকদের লোভের এবং ক্ষোভের বলিদের আমরা শহীদ বলে বাড়তি সম্মান দেখানোর মধ্য দিয়ে আসলে শাসকশ্রেণির অন্যায়কে জাস্টিফাই করি। আমি আসলেই জানি না, ২৩ বছরের সেই তরতাজা মৃত সৈনিকের কবরে একদিন বার্ষিক শ্রদ্ধাটা বড় নাকি ২৩ থেকে ৮৩ বছর অবধি বেঁচে থেকে তাঁর জীবন উদ্যাপন করাটা বড় হতো।
এই প্রশ্নের যেমন উত্তর মেলে না, তেমনি উত্তর খুঁজে পাই না, মানুষ কেন দেশ ছেড়ে যায় এই প্রশ্নেরও।
কত মানুষ কত দেশ থেকে এসে জমা হয়েছে এই শহরে, এ দেশে। যে দেশে তার নিজের কোনো প্রাকৃতজন নেই। যে দেশে সবাই ভিনদেশি। যেন অনেকটা পৃথিবীর ঢাকা শহরের মতো! যে শহরে অনেক মানুষ থাকে বছরের পর বছর ঠিকই, জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়ে দিয়েও মনের ভেতর লালন করে একটা ঠিকানা—যেটা ঢাকার বাইরে।
হয়তো নিকারাগুয়া বা এলসালভাদরের কোনো তরুণী পনিটেল ঝাঁকিয়ে হেঁটে যায়। হয়তো ফিলিপিনো কোনো মধ্যবয়সী দ্রুত এগোয়, কাজ থেকে ফিরছে। কারও–বা ঘর আছে, ঘরে মানুষ আছে। কারও–বা কোথাও কেউ নেই।
ঠিক সে রকমই এই দেশে মানুষ এসেছে নানা দেশ থেকে। এই দেশের জল হাওয়ায় থেকে বেড়ে ওঠে অথচ লালন করে অন্য এক দেশের ঐতিহ্য ও অভ্যাস। একটা সময় নিজেই ভুলে যায়, সে আসলে কার। গ্যাব্রিয়েল নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় একদিন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, আমি উরুগুয়ের মানুষ। পাঁচ বছর বয়সে এ দেশে এসেছি। আসার পর পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু আমি এখনো নিজেকে উরুগুইয়ান মনে করি। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলে, আমি আসলে কারও নই, না এদের না উরুগুয়ের। আসলেই তো জীবন বা জীবিকা মানুষকে কখন কোথায় টেনে নিয়ে যায়। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলে রাস্তা পার হতে হেঁটে যাওয়া মানুষের দলে কারও দিকে চেয়ে থাকি। অনুমান করার চেষ্টা করি সে কোন দেশের হতে পারে। হয়তো নিকারাগুয়া বা এলসালভাদরের কোনো তরুণী পনিটেল ঝাঁকিয়ে হেঁটে যায়। হয়তো ফিলিপিনো কোনো মধ্যবয়সী দ্রুত এগোয়, কাজ থেকে ফিরছে। কারও–বা ঘর আছে, ঘরে মানুষ আছে। কারও–বা কোথাও কেউ নেই। কারও হয়তো ঘরটাও নেই। কখনো দেখি আফ্রিকান বা জ্যামাইকান কোনো বিশাল পুরুষ ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে, এখানে সে নিতান্ত এক ইমিগ্র্যান্ট। অথচ তার দেশে হয়তো সে কবি, কিংবা তাত্ত্বিক। জীবন–জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে বহুদূরে।
জীবনে যার স্বদেশ, স্বভূমি ছাড়তে হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগা মনে হয় কেউ নেই। এই দুর্ভাগ্যকে বেশির ভাগ মানুষ স্বীকার করতে চায় না, প্রকাশ করতে চায় না। তাই ভান ধরে, ভালো থাকার ভান। এ কারণে, নিজে দেশে থাকতে মানুষ যতটা না নিজের দেশের প্রশংসা করে। প্রবাসী হলে পরবাসের দেশটা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে অনেক অনেক বেশি।
এই আপাতবাসের শহরেও আমাদের আবাস বদল হয়। প্রথমে ছিলাম একটা অস্থায়ী ঠিকানায়। হোটেলের মতো, ছোট্ট একটা সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে। শহরের প্রায় প্রাণকেন্দ্রে। এ দেশের যিনি প্রধান ব্যক্তি, তাঁর বিশাল সাদা বাড়ির কাছাকাছি এলাকায়। ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে পুবমুখে সোজা হাঁটা দিলে মিনিট ১৫ লাগত তাঁর বাড়ি পৌঁছাতে। এ রকম ঠিক পুবমুখে হেঁটে গেলে কত হাজার ঘণ্টা মিনিট পরে আমাদের নিজেদের রেখে আসা ছোট্ট বাসাটায় পৌঁছানো যাবে, কে জানে? যেই বাসায় আমরাই আমাদের রাজা-রানি।
জীবনে যার স্বদেশ, স্বভূমি ছাড়তে হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগা মনে হয় কেউ নেই। এই দুর্ভাগ্যকে বেশির ভাগ মানুষ স্বীকার করতে চায় না, প্রকাশ করতে চায় না। তাই ভান ধরে, ভালো থাকার ভান।
যা–ই হোক, দেশ থেকে আসার ঠিক দুমাসের দিনে আমরা হোটেল ছেড়ে বাসায় উঠি। যেদিন এ শহরে আমাদের পরিচয় তৈরি হয় ভাড়াটে হিসেবে। বহু বছর পর বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে সম্পর্কে ঢুকতে হলো নতুন করে। সেই যে জনপ্রতি দুটো করে ব্যাগ এনেছিলাম, সেগুলো নিয়ে সকাল সকাল হোটেল ছেড়ে এসে উঠলাম, নতুন ঠিকানায়। এখানে টিকে থাকতে হলে ঠিকানা খুব জরুরি। যেখানে যে কাজেই যাই না কেন, বাসার ঠিকানা চায় সবার আগে। সেই বাসা হলো, তবে তাকে বাসযোগ্য করার জন্য মৌলিক কিছু আসবাব চাই, তিন বেলা খেতে তো হবে, তার জন্য চাই হাঁড়িপাতিল।
সব শুরু হলো একদম নতুন করে। শূন্য থেকে শুরু। সঙ্গী কেবল, ঢাকার সংসারের, যাপিত জীবনের ফেলে আসা জিনিসপত্রের জন্য মন কেমন লাগা।
মজার বিষয় হলো, ২৫০০ পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ ছেড়ে যেদিন চলে আসি, সেদিনও মন খারাপ হলো। বাসা বদল করলে আসলে মন খারাপ হয়, তা যত কম সময়ই থাকা হোক না কেন। সেই মানুষের দেশবদলের খারাপ লাগাটা মাপার মতো বাটখারাই তো নেই কোথাও।
যাক, এবেলা মন খারাপের কথা বাদ দিই; বরং আবার ফুলেদের গল্পে ফিরে আসি। জুন–জুলাইয়ে এ শহরজুড়ে কোন ফুলটা ফুটল, জানো? ভুল করে শৈশবে যাকে আমরা চেরি নামে ডাকতে শিখেছিলাম। বড় হতে হতে জেনেছি, ওর নাম চেরি নয়, হয়তো ফুরুস বা অন্য কিছু। আমার ভালো লাগে ওকে ‘ভুলচেরি’ বলে ডাকতে। ওর সঙ্গে আমার শৈশব আছে, মিষ্টি একটা মায়া লেগে আছে। সাদা গোলাপি আর কখনো অল্পবিস্তর রক্তবর্ণ ভুলচেরিতে গাছগুলো সেজে আছে লম্বা সময়জুড়ে। আমাদের এই বাসার পাশের বাড়িটিতে আছে একটা গোলাপি ফুলের গাছ। ভুল করে সেই ভুলচেরি ঢুকে পড়েছে এ বাসার সীমানায়। বারান্দা থেকে হাত বাড়ালেই ধরা পড়ে গোলাপি পাপড়ি। পাপড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরে দেখি। এ উদয়পদ্মের শহর আমাকে নতুন করে শেখাল, জন্মভিটা বা নাড়ির টান শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ। পৃথিবীতে আসলে সেই মানুষটাই সবচেয়ে সুখী, যে আজীবন জন্মভিটায় রয়ে যেতে পারল। যাযাবররাও হয়তো সুখী, তাদের মতো করে। কিন্তু গৃহী মানুষের গৃহত্যাগের যাতনা বড় সংকটের। পুঁজিবাদ মানুষকে শিকড় ওপড়ানো শিখিয়েছে। শিকড় কেটে বের হয়ে মানুষ দিগ্বিদিক ঘুরছে, আরেকটু ভালো থাকার সন্ধানে। ‘একটু ভালো করে বাঁচব বলে আরেকটু বেশি রোজগার, ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালোবাসা আমার নীলচে পাহাড়’ বলে হাপিত্যেশ আসলে পুঁজিবাদের ষড়যন্ত্র। অথচ ভেবে দেখো, যে মানুষটা জন্ম থেকে একই বাড়িতে থাকছে বা থাকতে পারছে, যার কোথাও যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। ‘মায়ামমতায় জড়াজড়ি করি, মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি, মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়’ যে জনমভর থাকতে পারল। যার জীবন মানে তীব্র প্রতিযোগিতা না, অন্যকে মেরে ঠেলে এগিয়ে যাওয়া না। তার চেয়ে সুখী কে আছে?
মজার বিষয় হলো, ২৫০০ পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ ছেড়ে যেদিন চলে আসি, সেদিনও মন খারাপ হলো। বাসা বদল করলে আসলে মন খারাপ হয়, তা যত কম সময়ই থাকা হোক না কেন।
অথচ পুঁজিবাদ যা আজ বাস্তবতা নামে পরিচিতি, আমাদের শিখিয়েছে, ঘর ছেড়ে আসো, প্রতিদিন যুদ্ধ করো, টিকে থাকার যুদ্ধ, পৃথিবীর সব ভালো পণ্য তোমার নিজের করে নাও। এই না জীবন, এই না সুখ! অথচ দিন শেষে সব শূন্য, ফাঁকা। এ দেশে মানুষের ঝাঁ–চকচকে বাড়ি আছে, কয়েকখানা গাড়ি আছে, আর আছে ঋণের বোঝা। ভোগবাদী সমাজ এখানে ভোগবিলাস সহজলভ্য করেছে বা ভোগবিলাসে ভাসতে বাধ্য করেছে বটে, বিনিময়ে জড়িয়ে নিয়েছে ঋণের শিকল। এ এক ফাঁপা অর্থনীতি, শূন্য সুখ।
কয়েকটা প্রজন্ম গাধার মতো এই পুঁজিবাদের মুলার পেছনে ছুটে চলছি আমরা। কী নিদারুণ আমাদের জীবনের অপচয়! এই চক্র এমন চক্র, বুঝতে পারলেও ফেরার পথ নেই।
তুমি তো জানো, শৈশব থেকেই আমি হিসাবি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস পছন্দ নয়। এক পোশাক ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে পরি। অনেকবার পরা হলেও বা কোনো জিনিস পুরোনো হলেও ছুড়ে ফেলে না দিয়ে যত্নে রেখে দিই। অথবা কারও লাগলে, কেউ ভালোবেসে ব্যবহার করতে চাইলে দিয়ে দিই। যে কারণে ২৫ বছর আগের শাড়ি বা জামা এখনো আমার আলমারিতে পাওয়া যায়। কখনোসখনো গায়েও চড়ে। এ যুগে যাদের বলে মিনিমালিস্ট, আধুনিকতা প্রকাশের একটা নতুন ধারার চেষ্টা। সে আমি বছর ছয়েক বয়স থেকেই প্রাকৃতিকভাবেই মেনে চলি। ছয় বছর বয়সের একটা ঘটনা আমাকে শিখিয়েছিল, দরকারের বাইরে কোনো কিছু চাইতে নেই। একটা সময়ে বড় হয়েছি, নিজে স্বাবলম্বী হয়েছি, ইচ্ছেমতো কেনাকাটার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আমার সেই মিনিমালিস্ট অভ্যাসটা রয়েই গেছে। অথচ এই ভোগবাদীদের স্বর্গ আমাকে বাধ্য করে, অপ্রয়োজনে জিনিস কিনতে। একবার ব্যবহার হলো কী হলো না, ছুড়ে ফেলতে। এই দেশটা ছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্তের বেশ কিছু দেশে গিয়েছি, ঘুরেছি, থেকেছি। কোথাও এমন অপচয়ের অভ্যাস দেখিনি। সব দেশের মানুষকেই দেখেছি হিসাবি। তাদের তুলনায় বরং বাংলাদেশের মানুষ বাজারে গেলে বেশি জিনিস কেনে। ঢাকায় আমরা শজনে ডাঁটা কিনি কেজি হিসেবে। যেকোনো সবজিই কেউ আধা কেজির কমে তো কেনেই না। অথচ বহু দেশে যেকোনো সবজি মানুষ প্রয়োজনে একটাও কেনে। সে শজনে ডাঁটা হোক বা টমেটো কিংবা বেগুন। বিভিন্ন দেশে যেকোনো পণ্যের ছোট ছোট প্যাকেট আছে। একজন বা দুজনের জন্য। অথচ এখানে যা–ই কেনো, বেশি বেশি। বাজারে কোনো এক বা দুইজনের উপযোগী প্যাকেট নেই। সবকিছু ঢাউস সাইজ। এদের দেশ বড়, রাস্তা বড়, গাড়ি বড়, কফির মগ বড়, কোল্ড ড্রিংসের গ্লাস বড়, স্যান্ডউইচ বড়। খেতে পারলে খাও না পারলে ফেলে দাও; কিন্তু তোমার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কেনো।
এখানে আমাদের সাময়িক সংসার। এবং এ সংসারের খাট থেকে খুন্তি—সব কিনতে হচ্ছে নতুন করে। ঢাকায় যা কিনিনি, এখানে তা কেনা লাগে। ঢাকায় যা কিনেছি বা ছিল, এখানে তা–ও কেনা লাগে। এবং দিন শেষে মাথায় রাখা লাগে, এইগুলো সবই একবার ব্যবহারের জন্য।
বাটি–চামচের আলাপ রেখে আবার আসো আমরা ফুলেদের গল্প করি। সেদিন যে ভুলচেরির কথা বললাম। এখন পুরো শহর ছেয়ে গেছে, গোলাপি বেগুনি আর সাদা ভুলচেরিতে। এ শহরে যত চেরিগাছ, তার চেয়ে বেশি বোধ হয় ভুলচেরি। সেদিন কে যেন বলল, এটাই এই বছরের শেষ ফুল। এই ফুল ঝরতে ঝরতে গাছেদের রঙিন হয়ে পাতা ঝরার কাল চলে আসবে। পাতা ঝরে গেলেই সেই দীর্ঘ মেয়াদে সাদা ধবধবে শীতকাল।
শীত তো আমার বরাবরের অপছন্দের কাল। ছোট্ট একটা দিন কুঁকড়েমুকড়ে থাকো, অসহ্য। বাংলাদেশের মিঠে রোদেলা মিষ্টি শীতই যার ভালো লাগে না, তার তো বরফ পড়া, বেলা তিনটায় রাত নেমে আসা শীতের কথা মনে হলেও বিষণ্নতা ভর করে।
এখানে আমাদের সাময়িক সংসার। এবং এ সংসারের খাট থেকে খুন্তি—সব কিনতে হচ্ছে নতুন করে। ঢাকায় যা কিনিনি, এখানে তা কেনা লাগে। ঢাকায় যা কিনেছি বা ছিল, এখানে তা–ও কেনা লাগে। এইগুলো সবই একবার ব্যবহারের জন্য।
তবে সুখের কথা কী জানো? এ দেশেও বৃষ্টি নামে। এখানে এখন ভরা বর্ষা। আর মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের মতোই ঝুম বৃষ্টি নামে। এ বছর নাকি বাংলাদেশে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে? এখানে অতটা না, তবে বেশ ভালো বৃষ্টি হয়। একদিন সপ্তাহের বাজার করতে যাচ্ছিলাম, ঘণ্টাখানেক দূরের শহরে, অন্য রাজ্যে। যাওয়ার পথে আকাশ কালো করে ঘিরে ধরল শ্রাবণ মেঘ। ঢাকায় এমন বৃষ্টি দেখলে কাঁচাবাজার থেকে ইলিশ মাছ চলে আসে বাসায়। আর খেতে মন চায় মুড়ি দিয়ে কাঁঠাল। তো সেদিন চায়নিজদের সুপারমার্কেটে ঢুকেই পেয়ে গেলাম এক মস্ত কাঁঠাল। দেখেশুনে ট্রলিতে তুলে, মাছের কর্নারে গিয়ে দেখি চারখানা ইলিশ মাছ। ঢাকায় হয়তো এই সাইজের মাছ দেখলেও চোখ আরেকটু বড় সাইজের মাছটাই খুঁজবে। কিন্তু এখানে যে আস্ত তাজা ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই ঢের। সাইজ ডাজন্ট ম্যাটার। দেখেশুনে একখানা ইলিশও উঠে গেল ট্রলিতে। শ্রাবণের আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। কেনাকাটা সেরে তুমুল বৃষ্টি ভেজা পথে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা। এরপর, কাঁচা পেঁয়াজ মরিচ শর্ষের তেলে মেখে ইলিশের ঝোল ফিরে এল পাতে। মনে হলো, শাওন আসিলো ফিরে, সে কি ফিরে এল না নাকি এল? কী জানি, এভাবেই হয়তো দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েই চলবে প্রবাসজীবন।
আচ্ছা, তোমার প্রিয় ফুল কী, তা কি কখনো জানতে চেয়েছি? আমরা খুব অবলীলায় প্রশ্ন করি আপনার প্রিয় ফুল কী। আমাকে এই প্রশ্ন করলে আমি ভড়কে যাই। ফুল কি কখনো একটা কারও প্রিয় হতে পারে? সব ফুলই তো আমার প্রিয়। সব ফুলই তো সুন্দর। কৃষ্ণচূড়া থেকে কচুরিপানা, কার নাম বাদ দেব? এই প্রিয় ফুল প্রিয় ফুল খেলা খেলে, মানুষের ফুলকে ভালোবাসার গণ্ডি ছোট করে ফেলা হয়। গোলাপ বলি বা ধুতরা, টিউলিপ বা ভাঁট। ফুল মানেই সুন্দর। ফুল মানেই প্রিয়।
কাল ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার মুখে, যাকে আমরা গোধূলি বলি। সে সময়টাতে ফিরছিলাম, পোটোম্যাকের তীর ধরে। এখানে নদীর নাম পোটোম্যাক। পাড় বাঁধানো, ঝকঝকে তকতকে শহুরে নদী। আমাদের নদীরা হয় আটপৌরে নারী অথবা তেজস্বী পুরুষ। ছোটবেলায় যখন ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরতাম, মানিকগঞ্জের ইছামতী নদীটাকে একঝলকে দুচোখ ভরে দেখে নিতাম। মনে হতো নদী নয়, যেন এক তরুণী নববধূ। আটপৌরে শাড়ি ছড়িয়ে এ–গাঁয়ে ও–গাঁয়ে হেঁটে চলেছে। পাড়ে তার এখানে–ওখানে ফুটে আছে লাল কৃষ্ণচূড়া, যেন সেই বধূ ফুল গুঁজেছে খোঁপায়। আমাদের রমণীরাও তো নদীর মতোই। আর এখানে নদীরা নদী, স্বচ্ছতোয়া। বাঁধাহীন, বন্ধনহীন। প্রস্থে আমাদের পদ্মা, মেঘনার চেয়ে ঢের ক্ষীণ কিন্তু রুগ্ণ না, সুঠাম।
সেই নদীর পাড়ে হঠাৎ একটা তরুণ ম্যাপলগাছের পাতায় দেখি হলুদ রং লেগেছে। চল্লিশে চুলে যেমন এক–আধটু সাদা রং লাগে। সেভাবে ঘন সবুজ ম্যাপলের ঝোপে দু–একটা হলুদ পাতা! তাহলে কি শরৎ এসে পড়ল? দুদিন ধরে বাতাসেও একটা শীতল ভাব। সন্ধ্যার পর বাইরে গেলে বোঝা যায় ঘরের চেয়ে ঠান্ডা বেশি।
আমাদের শরৎ আসে কাশের বনে, নদীর কিনারায়, সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে নীল আকাশের গায়। আর এখানে শরৎ আসে ম্যাপলের পাতায়। আমাদের শরৎ সাদা। এদের শরৎ মানে হলুদ কমলা লাল। শরতের রং যা–ই হোক, শরৎ মানেই বর্ষার শেষ, শীতের আগমনী। এখানে কি তবে শীত আসছে? দীর্ঘ শীতল বরফ মোড়া শীত?
এই ফুলের শহর, ঋতুবদলের শহরে, সুখহীনতার শহরে সবচেয়ে ভালো লাগে কী, জানো? মানুষ এখানে বলতে পারে, যা বলা দরকার সেটা। একদিন সেই প্রধান ব্যক্তির বড় সাদা বাড়িটার সামনে দেখি, এক লোক গিটার বাজাচ্ছে একমনে। তার হাতে, পায়ে, মাথার কাছে অসংখ্য প্ল্যাকার্ড। বলা বাহুল্য, সবগুলোই শাসককে শাসিয়ে লেখা। পাশে ঘুরঘুর করছে, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অসংখ্য পুলিশ। কিন্তু সেই গানওয়ালা নির্বিকার বাজিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের কোনো হম্বিতম্বি নেই। নিসংকোচ।
একসময় এই দেশ ছিল সবার সেরা। পৃথিবীর সবকিছুতেই উত্থান আর পতন আছে। শীর্ষবিন্দু আছে আবার শিকড় আছে। এই যে হিমালয়, ভূমি থেকে উঠতে উঠতে চূড়ায় চলে গেল। আবার সেই চূড়া থেকে শুরু হলো মাটির দিকে যাত্রা। সবকিছুর মতো এই দেশটাও হয়তো শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলেছে। এখন কি তবে তার নেমে আসার সময়? যে দেশ যে শহর ছিল এত দিন সারা পৃথিবীর মানুষের স্বপ্নের দেশ, স্বপ্নের শহর, সেই দেশে এখন হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন। এখন এই সপ্তাহজুড়ে চলছে আর্থিক শাটডাউন। সকালে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি, একজন আগে থেকেই বসা ছিল। আরেকজন এল আমি যাওয়ার পর। প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে শুধাল, তোমাকে না দেখে ভাবছিলাম, হয়তো তোমার চাকরিটা আর নেই। দ্বিতীয়জন সরকারি চাকুরে, বলল, এ সপ্তাহেও যেতে বলেছে, সামনের সপ্তাহে কী হবে, জানি না।
গতকালকেই কথা হচ্ছিল বব আর আয়শার সঙ্গে। একজন নর্থ ক্যারোলাইনার আরেকজন সিয়েরা লিয়নের। ওদের দাম্পত্যের বয়স ৩২ বছর। এক ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে ভরা পরিবার। ছেলেটা কাজ করত কোনো এক এনজিওতে। কিছুদিন আগে চাকরি চলে গেছে। কারণ, সবাই যেমন জানে, তুমিও তো জানো। হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে রাজা আর তার ধনী বন্ধুর মনে হলো, গরিবদের আর সাহায্য করা দরকার নেই। বন্ধ করো এই সব। তো বন্ধ হয়ে গেল ৬৪ বছর ধরে চলে আসা গরিবদের সাহায্য করার দপ্তর। এতে চাকরি গেল পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার মানুষের। ক্ষুধার যন্ত্রণা বাড়ল কয়েক কোটি পোড় খাওয়া মানুষের। তাতে কার কী এসে গেল।
কিন্তু কান পাতলে শোনা যায়, মানুষ বড় কাঁদছে। সন্ধেবেলা মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে, মানুষ বড় একলা, তুমি তার পাশে এসে দাঁড়াও। কিন্তু পুঁজিবাদের এই ফাঁদপাতা শহরে মানুষের বুকের ভেতর আগুন জ্বলে বটে, কিন্তু দাবানল ওঠে না। কারণ, দিন শেষে এখানে কেউ কারও নয়। সবাই বড় একলা।