তেমুজিনের দেশে
উলনবাটোরের ট্রাফিক জ্যাম
মঙ্গোলিয়ার পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে চেঙ্গিস খানের নাম অথবা উল্টোটি বললেও ভুল হবে না। মধ্যযুগে মঙ্গোল সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। ভ্রমণকারী এলিজা বিনতে এলাহী একবিংশ শতাব্দীতে কেমন দেখলেন আজকের মঙ্গোলিয়া? সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করবেন ধারাবাহিকভাবে।
সেই ছেলেবেলা থেকে তেমুজিনকে নিয়ে জানাশোনা। আমার পরিণত ভ্রমণপ্রেম তাই সংগত কারণেই তাঁর ভূখণ্ড দেখার জন্য ব্যাকুল হবেই। কিন্তু পরিকল্পনা বারবার ভেস্তে যাচ্ছিল। ভাবলাম, আবার চেষ্টা করি। সেই একই বিপত্তি, ভিসা–বিভ্রাট। তবে অনেক খোঁজখবর করে, কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে তেমুজিনের দেশ ভ্রমণের সম্মতিপত্র, ই–ভিসা পেলাম। ট্রাভেল এজেন্সি বলছিল মাত্র এক মাসের ভিসা পাব। আচমকা একদিন ইমিগ্রেশন থেকে একটি ফরম পাঠানো হলো। এযাবৎ কতগুলো দেশ ভ্রমণ করেছি তার বিশদ তালিকা চাইলে সেটি পূরণ করতেও ভীষণ আলসেমি লাগছিল। কারণ, ভিসা পাব কি না, কোনো নিশ্চয়তা তখনো পাইনি। দিন দশেক পর ই–মেইলে ভিসা এল। ছয় মাসের ভিসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু থাকতে পারব শুধু ৯ দিন। এই স্তেপ-মরু অঞ্চলে গিয়েও কি আমাদের দেশের মানুষেরা ওভার-স্টে করে? নয়তো এত কঠোর হওয়ার কারণ কী হতে পারে?
একটি দেশ ঠিকঠাকভাবে ঘুরে দেখার জন্য ৯ দিন অনেক অল্প সময়। মাত্র ৯ দিনে একটি ভূখণ্ডের ইতিহাস, রূপ-রস-গন্ধ অনুধাবন কিংবা ধারণ করা দুরূহ। অবশ্য শূন্যের চেয়ে এক ভালো। উপরন্তু টাকায় আয় করে ডলারে ব্যয় করার মতো বিত্তশালী আমি কখনোই ছিলাম না যে ভূখণ্ডগুলোতে মাসাধিককাল কাটিয়ে দিতে পারি!
যাহোক, ভিসার ছয় মাস সময়কাল পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাকে দারুণ সহায়তা করল। প্রথম কাজ বিমান টিকিট কাটা। ৯ দিন কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। কারণ, এয়ার চায়নার ফ্লাইট প্রতিদিন নেই। বাংলাদেশ থেকে মঙ্গোলিয়া যেতে এয়ার চায়না নতুন ফ্লাইট চালু করেছে। এই বিমানে অল্প সময়ে একটি ট্রানজিট নিয়ে পৌঁছানো যাবে। আগে দুটো ট্রানজিট নিতে হতো ভিন্ন বিমানে, তখন ২৪ ঘণ্টা লাগত তেমুজিনের ভূখণ্ডে যেতে। আট দিনের পরিকল্পনা নিয়ে বের হলাম। সঙ্গে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আছেন গৃহবন্ধু ফাইয়াজ আলম খান। ২০২৩ সালে আফ্রিকার তিন দেশ ভ্রমণ করেছি একত্রে। আবার দুই বছর পর বের হলাম। মাঝে আমি একাই বিশ্বভ্রমণ করেছি।
রাশিয়া ও চীনের মধ্যে চিড়েচ্যাপটা ভূখণ্ডটি দেখব বলে রওনা দিলাম। ফ্লাইট কিছুটা লম্বা। হাতে যখনই ই-ভিসা থাকে, তখনই মনে হয় ইমিগ্রেশনের নিরাপত্তা বলয় পার হতে মেলা কথা খরচ করতে হবে। বারকয়েক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় মানে, স্যারদের—স্যারের সঙ্গে কথোপকথন শেষ হওয়ার পর আমাদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো।
ট্রানজিট বেইজিং শহরে। শেষবার চীন ভ্রমণ করেছি সেই ২০১৫ সালে। তারপর আর ওমুখো হইনি। চীনা উড়োজাহাজে খাবারের বিকট গন্ধ থাকে, গত ভ্রমণের স্মৃতি থেকেই বলছি। তা ছাড়া আমি সব সময় বাজেট প্লেনে ভ্রমণ করি, তাই একটু–আধটু সীমাবদ্ধতা মেনে নিতেই হয়। এবার এয়ার চায়নাতে সে রকম কোনো গন্ধ পাইনি। খাবার দেওয়া হলো, দুটি বক্সে। একটিতে ভাত, সবজি আর গরুর মাংস। অন্যটিতে কলা, ব্রেড। নিরেট দাগহীন কলা দেখে ছিলতেই ভয় পাচ্ছিলাম। চাঁদেরও কলঙ্ক রয়েছে, কিন্তু চায়নিজ কলায় কোনো দাগ নেই। একেবারে পেলব ত্বক। কলা যেমন ছিল, তেমনই রেখে দিলাম। ভাতগুলো একেবারে চকচক করছিল। ভয়ে ভয়ে মুখে দিলাম। এ রকম প্লাস্টিক ভাত আর গরুর মাংস আমি কোনো দিন খাইনি। স্বাদ, গন্ধ নেই। ৫ ঘণ্টা ১০ মিনিট পর নামলাম বেইজিং এয়ারপোর্টে। অল্প সময়ের ট্রানজিট।
বেইজিং থেকে দুই ঘণ্টায় মঙ্গোল রাজ্যে পৌঁছালাম। উড়োজাহাজের জানালা থেকে দেখছিলাম কেবল বাদামিরঙা পাহাড় আর খালি প্রান্তর, প্রান্তর ভেদ করে কিছু সরু পথ চলে গেছে। এমাথা–ওমাথা দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে দু–একটা বাড়ির অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রাজধানী শহরে কি জনমানব নেই! এই দেশ কি জনশূন্য? যখন উড়োজাহাজ রানওয়েতে, তখনো দেখতে পাচ্ছি চারদিকে বাদামিরঙা পাহাড়। পাহাড়ের মধ্যে এয়ারপোর্ট।
তেমুজিনের দেশ মঙ্গোলিয়ায় অবশেষে সত্যিই পদার্পণ করেছি! রাজধানী উলনবাটোরের চেঙ্গিস খান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিশ্ববিজেতা চেঙ্গিস খানের আসল নাম তেমুজিন। চেঙ্গিস খান তাঁর উপাধি। তিনি রাজাদের রাজা! মঙ্গোলরা তাঁকে ডাকে চিঙ্গিজ খান নামে। সব মঙ্গোল ও তুর্কি উপজাতিদের ঐক্যবদ্ধ করার কারণে গোত্রপ্রধানরা তাঁকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান উপাধি দেন। তেমুজিনের গল্প পরে হবে। সবে তো এলাম।
বিনা বাক্যব্যয়ে মঙ্গোলিয়া ইমিগ্রেশন পার হলাম। বাক্স-পেটরা পেলাম অল্প সময়ের মধ্যেই। এয়ারপোর্টের ইন্টারনেট ব্যবহার করলাম। ফোন খুলতেই ভেসে উঠল মঙ্গোলিয়ার গাইড তুসিনতুরের খুদে বার্তা—‘Eliza waiting for you! Welcome to Mongolia.’
এয়ারপোর্টটি খুব বেশি বড় নয়। তবে ছিমছাম গোছানো। বাইরের তাপমাত্রা সহনীয়। আমি ভেবেছিলাম কিছুটা ঠান্ডা অনুভব হবে। রোদের প্রকোপ রয়েছে। খোলা প্রান্তর, বেশ বাতাস বইছে। আমাদের যেতে হবে উলনবাটোর মূল শহরে। এয়ারপোর্ট থেকে দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। গাইড সাবধান করে দিল এই শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা বিষয়ে। জানতে চাইল আমরা আগে হোটেলে চেক-ইন করব নাকি দুপুরের খাবার খাব। সেই গতকাল বিকেলে বাসা থেকে রওনা করেছি, এখন দুপুর ১২টা বাজে। তাই একটু ফ্রেশ হয়েই বেরোতে চাচ্ছিলাম। গাইডও সম্মতি জানাল। গাইড তুসিনতুর আর ড্রাইভার আর্থ আগামী আট দিন সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গে থাকবে। তুসিনতুর বেশ ইংরেজি বলে। কিন্তু আর্থের ইংরেজি ইয়েস, নো, ভেরিগুডের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই সব সময় মুখটা হাসি হাসি করে রাখে।
জিপ যাচ্ছে তো যাচ্ছে। চারদিকে সেই বাদামিরঙা ছোট ছোট টিলার মতো। ফাঁকা উঁচুনিচু পথ। পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে এই শহর। বেশ খানিকটা দূরত্বে কয়েকটি করে দালান চোখে পড়ছে। এ রকম পথ চলতে থাকল মিনিট বিশেক। আমাদের পথটি শহরের উঁচু অংশে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম নিচে শহরের অবয়ব। লাল রঙের দালানকোঠা দেখা যাচ্ছে। সামনে উলনবাটোর শহর। কই, ট্রাফিক তো নেই। মনে হলো, এই তো চলে এসেছি। জিপ একটি মোড় নিল। তারপর শহর হারিয়ে গেল।
সামনে দেখা গেল হাজার হাজার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাইড বলল, ট্রাফিক শুরু হলো। জ্যামে বসে কখন চোখ বুজে গেছে বুঝিনি। প্রায় আধঘণ্টা পর ফাইয়াজের ডাকে চোখ মেললাম। একই জায়গায় রয়েছি? ফাইয়াজ জানাল, দুই ইঞ্চি এগিয়েছি কেবল। এই ট্রাফিক তো আমাদের জাদুর শহরের চেয়ে কঠিন। তবে একটি তফাত আছে—হর্নের শব্দ নেই। শহরজুড়ে আধুনিক বাস, উঁচু ইমারত।
উলনবাটোরের ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে অনেক কিছুই চোখে পড়ছে। ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল, পুরোনো ধরনের সোভিয়েত বিল্ডিং, মনেস্ট্রি, ব্যাংক, স্টক এক্সচেঞ্জ, ছয় লেনের রাস্তা। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো কোনো গাড়ির রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ, কোনো গাড়ির লেফট হ্যান্ড! ট্রাফিকিং সিস্টেম অবশ্য ব্রিটিশ উপনিবেশের দেশগুলোর উল্টো। ওহ্! বলতে ভুলে গেছি, আমাদের জিপ ফোর হুইলার এবং লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ।
এ রকম শম্বুকগতিতে উলনবাটোর শহরের কেন্দ্রে হোটেল নাইনে এসে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা লাগল। হোটেলের রিসিপশনে তুসিনতুর নিজ ভাষায় কথা বলতে লাগল। আবার মোবাইলেও কথা বলছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছি। বুঝতে পারছি কিছু জটিলতা রয়েছে। তুসিনতুর জানাল, ট্রাভেল এজেন্সি থেকে হোটেল রুম কনফার্ম করা হয়নি। রুম রেডি নেই। কিছু সময় প্রয়োজন। তুসিনতুরের পরামর্শ, এই ফাঁকে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে শহরে একটা চক্কর দিতে পারি।
ইউরোপের মতো মঙ্গোলিয়ায়ও গ্রীষ্মকালে দিন বেশ বড়। সূর্য অস্ত যাবে সন্ধ্যা ৯টায়! গ্রীষ্মে ইউরোপেও একই অসুবিধা হতো। আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। গাইড বলল, যেহেতু শহরে ট্রাফিক জ্যাম খুব বেশি, আমরা জিপ ছেড়ে হেঁটে রেস্তোরাঁয় যেতে পারি। খুব বেশি দূরে নয়!