নাভারন দ্বীপের শ্বেত ভাস্কর্য

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

পাভলোর মোট তিনটি বিড়াল—তিনটি ভিন্ন রঙের। সাদা, কালো আর ধূসর। তিনজনের প্রিয় বসার স্থানও ভিন্ন ভিন্ন। সাদাটি সর্বদা বসে থাকে দোতলার ছাদের কার্নিশে। কালোটি বসে থাকে কমলালেবুগাছের কোমল ছায়ায়। আর ধূসর রঙেরটি একতলার ছাদে পেতে রাখা টেবিলের কোণে। এই তিনটি বিড়ালের জন্য সকালের প্রাতরাশটা একটু ঝামেলাপূর্ণ হয়ে যায়। টেবিলে দুধ আর রুটি—এ দুটি বস্তু দেখলেই একজন পাশের চেয়ারে বসল তো ভিন্নজন এসে একেবারে টেবিলের ওপর আসন গেড়ে বসে গেলেন। সে এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। আবার যেহেতু পাভলোর পোষা আদুরে বিড়াল, তাই যে খুব করে কষে ধমক দিয়ে দাবড়ে দেব, সেটিও হচ্ছে না।

সকালের দিকটায় পাভলোর বেশ ব্যস্ত সময়। ওর বউ রান্নাঘরে চায়ের জল গরম করছে, আর ও দৌড়ে বউকে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। দুটি ছেলের মধ্যে যেটির বয়স সাড়ে তিন, সেটি গুটিগুটি পায়ে সারা ছাদ হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর ছয় মাসের ছোটটি প্যারাম্বুলেটরে বসে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে। দৌড়োদৌড়ির মধ্যে পাভলো কিছুক্ষণ পরপরই ছুটে গিয়ে দেখে আসছে ছোটটি কাঁদছে কি না।

‘আজ আমাদের গ্রামের বেকারিটা খুলেছে বেশ বেলা করে। এ জন্যই রুটি তুলে এখানে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।’ বেশ খানিকটা লজ্জিত মুখে পাভলো বলে।

পাভলোদের গ্রাম, মানে মারিতসা নামের ছোট্ট জনপদ—এখানে থেকে ঘণ্টাখানেক দূরের পথ। বাস আছে। পাভলো আর ওর বউ সাতসকালেই দুই ছেলেকে নিয়ে চলে আসে এই সরাইখানায়। বউ প্রাতরাশ বানায়। এরপর বেলা এগারোটা নাগাদ আবার বাড়ি ফিরে যায়। পাভলো থাকে সন্ধ্যা অবধি।

বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত প্রায় দুই শ বছরের পুরোনো স্থাপনা
ছবি: লেখক

এই সরাইখানার মালিক কিন্তু ওরাই। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত। তবে সেটিকে হয়তো পৈতৃক সূত্র না বলে প্রপৈতৃক সূত্র বলাই ভালো। কারণ, বংশানুক্রমিকভাবে এ স্থাপনাটির মালিক ওর পরিবার গত প্রায় দুই শ বছর ধরে। এমনটি খুব কমই দেখা যায়। অধিকাংশ সময়েই উত্তর প্রজন্ম নানা কারণে সম্পত্তি ছেড়ে দেয়। পাভলোর ক্ষেত্রেও তেমনটি হওয়ার কিছু সম্ভাবনা ছিল। কারণ, ওর একমাত্র বোন চলে গেছে জার্মানিতে। তার আর গ্রিসে ফেরার ইচ্ছে নেই। কিন্তু শুধু বাপ–ঠাকুরদার ব্যবসাকে আগলে রাখবে বলে পাভলো রয়ে গেছে গ্রিসের সর্ব পূর্ব প্রান্তের এই রোডস দ্বীপে। তাতে করে ও যে অসুখী তা কিন্তু নয়। বরং উল্টো। এই তো আমাকে বলছিল, ‘আমি এই সরাইখানা নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি অবধি পুরোপুরি বন্ধ রাখি। এই আর এক সপ্তাহ আগে এলেই বন্ধ পেতে। ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটাই ওই চার মাস। জীবনধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু হলেই আমি আর আমার বউ খুশি। খুব বেশি কিছু চাই না আমরা।’

কিন্তু আট মাসের আয় দিয়ে পুরো বছর চলে তোমাদের?

দাঁড়িতে একটু হাত বুলিয়ে ও বলে, ‘হ্যাঁ, তা চলে। দেখতেই তো পাচ্ছ, এটি একেবারে দুর্গের মধ্যে। বেশ স্বকীয়। ঝাঁ চকচকে হোটেল রেস্তোরাঁ, আধুনিক স্থাপনা তো কতই আছে। কিন্তু এমন কয়েক শ বছরের পুরোনো পাথরনির্মিত সরাইখানা লোকে কোথায় পাবে! আমার এখানে তাই সিজনে রুম খালি থাকে না। বেশ চড়া দামেই লোকে রুম বুক করে।’

আজ বেশ মিষ্টি রোদ উঠেছে। ছাদের পাশে লতিয়ে বেড়ে ওঠা বোগেনভেলিয়াগাছটা সেই সোনা রোদ মেখে মেলে দিয়েছে সব কটি ফুলের পাপড়ি। হালকা শীত। দু–একটা পাখি ডাকছে। উড়ে যাচ্ছে এগাছ থেকে ওগাছে। বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ। মন ভালো করে দেওয়ার মতো একটা সকাল। আমার তাড়া আছে। আবার নেই। সকাল নয়টার বাস ধরতে পারলে ভালো। না হলেও ক্ষতি নেই তেমন। পরেরটি অবশ্য ঘণ্টাখানেক বাদে।

পাভলো লেমনেডের শরবত তৈরি করছে খুব সম্ভবত। কাচের জগে চামচের টুংটাং শব্দ পাচ্ছি। সেই ফাঁকে পকেট থেকে পাসপোর্টটা বের করে টেবিলে বিছিয়ে রাখি। প্রাতরাশের সময়টায় যদি একটু রোদে শুকোয় আরকি। না, ওটি বৃষ্টিতে ভেজেনি। বেড সাইড টেবিলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি, নৌকার খোলের মতো বেঁকে আছে। স্পর্শ করে বুঝি, একদম যেন ভিজে আছে। তার মানে, চারদিকে প্রচুর জলীয় বাষ্প। কিন্তু সেটিই-বা কী করে হয়! বৃষ্টি নেই, বাদলা নেই। তবে?

‘যে ঘরে আমরা আছি, ওটা আসলে পাথরের গুহার মতো। পাথর খুব জল ধরে রাখে। আর বাইরের সঙ্গে তাপমাত্রারও একটা বিরাট ফারাক করে দেয়। ও জন্যই মনে হয় তোমার পাসপোর্টটা গেছে।’ পেছনে দাঁড়িয়ে ডন বলে। ডন আর ওর বউ মেরি সবে নেমে এল সকালের খাবারের জন্য। গোটা বাড়িতে এই ওরা আর আমি। ওরা এসেছে পুরো এক সপ্তাহের জন্য। স্বামী-স্ত্রী দুজনের বয়সই ষাটের কোঠায়। ডনের জন্য এবারই প্রথম গ্রিসে আসা। আর মেরি? সেই আশির দশকে, মানে মেরি যখন টগবগে তরুণী, তখন বান্ধবীদের সঙ্গে দল বেঁধে এথেন্সে এসেছিল। এরপর আর আসা হয়নি।

ওদের সঙ্গে গতকাল আমার প্রথম আলাপ। এই হোটেলে নয় অবশ্য। তখন দুপুরের সময়। এখান থেকে একটু দূরে এই দুর্গ শহরের ভেতরে খাবার খুঁজছি। অধিকাংশ রেস্তোরাঁই বন্ধ। এপ্রিলের আগে নাকি খুলবে না। অল্প খদ্দের সামলে ওরা ব্যবসা করতে পারে না। পাথর বেছানো পথে হাঁটছি। এভাবে পৌঁছে গেলাম দুর্গের একেবারে শেষ প্রান্তে। একটু খোলা চত্বর। মধ্যিখানে ফোয়ারা। তাতে জল নেই। দুই পাশে দোতলা বাড়ি। সুবিধামতো দোকান পেলাম একটা। নাম প্রেসিডেন্ট অব কেবাব। ঢুকতে যাব, এমন সময়ে দেখি বেশ রাগত ভঙ্গিতে এই দম্পতি বেরিয়ে আসছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় বলে ফেললেন, ‘ডাকাত। সাক্ষাৎ ডাকাত এরা। মেন্যুর দামের জায়গায় কাগজ মেরে রেখেছে। খাবার শেষ করে দেখি, দশ ইউরোর খাবারের দাম চাইছে ত্রিশ ইউরো। বোঝো একবার।’ আর একটুক্ষণ পরে এলেই হয়তো আমিও না জেনে বাড়তি বিশটি ইউরো গচ্চা দিয়ে বসতাম। এই দম্পতি বাঁচিয়ে দিলেন।

সমুদ্রের ধারে কয়েকটা বায়ুকল। আধুনিক নয়। বহুকাল আগেকার। সেই ত্রয়োদশ শতকের। পাখাগুলো কাঠের। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মাকড়সার জাল। সেকালে এই দিয়ে শস্য ভাঙানো হতো। ইজিয়ান সাগর থেকে ধেয়ে আসা হাওয়ায় ওগুলো ঘুরছে। একটা টংঘর। বিক্রি হচ্ছে বিড়ি-চুরুট, কোক-সেভেন আপ।
প্রেসিডেন্ট অব কেবাব
ছবি: লেখক

এরপর ওরাই আমাকে বললেন, ‘ইয়ং ম্যান। তোমাকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি। মিনিট দশেক হেঁটে দুর্গের বাইরে যাও। একটা মার্কেট পাবে। ওর ভেতরে এক কোণে এমন একটা কাবাবের দোকান আছে। বড়জোর হয়তো সাত-আট ইউরো নেবে। মেরি বড্ড ক্লান্ত বলে আমরা ভেবেছিলাম, কাছেই যেহেতু এই কাবাব শপ, তাই এখানেই খাবার সেরে নেই। দিল গলাটা কেটে।’

যে মার্কেটের কথা ওরা বলছিল, সেটি একতলা। গোলাকার। অনেকটা যেন ঢাকা নিউমার্কেটের মত। দোকানের সামনে প্যাসেজ। অধিকাংশরই শাটার বন্ধ। যে দু–চারটে খোলা আছে, তাদের অধিকাংশ বিক্রি করছে সাঁতারের জাঙ্গিয়া কিংবা চটি জুতো। আর হ্যাঁ, এসবের সঙ্গে খোলা ছিল ‘গ্রিক আরকিপিলাগো’ নামক কাবাব শপটি। ভাগ্যিস ছিল। সে কারণেই গত দুপুরটা পার করতে পেরেছিলাম আট ইউরো দিয়েই।

এই যে গোলাকার মার্কেটটা ছিমছাম। জৌলুশহীন। তবে সেটি দেয়ালের রং কিংবা প্যাসেজের পুরোনো হলদেটে টাইলসের দিক থেকে। ওদিকে আবার সাগর থেকে যে মাত্র দুকদম দূরে এর অবস্থান, সেটি যদি বলি, তাহলে আর এটিকে হেলাফেলা করা যায় না। এমন এক দুর্দান্ত জায়গায় আগে এমন কোনো মার্কেট দেখেছি কি না, সন্দেহ।

চিকেন কাবাব র‌্যাপ কিংবা ওরা যেটিকে গ্রিক দেশে বলে সুভ্লাকি, সেটি ভক্ষণ শেষে মনে হলো, এবারে তবে দুর্গের ভেতরে জাদুঘরটা আছে, ওটা দেখে নেওয়া যায়। বিকেল হতে মেলা দেরি।

একতলা মার্কেট
ছবি: লেখক

সমুদ্রের ধারে কয়েকটা বায়ুকল। আধুনিক নয়। বহুকাল আগেকার। সেই ত্রয়োদশ শতকের। পাখাগুলো কাঠের। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মাকড়সার জাল। সেকালে এই দিয়ে শস্য ভাঙানো হতো। ইজিয়ান সাগর থেকে ধেয়ে আসা হাওয়ায় ওগুলো ঘুরছে। একটা টংঘর। বিক্রি হচ্ছে বিড়ি-চুরুট, কোক-সেভেন আপ। তাকে পাশ কাটিয়ে আমি আবার দুর্গ শহরে ঢুকি। বাঁ পাশে পড়ে থাকে ইজিয়ানের টলটলে জলে মুখ চুবিয়ে ডুবে থাকা নুড়িপাথর।

এই যে দুর্গ বা দুর্গ শহর, বলা চলে এর টানেই না এলাম এই দ্বীপে। সেই কবে, কোনকালে দেখেছিলাম ‘গানস অব নাভারন’ সিনেমাটি। ১৯৬৫ সালে নির্মিত। দুর্দান্ত সিনেমা। রোমাঞ্চে ভরপুর। নাৎসি যোদ্ধারা দখল করে নিয়েছে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এক দ্বীপ। দ্বীপে অবস্থিত দুর্গের মাথায় বসানো বিশেষ, বিশাল কামান। যেন সমুদ্র থেকে মিত্রবাহিনীর জাহাজ এগিয়ে এলেই কামান থেকে গোলা ছুড়ে ডুবিয়ে দেওয়া যায়। ওদিকে ইউরোপ থেকে আফ্রিকা যাওয়ার নৌপথ হিসেবে এ দিকটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ কমান্ডো দলের ওপর ভার পড়ল দ্বীপে গিয়ে সেই বিশেষ কামানের স্থাপনাটি পুরোপুরি ধ্বংস করার। কিংবদন্তি অভিনেতা গ্রেগ্রি পেক অভিনয় করেছিলেন কমান্ডো দলটির দলনেতা হিসেবে।

সিনেমাটি কিন্তু বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত নয়। কাল্পনিক। কিন্তু সিনেমার পরিচালকের গুনে দর্শক ভাবতে বাধ্য হয়, ঘটনাটি বাস্তব না হয়েই যায়ই না। কাহিনি কাল্পনিক হলেও এ সিনেমা যে দুর্গ আর দ্বীপে চিত্রায়িত হয়েছিল, সেগুলো কিন্তু স্টুডিওর মেকি সেট নয়। বাস্তবেও সেই দুর্গম দুর্গ আছে, দ্বীপ আছে, দুর্গ শহরে ঢুকবার পাথরের সেতু আছে। আর সেসব দেখব বলেই না রোডস দ্বীপে আসা।

‘গানস অব নাভারন’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য শুধু ‘গানস অব নাভারন’-ই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত আরও একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন হয়েছিল এ দ্বীপে। এস্কেপ ফ্রম এথিনা। একটু কমেডি ধাঁচের ছবি। সত্তরের দশকে জেমস বন্ডের ছবিতে অভিনয় করে সাড়া ফেলা দেওয়া ব্রিটিশ অভিনেতা রজার মুর অভিনয় করেছিলেন এ সিনেমায়। সেই আমেরিকান দম্পতির সাথে পুরোনো শহরের ফোয়ারার কাছে যে জায়গাটায় দেখা হলো, সেটিও বেশ কয়েকবার এসেছে এ সিনেমায়।

আমার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে অবশ্য বেশি গেঁথে আছে ‘গানস অব নাভারন’–এর দৃশ্যগুলো। সেগুলোকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে আমি পৌঁছে যাই পাথরের সেতুটির কাছে, যেটি পেরিয়ে রাতের আঁধারে ব্রিটিশ কমান্ডো দলের ট্রাক ঢুকে গিয়েছিল দুর্গের অভ্যন্তরভাগে। এখন অবশ্য রাতের সময় নয়; রৌদ্রালোকিত দুপুর। একটু দূরে মলিন শার্ট পরা এক লোক বেহালা হাতে বেঞ্চে বসে আছে। আমি একটু কাছে এগুলেই তিনি বেহালাটিকে কোল থেকে তুলে নিয়ে ঘাড়ের কাছে জাপটে ধরেন। বেজে ওঠে সুর। অনুদান চাইবার এও এক পন্থা। পকেট থেকে দুই ইউরোর একটা কয়েন বের করে তার বেহালার বাক্সে রাখতেই বিনয়ী একটা হাসি উপহার দেন।

মূর্তি যাঁরা গড়তেন, তাঁরা অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন বিশাল এই দেশের নানা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। গ্রিসের সেরা শিল্পীরা ছিলেন ক্রিট, মাইলো, রোডস—এমন সব বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। তাঁদেরই একজন দিওদিলসাস। আর তাঁরই এক অমর কীর্তি ভেনাস অব রোডস।
চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত দুর্গ
ছবি: লেখক

আমি এবারে আসি দুর্গের একেবারে মধ্যিখানে। সিনেমায় দেখানো হয়েছিল, এখানেই জড়ো করা ছিল নাৎসি বাহিনীর সাঁজোয়া ট্রাক। আর চারদিকের ভবনগুলোতে ছিল নাৎসি বাহিনীর ব্যারাক। এখনকার এই সময়ে ভবনগুলো সবই আছে, তবে নেই কেবল কোনো ব্যারাক, সেনাদের হাঁকডাক। একেবারেই কিছু নেই, তা অবশ্য নয়। একটা জাদুঘর আছে। আর আছে টিকেট বেচবার ছোট্ট ঘর।

টিকেট কেটে ভেতরের চত্বরে ঢুকতে দেখি, ভবনের বিভিন্ন কোণে বেশ কিছু গোলাকার বল সাজিয়ে রাখা। যেন সেই মোগল আমলের কামানের গোলা। প্রস্তরনির্মিত। হাজার দুয়েকের বেশি বছর আগে গ্রিকরা কেন এমন নিখুঁতভাবে পাথর কেটে গোলাকার বল নির্মাণ করেছিল, তার সঠিক কারণ আজও অজানা।

সেই দুই হাজারের বেশি আগের সময়ে পৃথিবীতে যে কয়টি জাতি মূর্তি গড়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল মিসরীয়, এসিরিয়ান, গ্রিক আর ভারতীয়রা। এরা সবাই দুর্দান্ত সব মূর্তি গড়লেও একেকটি জাতি ব্যবহার করেছে একেক ধরনের পাথর। যেমন মিসরীয়রা ব্যবহার করত বেলেপাথর বা গ্রানাইট। এসিরীয়রা জিপসাম। ভারতীয়রা ব্যবহার করত বেলেপাথর আর কষ্টি পাথর। অন্যদিকে গ্রিকরা মূলত ব্যবহার করত মার্বেল পাথর।

গ্রিকদের মার্বেল পাথর দিয়ে মূর্তি গড়ার কারণ গ্রিসে মার্বেল পাথরের সহজলভ্যতা। পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মার্বেল পাথরের খনি ছিল গ্রিসে। পেন্তেলিকাস পাহাড় কিংবা পার্স দ্বীপে ছিল বিশাল মজুত। এসব খনিতে এখনো মার্বেল পাথরের মজুত পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়নি। যদিও আগেকার সেই কারিগর আর নেই। তারা হারিয়ে গেছে।

খ্রিষ্টপূর্ব এক থেকে তিন দশক আগেকার মূর্তিগুলোয় আমরা দেখি—সুন্দর, সুঠাম দেহের সব নারী-পুরুষ। তারা কেউ রুগ্ণ নয়। যেন ব্যায়াম করে পিটিয়ে তোলা স্বাস্থ্য। আসলে সেই সময়কালেও গ্রিকরা ছিল খেলাধুলা, খাবার আর শরীরচর্চার প্রতি যত্নশীল। যে কারণে আজও জনপ্রিয় বহু খেলার উৎপত্তিস্থল হিসেবে গ্রিসের নাম উঠে আসে। গ্রিসের খাদ্য সংস্কৃতিকে এখনো পৃথিবীর অন্যতম স্বাস্থ্যকর হিসেবে মনে করা হয়।

মূর্তি যাঁরা গড়তেন, তাঁরা অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন বিশাল এই দেশের নানা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। যদিও এথেন্সে গিয়ে পারথেনন দেখে অনেকেই ভেবে বসতে পারে, কেবল এথেন্সেই ছিল সব ভাস্কর্যশিল্পীর মিলনমেলা। বাস্তবে, গ্রিসের সেরা শিল্পীরা ছিলেন ক্রিট, মাইলো, রোডস—এমন সব বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা।

রোডস দ্বীপটির কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলতে হয়। ভূমধ্যসাগরে জেগে থাকা, আজকের তুরস্কের একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি এ দ্বীপে জন্মেছিলেন কিছু সাড়া জাগানো ভাস্কর্যশিল্পী। তাঁদেরই একজন দিওদিলসাস। আর তাঁরই এক অমর কীর্তি ভেনাস অব রোডস।

ভেনাসকে বলা হয় প্রেম আর সৌন্দর্যের দেবী। কেউ প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে গেলে এই ভেনাসের আরেকটি ভাস্কর্য দেখতে পাবেন, সেটিও গ্রিসের মাইলো দ্বীপে গড়া। সে কারণে ওটির নাম—ভেনাস অফ মাইলো। যদিও ভেনাস অব রোডস ভিন দেশের মিউজিয়ামে না গিয়ে কপাল গুণে শোভা পাচ্ছে নিজের জন্মভূমি রোডস দ্বীপের এই জাদুঘরেই।

চলচ্চিত্রে এখানেই জড়ো করা ছিল নাৎসি বাহিনীর সাঁজোয়া ট্রাক
ছবি: লেখক

মূর্তিটি দেখলে মনে হয়, মার্বেল পাথর নয়, যেন মোম দিয়ে গড়া। তেমন সূক্ষ্ম কোনো ভাঁজ নেই। সাজ নেই। চোখের পাপড়ি কিংবা ঠোঁটের কোণগুলো যেন ইচ্ছে করেই নিখুঁতভাবে খোঁদাই করা হয়নি। মূর্তিটি দেখলে মনে হয়—ভাস্কর চেয়েছিলেন, দর্শক যেন এটিকে ঠিক সামনাসামনি না দেখে ডান দিকের ত্রিশ ডিগ্রি কোণে দাঁড়িয়ে দেখে। আর ওখানটায় দাঁড়ালেই দেখা যায়—বুজে আসা চোখ, গ্রিক নাক, কাঁধের বঙ্কিম রেখা, কন্থা, দুটি স্তন, স্তন শীর্ষের অব্যাক্ত রেখা, দুটি স্তনের মাঝ দিয়ে নেমে যাওয়া রেখা, যেটি গিয়ে থেমেছে নাভিকূপে। পেটের আর কোমরের খাঁজ, যেখানে আলো ছায়ার খেলা চলে অবিরাম।

এখানে ভেনাস বসে আছে শরীরটাকে কিছুটা মুচড়িয়ে। হয়তো নিতম্বের বঙ্কিম রেখা আরও উজ্জ্বল করতে, বা যেন কোমরের বাঁকটি খুব সহজেই ধরা পড়ে।

তবে এত কিছু থাকলেও এ মূর্তিতে কোথায় যেন এক শান্ত, শুদ্ধ, কামনারহিত ভাব। দেবীর এই নির্ভীক, নমনীয় ভঙ্গি ঠিক দর্শককে লাস্যময়তায় উদ্দীপ্ত করে না, বরং এক অপার্থিব স্বর্গীয় সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে দর্শককে মোহাবিষ্ট করে।

‘ভেনাস অব রোডস’-এ আমরা নগ্ন ভেনাসকে আবিষ্কার করলেও অধিকাংশ গ্রিক নারী মূর্তিতে ঢোলা পোশাকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যদিও উল্টোটা আবার সত্যি পুরুষ চরিত্রের ভাস্কর্যগুলোর ক্ষেত্রে। তবে নারী কিংবা পুরুষ, উভয়ের ক্ষেত্রেই একটি বিষয় লক্ষ করার মতো—অভিব্যক্তিহীনতা। ঠিক তেমনই একটি প্রায় অক্ষত ভাস্কর্য আবিষ্কার করি এ জাদুঘরের কোণে। অক্ষত বলছি এ কারণে যে প্রায় দুই হাজার বছর আগের এই ভাস্কর্যগুলো যখন আধুনিককালে খননের নানা পর্যায়ে পাওয়া যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়, খণ্ডিত রূপে। কোনোটির মাথা নেই তো, কোনোটির হাত উধাও।

এখানকার বিশেষ ভাস্কর্যটি নিয়ে বলার আগে মনে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, পৃথিবীর বহু দেশের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল কিংবা ফার্মেসির লোগোতে সাপ দেখা যায়। বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের লোগোতেও আছে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক কোথায়?
ভেনাস অফ মাইলো
ছবি: লেখক

এখানকার বিশেষ ভাস্কর্যটি নিয়ে বলার আগে মনে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, পৃথিবীর বহু দেশের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল কিংবা ফার্মেসির লোগোতে সাপ দেখা যায়। লাঠি পেঁচিয়ে থাকা সাপ। কিংবা একটা পেয়ালায় চুমুকরত সাপ। বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের লোগোতেও আছে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক কোথায়? এই প্রশ্ন আমার মনে বহুকাল ছিল।

মূলত এই সাপ এসেছে গ্রিক দেবী হাইজিয়া আর তার পিতা আস্ক্লেপিওসের বাহন হিসেবে। হিন্দু পুরাণে যেমন একটি বিশেষ প্রাণী অধিকাংশ দেব-দেবীর বাহন হিসেবে থাকে, গ্রিক পুরাণেও কিছু কিছু দেব-দেবীর ক্ষেত্রে তেমনটি খুঁজে পাওয়া যায়।

গ্রিক দেবী হাইজিয়া হলেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ও রোগব্যাধি থেকে পরিত্রাণের দেবী। পবিত্র মনে তার মন্দিরে গিয়ে ভক্তি নিবেদন করলে লোকে আরোগ্য লাভ করত। দেবী হাইজিয়ার নাম থেকেই পরবর্তীকালে ইংরেজিতে ‘হাইজিন’ শব্দটির উদ্ভব।

হাইজিয়ার খুব বেশি ফুল সাইজ মূর্তি পাওয়া যায়নি। যে কটি পাওয়া গেছে, সেগুলোর বেশির ভাগের মধ্যে দেখা যায়, তিনি পোষা বলবান সাপটিকে পাত্র থেকে দুধ খাওয়াচ্ছেন। এ জাদুঘরে হাইজিয়ার যে ভাস্কর্যটি আমি দেখি, সেটিও তার ব্যতিক্রম নয়।

লিন্ডোসে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম গতকাল দেখা এই জাদুঘরের নানা ভাস্কর্যের কথা। নয়টার বাস পাইনি। ওটা চলে গেছে। এই বাসস্ট্যান্ডটি গতকালের সেই মার্কেটের এক পাশে। সবুজ রঙের চৌকোনা ঘর। সেখানে দুজন মহিলা বসে টিকিট বিক্রি করছেন। এখান থেকে বাস যায় দ্বীপের নানা প্রান্তে। একেবারে ছোট দ্বীপ নয় এটি। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যেতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক লাগে। আর লিন্ডোস, মানে যেখানে আজ সকালে যেতে চাচ্ছি, সেখানে লাগে এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের মতো। পথ চল্লিশ কিলোমিটারেরও কম।

বাস ছুটে চলে রোডস দ্বীপের নানা গ্রাম, ছোট পাড়া, গঞ্জ পেরিয়ে। লোকাল বাস। একটু পর পর থামছে। কোনো জায়গা থেকে উঠছে একঝাঁক স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে। খলবল করে নেমে যাচ্ছে দু–তিন স্টপেজ পরে। কোনোখানে হয়তো কাপড়ের ব্যাগে ঠেসেঠুসে জিনিস নিয়ে ওঠে গ্রামের চাষি। মাঝেমধ্যে দুই ধারে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের সারি। তাদের গায়ে লেগে থাকা সহস্র বছরের পুরোনো পাথরের চাঁই। চাষি বাড়ির ডালিমবাগান। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা বুনো ঘোড়া। বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা মোটরসাইকেল। জলপাই বন। হলদেটে মাটির রুক্ষ প্রান্তর। এমন নানান কিছু পেরোনোর সময়ে বাসের রেকর্ড প্লেয়ারে বাজে হাল আমলের আমেরিকান শিল্পীদের গান। এ পরিবেশে এমন গান একদমই মানায় না। এর চেয়ে বরং ম্যান্ডোলিনের সঙ্গে কোনো গ্রিক সুর বেজে উঠলে বেশ হতো।