আক্রা নগরীতে হাইস্কুল সুইটহার্ট ও মোমের চিত্রকলা

মা ও শিশু হরিণ
মা ও শিশু হরিণ

(প্রথম পর্ব)

ঘানা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ড্রাইভ করতে করতে ফ্রেড বিলেতি কেতায় চাঁদিতে ঘড়ি লাগানো দালানটির কাছে একটু থেমে তারপর ঢুকে পড়েন সংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনের পিচঢালা সড়কে। রাস্তাটির একপাশে লতানো উদ্ভিদকে বাঁকিয়ে টোপিয়ারি পদ্ধতিতে তৈরি দীর্ঘ সবুজ ফেন্স। প্যাসেনজার্স সিটে বসে আমি ভাবি, আক্রা নগরীতে ফ্রেড তার হাইস্কুল সুইটহার্টের তালাশ পেয়েছেন, দিস ইজ হাইলি ইন্টারেস্টিং!

ঘানার রাজধানী আক্রাতে এসে বছর কয়েক পর ফের যোগাযোগ হলো ফ্রেডের সঙ্গে। ২০০৯ সালের দিকে আমরা কাবুল শহরে মাস কয়েক পাশাপাশি কামরায় বাস করেছিলাম। আমি হাইয়ার এডুকেশন প্রজেক্টের তরফে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করছিলাম। আমার সিনিয়র সহকর্মী ড. ফ্রেড শ্যাংম্যানের দায়িত্ব ছিল কারিকুলাম উন্নয়নের সহায়তা দেওয়া। বছর চারেক আগে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ডিভোর্স দিয়েছেন। একাকিত্ব প্রকট হয়ে উঠলে ফ্রেড ফেসবুক বিছরিয়ে তাঁর হাইস্কুলজীবনের সুইটহার্ট ট্রুডিকে লকেট করেছেন আক্রায়। সত্তর দশকের প্রথম দিকে ফ্রেড ও ট্রুডির পরিবার কূটনৈতিক পেশার কারণে বছর দুয়েক বাস করেছিল আক্রায়। এখানকার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে সতীর্থ থাকাবস্থায় তাঁরা পরস্পরকে ভালোবাসেন এবং বছর দেড়েক ডেট করেন। বর্তমানে বিধবা ট্রুডি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে আক্রাতে কর্মরত। ফ্রেডের তালাশ পেয়ে তিনি তাঁকে লিভ টুগেদার করতে ইনভাইট করেছেন।

আক্রাতে ল্যান্ড করে ফ্রেডের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ হলে তিনি তাঁর আক্রাবাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে আমাকে এসব ব্যক্তিগত তথ্য দেন। শুনে আমি ট্রুডিকে চাক্ষুষ করার বাসনা ব্যক্ত করি। তাঁর সঙ্গে সন্ধ্যায় আমার দেখা করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফ্রেড আমাকে নিয়ে আসেন ইউনিভার্সিটি অব ঘানার ক্যাম্পাসে। তিনি জানতে চান, ‘হাউ ডু ইউ লাইক ড্রাইভিং থ্রু দিস ফেমাস ওয়েস্ট আফ্রিকান এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট?’ আমি গাছপালার ফাঁকে অনুষদগুলোর দালানকোঠা দেখতে দেখতে অনুরোধ করি, ‘ফ্রেড, আমাকে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দিলে ভালো হয়।’ কথা বলতে ফ্রেড পছন্দ করেন। তাঁর টুকটাক মন্তব্য থেকে জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে। এক জামানায় ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সঙ্গে একাডেমিকভাবে যুক্ত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওয়েস্ট আফ্রিকার প্রতিটি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ আমলা ও এলিটদের উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হতো। বর্তমানে এখানকার ছাত্রসংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। আফ্রিকার নানা দেশের ছাত্ররাও এখানে পড়াশোনা করছে।

ফ্রেড আরও জানান, তিনি আজকাল আর কনসালট্যান্সি করছেন না, তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এডজাংক্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে একটি কোর্স পড়াচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘কনসালট্যান্সির ধান্দায় নানা দেশে ক্রমাগত ঘুরে বেড়ানোর পরিণতিতে—আই লস্ট ওয়ান ইম্পরট্যান্ট উইমেন ইন মাই লাইফ, মেরি এ কারণে আমাকে ছেড়ে গেছে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লুজ মাই হাইস্কুল সুইটহার্ট ট্রুডি।’

আসান্তে রাজ্যের রাজার লাইফ-সাইফ ফটোগ্রাফ
আসান্তে রাজ্যের রাজার লাইফ-সাইফ ফটোগ্রাফ

গাড়ি পার্ক করে আমাকে নিয়ে ফ্রেড অতঃপর হেঁটে চলে আসেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের অজস্র বোল্ডারে পূর্ণ একটি পরিসরে। তার ভেতর দিয়ে কেটে কেটে বয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত সংকীর্ণ একটি ছড়া-নদী। ওখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই, খানিক দূরে বাঁশঝাড়ের তলায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসে গল্পগুজব করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা।

আমরা পাথরের পরিসর ছেড়ে চুপচাপ বনানীর ভেতর দিয়ে আগ বাড়ি। ফ্রেড জানতে চান, ‘হাউ ডু ইউ লাইক দিস প্লেস?’ আমি নিসর্গের মৌন শুশ্রূষায় উদ্দীপ্ত হয়ে জবাব দিই, ‘দিস ইজ ওয়ান অব দ্য বেস্ট অ্যাটমস্ফিয়ারিক স্পেস আই এভার সিন অ্যানিহোয়ার ইন ওয়েস্ট আফ্রিকা।’ ফ্রেড আমার সঙ্গে একমত হয়ে মন্তব্য করেন, ‘পঞ্চাশ হেক্টরের এ বোটানিক্যাল গার্ডেন...হাউ ডু আই ডেসক্রাইব ইট...আই মাস্ট সে...দ্য বেস্ট আউটডোর পিকনিক স্পট ইন দিস মেগা মেট্রোপলিটন।’

পামগাছের দীর্ঘ সারি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রীতিমতো সরণি। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে—মুখচোরা হরিণগুলো পদশব্দে লুকাচ্ছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। কেন জানি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্রেড বলেন, ‘দিস বোটানিক্যালস ওয়াজ আওয়ার ফেবারিট ডেটিং স্পট। আমাদের দিনযাপনে দুর্যোগ তীব্র হলে মোটরবাইকের পেছনে ট্রুডিকে বসিয়ে এখানে চলে আসতাম।’ জানতে চাই, ‘আপনারা তো তখন ছিলেন টিনএজার, দুর্যোগ বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন, ফ্রেড?’ কোনো দ্বিধা না করে তিনি জবাব দেন, ‘আমাদের দুজনের হেরিটেজ হচ্ছে ইতালিয়ান। আমি ইতালিয়ান—আমেরিকান, তবে ট্রুডিরা হচ্ছে ফ্লরেন্স শহরের বনেদি ইতালিয়ান। সম্পূর্ণ আলাদা দুটি পরিবার, বাস করছে আক্রাতে, কিন্তু আমাদের বেশ কতগুলো সমস্যা ছিল একই রকমের। আমার মা ও ট্রুডির মা দুজনের ছিল অত্যধিক অ্যালকোহলের অ্যাডিকশন। দুজনেই ভুগতেন নানা রকমের ডিপ্রেশনে, তখন আমাদের ওপর শাসনের চোটপাটটা তীব্র হতো। অসহনীয় হয়ে উঠলে আমি ট্রুডিকে নিয়ে চলে আসতাম এখানে।’

হেঁটে হেঁটে চলে আসি শান্ত সুনসান একটি লেকের পাড়ে। একটু দাঁড়াই। পাড়ে বাঁধা একটি নৌকা হ্রদটিকে রীতিমতো ভিউকার্ডের ভিজ্যুয়াল ব্যঞ্জনা দিয়েছে। ওপাড়ে বাতাসে উড়ে বড় বড় লালচে হলুদ রঙের ঝরা পাতা। এখানে হাওয়ার তোড় বেশ প্রবল, মনে হয়, সমুদ্রের তুখোড় তরঙ্গে সার্ফ করার মতো পাতাগুলো তোলপাড় হয়ে উড়ছে। এ দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে অনেক বছর পর কৈশোরে পড়া উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার একটি ছত্র মনে পড়ে, ‘নেচার নেভার ডিড বিট্রে দ্য হার্ট দ্যাট লাভড হার।’ অন্যমনস্ক স্বরে ফ্রেড বলেন, ‘তোমার মতো বার্ড ওয়াচিং করতে ট্রুডি ভালোবাসে। হর্নবিল তার প্রিয় পাখি, এখানে গ্রে হর্নবিল ও পাইপিং হর্নবিল—এ দুই প্রজাতির পাখিরা নীড় বেঁধে বাস করছে। ...বাট, টু ব্যাড, আই ডোন্ট সি অ্যানি হর্নবিল টুডে।’ আমি ওপারের একটি গাছের নিচু ডালে বসে থাকা বর্ণাঢ্য পাখিগুলোর দিকে ইশারা দিই। বাওয়া-বাওয়ি করছে দুটি আফ্রিকান গ্রে প্যারোট। চুপচাপ বসে বসে ঝিমাচ্ছে তিনটি সেনেগালি টিয়া। গাছতলায় ঘাসের বীজ খুঁটছে বেশ কতগুলো রোজ রিংগড প্যারাকিট। অনেক দিন পর আমি নিসর্গ নিবিড় পরিসরে রোজ রিংগড প্যারাকিট বা রংচঙে মুনিয়া পাখিদের দেখলাম। ‘দে জাস্ট মেড মাই ডে, ফ্রেড,’ বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি। ওয়েস্ট আফ্রিকান অর্কিডের গুচ্ছে গুচ্ছে সুশোভিত গাছপালার ওপর দিয়ে তৈরি ক্যানোপি ওয়াকের তলা দিয়ে আমরা পার্কিং লটে ফিরি। হাঁটতে হাঁটতে ফ্রেড বলেন, ‘ডেটিংয়ের সময় আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা হতো প্রচুর। কিন্তু বোটানিক্যাল গার্ডেনের নিসর্গনন্দিত পরিসরে আসলেই আপনা-আপনি ছুটে যেত সমস্যার জট।’

বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বেরিয়ে আমরা এসে পড়ি ট্রাসাকো ভ্যালি নামে নগরীর একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায়। এখানকার চকমিলান দালান-দুমেলা, সবুজাভ ঘাসে ছাওয়া লনগুলোয় উদ্যানচর্চার পরিশীলিত উদ্যোগ ইত্যাদি দেখে এলাকাটি যে আপস্কেইল নেইবারহুড, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। কিছু কিছু ভিলার আঙিনায় ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘের পতাকা দেখতে পেয়ে বুঝতে পারি, এ আবাসিক এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাষ্ট্রদূত প্রমুখের বাসভবনাদি। ট্রুডি যে ভিলাতে বাস করছেন, তার গেটে একাধিক বন্দুকধারী দরোয়ান।

গাড়ি থেকে নেমে আমরা আঙিনার বড় বড় গাছের ছায়ায় ভিলাটির দিকে এগোই। ফ্রেডের কাছে জেনেছি যে তাঁর হাইস্কুল সুইটহার্ট ট্রুডির প্রয়াত হাসবেন্ড ছিলেন অত্যন্ত বিত্তবান একজন ইতালিয়ান শিল্পপতি। আক্রায় নানা কলকারখানায় তাঁর পুঁজি খাটছে। তিনি ভালোবাসতেন আফ্রিকান নিসর্গ, তাই প্রচুর গাছপালা সংগ্রহ করে আক্রায় গড়ে তুলেছিলেন বিলাসবহুল বসতবাড়ি। এখানে এসে বাড়িখানির আকার-আয়তন দেখে আমার চমকে যাওয়ার দশা হয়!

বাগানখানা বিরাট, এতে কেয়ারি করা উদ্যানের কোনো নিদর্শন নেই, বরং গাছপালা ও ঝোপঝাড়গুলোয় পরিচয় মেলে নিষ্ঠাবান একজন মানুষের—যিনি চিন্তাভাবনা করে সংগ্রহ করেছেন হরেক প্রজাতির তরুবর। হাঁটতে হাঁটতে একটি বুদ্ধমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে আমি বিগ্রহটির অনিন্দ্যসুন্দর উপস্থিতিকে অবলোকন করি। একটু তাজ্জবও হই! আফ্রিকার এ আত্রাফে কপিলাবস্তুর রাজকুমারকে অত্যন্ত সুখী হালতে গালে হাত দিয়ে পাথরের পাটাতনে বসে থাকতে দেখব—তা প্রত্যাশা করিনি। ফ্রেডের টুকটাক কথাবার্তা থেকে জানতে পারি, নিঃসন্তান ট্রুডি বৌদ্ধধর্ম আর ইয়োগা নিয়ে দিন কাটান। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বছর তিনেক লেখাপড়া বাদ দিয়ে ট্রুডি নাকি হিপি হয়ে নানা দেশে ব্যাকপ্যাক পিটে ভ্রমণ করেছিলেন। তখন ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরে বেড়ানো সময় তিনি বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হন। তাঁর বিত্তবান স্বামী উপহার হিসেবে এ মূর্তিটি শ্রীলঙ্কা থেকে আনিয়ে দেন।

ইউনিভারসিটি অব ঘানার দালানকোটা
ইউনিভারসিটি অব ঘানার দালানকোটা

চলে আসি পানাপুকুরের মতো একটি জলাশয়ে। পাড়ে পড়ে থাকা একটি গাছের গুঁড়িতে বসে গোটা বারো পাখি যেন আচামনের উদ্যোগ নিচ্ছে। তাদের পালকের আশ্চর্য বর্ণাঢ্যতা আমার মনে সংক্রামিত হয় দ্রুত। চারপাশে বাসরের লাজরক্তিম কনেটির মতো নামছে লালচে-গোলাপি গোধূলি। একটি কাঁচকলার ঝাড়ে প্লানটিন ইটার নামে দুটি পাখি পাকা কলার ভাগ নিয়ে বাধিয়েছে দারুণ কোন্দল। ফ্রেডের সেলফোনে ট্রুডির মেসেজ আসে। তিনি গ্রিনহাউসে বসে পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছেন একটি মাংসাশী উদ্ভিদের পতঙ্গ ভক্ষণ। আমরা দ্রুত চলে আসি গ্রিনহাউসের পরিসরে। সেলফোন দিয়ে পুরো দৃশ্য ভিডিও করতে করতে চোখ তুলে হাসিমুখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমাদের উপস্থিতিকে আমলে আনেন ট্রুডি। আমি অর্কিড, ফার্ন ও নানাবিধ ছোট ছোট উদ্ভিদে জমজমাট গ্রিনহাউসে চুপচাপ দাঁড়াই।

ট্রুডির ফোন-ক্যামেরার সামনে টবে ছোট্ট একটি কাঁটাওয়ালা উদ্ভিদ। এ তরুবরটির নাম ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ। এ ধরনের ছোট্ট তরু যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ও সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের বনানীতে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়। পতঙ্গভুক এ উদ্ভিদকে আক্রায় প্রত্যাশা করিনি। জানতে পারি, ট্রুডির প্রয়াত স্বামী এর চারা আমেরিকা থেকে আমদানি করে গ্রিনহাউসে লাগিয়েছিলেন। মুমূর্ষু হালতে তরুটি বেঁচে আছে বছর দুয়েক ধরে। কিছুদিন আগে ট্রুডির সেবাযত্নে তা সতেজ হয়ে ওঠে।

আমরা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের পাতায় বসা একটি পতঙ্গ দেখতে পাই। অতি ধীরে পত্রের দুদিকের দুটি ভাঁজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কপাটের মতো। পতঙ্গটি যে আটকা পড়েছে—এ ব্যাপারে সে সচেতন হয়ে ওঠে অন্তিম মুহূর্তে, বাট ইট ওয়াজ টু লেট...। বন্ধ হয়ে যায় পাতার কপাট। ভেতরে পতঙ্গটির ছটফটানোর ছায়া খানিক দূরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পাই।

পুরো দৃশ্যটি আইফোনে ভিডিও করে ট্রুডি বেরিয়ে আসেন গ্রিনহাউস থেকে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। ফ্রেড আগেই আমার কথা ট্রুডিকে বিস্তারিত বলে রেখেছেন, তিনি উষ্ণভাবে বলেন, ‘সো ইউ আর দ্য সুলতান, হু ওয়ার্কড উইথ মাই হাইস্কুল সুইটহার্ট ফ্রেড।’ তিনি বৌদ্ধ শিষ্টাচারানুযায়ী দুহাত জোড় করে বুকের কাছে নিয়ে এসে আমাকে প্রণাম করেন। ট্রুডিকে দেখামাত্রই মনে হয়...শি ইজ ওয়ান্ডারফুল, তার চোখ দুটো যেন ভালোবাসার আবেশে মদির হয়ে আছে। প্রণামের জবাবে আমিও মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁকে বাও করি। তিনি কবজি বাড়িয়ে দেন, আমি তাতে ঠোঁট ছোঁয়াই এবং ফের তাঁকে অবলোকন করি। মনে হয়, ইয়োগার জাদুবলে তিনি শরীর থেকে বেশ দূরে রাখতে পেরেছেন বয়সজনিত জরা। ট্রুডি আমার কাঁধে হাত ছুঁইয়ে ভিলার দিকে যাওয়ার ইশারা করে বলেন, ‘আই অ্যাম ডিপলি সরি সুলতান, তুমি এসেই একটি পতঙ্গের মৃত্যু অবলোকন করলে। বাট ইউ নো দিস ইজ হোয়াট লাইফ ইজ অল অ্যাবাউট। পতঙ্গ ভক্ষণ করেই ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ বেঁচে থাকে। একটি পোকার মৃত্যুর সঙ্গে একটি তরুর বেঁচে থাকা কী রকম নির্ভরশীল। আমার হাসবেন্ড বেঁচে থাকলে সে খুব খুশি হতো, তার শখের ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ আফ্রিকান সয়েলে এবার অ্যাডজাস্ট করতে শুরু করেছে।’ আমি ভিলার দিকে হেঁটে যেতে যেতে—তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করি। তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, ‘লেট মি টেল ইউ সুলতান সামথিং ভেরি ফ্র্যাংকলি, বেচারা হঠাৎ করে মারা গেল, বাট হি গেভ মি আ পেয়ার অব উইংস, ঠিক বুঝতে পারছি না, এ পাখা দুটো দিয়ে উড়ে উড়ে এখন কোথায় যাব।’

ভিলার গালিচা পাতা পারলার চেয়ে দেখার মতো প্রশস্ত। ভিনটেজ ফার্নিচারের সাজসজ্জা দেখে মনে হয়, আফ্রিকার কলোনিয়েল আমলের কোনো চলচ্চিত্র শুটিংয়ের সেটে দাঁড়িয়ে আছি। ফ্রেড ট্রুডিকে উষ্ণ হাগে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে আমাকে নিয়ে ঢোকেন ফ্যামিলি রুমে। এ কামরাটির সাজসজ্জা আটপৌরে, তাই স্বস্তি বোধ করি। ট্রুডির চোখেমুখে কী রকম যেন স্বপ্নের মেঘমালায় ভেসে বেড়ানোর আবেশ ফোটে। তিনি খুব উষ্ণ অন্তরঙ্গতায় বলেন, ‘আই লার্ন আ হৌল লট অ্যাবাউট ইউ ফ্রম ফ্রেড। তুমি তো আর্ট ট্রাভেলার, তোমার লেখার জন্য কিছু উপকরণ আজ সন্ধ্যায় এ ভিলাতে পেয়ে যাবে।’ প্রতিক্রিয়ায় আমি তাকে বলি, ‘ফ্রেডের মতো আমিও যে দেশে যাই, একটু খোঁজখবর নিই, শিল্পকলার অঙ্গনে কী ঘটছে, আর্ট ট্রাভেলার নামে আমি একটি বইও লিখতে চেয়েছিলাম, কাজ খানিকটা আগানোর পর নানা ঝামেলায় তা থেমে আছে।’ ফ্রেড কথাবার্তায় যোগ দিয়ে ট্রুডিকে বলেন, ‘সুইটহার্ট, আমি কিচেনে ডিনারের ব্যাপার ম্যানেজ করছি। তুমি সুলতানকে তোমার স্টুডিওটা একটু দেখাও। আই অ্যাম শিওর, হি ইজ গোয়িং টু লাভ ইয়োর ওয়াক্স পেইন্টিং।’ ওয়াক্স পেইন্টিং বা তপ্ত মোমে বর্ণের পিগমেন্ট মিশিয়ে চিত্র তৈরির প্রকরণ সম্পর্কে আমার আগ্রহ প্রচুর, তবে এ ধরনের কাজ আমি দেখেছি খুব কম। তাই উদ্দীপ্ত হয়ে বলি, ‘ট্রুডি, খুব ভালো লাগবে, ইট উড বি আ রিয়েল প্লেজার টু অবজার্ভ সাম অব ইয়োর ওয়াক্স পেইন্টিং।’ তিনি আন্তরিকতায় আমার কবজি ছুঁয়ে বলেন, ‘দেন লেটস গো, উপরতলায় যেতে হবে, থার্ড ফ্লোরে আমার স্টুডিও।’ আমরা সিঁড়ির দিকে রওনা হই, পেছন থেকে ফ্রেড বলে ওঠেন, ‘ট্রুডি...হানিবান, সুলতান লাভস ব্যাকগ্রাউন্ড, তাকে ওয়াক্স পেইন্টিংয়ের একটু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দিলে...হি ইজ গোয়িং টু লাভ ইউ ফরএভার।’ ‘অলরাইট ডিয়ার’ বলে ট্রুডি আমাকে নিয়ে সিঁড়িতে পা রাখেন।

(আগামীকাল সমাপ্য)