আক্রা নগরীতে হাইস্কুল সুইটহার্ট ও মোমের চিত্রকলা

ট্রাসাকো ভ্যালির আপস্কেইল নেইভারহুড
ট্রাসাকো ভ্যালির আপস্কেইল নেইভারহুড

(দ্বিতীয় পর্ব)
দোতলার অনেকটা জুড়ে আছে ‘এল’ শেপের একটি ওভারসাইজ করিডর। ওখানে ঘানার অন্তর্গত আসান্তে রাজ্যের রাজাধিরাজ ওটুমফুও নানা টুটুর লাইফ-সাইজ ফটোগ্রাফস দেখে অবাক হই! রাজাটি স্বর্ণের সনাতনী জেওরাত পরে সিরিয়াস মুখে তাকিয়ে আছেন তাঁর দরবারে হাজেরান প্রজাকুলের দিকে। করিডরের সর্বত্র সিস্টেমেটিক্যালি সাজানো—মুখোশ, যুদ্ধের হাতিয়ারপত্র, শস্য কুটার গাইল-ছিয়া, মূর্তির আকৃতিতে তৈরি কুরসি-কেদারা প্রভৃতি। এসব মহার্ঘ্য বস্তু যেন স্পেসটিকে জাদুঘরের অনুকৃতি করে তুলেছে। আমি রাজচিত্রটিকে নিরিখ করে অবলোকন করি। ট্রুডি দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, ‘রাজাটির সঙ্গে আমার প্রয়াত স্বামীর গড়ে উঠেছিল এক ধরনের সখ্য। হিজ হাইনেস নানা টুটু পছন্দ করেন ইতালিয়ান ওয়াইন। আমার স্বামী তাকে পালা-পরবে পাঠাতেন এক কেস প্রসেকো বা অন্য কোনো ধরনের পানীয়। বিনিময়ে রাজ অনুচরা তাকে বিচিত্র দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতে সাহায্য করে। বাগানের কিছু বিরল প্রজাতির গাছ-বৃক্ষের চারাও এসেছে রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণ থেকে।’ ট্রুডির সঙ্গে তিনতলার দিকে যেতে যেতে আমি ভাবি, তার মরহুম স্বামীপ্রবরটি তো দেখি আফ্রিকার আর্টিস্টিক আত্মাকে শোকেসে পুরে দিব্যি নিজস্ব বাসভবনে গৃহবন্দী করে রেখেছেন।

তিনতলার রুফটপ গার্ডেনের ছোট ছোট বৃক্ষলতায় ড্রিপ পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঝরছে জল। তারাভরা আকাশের নিচে মৃদু আলোয় ইগলুর মতো গোলমোল একটি পাথরের তাঁবু দেখতে পেয়ে আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। ট্রুডি কপাট খুলে ভেতরটা দেখিয়ে বলেন, ‘দিস ইজ মাই হিমালয়ান সল্ট কেভ। এখানে আমি ভোরবেলা ইয়োগা প্র্যাকটিস করি। এ কেভের ভেতর দিকের দেয়ালগুলো হিমাচল পাহাড়ের জমানো লবণ দিয়ে তৈরি। এখানকার প্রতিটি বাতিও নুনের প্রস্তরীভূত চাকলায় নির্মিত। মাই হাজবেন্ড হ্যাড ইমপোর্টেড অল দিজ সল্ট স্ল্যাভস ফ্রম নেপাল জাস্ট টু এন্টারটেইন মি ফর মাই বার্থডে।’ মনে হয় ইয়োগা তার দেহকে তীব্র শাসনে রেখেছে। এ বয়সেও তার শরীরের ছন্দময় ফিগারের রহস্য এবার আমার কাছে পরিষ্কার হয়।

ছাদের এক পাশ জুড়ে তার আঁকাজোকার স্টুডিও। হলকক্ষটি মনে হয় ট্রুডির সঙ্গে বিবাহিত হওয়ার পর তার স্বামী ভিলার উপরিভাগে যোগ করেছেন। স্টুডিওর কাচের জানালাগুলো ফ্লোর থেকে ছাদ অবধি বিস্তৃত। দেয়ালেও অনেকগুলো চিত্র একসঙ্গে ঝোলানোর বিস্তর স্পেস। তাতে নিরিবিলি কাজের পরিবেশের চেয়ে চিত্রশালার দেখনদারি আবহ ফুটেছে প্রবলভাবে। মনে হয়, ট্রুডি স্টুডিওতে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করে থাকেন। আমরা আয়েশ করে সোফাতে বসি। লাগোয়া মিনিয়েচার বারের কেবিনেট খুলে ট্রুডি জানতে চান, ‘আমি চিত্র দেখার সময় এক পেয়ালা ক্যাম্পারি পান করে থাকি। তুমি কি একটু ক্যাম্পারি চেখে দেখবে? আমার কেবিনেটে ভারমুথ বা কনিয়াকও আছে।’ আমি মেজবানের অফার করা ক্যাম্পারিতেই সন্তুষ্ট হই। তিনি পানপাত্রে সিপ নিয়ে সাইডটেবিলে এক তাড়া সিডি নাড়াচাড়া করতে করতে বলেন, ‘ফ্রেডের কাছে শুনলাম—ইউ এনজয় ইউরোপিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক হোয়াইল ওয়াচিং পেইনটিংস। তোমার পছন্দমতো একটি সিডি চুজ করো। আমরা মিউজিক শুনতে শুনতে ওয়াক্স পেইনটিংগুলো দেখব। দ্য মিউজিক ইজ গোয়িং টু পুট আস ইনটু রাইট মাইন্ড সেট ফর এনজয়িং ফাইন আর্ট।’ সিডির তাড়া হাতে নিতেই চোখে পড়ে ইতালির ধ্রুপদি কম্পোজার রসিনির (১৭৯২-১৮৬৮) ‘ডুয়েটো ইন ডি মেজর ফর চেলো এন্ড বাস’ নামে একটি সংগীতের ডিস্ক। রসিনি সম্পর্কে আমার খানিকটা ধারণা আছে, আন্দাজ করি, সন্ধ্যার সময় চেলো ও বাসের যৌথ বাদন জমবে, তাই সিডিটি ট্রুডির হাতে তুলে দিই। তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে হাসিমুখে বলেন, ‘আই লাইক রসিনি।’ তিনি সিডিটি প্লেয়ারে চড়িয়ে দিয়ে জানতে চান, ‘পারহেপ্স ইউ টেল মি...রসিনি তুমি পছন্দ করলে কেন?’ আমি জবাব দিই, ‘এ কম্পোজিশনটি আমি ও ফ্রেড আমাদের কাবুলে বসবাসের সময় একত্রে বার কয়েক শুনেছি। এর মেলোডি অত্যন্ত সিম্পোল এবং রিদমও ক্লিয়ার। আমি আজকের সন্ধ্যায় জটিল কিছু শুনতে চাচ্ছি না।’ রেকর্ডে বেজে ওঠা চেলো ও বাসের যৌথ সেরেনাদ একটু শুনে নিয়ে ট্রুডি বলেন, ‘আই টোটালি অ্যাগ্রি উইথ ইউ...রসিনির সংগীতের মেজাজে আছে অনাবিল আনন্দ, আপ্রোপ্রিয়েট চয়েজ ফর দ্য ইভিনিং, রসিনি নিজেই বলেছেন ডিলাইট মাস্ট বি দ্য বেসিস অ্যান্ড এইম অব আর্ট।’

সংগীত একটু জমে উঠতেই ট্রুডি দেয়ালে ঝোলানো তপ্ত মোমে রং মিশিয়ে আঁকা চিত্রগুলোর দিকে ইশারা দিয়ে তা অবলোকন করার জন্য আমাকে ইনভাইট করেন। আমি ওঠে দাঁড়াই, দেয়ালে মোমচিত্রগুলো ছড়াচ্ছে প্রভাতি আলোয় উদ্ভাসিত মৃদু অঙ্গের মোলায়েম আভা। ট্রুডি প্রথমে শিল্পকলার এ প্রকরণটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু তথ্য দেন। জানতে পারি, আঙ্গিকটি ওয়াক্স পেইন্টিং নামে পরিচিত বটে, তবে এ চিত্রধারার পোশাকি নাম হচ্ছে এনকোয়াসটিক পেইন্টিং। এনকোয়াসটিক শব্দটা এসেছে গ্রিক এনকোয়াসটিকস থেকে, যার সাদামাটা অর্থ হচ্ছে উত্তপ্ত করা। সচরাচর মোমকে তপ্ত করে তা কাঠ কিংবা ক্যানভাসে ছড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা হয় চিত্রের বেস। এ ধারার চিত্রকলার সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শন পাওয়া গেছে মিসরের পিরামিডে। আদিকালের ওয়াক্স পেইন্টাররা মমি কেসের ওপর প্রয়াত ফারাওয়ের পোর্ট্রেট আঁকতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। ওয়াক্স পেইন্টিংয়ের অঙ্কনপ্রক্রিয়ার প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ নামক গ্রন্থে। রোমান স্কলার প্লিনি দ্য এলডার প্রথম শতাব্দীতে পুস্তকটি রচনা করেছিলেন।

বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুদর্শন লেক
বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুদর্শন লেক

আমি এইমাত্র জানতে পারা তথ্যগুলো নোটবুকে টুকে নিতে একটু সময় নিই। চোখ তুলে দেখি, ট্রুডি জাদুঘরের আর্টগাইডের মতো চিত্রিত দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তো নোটবুক গুটিয়ে আমিও ক্যানভাসে তপ্ত মোমে বর্ণের বিচিত্র বিন্যাস দেখতে শুরু করি। ছবিগুলোয় ইমপ্রেশনিস্ট ধারার আবছা স্বপ্নময় ইমেজের সঙ্গে সার্থকভাবে ঘটেছে অনুভূতির মিশেল। বেশ কতগুলো চিত্রপটে প্রকৃতি এসেছে হরেক নকশায়—প্রতীকের আধো রহস্যময় টোপর পরে। আমি চিত্রগুলো গাঢ়ভাবে অবলোকন করতে করতে মন্তব্য করি, ‘ট্রুডি, এ ছবিগুলোয় দিঘির পাড়ে ঝিম ধরে বসে থাকা শ্বেত-শুভ্র সারসের মতো কেমন যেন ধ্যানমগ্নতা নানা বর্ণের বিচ্ছুরণে থেকে থেকে মূর্ত হয়ে উঠছে।’ তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনে গাঢ় স্বরে বলেন, ‘ক্যান ইউ পুট ইওর কমেন্ট ইন রাইটিং।’ আমি চিন্তাভাবনা করে ই-মেইলে আমার মতামত জানানোর প্রতিশ্রুতি দিই এবং জানতে চাই, ‘দিনের কোন সময় আপনি আঁকেন? আঁকাজোকার প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটু বললে ভালো হয়।’ তিনি চিত্রময় দেয়াল থেকে চোখ সরান না, তবে গাঢ় স্বরে কথা বলে যান, ‘খুব ভোরে হিমালয়ান সল্ট কেভে বসে আমি বিপাসনা মেডিটেশনে বিভোর হই। অপেক্ষা করতে থাকি—কখন প্রভাতি রশ্মি নুনের আবছা মতো দেয়াল দিয়ে প্রতিসরিত হয়, কোন কোন দিন প্রতিসরণের নকশা থেকে আসে প্রেরণা। তখন সল্ট কেভ থেকে বেরিয়ে এসে আঁকাজোকায় হাত দিই।’ আমি ফের চিত্রে মনযোগ দিই, কিছু ছবিতে আবছাভাবে এসেছে ফ্রেডের দেহভঙ্গি। তার চারপাশে ছড়ানো বর্ণে যেন মিশে আছে স্মৃতি, সংকট ও প্রত্যাশা। রেখাচিত্রের কিছু নকশায় আশাভঙ্গের ব্যাপারটাও সংগোপন থাকেনি। কী ভেবে আমি জানতে চাই, ‘সো ইউ ফাউন্ড ইওর হাইস্কুল সুইটহার্ট আফটার মেনি মেনি ইয়ার্স। হাউ ইজ ইট গোয়িং উইথ হিম নাউ।’ লাজরক্তিম তরুণীর মতো গণ্ডদেশে ব্লাশের লালিমা ছড়িয়ে তিনি জবাব দেন, ‘লুক, হি ইজ ট্রুলি ওয়ান্ডারফুল। তাকে যে প্রতিদিন-প্রতি রাতে খুব কাছে পাচ্ছি, এ বয়সে এটাইবা কম কী।’ আমি তাঁদের যৌথ দিনযাপনের শুভ কামনা করি। ট্রুডি কপাল কুঁচকে দ্বিধা জড়ানো স্বরে বলেই ফেলেন, ‘বাট...ইউ নো...হি ইজ নট দ্য সেম বয় আই ডেটেড লং লং টাইম অ্যাগো। ফ্রেড এত বদলে গেছে যে তার আচার আচরণ বুঝতে পারা কখনো কখনো কঠিন হয়ে ওঠে।’ শুনে আমি সহানুভূতি জানাই, বলি, ‘আই অ্যাম স্যারি দ্যাট ফ্রেড ইজ গিভিং ইউ সাম ট্রাবোল।’ চোখ তুলে দেখি ট্রুডি সিরিয়াসলি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, তিনি জানতে চান, ‘তুমি তো কাবুলে ফ্রেডের পাশের কামরায় বাস করতে, তার অনিদ্রা ও স্লিপওয়াকের ব্যাপারটা তোমার চোখে পড়েছে কী?’ কিছু গোপন না করে আমি জবাব দিই, ‘কাবুলে যখন স্ট্রেস তীব্র হতো, তখন ফ্রেড ক্রমাগত অনিদ্রায় ভুগতেন, তারপর নিট জ্যাক ডেনিয়েল পান করে একটু ঘুমালে মাঝরাতে হল্লাচিত্কার করে, অদৃশ্য কার সঙ্গে যেন ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যেতেন আঙিনায়। দরোয়ানরা ধরে-করে তাঁকে ফিরিয়ে আনতো বেডরুমে।’ শুনে ট্রুডি বিষণ্ন স্বরে বলেন, ‘দিস স্লিপওয়াক প্রবলেম কনটিনিউজ স্টিল টু-ডে, প্রায় প্রতিরাতে...তার সাবেক স্ত্রী সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চায়।’ আমি পরামর্শ দিই, ‘হাউ অ্যাবাউট টেকিং হিম টু আ সাইক্রিয়াটিস্ট?’ ট্রুডি ক্ষীণ স্বরে বলেন, ‘চেষ্টা তো করছি সুলতান, কিন্তু আক্রাতে ভালো সাইকিয়াটিস্ট পাওয়ার কোন উপায় নেই, ইতালি বা আমেরিকাতেও সে যেতে রাজি হচ্ছে না।’ প্রতিক্রিয়ায় আমি মৌন থাকি ও ফের চিত্র পর্যবেক্ষণে মনযোগ দিই।

বেশ বড় সড় ক্যানভাসে ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের চিত্রটি আমার নজর কাড়ে। ছবিটির দিকে ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তাকালে তার প্রেক্ষাপটের ঝোপঝাড় ও লতাগুল্মে যেন ফুটে ওঠে ওয়েস্ট আফ্রিকার মানচিত্রের অনুকৃতি। মাংসাশী তরুটির ঘাতক পত্রে জোড়া হয়ে বসেছে ব্লোআপ করা দুটি পতঙ্গ, পত্রটির দুপাশের শুঁড়ওয়ালা কপাট ক্রমে বন্ধ হয়ে আসছে। কৌতূহলী হয়ে আমি পতঙ্গ দুটিকে কাছ থেকে অবলোকন করার চেষ্টা করি। মৃদু হেসে ট্রুডি বাড়িয়ে দেন একটি ম্যাগনেফাইয়িং গ্লাস। ভারী আতশি কাচের ভেতর দিয়ে এবার আমি পতঙ্গ দুটির মুখে ফ্রেড ও ট্রুডির আদল দেখতে পাই। ওয়াক্স পেইনটিংয়ে পার্সি মিনিয়েচার-শৈলীর দক্ষ প্রয়োগের তারিফ করে আমি ট্রুডির দিকে তাকাই। তিনি অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলেন, ‘দিস সামসআপ বোথ অব আওয়ার লাইভস ইন আফ্রিকা। ফ্রেড ও আমি কৈশোরে বেড়ে উঠি আফ্রিকার এ অঞ্চলের নানা শহরে। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে পেশাদারি কাজে আমরা বারবার ফিরে এসেছি আফ্রিকায়। আফ্রিকাকে আমরা যে খুব করে ভালোবাসি, তাও নয়। এখানে ম্যালেরিয়া, ইবোলা থেকে শুরু করে হামেশা লেগে আছে গৃহযুদ্ধ, ছড়াচ্ছে ক্রাইম—নেগেটিভ কিছুর অভাব নেই কোনো। কিন্তু আফ্রিকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কোনো উপায় আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কখনোসখনো মনে হয়, ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের মতো আফ্রিকা আমাদের হজম করে নিচ্ছে জীবিতাবস্থায়।’

বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাম সরনী
বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাম সরনী

বর্ণ ও সংগীতের তরতাজা স্মৃতি নিয়ে বেরিয়ে আসি ট্রুডির স্টুডিও থেকে। ছাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন তরু থেকে ছড়াচ্ছে উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের তীব্র সৌরভ। সিঁড়িঘরের দিকে যাওয়ার সময় চোখের কোণ দিয়ে দেখি, চৌবাচ্চায় প্রতিফলিত হচ্ছে ছায়াপথের খানিকটা। ফ্রেডকে পাওয়া যায় নিচের তলার ডাইনিং পারলারে। বিরাট আকারের কামরাটিকে ব্যাংকোয়েট হল বললে অত্যুক্তি কিছু হয় না। অনায়াসে এখানে জনা পনেরো ডিগনিটারিকে ভোজে ডেকে জিয়াফত খাওয়ানো যায়। আমি অবাক হয়ে তাকাচ্ছি, ট্রুডি অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, ‘আসান্তে রয়েল ফ্যামিলির ছেলেপিলেরা আক্রাতে এলে আমার লেট হাজবেন্ড এ কামরায় তাদের এন্টারটেইন করত। একবার হিজ হাইনেস স্বয়ং মহারাজ এখানে চা পান করতে এসেছিলেন।’ আমি সাইডটেবিলে রাখা অস্ট্রিচ পাখির আন্ডা দিয়ে তৈরি কাপ ও ডিশের দিকে কপট তারিফের দৃষ্টিতে তাকাই। অতঃপর আমার দৃষ্টি আটকে যায়, একটি ভিনটেজ গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের কারুকাজ করা কেসে। ফ্রেড ঠাট্টা করে বলেন, ‘দিস ক্লক ইজ ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড সেভেনটিন ইয়ার্স ওল্ড। এতে দিন, মাস, বছর ও চন্দ্রকলার হিসাব-কিতাব করার ব্যবস্থা আছে, বুঝলে। জাস্ট ইমাজিন সুলতান, দিস ড্যাম ক্লক ইজ কিপ টিকিং ফর অভার হান্ড্রেড ইয়ার্স, অল ইট ইজ ডুয়িং ইজ টিকিং...টিক টক টিক টক...।’ আমি চোখেমুখে কৃত্রিম আতঙ্ক ফুটিয়ে তুলে বলি, ‘ট্রুডি, আমাকে কি অস্ট্রিচের আন্ডা দিয়ে তৈরি বাসন-বর্তনে ডিনার খেতে হবে?’ তিনি হেসে জবাব দেন, ‘ওহ হেল নো, ফ্রেড ইজ গোয়িং টু সার্ভ আস অ্যান ইন্টিমেট ফ্যামিলি ডিনার ইন আ ডিফরেন্ট ভেরি স্মল ডাইনিংরুম।’ এ বেঢপ সাইজের কামরায় খেতে হবে না জানতে পেরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার অনুভূতি হয়। তখন খেয়াল করি, ফ্রেড রীতিমতো রেস্তোরাঁর শেফ বা বাবুর্চির ধবধবে সাদা অ্যাপ্রোন পরে আছেন। তাতে টমেটো সচের লালচে দাগ দেখে আন্দাজ করি, আমি যখন ট্রুডির সঙ্গে স্টুডিওতে চিত্রাদি দেখছিলাম, তখন ফ্রেড বাবুর্চিখানায় নিজ হাতে রান্নাবান্না সেরেছেন।

সম্পূর্ণ কাচের গ্রিনহাউসের মতো দেয়ালওয়ালা ছোট্ট চার চেয়ারের ডাইনিংরুমটি দীর্ঘ এক করিডর দিয়ে মূল ভবনের সঙ্গে যুক্ত। সাইডটেবিলে সাজানো খাবার ফ্রেড নিজেই হাতে তুলে সার্ভ করেন। ট্রুডি শেফরা পরে এ ধরনের একটি ক্যাপ ফ্রেডের মাথায় পরিয়ে দিলে তিনি তার কোমর জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে কষে চুমো খান। স্টার্টার হিসেবে পরিবেশিত হয় গর্মাগরম ব্রুসকেটা। মাত্সারেলা চিজের প্রলেপের ওপর অলিভ অয়েল মাখানো টমেটো ও রসুনের টুকরো ছড়ানো টোস্ট করা রুটির ব্রুসকেটা খিদের মুখে চিবাতে ভালোই লাগে। আমি খেতে খেতে কাচের স্বচ্ছ দেয়াল অতিক্রম করে দেখতে পাই, আলোয় ঝলমলে সবুজাভ এক উপবন। দ্বিতীয় কোর্স হিসাবে পরিবেশিত হয় বেগুনের চাকতিতে চিজের গুঁড়ো ছড়ানো এগপ্ল্যান্ট পামারাজান। তা খেতে খেতে খেয়াল করি, ফ্রেড রসিনির একটি সিম্ফনি প্লেয়ারে বাজাচ্ছেন। সংগীতটি আমার খুব প্রিয়, কাবুলে বসবাসের দিনগুলোয় অনেকবার এ মিউজিক ফ্রেডের আইপডে শুনেছি। খুশি হয়ে আমি ফ্রেডকে কৃতজ্ঞতা জানাই, বলি, এ গান শুনলে কেবলই মনে হয়, তারুণ্যের তাবৎ নির্যাসকে নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের জীবন। মনোযোগ দিয়ে ফ্রেড আমার মন্তব্য শুনে পাল্টি দেন, ‘ইয়েস, ইউ আর রাইট, কিন্তু খেয়াল করে দেখো—এক যুগ হতে চলল আমাদের তিনজনের দেহ থেকে স্রেফ বেখবর হয়ে গেছে তারুণ্য, তারপরও এ গানের আবেদন কিন্তু কমেনি।’ ট্রুডি হারিয়ে যাওয়া তারুণ্য নিয়ে বিশেষ একটা উদ্বিগ্ন হন না, তিনি পানপাত্রে আরেক দফা মনতিচিয়ানো ঢেলে দেন। অতঃপর চুমুক দিয়ে জানান, ট্র্যাজিডি হচ্ছে এ সংগীতগুলো রসিনি কম্পোজ করেছিলেন প্রথম যৌবনে, তাঁর জীবনের শেষ চল্লিশ বছরে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু কম্পোজ করেননি। একটি তথ্য মনে পড়ে, কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থও নাকি তাঁর জীবনের শেষ তিরিশ বছর প্রথম জীবনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য কোনো কবিতা রচনা করেননি। এ তথ্যটি আমি কোথায় যেন পড়েছি, কিন্তু রেফারেন্স মনে পড়ে না। ভাবি, স্রেফ স্মৃতির ওপর ভরসা করে কিছু শেয়ার করা সঠিক নয়। ফ্রেড ট্রুডির মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানান, রসিনি যশস্বী হয়ে যাওয়ার পর তো শেষ চল্লিশ বছর প্যারিসে তিনি স্রেফ ফুর্তিফার্তা করে কাটিয়েছেন। ট্রুডি কিছু না বলে উঠে ডিনারের মেন কোর্স শ্রিম্প আলফ্রেডো সার্ভ করেন। এ ডিশটি ফ্রেড এর কল্যাণে কাবুলে আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিল। দিন-কে-দিন নানরুটি ও কাবাব খেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে চোরাই পথে ইরানের বন্দর আব্বাস থেকে কাবুলে আমদানি করা গাব্দাগোব্দা চিংড়ি কিনে নিয়ে আসতাম। ফ্রেড পাসটার সঙ্গে তা মিশিয়ে টমেটো সচ দিয়ে শ্রিম্প আলফ্রেডো রান্না করতেন। তাতে সহনীয় হয়ে উঠত আমাদের জিন্দেগি ও বন্দেগি।

বাগানে বৌদ্ধ মূর্তির অনিন্দ সুন্দর উপস্থিতি
বাগানে বৌদ্ধ মূর্তির অনিন্দ সুন্দর উপস্থিতি

একটু তারিয়ে তারিয়ে আক্রার গলদা চিংড়ি চিবুচ্ছিলাম। ট্রুডি ইশারায় কাচের দেয়াল ভেদ করে বাইরে তাকাতে অনুরোধ করেন। দেখি, কৃত্রিম উপবন থেকে আলোয় বেরিয়ে এসেছে একটি ছানাসহ হরিণী। মা হরিণী যত্নে শিশুটিকে দুধ খাওয়ায়। আমরা ধুন ধরে তাকিয়ে থাকি। ট্রুডির চোখে আমার চোখ পড়ে, স্পষ্ট বুঝতে পারি, তিনি এ দৃশ্যপটকে কীভাবে মোমচিত্রে নিয়ে আসা যায়—তা ভাবছেন। আমার ভাবনাস্রোতও ধাবিত হয় অলিখিত পাণ্ডুলিপির দিকে। কেন জানি ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি ছত্র, ‘ফিল ইওর পেপার উইথ দ্য ব্রিদিংস অব ইওর হার্ট’, বা ‘পাণ্ডুলিপিটি ভরিয়ে তুলো তোমার হৃদয় নিংড়ানো নিশ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে’, মেঘের মতো ভেসে আসে মনে। ভাবি, মা ও শিশু হরিণের এ ইমেজটিকে সত্যিকারের আবেগ দিয়ে বর্ণনা করার অবকাশ পাব কি?

ডিনার প্রায় শেষ হয়েই আসে। আমরা কেউই ডেজার্ট বা আফটার ডিনার ডাইজেসটিভ ড্রিংকস নিতে চাই না। আমি চমৎকার একটি ইতালিয়ান ডিনার সার্ভ করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। গাড়িবারান্দার দিকে আসার পথে ট্রুডি বলেন, ‘জীবনের বেশির ভাগ সময় আমি কাটিয়েছি ইতালির বাইরে। কিন্তু খাবার, এই একটা ব্যাপারে আমি কম্প্রোমাইজ করতে পারি না। আই লাভ মাই ইতালিয়ান ফুড।’ আমারও ঘটনা হরেদরে একই রকমের, যে দেশেই যাই না কেন—মাঝেমধ্যে বারিক চালের ভাতের সঙ্গে এক বাটি মুগডাল, চাকতি করে ভাঁজা বেগুন ও এক টুকরা কাগজি লেবু স্মৃতিতে প্রবল হয়ে ওঠে। ট্রুডি গুডনাইট বলে বিদায় চুম্বনের জন্য গণ্ডদেশ বাড়িয়ে দেন। ফ্রেডকে আলিঙ্গন করে আমি তাঁদের শোফার চালিত ল্যান্ডরাবারে উঠি। রাত বেশ হয়েছে, এত রাতে যে আমাকে আক্রার ট্যাক্সি চড়তে হচ্ছে না—এ জন্য আমার জীবনের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রককে শোকরানা জানাই।