আদিবাসীদের মিউজিক মজমা

আমেরিকার ফ্লোরিডায় ‘নেটিভ রিদমস’ শিরোনামে আদিবাসীদের মিউজিক মজমায় তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং। ছবি: লেখক
আমেরিকার ফ্লোরিডায় ‘নেটিভ রিদমস’ শিরোনামে আদিবাসীদের মিউজিক মজমায় তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং। ছবি: লেখক

বাঁশরির মিহি সুরে বেরিয়ে আসি তাঁবু থেকে। চারপাশের পামবৃক্ষে জড়িয়ে আছে কুয়াশার ধূসর গিলাফ। সুরুজ ওঠেছে কী? ঠাহর করে বলা মুশকিল। তবে প্রিমরোজ উইলোর সোনালি ফুলে ফুলে ঝলমল করছে শিশিরের বিন্দু বিন্দু আভা। চপ্পল পায়ে দীর্ঘ ঘাস মাড়িয়ে সামনে বাড়ি। পদশব্দে ভারী গতরের একটি কচ্চপ গলা বাড়িয়ে আড়চোখে তাকায়। বাঁশরির ধ্বনি কুয়াশায় দিক্​ভ্রান্ত মাঝির তিরসন্ধানী আর্তনাদের মতো প্রতিধ্বনিত হয় উইকহাম উপবনে।

গতকাল বিকেলে আমি এ বনানীতে তাঁবু খাঁটিয়ে ক্যাম্পিং করতে এসেছি। আমার আশপাশে ইয়োলো-আইড গ্রাসের ঝোপঝাড়ে তাঁবু খাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হরেক অঙ্গরাজ্য থেকে আগত জনা পঞ্চাশেক সংগীত সমঝদার। আমরা এখানে এসেছি ‘নেটিভ রিদমস’ শিরোনামে আমেরিকার আদিবাসী কলাকারদের তিন দিনব্যপী মিউজিক মজমায় শামিল হতে। উইকহাম নামে উপবনটি হালফিল পার্ক হিসেবে হরেক কিসিমের সামাজিকতা তথা ঘোড়ায় চড়া কিংবা তির ছোড়ার অনুশীলনে সরগরম হয়ে আছে। এ পরিসরে আছে একাধিক হাঁসভাসা হ্রদ। পার্কটির অবস্থান ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মেলবর্ন শহরের প্রান্তিকে। 

আমেরিকার আদিবাসী সিমিওনোল সম্প্রদায়ের কথ্য জবান মিকাসুকিতে উইকহাম শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘হাইআউট’ বা লুকানোর থান। এক জামানায় ফ্লোরিডার সর্বত্র ছিল আমেরিকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের পল্লিগ্রাম। অষ্টাদশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ প্রশাসন এদের ফ্লোরিডা ছেড়ে মিসিসিপি নদীর পশ্চিম পাড়ে যেতে হুকুম করে। আদেশ বাস্তবায়নে সৈনিকরা শুধু জোরজবরদস্তি নয়, খুন-জখম করে, পায়ে হাঁটিয়ে তাদের খেদিয়ে নিয়ে যায় অক্লাহোমা অঙ্গরাজ্যের দিকে। কিছু বাস্তুহারা আদিবাসী, সংখ্যায় শ তিনেক, জন্মভূমি ত্যাগে অস্বীকার করে। প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু জ্যাকসনের হুকুমে ১৮১৮ সালে এদের সশস্ত্রভাবে আক্রমণ করা হয়। যুদ্ধরত সিমিওনোলরা দিন কতক এই উপবনে লুকিয়ে ছিল। সে ঘটনার স্মৃতিতে গেল কয়েক বছর ধরে এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে লাগাতার মিউজিক মজমা। এ ঘটনার সাক্ষী হতে এখানে তাঁবু খাটিয়েছি আমি। এ মুহূর্তে বাঁশরির মরমি ধ্বনিপুঞ্জকে অনুসরণ করা আমার একমাত্র অভীষ্ট। 

হ্রদের আধডোবা পাথরে জলে পা চুবিয়ে বসে বাঁশরিতে ধ্বনি তৈরি করছেন যে সংগীত–কলাকার, তাঁর নাম শেলি মনিংসঙ। মনটেনার শাইয়ান গোত্রে তাঁর জন্ম। পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পী স্বয়ং কম্পোজ করেন সংগীত। তবে চেচেনবৃক্ষের কাঠে গড়া বাঁশরিটির নির্মাতা তাঁর গ্রোত্রের অন্য এক সুহৃদ, যাঁর সঙ্গে কৈশোরে শেলির প্রণয় ছিল। আমি হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করি ধ্বনির লীলাবৈভব। সূর্যের কিরণে ক্রমশ দল মেলছে শাপলা। মনে হয়, উপবনের তাবৎ উদ্ভিদ শুষে নিচ্ছে আলোর সঞ্জীবন। 

জমকালো পোশাকে ফাবিয়েন ফনটেনেলে
জমকালো পোশাকে ফাবিয়েন ফনটেনেলে

গতকাল এসেই তাঁবু খাটিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম সংগীতের সান্ধ্য মাইফেলে। শেলি মনিংসঙ বাঁশরি বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে বর্ণনা করছিলেন তাঁর কম্পোজিশনের মর্মার্থ। নক্ষত্রলোক থেকে এই গ্রহে এসেছে জীবনের বীজ। তাদের গোত্রের আদি নারীর নিবাস ছিল মহাকাশে। সুরতরঙ্গের সঙ্গে সংগতি রেখে ঢিমেতালে ড্যান্স করছিলেন তাঁর স্বামী ফাবিয়েন ফনটেনেলে। মঞ্চের সবগুলো আলো নিভিয়ে দিয়ে কেবল একটি স্পটলাইটের বৃত্তে তিনি তৈরি করছিলেন হরেক রকমের মুদ্রায় নক্ষত্রমণ্ডলীর নকশা। তাঁর মস্তকে ছিল হরিণের মুখোশ। তাতে সফেদ দেয়ালে ফুটেছিল বুনো এক শিঙ্গালের তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার ছায়াময় দৃশ্যপট।

ভোরের বাঁশরি বাদনে আমেজ হয় প্রচুর, তাঁবুতে ফিরতে আর ইচ্ছা হয় না। একটু হাঁটি। কাছেই একটি তাবেবুইয়া বৃক্ষ ফুলে ফুলে ছড়াচ্ছে বেগুনি আভা। তার পেছনবাগে দাঁড়িয়ে পালকের শিরোভূষণ পরে ফাবিয়েন ফনটেনেলে অনুশীলন করছেন নৃত্যের। নেটিভ আমেরিকান ড্যান্স ট্রুপে পারফরম্যান্সের মাধ্যমে এই শিল্পী মশহুর হয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিসরে। তাঁর গ্রেট-গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ছিলেন অমাহা গোত্রের চিফ বিগ এল্ক, শিঙ্গাল হরিণের মুখোশনৃত্যে তাঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার। গেল সন্ধ্যায় ফাবিয়েনের সঙ্গে খানিক বাতচিত হয়েছে। আলাপচারিতায় অকপটে তিনি প্রকাশ করেন উচ্ছ্বাস। পরিহাসও তাঁর বাচনভঙ্গিও বৈশিষ্ট্য।

তাঁবুটির সামনে টুলে চুপচাপ বসে আছেন সিমিওনোল সম্প্রদায়ের মানুষ প্যাসনেট ট্র্যাকার পল। খানিক বাতচিত হয় তাঁর সঙ্গে। জানতে পারি, সিমিওনোল শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পলাতক বন্যজন’। যে তিন শত আদিবাসী শ্বেতাঙ্গ সরকারের হুকুম তামিল না করে মিসিসিপি নদীর পশ্চিম পাড়ের নির্বাসনে রাজি হয়নি, তাদেরই অধঃস্তন পুরুষ ইনি। যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকরা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে মিসমার করে দিয়েছিল। বাস্তুহারা এ মানুষদের কোনো জনপদে বসবাস করার উপায় ছিল না। তাই তারা বেছে নিয়েছিল বনানীতে ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন। মাঝেসাঝে সৈনিকরা তাদের ধাওয়া করত, তাতে ঘোড়া ছুটিয়ে তারা চলে যেত অরণ্যের আরও গভীরে। শতাধিক বছর এভাবে জঙ্গলবাসের ফলে তাদের মধ্যে তৈরি হয় ট্র্যাকিং ও ক্যাম্পিং সংস্কৃতি। শিকার হয়ে পড়ে তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। সমাজের মূলধারা মুছে ফেলতে চায় তাদের অস্তিত্ব। কিন্তু সিমিওনোলরা সহজে হাল ছাড়ছে না। সুযোগ পেলেই তারা বনানীতে তাঁবু খাটিয়ে যেভাবে দিন গুজরান করত, তা রিঅ্যানেক্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে ক্রমাগত ট্র্যাক করার স্মৃতিকে জিইয়ে রাখছে। 

এদিকের পরিসরটি মেলার মতো। ভেন্ডিংকারে করে আসা আদিবাসীদের হস্তশিল্পের পসরাগুলোর দোকান এখনো খোলেনি। তবে একটি ফুডকার্টে মোবাইল কফিশপটির ঝাঁপি খুলেছে। তার কাছেই সাক্ষাৎ পাওয়া যায় লস্ট পিজিওন প্যাট্রিকের। গৃহহীন এ মানুষটি গেল রাতে আমার তাঁবুর কাছেই বৃক্ষের দু–ডালায় দড়ির হ্যামোক ঝুলিয়ে রাত কাটিয়েছেন। লস্ট পিজিওন প্যাট্রিকের সম্পদ-বিত্ত বলতে কিছু নেই, ব্যাকপ্যাকই সম্বল, তবে তাঁর চিত্তে আনন্দের কোনো খামতিও নেই। ডিনারের প্রয়োজনে আমি ভেজিবার্গার গ্রিল করছিলাম, তিনি হ্যামোক চড়াচ্ছিলেন, তো আমি তাকে একসঙ্গে খাবার শেয়ার করার আমন্ত্রণ করি, তখন জমে উঠেছিল আমাদের বাতচিত। আদিবাসীদের মোহাক গোত্রের সন্তান তিনি। বেড়ে ওঠেছেন বস্তুত পথশিশু হিসেবে নিউইয়র্ক ও আটলান্টা নগরীতে। সৈনিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ইরাকের কিরকুকে। ওখানে গার্ড টাওয়ারে ডিউটিরতাবস্থায় বাঁশি বাজানোর অপরাধে প্রথমে কারারুদ্ধ হন, তাতে তাঁর খাসিলতের পরিবর্তন না হলে তাঁকে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠিয়ে চাকুরিচ্যুত করা হয়। অসম্মানজনকভাবে প্যাট্রিক সেনাবাহিনী থেকে ডিসচার্জ হয়েছেন, তাই তাঁকে পেনশন থেকেও বঞ্চিত করা হয়। 

গেল রাতে আহারাদির পর অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে পাথরের কল্কে দিয়ে শুষ্কমঞ্জরি সেবন করেছিলেন প্যাট্রিক। তখন তাঁর পদবি লস্ট পিজিওনের মর্মার্থ জানার সুযোগ হয়েছিল। ইরাক দেশটাকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। এখনো কপোতের মতো উড়ে যেতে চান ব্যাবিলনের ঊষর মরুভূমে, কিন্তু নাচার তিনি, টিকিট কেনার রেস্ত তাঁর নেই। মিনিট পাঁচেক বাঁশরিও বাজিয়েছিলেন, সুরলহরিটি রেকর্ড করে রাখিনি, তাই খেদ হয়। হলফ করে বলতে পারি, এ বাদন শুনলে কেষ্ট ঠাকুরের ঈর্ষা হাওয়া অস্বাভাবিক হবে না। 

মোবাইল কফিকার্টের সামনে দাঁড়িয়ে পথহারা কপোত প্যাট্রিক ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘এখানে গর্মাগরম নাবাহো ব্রেড ভাঁজা হচ্ছে, সঙ্গে তাজা স্ট্রবেরিও দিচ্ছে। ’ আমি তাঁকে উৎসাহ দিয়ে বলি, ‘কামান, লেটস্ হ্যাভ সাম ব্রেকফার্স্ট।’ মুচমুচে নাবাহো ব্রেড স্বাদে মুখরোচক, কফির কোয়ালিটিও ভালো। বিল দেওয়ার সময় প্যাট্রিক একখানা কড়কড়ে দশ ডলারের নোট বের করে আমাকে তাজ্জব করে দেন! জানতে পারি, কার্ডবোর্ডে ‘যুদ্ধফেরত বংশীবাদক’ লিখে পার্কের জিমনেশিয়ামের কাছে ভোরবেলা তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, ব্যায়াম করনেওয়ালারা তাতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর হ্যাটে কিছু ডলারের নোট রেখেছে। 

কফির পেয়ালা হাতে চলে আসি মঞ্চের চাতালে। বেশ দূরে একটি বৃক্ষের দু-ডালায় দর্শনীয়ভাবে বসে আছেন বংশীবাদক বিলি হোয়াইটফক্স। দুই কাঁধ বেয়ে তাঁর দীর্ঘ শ্বেতশুভ্র চুল বুকের ওপর নেমে এসেছে দর্শনীয়ভাবে। ফাবিয়েন ফনটেনেলে উৎসবাদিতে পরার জমকালো পোশাক পরে ইগলের পালক উঁচিয়ে আসরে অবতীর্ণ হন। মাইক্রোফোনে এলান হয়, আজকের অনুষ্ঠানের শুরুয়াত হিসেবে প্রার্থনানৃত্যের জন্য তিনি প্রাঙ্গণটি প্রস্তুত করবেন। গাছে বসা হোয়াইটফক্সের বাঁশরির ধ্বনির সঙ্গে নৃত্যমুদ্রা সংগত করে ফাবিয়েন প্রথমে স্রষ্টাকে আরেকটি শোভন দিন উপহার দেওয়ার জন্য কুর্নিশ করেন। আড়াল থেকে কারা যেন ড্রামে চাটি মারে। তার সুরছন্দে ফনটেনেলে পদাঘাতে ধামসাতে শুরু করেন আঙিনার দীর্ঘ ঘাস। এ নৃত্যের প্রেক্ষাপট হিসেবে নেপথ্য থেকে মাইক্রোফোনে বলা হয়, ‘আদিবাসীদের শিল্পকলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আত্মকেন্দ্রিকতাকে পরিহার করে নৃত্য বা সংগীতকে অন্যের উপকারে উৎসর্গ করা।’ আন্দাজ করি, ফনটেনেলে মহোদয় তাবৎ ঘাস ধামসে দিয়ে আঙিনাটি প্রস্তুত করে দিলেন অন্য শিল্পীদের নৃত্যকলা উপস্থাপনের জন্য। 

প্রার্থনানৃত্যের সূচনায় ক্যামেরা ও সেলফোন বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়। বেশ কয়েকজন আদিবাসী নৃত্যশিল্পী নানা ধরনের পশুপাখির মুখোশ পরে আসরে নামেন। দু–একজনের শিরস্ত্রাণে শোভা পাচ্ছে পুষ্পিত বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা। সমবেত এ নৃত্যে শরিক হওয়ার জন্য দর্শক-শ্রোতাদের আহ্বান জানানো হয়। এ প্রার্থনানৃত্যের পোশাকি নাম হলো ‘ইন্টারকানেকটেডনেস বা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্তি।’ নেপথ্যে মৃদুলয়ে দ্রিম দ্রিম করে ড্রাম বাজে। ফনটেনেলে মহোদয় ইশারায় লিড করেন, রিদমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবাই স্টেপ ফেলছেন। বলা হয়, যেসব বুনো প্রাণী শিকারে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে, যাদের চামড়া দিয়ে বানানো হয়েছে এ ড্রাম, তাদের হৃৎস্পন্দনের অনুকৃতিতে তৈরি হয়েছে এই সুরছন্দের কম্পোজিশন। নৃত্যরতরা বুকে হাত দিয়ে নিজেদের হৃৎস্পন্দনকে অনুভব করে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য কৃতজ্ঞবোধ করেন। পরস্পরের হাত ধরাধরি করে বৃত্তাকারে পল্লবিত হয় সমবেত নৃত্য। মানুষ যে পরিপার্শ্বের পশুপ্রাণী ও উদ্ভিদ তথা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত, একে–অন্যের ওপরও নির্ভরশীল—এ বিষয়টি ফুটে ওঠে বিশদভাবে। বিলি হোয়াটফক্সের সুরনিনাদের প্রার্থনানৃত্যের তামাদি হলেÑকিছু দর্শক-শ্রোতা ও নৃত্যশিল্পীকে আলিঙ্গন করতে দেখা যায়। কেউ কেউ বিনিময় করেন টেলিফোন নম্বর ও ই–মেইল আইডি। 

বিলি হোয়াইটফক্সকে এবার আনুষ্ঠানিকভাবে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ইনি মুশকোজি ক্রিক গোত্রের মানুষ। ট্র্যাক করা পছন্দ করেন, বছরের বেশির ভাগ সময় বনানীতে তাঁবু খাঁটিয়ে বাস করেন। খাদ্যের প্রয়োজনে তির–ধনুকের সাহায্যে কখনো–সখনো শিকারও করেন, তবে যে প্রাণীদেহ তাঁকে পুষ্টি জোগায়, তার প্রতি তিনি সংবেদনশীল, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে সৃজন করেছেন একাধিক মিউজিক্যাল কম্পোজিশন। ‘সেক্রেড জার্নি’ শিরোনামে হোয়াইটফক্সের বংশীবাদনের একটি সিডি লোকপ্রিয় হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। 

গাছের দু-ডালায় বসে বিলি হোয়াইটফক্স
গাছের দু-ডালায় বসে বিলি হোয়াইটফক্স

বাস্কেটভর্তি বিচিত্র কতগুলো বাঁশরি তিনি প্রদর্শন করেন। এগুলো নিজেই তৈরি করেছেন। তাঁর নির্মিত একটি বাঁশি হরিণের পাঁজরের হাড় দিয়ে বানানো। জঙ্গলে ট্র্যাক করার সময় হরিণের কঙ্কাল থেকে হাড়টি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। অনেক বছর তাঁর ঝোলাতে পড়ে ছিল এ হাড়। একবার তা স্পর্শ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখন হরিণটি তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেয়। কিছু বাতচিতও হয় তাদের মধ্যে। তো ঘুম থেকে জেগে ওঠে হাড়টিকে বাঁশিতে রূপান্তরিত করেন তিনি। এ পর্যন্ত বলে পাঁজরের হাড়টি বাজান হোয়াইটফক্স। তার ধ্বনি যেন সুরের ইন্দ্রজাল ছড়ায়। মনে হয়, চোখ মুদে উপত্যকায় একটি হরিণের যাপিত জীবনকে অনুভব করছি আমরা।

পরবর্তী উপস্থানায়ও বিলি হোয়াইটফক্স বংশীবাদনের সঙ্গে গল্প বলার আটপৌরে ঢংকে মেশান। এবারকার কেসসার প্রধান চরিত্র আরেকটি হরিণ। খাদ্যের প্রয়োজনে হোয়াইটফক্স শিঙ্গালটির দিকে ধনুক তাক করেছিলেন। তির ছোড়ার মুহূর্তে গাছের একটি ঝুঁকে আসা ডাল বাতাসে বেঁকে গিয়ে শব্দ তুলে ‘প্যাঁও’, এতে সতর্ক হয়ে ছুটে পালায় হারিণ। ঘটনাটি নিয়ে হোয়াইটফক্স প্রচুর ভাবেন। তাঁর মনে হয়েছিল, জগৎ-সংসারে কখনো কেউ ভিকটিম হলে নির্লিপ্ত থাকাটা গ্রহণযোগ্য নয়। কাউকে শিকার হতে দেখলে সাহায্য করতে না পারলেও তাকে সতর্ক করে দেওয়াটা আমাদের উচিত। এ প্রেরণা থেকে শব্দ করা ডালটি কেটে এনে হোয়াইটফক্স বানিয়েছেন আরেকটি বাঁশি। কম্পোজিশনটি অপঘাতে শিকার হওয়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে বাঁশরিতে ফের সম্মোহন ছড়ান তিনি।

এবার মঞ্চে লস্ট পিজিওন প্যাট্রিককে পরিচয় করিয়ে দিলে চমকে উঠি আমি! তাঁর বেশভূষায় কোনো সাজসজ্জা নেই, তবে আধময়লা জ্যাকেট ও ঝাঁকড়া চুলে কিছু তাবেবুইয়া ফুলের বেগুনি পাপড়ি অসাবধানে আটকে আছে। তাঁর ইরাকে যুদ্ধ করার ব্যাকগ্রাউন্ড শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে তৈরি করে না তেমন কোনো আগ্রহ। স্পষ্টত স্টার বাদক নন প্যাট্রিক। তিনি অপ্রস্তুতভাবে তাঁর বাঁশিটি প্রস্তুত করার কাহিনি বলেন। কিরকুকে রোডসাইড বোমায় পুড়ে যাওয়া একটি সুদর্শন বৃক্ষের ডালে ড্রিল করে বাঁশিটি তিনি তৈরি করেছেন। তাতে আছে আলাদা আলাদা তিনটি নালি। আমি অতীতে আমেরিকার আদিবাসীদের হাতে দোনলা বাঁশরি দেখেছি, ত্রিনলা বাঁশির অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই। তাই একটু আগ্রহী হই। কিন্তু আধপোড়া বাঁশির ব্যতিক্রমী অবয়বও শ্রোতাদের মধ্যে জাগায় না কোনো উৎসাহ। মনমরা ভঙ্গিতে সুর তোলেন প্যাট্রিক। ধ্বনির কিছু একটা ছুঁয়ে যায় মাইফেলের হৃদয়মন। শ্রোতারা পরস্পরের দিকে সপ্রশংস নজরে নড করেন। প্যাট্রিক মঞ্চের প্রান্তিকে এসে ফুৎকারে ধ্বনিপুঞ্জকে দরাজ করে তোলেন। সঙ্গে সঙ্গে হ্রদের জলে একাধিক মাছের ঘাই মারার মতো হাততালি পড়ে। 

পজ নিয়ে ফের কথা বলেন প্যাট্রিক। রাত-নিশীথে কিরকুরের গার্ড টাওয়ারে বসে ভিন্ন একটি বাঁশরিতে সুর তুলেছিলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের জনপদ থেকে ভেসে আসে অজানা আরেকটি বাঁশরির ধ্বনি। দুটি বাঁশরি যেন সওয়াল-জবাবের ভঙ্গিতে চালিয়ে যায় সংগীতের সরগরম সংলাপ। এ ব্যাপারটা ঘটে পরপর কয়েক রাতে। পঞ্চম রাত্রিতে বাঁশরির যুগল সংলাপে যোগ দেন আজানা আরেক বংশীবাদক। অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে তাদের ত্রিবেণি মূর্ছনা। পরদিন শৃঙ্খলাভঙ্গ করে আজানা দুশমনের সঙ্গে বাঁশরিতে সংযোগ স্থাপনের অপরাধে প্যাট্রিককে নেওয়া হয় মিলিটারি কারাগারে। রিলিজ পেয়ে প্রথম যে কাজটি তিনি করেন, তা হলো বিস্ফোরণে আধপোড়া একটি বৃক্ষের ডাল সংগ্রহ করে তা
দিয়ে তৈরি করেন ত্রিনলা একটি বাঁশরি। প্যাট্রিক পরপর দুটি ভিন্ন নলে ফুঁ দিয়ে আজানা ইরাকি বাদকদ্বয়ের সুরও শুনিয়ে দেন। পুরো মাইফেল উঠে দাঁড়িয়ে তুমুল হাততালিতে তাঁকে স্ট্যান্ডিং অভেশন দেয়। 

আমার উচ্ছ্বাসও ততক্ষণে চরমে পৌঁছে। আমি মঞ্চের পেছন দিকে ছুটে যাই তাঁকে অভিনন্দন জানাতে। প্যাট্রিককে অবসন্ন দেখায়। তিনি ম্লান হেসে বলেন, ‘এ রকম আজাইরা হাততালি না দিয়ে আমাকে দশ-বিশটি ডলার দিলে সিক্স প্যাক বিয়ার কিনতে পারতাম।’ আমি তাঁকে ভরসা দিয়ে বলি, ‘সন্ধ্যার দিকে চলে এসো আমার তাঁবুতে। তোমার মৌতাতের বন্দোবস্ত আমি করে দেব, মাই গুড ফ্রেন্ড। ’