চূর্ণ ভ্রমণমালা

ফুলের হাটে বহুবর্ণ প্লাবন। ছবি: লেখক
ফুলের হাটে বহুবর্ণ প্লাবন। ছবি: লেখক

ডেট্রয়েটের কৃষিবাজার

টোর সিটি নামে একসময় পরিচিত ডেট্রয়েট শহরের কেন্দ্রের ক্যাডিলাক স্কোয়ারে কৃষিপণ্য বিক্রির জন্য উৎপাদকদের সরাসরি অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে আজ থেকে পৌনে দুই শ বছর আগে বসানো হয়েছিল কৃষিবাজার। সেটিই পরবর্তী এক দশকের মাথায় শহরের পূর্ব প্রান্তে ইস্টার্ন মার্কেট নামে রমরমা আকার ধারণ করে। এক রোববারের উজ্জ্বল সোনারোদ সকালে সেটি দেখাতে নিয়ে যায় ভ্রাতুষ্পুত্র রনি। দেখার মতো জায়গাই বটে। বাংলাদেশের গ্রামের হাটে যে রকম তাজা শাকসবজি বিক্রি করতে নিয়ে আসে কৃষকেরা, এখানেও উৎপাদকেরা নিয়ে আসে তাদের জমিতে ফলানো তাজা শবজি, ফল, ফুল, গবাদি পণ্য।

কিছুটা এলোমেলো পার্কিংয়ে গাড়ি থেকে নামলেই সামনে লালরঙের জোড়া আর্চের বিশাল গেট, উঁচু শেড ছড়িয়ে গেছে দুপাশে। ঢোকার মুখে বড় চাকা লাগানো ঠেলাগাড়ির মতো ভ্যানের ওপর নধর টমেটো, গাজর, আলু আর ভুট্টা সাজিয়ে অপেক্ষমাণ সায়েব কৃষক। গিন্নিবান্নি চেহারার মোটাসোটা বেজায় খুঁতখুঁতে এক মহিলা খুব মনোযোগ দিয়ে পরখ করে দেখছে সেসব, যদিও বাছাবাছির দরকার পড়ে না, দর–কষাকষিরও কোনো রেওয়াজ নেই। কার্ডবোর্ডের বাক্সের ঢাকনা খুলে দেখিয়ে রাখা আছে সব, পাশে বোর্ডে মোটা তুলি দিয়ে দাম লেখা, কোনোটির এক বাক্স দুই ডলার, কোনোটি আড়াই ডলার। দেখতে এতই নিখুঁত, যেন মনে হয় প্লাস্টিকের তৈরি সব। অন্যপাশে ঠেলাগাড়ির ওপর উজ্জ্বল রোদের নিচে কমলার সাজানো পাহাড় থেকে বিচ্ছুরিত হয় আগুনের আভা।

রোববার এখানে বসে ফুলের হাট। চারপাশ খোলা শেডের নিচে ঢুকলেই মনে হয় যেন বহুবর্ণ এক অবিশ্বাস্য প্লাবন ফুলের রূপ ধরে এই বাজারের ভেতরে এসে থমকে গেছে। শেডের বাইরের খোলা চত্বরেও ছোট ছোট টবে ফুলের মেলা। চনমনে রোদের নিচে একদিকে টবে সাজানো ফুটন্ত ডালিয়ার চারকোনা একটা ব্লক, ঠিক তার পাশে বেগুনি স্যালভিয়া, আবার অন্য পাশে উজ্জ্বল পিটুনিয়া দেখে আচমকা আমাদের কলমি ফুল বলে ভ্রম হয়। টবে সাজানো ফুটন্ত ফুলের সাজানো ব্লকগুলোকে দেখে মনে হয় কোনো কিশোরী যেন মিলিয়ে রেখে গেছে ফুলের ছবির বিশাল জিগ স পাজল। সেই ফুলের অরণ্যের মধ্যে এক জায়গায় সিগ্ধ আভা ছড়িয়ে ফুটে আছে আমাদের অপরাজিতার মতো অগণিত নীল লোবেলিয়া। জিনিয়া আর কসমস এমনই নিখুঁত যে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ওগুলো প্লাস্টিকের কি না। সেই কোন স্কুল জমানায় ইংরেজি বইয়ের পাঠ্য কবিতা ‘ড্যাফোডিলস’ পড়ে এই ফুলের সৌন্দর্য আর কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের নির্জনতার অনুভব ব্যাখ্যা করতে হতো পরীক্ষার খাতায়। এবার এই ফুলের হাটে সেই অদেখা ফুলটির দেখা মেলে, সাদামাটা এই ফুলের বিপুল সমাহার দেখে লেখা কবিতাটা নাকি ওয়ার্ডসওয়ার্থের তাঁর বিখ্যাতগুলোর একটি। তবে বায়রনের মতো তাঁর সমসাময়িক কবিদের কেউ কেউ কবিতাটির প্রতি খুব সদয় আচরণ করেননি। বায়রন তাঁর এ জাতীয় কবিতাগুলোকে ‘বালসুলভ’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন। অতএব আমরা ড্যাফোডিল ছেড়ে অন্যদিকে যেতে পারি।

শার্পনার দিয়ে কাটার পর পেনসিলের কাঠের যে পাতলা পরতগুলো বের হয়, পাপড়ির গায়ে সে রকম ছোপ ছোপ একটা ফুল দেখতাম, নাম জানতাম না। ফুলের বাজারে গিয়ে জানা হলো তার নাম ফ্লক্স। দেখা মেলে গাঁদা, বাগানবিলাস, ল্যাভেন্ডার, হাইড্রেঞ্জা, ম্যাগনোলিয়া, টিউলিপ, গ্ল্যাডিওলাস আর আইরিস, অর্থাৎ নীল দূর্বা ফুলের। পান্ডার কালো চোখের মতো কালো ছোপ পাপড়িতে আঁকা এক প্রজাতির ফুলের নাম জানা গেল—প্যানজি। এত তাজা ফুল একসঙ্গে দেখে পুষ্পাহত অবস্থায় অন্যদিকে ফেরার মুখে আমার ভাইপোটি ঝোলানোর ব্যবস্থাসহ চারপাশে ছড়ানো জেরানিয়ামের ঝাড় নিয়ে বসা এক ফুলওয়ালার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়। এখানে দর–কষাকষির ব্যবস্থা নেই, তা-ও কী যে আলাপ করে কে জানে?

আফ্রিকান বাদ্যের পশরা
আফ্রিকান বাদ্যের পশরা

এ সময় হলুদ জবাগাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে নানদের মতো সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে এক কৃষ্ণাঙ্গ রমণী ট্রাম্পেটে বাজিয়ে যাচ্ছে অজানা গানের সুর। আঁটসাঁট পোশাকে শরীরের তীব্র বাঁকগুলো দৃশ্যমান হলেও পাগড়ির মতো সাদা কাপড়ের মস্তকাবরণীর কারণে তাকে খুব পরহেজগার ঈশ্বরভক্ত সন্ন্যাসিনীর মতো দেখায়।

সেখান থেকে এগিয়ে দেখা মেলে করুণ সুর দিয়ে বেহালার তার কাটতে কাটতে ছড় বোলানোয় মগ্ন আরেক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর। তার মাথা ঢাকা রঙিন চেকের স্কার্ফের নিচ থেকে পিল পিল করে বের হয়ে আসা চিকন সাপের মতো বিনুনির লতা সুরের অদৃশ্য ঘায়ে মৃদু দোল খায়। এরপর একে একে আরও কিছু পথশিল্পীর দেখা মেলে। এক বেজায় মোটা তরুণ গিটারে তুলছে তুমুল ঝংকার, তার পাশে বেহালা হাতে কিশোর গিটারের গিটকিরির সঙ্গে কী বাজাবে বুঝতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আরেকজনকে দেখা যায় রীতিমতো চেয়ার পেতে ঠুকে যাচ্ছে জাইলোফোনের রিড। খানিক দূরে একজন দালানের ছায়ায় দুটো ড্রাম পিটিয়ে মাতিয়ে রেখেছে আশপাশ। অন্য পাশে এক পৃথুলা রমণী সামনে একগাদা ঢোলক নিয়ে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে। এসব শিল্পীর সবাই কৃষ্ণাঙ্গ। কিছুদূরে এক শ্বেতাঙ্গ শিল্পী সামনের স্ট্যান্ডে স্টাফ নোটেশন রেখে সেক্সোফোনে বাজায় বেশ জমকালো সুর। আরেক সাদা তরুণ উপুড় করা প্লাস্টিকের দুটো খালি বালতি সামনে নিয়ে আরেকটির ওপর বসে অক্টাপেডের কায়দায় মৃদুলয়ে বাজিয়ে চলে তাল। ওর পায়ের কাছে ফেলে রাখা করতালটিতেও নির্দিষ্ট তালে ঠুকছে ঢাকের কাঠি। পেছনে দাঁড় করানো ওর সাইকেল, এক পাশে রাখা কফির মগ। খোঁচা খোঁচা না–কামানো দাঁড়িতে বিষণ্ন তরুণের উদ্ভাবনী বাদ্যযন্ত্রের প্রশংসার স্বীকৃতি হিসেবেই বোধ হয় ওর সামনে রাখা হ্যাটের মধ্যে ডাইম আর কোয়ার্টারের পরিমাণটা একটু বেশি।

ট্রাম্পেটে বাদনরত কৃষ্ণাঙ্গ রমণী
ট্রাম্পেটে বাদনরত কৃষ্ণাঙ্গ রমণী

বাজারের এক প্রান্তে আছে ফারমার্স রেস্তোঁরা, তার সামনে এই দুপুরের ভরা রোদের নিচে চেয়ার–টেবিল পেতে চলছে খাওয়াদাওয়া। তার কাছেই মিশকালো এক আফ্রিকান পসরা সাজিয়ে বসেছে নানা জাতের ঢোল–তবলা নিয়ে। পাশের লোহার জালির গায়ে ঝোলানো আমাদের দোতারার মতো দেখতে এঙ্গোনি, খঞ্জনির মতো শেকারসহ নানান বাদ্যযন্ত্র। জেম্বে নামের ট্র্যাডিশনাল আফ্রিকান ঢাকটায় দুটো চাঁটি দিয়ে এক অদ্ভুত বোল তুলে সে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটির আওয়াজ অবশ্য আমাদের খোলের মতো মিঠে নয়। আমার ভাইপোটিও একটা টেনে নিয়ে ওর সঙ্গে সংগত করার চেষ্টা করলে লোকটি ঠা–ঠা করে হাসে। তারপর আবার বাজায় তার বোলটি। আমরা কিছুই না কিনে সরে আসার সময় লোকটির কৃষ্ণবর্ণ চেহারায় ছায়া পড়ে কি না বোঝা যায় না।

অ্যালান পোর বাড়ি এবং কুকুরসঙ্গী মহিলা

বহু ঘোরাঘুরি করে ম্যানহাটনের গ্রিনিচ ভিলেজের থার্ড স্ট্রিটে এডগার এলান পোর স্বল্প সময়ের আবাস ৮৫ নম্বর বাড়িটি খুঁজে বের করতে পারি। কিন্তু সে বাড়ি আর নেই, ২০০১ সালে সেটি ভেঙে তৈরি হয়েছে লাল ইটের তৈরি আধুনিক নতুন ভবন, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আইন অনুষদের ক্যাম্পাস। ১৮৪৫ সালের শেষ দিকে পো তাঁর অসুস্থ স্ত্রী আর শাশুড়িকে নিয়ে এই ঠিকানার চারতলা একটা বাড়িতে বাস করেছেন। সে বছরের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বহুল প্রশংসিত কাব্যগ্রন্থ দ্য র‌্যাভেন। বাড়িটি অধিগ্রহণ করে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি যখন সেখানে নতুন অ্যাকাডেমিক ভবন তৈরির উদ্যোগ নেয়, পো–ভক্তরা সমস্বরে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে তেমন পাত্তা দেয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল, নয় বছরে পো ম্যানহাটনের যে নয়টি বাড়িতে বিভিন্ন সময় থেকেছেন, এটি সেগুলোরই একটা। বাড়িটিতে তাঁর অবস্থান ছিল মাত্র পাঁচ মাসের, এই সময়ে এ বাড়িতে বসে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা করেননি। তা ছাড়া বাড়িটির আর কোনো ঐতিহাসিক স্থাপত্য–বৈশিষ্ট্যও নেই। ফলে পোর স্বল্পকালীন বাসভবনটিকে সংরক্ষণ করা যায়নি।

ঠিকানা খুঁজে পেয়ে যতখানি উৎফুল্ল হয়েছিলাম, ঝাঁ–চকচকে ভবনটি দেখে ততখানি হতাশ হই। অ্যালান পোর স্মৃতি বলতে দরজার পাশে লাগানো একটা কাঠের ফলকে উৎকীর্ণ লেখাগুলো, ‘৮৫ ওয়েস্ট থার্ড স্ট্রিট (পুরাতন অ্যামিটি স্ট্রিট)। ১৮৪৫–৪৬ সালে এডগার অ্যালান পো এটার কাছে জুদা হাম্মোন্ডের জন্য ১৮৩৫ সালে তৈরি একটা বাড়িতে থাকতেন। এখানে পো রচনা করেছেন দ্য ফ্যাক্টস ইন দ্য কেস অব এম ভালদেমার, দ্য স্ফিংকস এবং শুরু করেছেন দ্য কাস্ক অব অ্যামনটিলাডো লিটারেটি অব নিউইয়র্ক সিটির কাজ। বর্তমান বহির্দৃশ্যটা ব্যাখ্যামূলক পুনর্নির্মাণ।’

প্রৌঢ়া ছোট একটা কুকুরের গলায় বাঁধা রশি ধরে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন
প্রৌঢ়া ছোট একটা কুকুরের গলায় বাঁধা রশি ধরে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন

পোর বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত এবং শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে সিক্সথ অ্যাভিনিউর পাশে একটা বেঞ্চিতে বসে ছিলাম দুজনে। মাত্র গত পরশু মোমাতে (মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টস) কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে এসেছি, সে কথাই আলাপ হচ্ছিল। এ সময় এক প্রৌঢ়া ছোট একটা কুকুরের গলায় বাঁধা রশি ধরে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। মহিলার বয়স চেখভের আনা সের্গেইয়েভনার চেয়ে ঢের বেশি, তবু তাঁকে দেখে আমার চেখভের ‘কুকুরসঙ্গী মহিলা’ গল্পটির কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের ঠিক সামনে এসে কুকুরটি দাঁড়িয়ে পড়ে। অগত্যা ভদ্রমহিলাকেও দাঁড়াতে হয়। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে সম্ভাষণের ভঙ্গিতে মৃদু হাসেন। কুকুরটি জুলজুল করে আমাদের দেখছিল। কুকুরসঙ্গী মহিলাকে খুশি করার জন্য আমি বলি ‘হাউ সুইট’। মহিলা ‘থ্যাংক ইউ’ বলে হাতের রশি ধরে টান দিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েও থেমে যান, সারমেয় শাবকটি অবাধ্য ছেলের মতো ত্যাড়া বোঝা গেল। তিনি যতবারই টানেন, কুকুরটি গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি একবার ‘ইউ নটি বয়’ বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বিব্রত হাসি হাসেন। তারপর হাতের টান শক্ত করলে কুকুরটি চার পা কংক্রিটের ফুটপাতের ওপর শক্ত করে ঠেকিয়ে নিঃশব্দ প্রতিবাদের মাধ্যমে যেতে অনিচ্ছা জানায়। সারমেয় শাবকটির প্রতিরোধের কাছে হার মেনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকেন মহিলা। বুঝতে পারি, কুকুরটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অপরিচিত গাত্রবর্ণের ভিনদেশিদের প্রতি কৌতূহল আর আকর্ষণের কারণে তার মালকিনের সঙ্গে যেতে অনিচ্ছুক। বিষয়টা বুঝতে পারার পর আমরা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে উল্টো দিকে পা বাড়ালে কুকুরটি হাল ছেড়ে দিয়ে বাধ্য ছেলের মতো মহিলার অনুগামী হয়। কুকুরসঙ্গী মহিলা আমাদের এই সহযোগিতার জন্য কয়েকবার ধন্যবাদ জানিয়ে সারমেয়ছানার সঙ্গে গুনগুন করে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকেন।