মামণির গল্প

ছোটবেলা থেকেই শুনছি, আমার নানুমণি আর নানাভাই নেই। মামণি বলেছে, ‘যখন মামণির নয় বছর, তখন নানুমণি দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে।’
মামণিরা ছিল পাঁচ ভাইবোন। আমার মামণি সবার ছোট, মানে আমার কাঠবেড়ালি মামার (ছোট মামার) প্রায় সাড়ে নয় বছরের ছোট। মামণি ছিল যেমন জেদি, তেমনি আহ্লাদি। একপলকের মধ্যে সবার মন জয় করে নিত আদর ও ভালোবাসায়। মামণি ছিল চার ভাইয়ের চোখের মণি। যখন যেটার বায়না ধরেছে, তখনই তাকে সেটা এনে দিতেই হতো। আমার ভোগলু মামা (মেজো মামা) এখনো বলে, তোর মা যদি বলত সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে, তাহলে সবাইকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে হতো, ‘তাই তো! আজ সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে, কী দারুণ ব্যাপার!’ কেউ কোনো কাজ করতে নিষেধ করলেই মামণি কেঁদে উঠত। আমার মামুজা (সেজো মামা) বলে, ‘তোর মা তো কেঁদেই বিশ্বজয় করত।’
নানুমণি আর নানাভাইয়ের রীতিমতো ভয় ছিল, এই মেয়েকে দিয়ে পড়াশোনা হবে কীভাবে? কারণ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত নানুমণিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে বসে থাকতে হতো। নানুকে ছাড়া মামণি ক্লাস করত না। নানুমণি যদি দপ্তরিকে পান কিনে আনার জন্য টাকা দিতে যেতেন, অমনি মামণি ক্লাস থেকে বের হয়ে আসত। নানুমণিকে সব সময় এমন জায়গায় বসতে হতো যেন ক্লাস থেকে মামণি তাঁকে দেখতে পায়। মামণি ক্লাস করত আর নানুমণিকে দেখত। নানুমণি তাঁর সংসারের সব কাজ বাদ দিয়ে মামণিকে স্কুলে নিয়ে যেতেন।
নানুমণির খুব কষ্ট হতো ফিরে এসে সব কাজ করতে; কিন্তু তবুও তিনি চাইতেন তাঁর একমাত্র আদরের মেয়ে পড়ালেখা শিখুক। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও বলতেন, ‘আপা, আপনি ওকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে আসেন। নইলে ওর পড়াশোনা হবে না।’ মামণির পৃথিবী ছিলেন নানুমণি। মামণি সব সময় নানুমণির পিছু পিছু ঘুরত। কখনোই কাছছাড়া হতো না। সবাই মামণির এমন জেদ দেখে বলত, ‘ওকে ঘরে তালা দিয়ে রাখেন। তাহলে শিক্ষা হবে।’ নানুমণি এসব শুনতেন আর সবাইকে বকা দিতেন।
শুনেছি নানুমণি কাজ করতে করতে গুনগুন করে গান গাইতেন। আমার মামণি আর চার মামাই অনেক সুন্দর করে গান গাইতে পারে। মামণির গানের গলা খুবই সুন্দর। কত যে পুরস্কার পেয়েছে মামণি! তার হিসাব নেই।
নানাভাই মামণিকে অনেক আদর করতেন। তিনি মামণির সব আবদার পূরণ করতেন। নানুমণি তারা হয়ে যাওয়ার পর মামণির জগৎ হলেন নানাভাই। নানাভাইয়ের কাছেই তার সব জেদ। তারপর নানাভাই তারা হয়ে যাওয়ার সময় মামণি অনেক কেঁদেছেন। তিনি চলে যাওয়ার পর মামণি অনেক বদলে গেছেন। বুঝতে শিখেছেন।
ছোটবেলা থেকেই মামণি ডানপিটে ছিল। গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো—এসব নিয়েই মেতে থাকত সব সময়। বিকেল হলেই একছুটে বাড়ি ছেড়ে বান্ধবীদের সঙ্গে গোল্লাছুট, কানামাছি, লম্বাদড়ি, লুকোচুরি খেলতে চলে যেত। পড়াশোনা ছেড়ে খেলতে দেখে মামারা মামণিকে বকা দিত। মজা হতো তখন, যখনই মামণিকে কাঠবেড়ালি মামা বকা বা পিটুনি দিত। তখন বড্ডমামা (বড় মামা), ভোগলুমামা আর মামুজা—সবাই মিলে কাঠবেড়ালিকেও বকা দিত।
যা-ই হোক, মায়ের কথা তো লিখে শেষ করা যায় না। মামণি ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালোবাসায় বড় হয়েছে। আমার বাবাও মামণিকে খুব ভালোবাসে। আমিও!
আমার মামণি এই বাংলা মায়ের মতো সুন্দর। লাভ ইউ মামণি!
অষ্টম শ্রেণি, সানশাইন স্কুল