
গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই করছে। বাইরে সুনসান নীরবতা। নাইট গার্ডগুলোও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বাঁশির শব্দ নেই। নিলয় লাইট অফ করে বিছানায় শুয়েছে ১০ মিনিট হয়। সামনে পরীক্ষা। তাই রাত জেগে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এক দিনও সাড়ে ১২টার আগে শোয়ার উপায় নেই। নিলয় পাশ ফিরে শোয়। তার চোখে রাজ্যের ঘুম।
হঠাৎ ধপ করে একটা আওয়াজ! ‘কে?’ নিলয় বালিশ থেকে মাথা তুলে আবছা অন্ধকারে এদিক-ওদিক তাকায়। না, ঘরে তো কেউ ঢোকেনি। সে আবার শুয়ে পড়ে, কিন্তু ঘুম আসে না।
মিনিট তিনেকের মাথায় আবারও সেই শব্দ। নিলয় এবার কান খাড়া করে। বুঝতে পারে, আওয়াজটা আসছে ছাদ থেকে। কিন্তু এত রাতে ছাদে আওয়াজ কিসের! বাড়িওয়ালা আঙ্কেল দিনের বেলায়ও কাউকে ছাদে উঠতে দেন না। এমনকি নিজেও ওঠেন না। তাঁর ধারণা, নিজে ওঠার জন্য যদি তিনি ছাদের তালা খোলেন, এই সুযোগে ভাড়াটেরাও উঠে পড়তে পারে।
নিলয় শোয়া থেকে উঠে বসেছে। এখন মনে হচ্ছে ছাদে কেউ হাঁটছে। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রচণ্ড গরমেও সে পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে নেয়। কাঁথামুড়ি দিয়ে চোখ বুজে ভাবতে থাকে, কোনোমতে রাতটা পার হলে হয়...
২.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিলয় ছুটে যায় আকাশদের বাড়িতে। আকাশরাও ভাড়াটে, থাকে নিচতলায়। সমবয়সী হওয়ায় দুজনের মধ্যে গলায় গলায় ভাব। রাতের ঘটনা এক্ষুনি ওকে না বললেই নয়!
সব শুনে ভয়ে আকাশের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। নিলয় বলে, ‘এখন তো আর রাত না। এই দিনের বেলায় ভয়ের কিছু নেই। আয় ছাদে যাই। দরজা বন্ধ, জানি। তবু ফাঁকফোকর দিয়ে যদি কিছু দেখা যায়...চল!’
ছাদের দরজায় অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা ছিদ্র পাওয়া গেল। সেখানে চোখ রেখে নিলয় উঁকিঝুঁকি মারে।
‘কী যেন একটা পড়ে আছে। অনেকটা কামানের মতো দেখতে।’
শুনে আকাশ চমকে ওঠে, ‘কামানের মতো! তাহলে নিশ্চয়ই এটা ডাকাতদের কাজ। তুই রাতে ডাকাতদের পায়ের আওয়াজ শুনেছিস। শিগগির চল, এখানে এক সেকেন্ডও থাকা যাবে না। খবরদার! আর কখনো এই ছাদের দিকে আসবি না। এখানে নিশ্চয়ই ডাকাতদের যাতায়াত আছে। ডাকাতেরা যদি জানতে পারে আমরা তাদের আস্তানা চিনে গেছি, তাহলে কিন্তু সর্বনাশ।’
নিচে নামতে নামতে নিলয় বলে, ‘আমাদের উচিত বাড়িওয়ালা আঙ্কেলকে বিষয়টা জানানো।’
‘উঁহু, তাঁকে জানাতে গেলেই হইচই শুরু করে দেবেন। ঝামেলা আরও বাড়বে।’ আকাশের কথা শেষ হতে না হতেই ততক্ষণে কে যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে ফিরে দুই বন্ধু চমকে ওঠে। স্বয়ং বাড়িওয়ালা!
‘ঘটনা কী? কিসের ঝামেলা?’ জানতে চান তিনি।
দুই বন্ধু কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে হড়বড় করে পুরো ঘটনা খুলে বলে।
কিন্তু আশ্চর্য! সব শুনে বাড়িওয়ালার মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়ে না। বরং তিনি মুচকি হাসেন।
নিলয় আর আকাশকে নিয়ে আবার ওপরে উঠে আসেন তিনি। ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তোমাদের সবাইকে একটা চমক দিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কাজটা শেষ হলে সবাইকে জানাব। কিন্তু তোমরা যেহেতু আগেই টের পেয়ে গেছ, ব্যাপারটা বলেই ফেলি। তোমাদের মতো বয়সে থাকতাম গ্রামে। বহু বছর পর গত সপ্তাহে আবার নিজের গ্রামে গিয়েছিলাম। গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছোটবেলায় আমরা যেসব ঐতিহ্যবাহী জিনিস দেখেছি, সেগুলো আর নেই। প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ছাদের ওপর একটা জাদুঘর বানাব।’
‘জাদুঘর!’ দুই বন্ধু চমকে ওঠে।
‘হ্যাঁ, জাদুঘর। ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোর মধ্যে এখনো যেগুলো বিলুপ্ত হয়নি, সেগুলো এনে ছাদে সাজিয়ে রাখব। গত রাতে কয়েকটা জিনিস আনলাম। আমার পায়ের আওয়াজই তুমি শুনেছিল।’
‘কিন্তু রাতে কেন?’
‘ওই যে বললাম, চমক! দিনে আনলে সবাই দেখে ফেলত। চমকটা আর থাকত না।’
‘কিন্তু আঙ্কেল, আপনার জাদুঘরটা তো সামরিক জাদুঘর না। তাহলে কামান রেখেছেন কেন?’ নিলয়ের প্রশ্ন শুনে হা হা করে হেসে ফেলেন আঙ্কেল। হাসতে হাসতেই বলেন, ‘আরে বোকা, তোমরা যেটা দেখেছ, ওটা কামান নয়। ঢেঁকি!’