আবু রুশদের ‘সংস অব লালন’ ও বিদেশিদের লালনচর্চা

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।।
ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়।।

আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা,
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা,
তার উপরে সদর কোঠা,
আয়না মহল তায়।।

How does the strange bird
Flit in and out of the cage
If I could catch the bird
I would put it under the fetters of my heart

The cage has eight cells and nine doors
With latticed openings here and there
Above it is the main hall
With a mirror-chamber.
প্রখ্যাত সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক আবু রুশদের অনুবাদে ‘সংস অব লালন শাহ’ বা ‘লালন শাহের গান’ বইটি প্রথম বেরিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। বাংলা একাডেমি বের করেছিল বইটি। এরপর এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় ২৬ বছর পর ১৯৯১ সালে। বইটি এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য। অথচ লালনের গান নিয়ে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকের আগ্রহ বাড়ছে বৈ কমছে না।

বিগত শতকের ষাটের দশকে এ অঞ্চলে লালন শাহ সম্পর্কে আগ্রহের সূচনা। ঠিক ওই সময়েই ‘সংস অব লালন’ বেরিয়েছিল। এরপর কয়েক দশক ধরে লালন ও তাঁর গান নিয়ে দেশে ও বিদেশে আগ্রহ, গবেষণা কেবল বেড়েই চলেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এ বিষয়ে আলোচনার আগে আমাদের চিন্তা করতে হবে আবু রুশদ কেন লালন শাহের গান নিয়ে কাজ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। সেটাও জানার আগে আবু রুশদ সম্পর্কে দু–চার কথা এ প্রজন্মের পাঠকদের জানা প্রয়োজন। কারণ, আবু রুশদ নামটিও তো প্রায় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে।

আবু রুশদ মতিনউদ্দিন চল্লিশের দশকের এ অঞ্চলের প্রধান কথাসাহিত্যিকদের একজন। তাঁর সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শামসুদ্‌দীন আবুল কালাম, আবুল হোসেন, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ।

আজন্ম ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক আবু রুশদ দেশভাগ, মুসলিম শিক্ষিত সমাজের উত্থান, মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের জীবনকাহিনির সুনিপুণ উপস্থাপক ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মূল্যায়নে, যাঁরা ৩০ থেকে ৪০ দশকের নতুন সাহিত্যের ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কবিতায় ছিলেন আবুল হোসেন ও সৈয়দ আলী আহসান। আর কথাসাহিত্যে ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান ও আবু রুশদ। তাঁরা সবাই নাগরিক বৈদগ্ধের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। সবাই কলকাতায় থাকতেন এবং তাঁদের সঙ্গে সমকালীন তরুণ সাহিত্যিকদের যোগাযোগ ছিল। তবে তাঁদের মধ্যে কথাশিল্পী হিসেবে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল আবু রুশদের।

৬টি উপন্যাস, ৫০টি ছোটগল্প এবং ৩ খণ্ডের আত্মজীবনী রচনা করেছেন আবু রুশদ। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম ‘রাজধানীতে ঝড়’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। উল্লেখযোগ্য অন্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ‘এলোমেলো’(১৯৪৬), ‘সামনে নতুন দিন’(১৯৫১), ‘ডোবা হলো দীঘি’(১৯৬০), ‘নোঙ্গর’(১৯৬৭), ‘অনিশ্চিত রাগিণী’(১৯৬৯), ‘স্থগিত দ্বীপ’(১৯৭৪)।

এর বাইরে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের জন্য অনুবাদ করেছেন উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের কবিতা, তেমনি ইংরেজিভাষী পাঠকের সামনে হাজির করেছেন বাংলার ভাববাদী লোককবি ফকির লালন শাহকে তাঁর গান ইংরেজিতে অনুবাদের মধ্য দিয়ে।

২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ছিল এই গুণি সাহিত্যিকের জন্মশতবার্ষিকী। আর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর মৃত্যুবাষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই এই নিবন্ধ।


দুই.


মহাপুরুষ ফকির লালন শাহর জন্ম ১৭৭৪ সালে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া এলাকায়। যদিও তাঁর জন্মসাল নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বাউল সম্প্রদায়ের একজন মানুষ ছিলেন। দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন। ১১২, ১১৬, এমনকি ১২৬ বছর পর্যন্ত তাঁর আয়ুষ্কাল ধরা হয়ে থাকে। তবে ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুর তারিখটির ব্যাপারে আমরা অনেকেই নিশ্চিত। তখন কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক হিতকরী পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর খবর বেরিয়েছিল।

লালন শাহ অসংখ্য গানের রচয়িতা। তাঁর গানের ভক্তিরসের আবেশ আর বিহ্বলতা মনে শিহরণ তোলে। এর কিছু অংশ এ বইয়ে স্থান পেয়েছে। ১৯৬৪ সালে যে সংস্করণটি বেরিয়েছিল, ১৯৯১ সালের সংস্করণে এর চেয়ে ১৫টি গান বেশি আছে, যেগুলো বৈশিষ্ট্যগতভাবে ভক্তিসংগীত। বইটি প্রকাশের প্রাক্কালে মুখবন্ধ লিখেছিলেন আবু রুশদ। তখন তিনি চট্টগ্রামের একটি কলেজের অধ্যক্ষ। ১৯৬৩ সালের ৮ জুলাই অধ্যক্ষের বাংলোয় বসে লেখা মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এ বইয়ের জন্য নিবাচিত গানগুলোতে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম ধর্মের সঙ্গে লালন শাহের একধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। লালন শাহের ওই সময়ের জন্য এটা মোটেই বিস্ময়কর ছিল না। কারণ, ওই সময় পুরো নদীয়া জেলায়, যার একটি অংশ এখন পশ্চিম বাংলার মধ্যে পড়েছে, খ্রিষ্টান মিশনারি ও হিন্দু ধর্মতাত্ত্বিকগণের বিরাট প্রভাব ছিল। এর বাইরে বাউল সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি হিসেবে সব ধর্মের প্রতিই লালন শাহের এক ধরনের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।’

লালন গবেষক ক্যারল সলোমন
ছবি: সংগৃহীত

লালনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সব সময়ই মানুষের মনে বিশেষ আগ্রহ ছিল। এর জবাবে লালন নিজেই লিখেছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালন বলে, জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।’ কেউ কেউ দাবি করেছেন, তিনি হিন্দু ছিলেন। অন্যরা মনে করেছেন, তিনি মুসলিম ছিলেন। কিন্তু লালনের ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্ন সব সময় বড় হয়ে ওঠেনি তাঁর লেখা গানের গুণমানের কারণে। তাঁর বেশির ভাগ গানে স্থানীয় জীবনচিত্র, ভাব, ভাষা, বোধ ধরা পড়েছে। আবু রুশদের কথায়, লালনের কিছু শব্দ বিদেশি পাঠককে বোঝাতে সঠিক ইংরেজি প্রতিশব্দ পাওয়া মুশকিল। সেসব গান অধ্যাপক আবু রুশদ এ বইতে রাখেননি, যদিও সেসব গানের সাহিত্যগুণকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

লালনের গানের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে এক হাজারের কম হবে না হয়তো। প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে গান রচনা করেছেন তিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্তিসংগীত লালন দ্বারা প্রভাবিত, স্বয়ং কবিগুরু এ কথা কবুল করে গেছেন।

তিন.

কয়েক দশক ধরে বিদেশিদের মধ্যে লালনচর্চা বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। প্রতিবছর ছেঁউড়িয়ায় লালন স্মরণোৎসবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি হাজির হন। আমরা এখানে ক্যারল সলোমন নামের এক সাধিকা-গবেষকের নাম উল্লেখ করতে পারি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। লালনের গানের পাঠোদ্ধার নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে বাংলাদেশে লালনের গানের অন্যতম প্রধান শিল্পী ও তত্ত্বজ্ঞ খোদা বক্সের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। খোদা বক্সের গুরুর নাম শুকচাঁদ শাহ। খোদা বক্স ২০ বছর কাটিয়েছেন শুকচাঁদের সঙ্গে। শুকচাঁদের গুরু ছিলেন বৃহত্তর যশোর জেলার হরিয়ারঘাটের অন্য এক খোদা বক্স শাহ। এই খোদা বক্স শাহের গুরু ছিলেন মনিরুদ্দিন শাহ। মনিরুদ্দিন শাহ ছিলেন লালনের নিজের হাতে দীক্ষিত শিষ্য। খোদা বক্সের হিসাব অনুযায়ী, তিনি লালনের ৫০০ গান জানতেন এবং তাঁর স্মৃতিভান্ডারে ৭৬ লোককবির ১ হাজার ৭০০ গান ছিল। (১৪ এপ্রিল ২০১৫, প্রথম আলোয় প্রকাশিত ক্যারল সলোমনের নিবন্ধ)। ক্যারল সলোমন মূলত বিভিন্নজনের লেখায় কীভাবে লালনের গানের মূল রূপটি বিকৃত হয়েছে, সেটা যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি আদি ও প্রকৃত রূপটির অনুসন্ধান করে গেছেন এ দেশের পথেপ্রান্তরে দুই যুগের বেশি সময় ঘুরে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে, বাউল সাধকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে।

একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ‘কুলের ভয়ে কাজ হারাবি, কুল কি নিবি সঙ্গে করে। পস্তাবি শ্মশানে যেদিন ফেলবে তোরে, দিসনে আর আঁচির কড়ি, নাড়ার নাড়ি হও যেই রে।’ অনেক গবেষকের লেখায় এই ‘আঁচির কড়ি’র বদলে আড়াই কড়ি, আচার কড়ি, আটির কড়ি উল্লেখ করা হয়েছে। খোদা বক্সের মাধ্যমে ক্যারল সলোমন নিশ্চিত হয়েছেন, এটি আসলে ‘আঁচির কড়ি।’ আঁচি মানে জননাশৌচ। আর ‘আঁচির কড়ি’ মানে যে টাকা দাইকে দেওয়া হয়।

ক্যারল সলোমন তাঁর ৩০ বছরের সাধনায় লালনের ১৩০টি গানের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, যদিও তা বই আকারে প্রকাশ করতে পারেননি আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায়।
ক্যারল সলোমন একা নন, আরও অনেক বিদেশি লালনের গানের রূপ-রস–ঘ্রাণে মোহিত হয়েছেন এবং কাজ করে চলেছেন। আর তাঁদের জন্যই লালনকে চেনার দ্বার উন্মোচন করেছেন আবু রুশদ তাঁর ‘সংস অব লালন’ বা ‘লালন শাহের গান’–এর মাধ্যমে। কিন্তু অনেক উৎসাহী গবেষকের কাছে বইটির কথা অজানা রয়ে গেছে হয়তো।

চার.


এ বইয়ে লালনের গানকে সাতটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন অনুবাদক আবু রুশদ। এগুলো হলো হিমস বা প্রশস্তি, ডিভোশনাল সংস বা ভক্তিসংগীত, বডি মিস্টরি বা দেহতত্ত্ব, সেলফ নলেজ বা আত্মতত্ত্ব, ইনকোয়ারি বা আত্মজিজ্ঞাসা, আলটিমেট নলেজ বা পরমতত্ত্ব ও মিসলেনিয়াস বা বিবিধ।

বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ যখন বেরোয়, তখন ঘটনাক্রমে এই সাধক কবির মৃত্যুর শততমবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল। সেটাও দ্বিতীয় সংস্করণের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়।
অধ্যাপক আবু রুশদ বলে গেছেন, তিনি সত্যিই আপ্লুত হবেন এই বই যদি বিদেশি পাঠকদের কাছে লালনকে কবি হিসেবে কিছুটা বোঝার স্বাদ এনে দিতে পারে। দ্বিতীয় সংস্করণের প্রাক্কালে বাংলা একাডেমির তখনকার মহাপরিচালক মাহমুদ শাহ কোরেশি আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, বইটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লালনভক্তদের চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করবে।

আবু রুশদের অনুবাদে ‘সংস অব লালন’ বা ‘লালন শাহের গান’ নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের ভান্ডারে একটি প্রয়োজনীয় সংযোজন। যেহেতু বইটি বাজারে সহজলভ্য নয়, তাই ৩১ বছর পর হলেও তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন এ সংস্করণের শুরুতে বিদেশিদের লালনচর্চার ওপর ইংরেজিতে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ যুক্ত করা যেতে পারে।

সূত্র: গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ঢাকায় আবু রুশদ সম্মাননা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তৃতা, ১৪ এপ্রিল ২০১৫, প্রথম আলোয় প্রকাশিত ক্যারল সলোমনের নিবন্ধ ও ‘সংস অব লালন’ বা ‘লালন শাহের গান’।