‘আমার বইয়ের দাম সব সময় বেশি, আমি সস্তা বই লিখি না।’ বলে হাসলাম। আমার সামনে দাঁড়ানো তরুণটি কিন্তু হাসছেন না। তাঁর মুখ গম্ভীর। মনোযোগ দিয়ে জিনসের প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বের করে গুনছেন তিনি। পাশে তাঁর বান্ধবী। তরুণটি টাকার ভাঁজ খুলতে খুলতে বললেন, ‘আপনার বইয়ের দাম দিলে আমাদের আর ফেরার টাকা থাকে না।’
আমি বললাম, ‘আপনি ফেরার টাকা পকেটে রাখেন। আরও কয়েকটা টাকা ইমার্জেন্সির জন্য রাখতে হবে। এবার বলেন, আপনি কত টাকা দিতে পারবেন?’
আমার বইটার দাম তিন শ টাকা। কমিশন বাদ দিয়ে আসে ২২৫ টাকা। তরুণ বললেন, ‘দেড় শ টাকা দিতে পারব।’
আমি বললাম, ‘আপনি এক শ টাকা দ্যান। বাকি টাকা আমি আমার নামে লিখে রাখব। সৌজন্য সংখ্যার অনেক কপি আমি প্রকাশকেরের কাছ থেকে পাই। নেওয়া হয় না। একটা বইয়ের দাম কম নিলে প্রকাশকের এমন কোনো ক্ষতি হবে না।’
বইমেলায় আমি নিয়মিত যাই। এটা শুরু করেছি ১৯৮০-এর দশক থেকে। তখন আমি রংপুর থেকে ঢাকায় আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব বলে। ১৯৮৭ সালে আমরা জাতীয় কবিতা উৎসবে সক্রিয় হই। তখন থেকে ফেব্রুয়ারি এলেই টিএসসি আর বইমেলায় আসা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম বই ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’। ‘তুই কি আমার দুঃখ হবি’ কবিতাটা এই বইয়েই আছে। ‘মানুষ জাগবে ফের’ নামের কবিতাটাও এতে প্রকাশিত। আমার প্রথম বই বের করেন আমাদের বন্ধু ছোট ভাই আর্কিটেকচারের রম্য রহিম। প্রচ্ছদও ছিল তাঁরই করা। ফটো কম্পোজ নামে তখন একটা জিনিস ছিল। ঝকঝক করত অক্ষরগুলো। আমি সে সময় মোজাম্মেল বাবুর ‘দেশবন্ধু’ পত্রিকায় কাজ করতাম। সেই সুবাদে ইত্তেফাক গ্রুপের জেনিথ প্যাকেজিং অ্যান্ড প্রেস থেকে ফটো কম্পোজ বিনা মূল্যে করে দেন বাঁধন সরকার আর সাংবাদিক কুদ্দুস আফ্রাদ। আমি সে সময় ইউকসুর (প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) বার্ষিকী সম্পাদক। আর্কিটেক্ট নিখিলদা আমাদের নেতা ছিলেন। বইয়ের জন্য তিনি কিছু চাঁদা দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, মোস্তফা জব্বার ভাইয়ের ভাই রব্বানি জব্বার তাঁর নিজের প্রেসে বইটা বিনা পয়সায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা প্রথম বই, নাকি দ্বিতীয়, তা মনে পড়ছে না। জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু ভাইও চাঁদা দিয়ে থাকতে পারেন।
অফসেট কাগজে তিন ফর্মার বই ছাপা হয়ে বেরিয়ে গেল। দাম কুড়ি টাকা। বইমেলায় মাদুর বিছিয়ে, পরে একটা ছোট টেবিল জোগাড় করে তাতে বই সাজিয়ে আমি নিজে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করতাম। প্রথম মুদ্রণের ৬০০ কপি এক বইমেলায় বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। কারণ, তখন আমি বুয়েটের নেতা। টিএসসিরও পরিচিত মুখ। বুয়েটের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এসে তাঁদের বন্ধুর বই কিনে নিয়ে যেত। আমার বই বিক্রি হওয়ার আরও দুটো কারণ ছিল। আবৃত্তিকারেরা আমার কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। মিছিলে মিছিলে আমার কবিতা আবৃত্তি হতো। হাসান আরিফ, শিমুল মুস্তাফা, মাহিদুল ইসলাম মাহি প্রমুখ অবৃত্তি করতেন। আরেকটা কারণ হলো, বইটার দাম ছিল কম। ২০ টাকা দামের বই বিক্রি হতো ১৭ টাকায়। এক পাঠক আমার বইটা কিনতে গিয়ে অভিযোগ করলেন, ‘ফটো কম্পোজ করা বই, অফসেটে ছাপা, দাম এত কম নিচ্ছেন কেন?’
আমি বললাম, ‘পাঁচ শ বই বিক্রি হয়ে গেলে আমার লাভ হবে। আমি তো অনেক কিছু ফ্রিতে করেছি। শুধু কাগজের দাম আর বাঁধাইয়ের খরচ লেগেছে।’
তিনি বললেন, কিন্তু অন্যদের বেলায় তো এটা হবে না। অন্যরা তো আর ফ্রি পাবে না।
১৯৮৯ সাল থেকে লেখক হিসেবেই আমি বইমেলায় যাই। ১৯৯৩ সালে বের হয় আমার ‘গদ্যকার্টুন’। বের করেছিলেন নুরুল আলম আতিক আর তাজুল হক, নদী প্রকাশন থেকে। দাম ছিল ৬৫ টাকা। এক মাস বাদে মার্চে রয়ালটি পেলাম—১৮ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে আমার বিয়ের গায়েহলুদের খরচ নির্বাহ করেছিলাম।
তো, তখন বইমেলায় গেলে সময় প্রকাশনের স্টলে দাঁড়াতাম। ১৯৯০-এর দশকে সময়ের স্টলে মাঝেমধ্যে আসতেন মুনতাসীর মামুন স্যার। স্যারের বই দুই-চার কপি বিক্রি হয়ে গেলে তিনি বলতেন, ‘ফরিদ, দুই বই বিক্রি হয়েছে, চায়ের দাম বোধ হয় উঠে গেছে। দুই কাপ চা দিতে বলেন।’
মুনতাসীর মামুন আর আমি সময় প্রকাশনীর মালিক ফরিদ আহমেদের কিপটেমি নিয়ে নানা রকম ঠাট্টা করতাম। সেটা উপভোগ করতেন ফরিদ ভাই। আর তাঁর স্ত্রী তানি ভাবি করতেন রাগ।
তো একবার ঘটল সেই ঘটনা।
এক তরুণ আর এক তরুণী এসেছেন সময় প্রকাশনীর স্টলে। তাঁরা আমার ‘মা’ বইটি কিনবেন। কিন্তু সমস্যা হলো বইয়ের দাম বেশি।
তরুণটি আমাকে বললেন, ‘আপনার বইয়ের দাম তো বেশি।’
আমি ‘গদ্যকার্টুন’ লিখি। কৌতুক করা আমার স্বাভাবিক প্রবণতা। আমি রসিকতা করার চেষ্টা করলাম, ‘আমার বইয়ের দাম সব সময় বেশি, আমি সস্তা বই লিখি না।’
তিনি আমার রসিকতা শুনলেন না। তিনি তখন টাকার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। বহু দূর থেকে এসেছেন। তাঁদের চার হাতে অনেক বইয়ের ব্যাগ। বেশ কিছু বই তাঁরা কিনেছেন। বাজেট শেষ। কিন্তু ‘মা’ বইটাও কিনতে চান।
আমি বুঝলাম, এই পরিস্থিতি রসিকতার জন্য উপযুক্ত নয়। বললাম, ‘সত্যিই, বইয়ের দাম বেশি। আমি মানি যে বইয়ের দাম একটু বেশি। কমানো উচিত। কমানো দরকার। সবাই মিলে চেষ্টা করা যেতে পারে।’
বাংলা বইয়ের দাম বেশি—এটা অবশ্য মানতে চাননি সৈয়দ মুজতবা আলী। ‘বইকেনা’ প্রবন্ধে তিনি বাঙালিদের বই না কেনার অভ্যাস সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘এ রকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতে কোথাও দেখিনি। জ্ঞানতৃষ্ণা তার প্রবল, কিন্তু বই কেনার বেলা সে অবলা। আবার কোনো কোনো বেশরম বলে, “বাঙালির পয়সার অভাব।” বটে? কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে লোকটা এ কথা? ফুটবল মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে, না সিনেমার টিকিট কাটার “কিউ” থেকে?’
বইয়ের দাম বেশি, এটা সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে এ দেশের মানুষ দশ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কিনে শাহরুখ খানের শো দেখতে স্টেডিয়ামে গেছে, মাঠে তিলধারণের স্থান ছিল না। এক পিস ফ্রায়েড চিকেনের দাম ১৫০ টাকা। সেদিন মাওয়া গিয়েছিলাম ইলিশ খেতে, দশ জনে আট হাজার টাকা বিল দিয়ে এসেছি, দুটো ইলিশ নিয়েছে পাঁচ হাজার।
অথচ এই আট হাজার টাকা নিয়ে বইমেলায় গেলে বই কিনে আনতে মিন্তি লাগবে। একটু পুরোনো সংস্করণের বই এখনো বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। বাংলা একাডেমির বই তো রীতিমতো সস্তাই ছিল। বলি, আপনার বাড়িতে নিশ্চয়ই একটা বাংলা অভিধান আছে। অতি সস্তায় বাংলা একাডেমিতে অভিধান বিক্রি হয়।
আচ্ছা, আমাদের সবার বাড়িতে একটা ‘গল্পগুচ্ছ’, ‘সঞ্চয়িতা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘বিষাদ–সিন্ধু’, ‘বনলতা সেন’, ‘বোবাকাহিনী’, ‘চাচাকাহিনী’ আছে তো? আমাদের সবার বাড়িতে টিভি আছে, স্মার্টফোন আছে, আমরা মাসে তিন শ টাকা ডেটার জন্য খরচ করতে পারি, চার শ টাকা ডিশ অ্যান্টেনার লাইনের বিল দিতে কার্পণ্য করি না; কিন্তু বই কেনার সময় আমাদের পকেটে টাকায় টান পড়ে। এই ঢাকা শহরে মিষ্টির কেজি চৌদ্দ শ টাকা। দোকানে এক শ গ্রামের দাম এক শ চল্লিশ টাকা লেখা আছে। জিজ্ঞেস করুন, চিনি, দুধ, আটা কোনোটার কেজি এক শ টাকার বেশি নয়, মিষ্টির দাম কী করে আট শ থেকে চৌদ্দ শ টাকা কেজি হয়? যে দোকানে দাম বেশি, সেই দোকানে বেশি বিক্রি হয়।
বাংলাদেশে বইয়ের দাম বেশি হওয়ার এক নম্বর কারণ খুচরা বিক্রেতারাও ২০% ছাড় দেয়। অর্থাৎ দুই শ টাকার বইয়ের দাম এক শ ষাট টাকা অনায়াসে রাখা যায়। এর পরের কারণটা মুজতবা আলী বলে গেছেন:
‘বইয়ের দাম যদি আরও কমানো যায়, তবে আরও অনেক বেশি বই বিক্রি হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই যদি প্রকাশককে বলা হয়, “বইয়ের দাম কমাও”, তবে সে বলে, “বই যথেষ্ট পরিমাণে বিক্রি না হলে বইয়ের দাম কমাব কী করে?”
“কেন মশাই, সংখ্যার দিক দিয়ে দেখতে গেলে বাংলা পৃথিবীর ছয় অথবা সাত নম্বরের ভাষা। এই ধরুন ফরাসি ভাষা। এ ভাষায় বাংলার তুলনায় ঢের কম লোক কথা কয়। অথচ যুদ্ধের পূর্বে বারো আনা, চৌদ্দ আনা, জোর পাঁচ সিকে দিয়ে যেকোনো ভালো বই কেনা যেত। আপনারা পারেন না কেন?”
“আজ্ঞে, ফরাসি প্রকাশক নির্ভয়ে যেকোনো ভালো বই একঝটকায় বিশ হাজার ছাপাতে পারে। আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে দু–হাজার ছাপাতে গেলেই, বেশি ছাপিয়ে দেউলে হব নাকি?”
তাই এই অচ্ছেদ্য চক্র। বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।’
বইমেলায় কিংবা বইয়ের দোকানে তরুণ ছাত্র ক্রেতা যখন দাম মেলাতে পকেট হাতড়ান, মনটা দমে যায়। যাঁদের টাকা আছে, তাঁরা বই কেনেন তো! যাঁদের বই কেনার ইচ্ছা প্রবল, তাঁদের পকেটে টাকা কম থাকে কেন?
বই বেশি বিক্রি হলে দাম কমানো যেত। কিন্তু যে লেখকের বই বেশি বিক্রি হয়—যেমন হুমায়ূন আহমেদ—তাঁর বইয়ের দাম তো কোনো প্রকাশক কম রাখেন না, তার বেলা? এর কারণটাও আমি জানি। বইয়ের ব্যবসার মতো লোকসানি ব্যবসা আর নেই। আপনি এক শ টাকার একটা বই এক হাজার কপি ছাপালে কমপক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা লগ্নি করবেন। বাংলাদেশে বেশির ভাগ লেখকের বই বেরোনোর পর এক শ কপির বেশি বিক্রি হয় না। ৪০% কমিশন দিলে এক শ কপিতে ছয় শ টাকা উঠবে। পাঁচ শ বই বিক্রি হলে প্রকাশকের লগ্নি করা টাকা উঠে আসবে। এই পাঁচ শ কপি বিক্রি হতে পাঁচ বছর লাগবে। এর মধ্যে গোডাউনের ভাড়া আছে, শো রুমের ভাড়া আছে, কর্মচারীদের বেতন আছে, বিদ্যুৎ বিল আছে। লেখকের রয়ালটির তো প্রশ্নই আসে না। পুরোই ‘লস প্রজেক্ট’। প্রকাশক এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখকদের চালু বই থেকে। তবে হুমায়ূন আহমেদ মাত্র একজনই ছিলেন।
রয়ালটির ব্যাপারে আপনাদের এবার ‘ভেতরের খবর’টা বলে দিই। একটা বইয়ের দাম এক শ টাকা হলে লেখক প্রতি কপিতে দশ থেকে পনেরো টাকা পাবেন। এক হাজার বই বিক্রি করতে জীবন বের হয়ে যায়। এক হাজার কপি বিক্রি হলে লেখক পান দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। সেই এক হাজার কপি বিক্রি করতে হলে কাগজে চল্লিশ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন দিতে হয়, ফেসবুকে চল্লিশবার স্ট্যাটাস দিতে হয়, আর বইমেলায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসিমুখে মানুষের সঙ্গে সেলফি তুলতে হয়। এই সময়টা রিকশা চালালে দেড় লাখ টাকা আয় করা যাবে। তারপরও কেন লেখক লেখেন? কেন তাঁর বই বিক্রি হলে খুশি হন। কারণ, যিনি লেখক, তিনি তাঁর ভেতরের একটা কথা, একটা শিল্পবাসনা, একটা সৌন্দর্যবোধ অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য লেখেন। কেউ যখন দাম দিয়ে সেটা সংগ্রহ করে, আশা করা যায়, জিনিসটা অপাত্রে যাবে না। তিনি অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারবেন।
শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী আমাকে সব সময়ই উৎসাহ দেন। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে তিনি বলেছিলেন, শিল্পী–লেখকেরা যদি নিজের প্রিয়তর কাজটা করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, সেটাকে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসার চোখে দেখেন। মানে ধরা যাক, একজন চিত্রকর ছবি এঁকেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন, জীবিকা নির্বাহ করতে পারলেন, এটাই তো সবচেয়ে প্রশংসাযোগ্য হওয়া উচিত।
কিন্তু সেটা করা বেশ কঠিন। আর অলাভজনকও। আমাদের এক প্রকৌশলী কত হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে গেলেন, দেখলেন তো। আমি যখন রেলের চাকরিটা ছেড়ে দিই, তখন এক রসিক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘গোটা দুই রেলগাড়ি বিক্রি করে বালিশে ভরে টাকা নিয়ে এসেছ তো? ডলার করে বিদেশে পাঠিয়ে দাও।’
আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, উপন্যাস লেখা মানে নিজের রক্ত ঢেলে দেওয়া, প্রতিটা অক্ষরের সঙ্গে লেখকের এক ফোঁটা করে রক্ত ক্ষরিত হওয়া। তারপরও লেখক লেখেন। কারণ, না লিখে তিনি পারেন না। শিল্পী ছবি আঁকেন, কারণ না এঁকে তিনি পারেন না।
এঁরা আসলে পাগল। শিল্পের এক নাছোড় তাড়না তাঁদের দিয়ে লিখিয়ে নেয়। বাংলাদেশে একজন লেখকও নেই, যিনি কেবল টাকার জন্য লেখেন। সব লেখকই আসলে জীবনানন্দ দাশ–উক্ত সেই ‘কারুবাসনা’র দ্বারা প্রাণিত হয়ে না লিখে পারেন না বলেই লেখেন।
ভারতের তুলনায় কি বাংলাদেশে বইয়ের দাম বেশি?
এটা একটু তুলনা করে দেখা যেতে পারে।
আমার ‘আয়েশামঙ্গল’-এর অনুবাদ ‘ব্যালাড অব আয়েশা’ ১৮৬ পৃষ্ঠা, পেপারব্যাক, দাম ২৯৯ রুপি। বের করেছে হারপার কলিন্স ইন্ডিয়া। আর ঢাকার পার্ল পাবলিকেশনস থেকে বেরোনো ‘আয়েশামঙ্গল’ ১২৮ পৃষ্ঠা। দাম ২০০ টাকা। ভারতীয় সংস্করণের বইয়ের দাম কম বলি কী করে?
তারপরও বলি, বইমেলায় কিংবা বইয়ের দোকানে তরুণ ছাত্র ক্রেতা যখন দাম মেলাতে পকেট তড়ান, মনটা দমে যায়। যাঁদের টাকা আছে, তাঁরা বই কেনেন তো! যাঁদের বই কেনার ইচ্ছা প্রবল, তাঁদের পকেটে টাকা কম থাকে কেন?
তারাশঙ্করের ‘কবি’র মতো বলতে হয়, ‘যে যাহারে ভালোবাসে সে তাহারে পায় না কেন?’
যে তরুণে সঙ্গে রসিকতা করেছিলাম, বলেছিলাম, ‘আমি দামি লেখক, সস্তা বই লিখি না,’ পরে এ কথা বলার জন্য তাঁকে ‘সরি’ও বলেছিলাম। সেই গল্পটাই এখন বলি।
আমার বই কিনে নিয়ে কাগজের প্যাকেট থেকে বইটি বের করলেন তরুণ। বললেন, ‘আপনি একটা অটোগ্রাফ দিন।’
আমি বললাম, ‘আপনাকে দেব নাকি ওনাকে (তরুণের বন্ধবীকে) দেব? নামটা বলবেন?’
তরুণ বললেন, ‘আমার মাকে দেবেন। আমার মা বইটা ধার নিয়ে পড়েছেন। আপনার বইটা তাঁর খুব প্রিয়। মা ক্যানসারের পেশেন্ট। ডাক্তার বলে রেখেছেন, আর বেশি দিন নে। হার ডেজ আর নাম্বারড।’
আমি বললাম, ‘আপনার নাম বলুন।’
‘জোবায়ের।’
‘আপনি মাকে মা বলে ডাকেন না আম্মা বলে?’
‘মা।’
আমি লিখলাম, ‘জোবায়েরের মাকে... জীবন জয়ী হবে।’
পরে তাঁর হাতে বইটা তুলে দিয়ে বললাম, ‘সরি জোবায়ের। আপনার মায়ের জন্য আমার অনেক দোয়া থাকল।’
জোবায়েরের মুখটা আমি আজও ভুলিনি। জোবায়েরের মা কি কোনো মিরাকলের কারণে বেঁচে আছেন? নাকি তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন? তাঁদের ঘরে ‘মা’ বইটা কি এখনো আছে?
আমরা কেউই চিরদিন থাকব না। কিন্তু ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।’ থেকে যাবে মহাজীবন। জীবন জয়ী হবে। আর সেই অপরাজেয় জীবনের গল্প লিখে যাবেন লেখকেরা। ধূপের মতো নিজেকে পুড়িয়ে তাঁরা সুগন্ধ ছড়িয়ে যাবেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে...।’