জুলিও কুরি পদক, বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বশান্তি

আজ ২৩ মে। ১৯৭৩ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হয় জুলিও কুরি পদক। সেই পদক প্রাপ্তির ৪৮তম বার্ষিকী আজ।

বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক পরিয়ে দেন পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র, ১৯৭৩ছবি: সংগৃহীত

তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন আগেই, সেই ১৯৬৯ সালে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে করেছে বাঙালির ‘অবিসংবাদিত নেতা’। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে পান শান্তি পদক জোলিও কুরি। তিনিই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় ১৪০টি দেশের প্রায় ২০০ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সবাই একমত হয়েছিলেন, সারা জীবনের দর্শন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কত্বের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করার। সে বিবেচনায় বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর পদকপ্রাপক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করে। আর পরের বছর ২৩ মে এশীয় শান্তি সম্মেলনের এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে সেই পদক বঙ্গবন্ধুকে পরিয়ে দেন পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র। সেই অনুষ্ঠানে রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’ স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্রনেতার সেটিই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক পদক লাভ।

বাংলায় এই পদকের নাম ‘জুলিও কুরি’ বলা হলেও এর ফরাসি উচ্চারণ ‘জোলিও ক্যুরি’। ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও ক্যুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বশান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে রাখে ‘জোলিও ক্যুরি’। ফ্রেডেরিকের মূল নাম ছিল জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও। ফ্রেডেরিকের স্ত্রী ইরেন ক্যুরি। তিনিও বিজ্ঞানী। বিয়ের পর ফ্রেডেরিক ও ইরেন উভয়ে উভয়ের পদবি গ্রহণ করেন এবং একজনের নাম হয় জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও ক্যুরি এবং অন্যজনের নাম ইরেন জোলিও ক্যুরি। পরে যৌথভাবে তাঁরা নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রেডেরিক জোলিও ক্যুরি শুধু বিজ্ঞানী হিসেবেই কাজ করেননি, তিনি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে এবং তাদের জন্য হাতিয়ার তৈরি করেও অবদান রাখেন। তাঁর অবদানের কারণেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিসমাপ্তি সহজতর হয়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এই যুদ্ধ পরিসমাপ্তি ছিল খুবই জরুরি। তিনি নিজে বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতিও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই পদকপ্রাপ্তির আগে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের সংগ্রামী নেতা হো চি মিন, চিলির গণ-আন্দোলনের নেতা সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের জনদরদি নেতা ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ এই পদকপ্রাপ্ত হয়েছেন। মূলত, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা এবং মানবতার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা এই পদকে ভূষিত হয়ে আসছিলেন ১৯৫০ সাল থেকে।

বিশ্বশান্তিতে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ছাত্রাবস্থা থেকেই। পরে রাজনীতির মাঠে পুরোপুরি নেমে তিনি এদিকে আরও বেশি নজর দেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। আর সে বছরই অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’। তাতে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। এই সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে অন্য ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছিলেন। সে বক্তব্য আর অভিজ্ঞতার কথা তিনি একটি গ্রন্থে লিখেছেন। ১৯৫৬ সালের ৫–৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনেও অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। শান্তি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে এই আশার স্বাভাবিক বাস্তবায়ন দেখেননি। প্রথমত, স্বদেশে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের শুধু শোষণ আর নির্যাতনই করেনি, কারণে-অকারণে হত্যা করেছে। ব্রিটিশ শাসনামলের বিরূপকালেও রাস্তা জনতার রক্তে সিক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা বাঙালির ছিল না। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারিতে সেটি শুরু হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত ছিল। পাশাপাশি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের উত্থান আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র, সেটিও ছিল খুবই অমানবিক। বঙ্গবন্ধু এই দুটোরই বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে বিশ্ব পরাশক্তির একাংশের যে অমানবিক অবস্থান, তার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসীনীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা, তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’

পৃথিবীতে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে, মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা খর্ব করা হবে, শোষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হবে শোষকের স্বার্থের ইমারত, তখনো কি নিরপেক্ষতার নামে নির্লিপ্ত থাকবে বাংলাদেশ? না। বঙ্গবন্ধু সেই নেতা ছিলেন না। যিনি স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেন, পৃথিবী দুভাগে বিভক্ত, কিন্তু তিনি শোষিতের পক্ষে। তিনি দেশ বা বিদেশ যেখানেই মানবাধিকারের লঙ্ঘন দেখেন, মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সংবাদ পান, সেখানেই প্রতিবাদের ঝড় তোলেন।

বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনে একটি বিশ্বযুদ্ধ (দ্বিতীয়) এবং এর প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছেন। সে সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুস্থ ও অনাহারীদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’ এটি তাঁর প্রত্যাশাই শুধু নয়, নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে এগিয়ে আসাও। তাই স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে জোর দিয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ওপর। বিশ্বরাজনীতিতে তখন প্রত্যক্ষ দুটো ব্লক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনায়। তা ছাড়া ছিল সামরিক জোটও। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

তবে নিরপেক্ষতা মানে কি নির্লিপ্ততা? পৃথিবীতে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে, মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা খর্ব করা হবে, শোষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হবে শোষকের স্বার্থের ইমারত, তখনো কি নিরপেক্ষতার নামে নির্লিপ্ত থাকবে বাংলাদেশ? না। বঙ্গবন্ধু সেই নেতা ছিলেন না। যিনি স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেন, পৃথিবী দুভাগে বিভক্ত, কিন্তু তিনি শোষিতের পক্ষে—তিনি দেশ বা বিদেশ যেখানেই মানবাধিকারের লঙ্ঘন দেখেন, মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সংবাদ পান, সেখানেই প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। এই প্রতিবাদ জাতীয় স্তর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। দেশি-বিদেশি শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে তাঁর নেতৃত্বে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমাদের মুক্তিসংগ্রামের আলোকেই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল্য আমরা অর্জন করেছি। আমরা জানি, মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সংগত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না। সে জন্য ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনি বিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরায়েল কর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। আমরা সমর্থন জানাই বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানবকল্যাণের যেকোনো মহৎ প্রচেষ্টাকে।’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের এই উচ্চারণ কি আজও সমান প্রাসঙ্গিক নয়, যখন ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হতাহত হচ্ছে ফিলিস্তিনের নিষ্পাপ মানুষ! বঙ্গবন্ধুর আহ্বান বাস্তবায়নের মধ্যেই তো রয়েছে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বীজমন্ত্র।


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]