জেবউন্নেসার একটি শের ও কিছু প্রসঙ্গ
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মেয়ে জেবউন্নেসা ছিলেন কবি। বারবার জীবন তাঁকে কেবল দিয়েছিল ব্যথাতুর স্পর্শ। আর সেই বেদনাকে সম্বল করেই তিনি লিখেছিলেন স্মরণীয় কিছু পঙ্ক্তি।
লিপিকর, অঙ্কনবিদ, ধর্মভাষ্যকার, কাব্যশাস্ত্রী ও বাকপটু ছিলেন জেবউন্নেসা কিন্তু আওরঙ্গজেবকন্যার দুনিয়াজোড়া খ্যাতি মূলত তাঁর কবি পরিচয়েই। ‘মখফি’ তাঁর তখল্লুস বা কবিনাম, যার অর্থ গুপ্ত। অন্য কবিরাও বিভিন্ন সময়ে এই তখল্লুস গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু দিওয়ান-এ-মখফির কারণে ‘মখফি’ এখন জেবউন্নেসারই কবিনাম। ১৯১৩ সালে মুদ্রিত ওয়েস্টব্রুক প্রণীত বহুলপঠিত কাব্য সংকলন দি দিওয়ান অব জেবউন্নেসা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিখ্যাতি সত্ত্বেও তাঁর নিচের শেরটি কীভাবে যে নূরজাহানের নামে প্রচারিত হলো, সেটাই বিস্ময়!
‘দীনের মাজারে কেউ দেবে না তো ফুলের স্তবক
কেউ এসে মাগরেবে জ্বালাবে না বাতি
পতঙ্গ আসেও যদি, ডানাহীন সে-ও
এখানে যাবে না শোনা
বুলবুল পাখির আওয়াজ।’
জেবউন্নেসার দুই পঙ্ক্তির শেরটিকে একটু স্বাধীনতা নিয়ে চার পঙ্ক্তিতে রূপান্তর করার পর এক অগ্রজ কবিকে শোনাতেই তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘কবর-ই-নূরজাহান’ কবিতাটির কথা মনে করিয়ে দিলেন। মৌলিকত্বের বিষয়টি বাদ দিলে, স্বতন্ত্র কবিতা হিসেবে নানা কারণে ‘কবর-ই-নূরজাহান’ আজও অনবদ্য। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ধারে ও বেধারে মহাজনদের কাছ থেকে যা যা আত্মস্থ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, তা নিয়ে কোনো যোগ্য গবেষক হয়তো কখনো নির্মোহ কাজ করবেন। এখানে ভালো লাগল, অগ্রজ কবি এখনকার রূপান্তরে সেই কবিতার আবহ খুঁজে পেয়েছেন। কারণ, আমরা তো নিশ্চিতই যে সে কবিতার কিছু অংশ জেবউন্নেসার নিম্নোক্ত শের থেকেই গৃহীত:
‘বর মজার-এ মা গরীবাঁ নে চেরাগ ও নে গুলে
নে পর-এ পরওয়নাহ-এ ও নে সদা-এ-বুলবুলে।’
আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন:
‘লিখছ তুমি “গরিব আমি”
পড়তে যে চোখ যায় ভরি।
গরিব-গোরে দীপ জ্বেলো না ফুল দিয়ো না
কেউ ভুলে—
শামাপোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে।’
সত্যি তোমার কবরে আর দীপ জ্বলে না, নূরজাহান!
এই কবিতায় শেরটিকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের ক্ষমতাময়ী স্ত্রী নূরজাহানের বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। এ ছাড়া এটি যদি এপিটাফ হিসেবেও পরিচিতি পায়, তবু এর সঙ্গে নূরজাহানের জীবনকাহিনির কি নিবিড় কোনো সম্বন্ধ আছে?
আমরা জানি, নূরজাহানের বাল্যপ্রেম ব্যর্থ হয়েছিল, বিয়ে-পরবর্তী জীবনেও মেনে নিতে হয়েছে নিরুপায় বিচ্ছেদ, তারপর একসময় তিনি পেয়েছিলেন অন্য রকম সাফল্য আর ক্ষমতার স্বাদ। কারও কারও মতে, কবিতাও লিখতেন নূরজাহান কিন্তু জেবউন্নেসার যেমন রয়েছে দিওয়ান-এ-মখফি বা দি দিওয়ান অব জেবউন্নেসার (জেবউন্নেসার কাব্য সংকলন) মতো অনন্য কীর্তি, নূরজাহানের তো সে রকম কোনো উল্লেখযোগ্য সংকলনই নেই।
এ কারণে সহজেই বলা যায়, ওপরের শেরটি জেবউন্নেসারই রচনা এবং মৃত্যু–পরবর্তী সময়ের পরিণতিকে জীবদ্দশায় কল্পনায় ধারণ করে মৃত্যুর আগে আগে সেটি লিখিত। এটি যে তাঁরই রচনা, এর প্রমাণ হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকাসংবলিত সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্ম্মার জেবুন্নিসা বেগম (প্র. ১৯২৯) বইটি ছাড়া আরও একাধিক প্রাচীন গ্রন্থ ও প্রবন্ধের উল্লেখ করা যায় কিন্তু এর চেয়েও বাস্তব উদাহরণ হলো জেবউন্নেসার শেষজীবনের ভয়াবহতা, যার করুণ ও দুর্বহ পরিণতিই এই শেরের উৎস।
১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী জেবউন্নেসা অল্প বয়সে কোরআন শরিফ মুখস্থ করে ফেলায় ধর্মপ্রাণ পিতা তাঁর ওপর খুবই সন্তুষ্ট হন এবং মোল্লা আশরফসহ কয়েকজন গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। জেবউন্নেসা ওস্তাদদের কাছ থেকে শুধু আরবি-ফারসি আর ধর্মশাস্ত্র শেখেননি, কাব্যশাস্ত্রেও দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব নিজের ধর্মনীতির নিরিখে কবিতার বিচার করতেন বলে জেবউন্নেসা এ বিষয়ে ছিলেন সজাগ। কারণ, প্রেম, সুন্দরী আর সুরার প্রসঙ্গ থাকার কারণে শামসুদ্দিন হাফিজের মতো সাধককবির দেওয়ানকেও গ্রহণ করতে পারতেন না আওরঙ্গজেব। তাই বাবার সঙ্গে ধর্ম, রাজনীতিসহ বহু বিষয়ে তর্ক ও আলোচনায় লিপ্ত হলেও কবিতা বিষয়ে নীরব থাকতেন আর প্রেমের কবিতাগুলোকে তো যথাসম্ভব লুকিয়েই রাখতেন। একবার ভাবমগ্ন জেবউন্নেসা স্বরচিত কবিতা পড়ছিলেন, ‘চাহার চীজ গম-এ দিল বুরদ কদাম চাহার/ শরাব ও সব্জা ও আব-ই রোয়াঁ ও রো-এ নিগার’, যার অর্থ ‘চারটি জিনিস মনের দুশ্চিন্তা দূর করে—সুরা, সবুজ, পানির ফোয়ারা ও সুন্দর মুখ’, তখন তাঁর বাবা হঠাৎ সেখানে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কী পড়ছিলে?’ জবাবে শেষ পঙ্ক্তির শব্দগুলো বদলে দিয়ে জেবউন্নেসা পড়লেন, ‘চাহার চীজ গম-এ দিল বুরদ কদাম চাহার/ নমাজ ও রোজাহ তসবিহ ও তওবাহ ও ইস্তেগফার’, পিতা আওরঙ্গজেব কন্যার মুখে ধর্মস্তোত্র শুনে খুশি হয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।
কবিতা ছাড়াও নিজের জীবনের প্রেমের বিষয়টি বাবার কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করেছিলেন জেবউন্নেসা কিন্তু পারেননি। অবশ্য এ বিষয়ে তিনি নিজেও কম সংযত ছিলেন না, একাধিকবার মনে প্রেমভাবের জন্ম হলেও আজন্ম প্রকৃতিপ্রেমী, বিদুষী, সুন্দরী এই কবি ছিলেন যথা অর্থেই দূরবিহারী। তর্কাতীত নয় যদিও তবু এখানে এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করলে তাঁর সংযত চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।
একদিন জেবউন্নেসাকে প্রাসাদের ছাদে দেখে প্রেমকাতর উজিরপুত্র আকিল খাঁ এ রকম একটি বার্তা পাঠান যে ‘আমার স্বপ্নের প্রিয়তমা আজ রক্তিম আলো হয়ে দেখা দিয়েছে।’ জবাবে জেব লিখলেন, ‘বিনয়, আকুলতা, ক্ষমতা, সম্পদ কোনো কিছু দ্বারাই আরাধ্যকে খরিদ করা যায় না।’ এর সঙ্গে তিনি শেখ সাদির এই মহামূল্য বাণীটিও শুনিয়ে দিতে ভুললেন না যে মানুষ এমন কাজ কেন করবে, যাতে পরে পস্তাতে হয়।
বহু গুপ্তচর থাকার কারণে আরেকটি বিষয় আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারেননি জেবউন্নেসা, সেই ঘটনাই তাঁকে দিল দুঃসহ কারাবাসের শাস্তি।
রাজপুতদের দমনকাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁর ভাই মুহাম্মদ আকবরকে একসময় অপসারণ করেছিলেন বাবা আওরঙ্গজেব। কিন্তু ভাইটিকে ভীষণ ভালোবাসতেন জেবউন্নেসা আর ভাইটিও বোনের জন্য বিলকুল আত্মহারা। প্রীতি ও শ্রদ্ধাবশত একবার তিনি বোনকে চিঠিতে এ কথাও লিখে ফেললেন যে ‘যাহা তোমার তাহা আমার, আর যাহা আমার তাহাতে তোমার অধিকার রয়েছে এবং তোমার আদেশকে আমি কোরআন–হাদিসের মতো মনে করি।’ রাজপুত দমনের ক্ষমতা থেকে সদ্য অপসারিত এই শাহজাদা আকবর যখন সম্রাট আওরঙ্গজেবের আয়ত্তের বাইরে গিয়ে রাজপুতদের দলে ভিড়েছেন, সেই সময় ভাইকে লেখা প্রাসাদের গোপন তথ্য ধারণকারী জেবউন্নেসার একগুচ্ছ চিঠি পেয়ে যান আওরঙ্গজেব এবং এরপর তাঁর অতি আদরের কন্যার বার্ষিক চার লাখ টাকার ভাতা বাতিল করে দিয়ে সলিমগড়ে/নূরনগরে সারা জীবনের জন্য বন্দী করে রাখেন। স্নেহ ও বিদ্যার অধিকারে পিতার ওপর একসময়কার প্রভাব বিস্তারকারী সংবেদনশীল জেবউন্নেসা এর পর থেকে অন্য এক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলেন।
তার ওপর উজিরপুত্র আকিল খাঁর সঙ্গে সম্পর্কের কানাঘুষায় এবং তর্কাতীত নয় যদিও তবু কারও কারও মতে, শিবাজী রামের প্রতি আগ্রহী হওয়ায় মেয়ের প্রতি বেজায় রুষ্ট হন আওরঙ্গজেব। পরে বিয়ের অসিলায় আকিল খাঁকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হলে তিনি পিছু হটে যান আর এদিকে জেবউন্নেসা তাঁকে দূর থেকে ভুল বুঝে, অভিমানে, মর্মাহত হয়ে, চিরকুমারী থাকার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। যে কারণে পরে ইরানের রাজপুত্র ফরুখের কাছ থেকে শাদির পয়গাম এলে সাক্ষাৎকারের সময় বৈঠকি শব্দক্রীড়ার জের ধরে তিনি তাঁকেও ফিরিয়ে দেন আর আকিল খাঁর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এ শাদি হয়নি মর্মে কথাটি সর্বত্র রটিয়ে দিয়ে ফরুখ তাঁকে আহত করেন। এসব কারণে জেবউন্নেসা একদম নির্জনবাসে চলে গিয়ে কবিতা ও অন্যান্য বিদ্যাচর্চায় মনোযোগী হন।
আপনজন কীভাবে দূরে চলে যায়, কারাবাসের সময় তা ভালোভাবে বুঝেছিলেন, মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে তা আরও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন জেবউন্নেসা। এরপরও এ কথা তাঁর বুঝতে বাকি ছিল না যে শেষ পর্যন্ত তাঁর সমাধিতে বাতি জ্বালাতে আসবে না কেউ, ফুলও দিতে আসবে না আর সে কারণেই আগে লিখে ফেলেছিলেন এমন দুঃখবিধুর পঙ্ক্তি দুটি।
আজ জেবউন্নেসা নেই, অনেক লেখা হারিয়ে গেলেও তাঁর কিছু দিওয়ান আছে, কিছু গজলও রয়ে গেছে। আর তাঁর নিজের কবরগায় যুক্ত না হোক তবু অক্ষত রয়ে গেছে এই অনবদ্য এপিটাফতুল্য পঙ্ক্তি দুটি।