তাঁদের কথা মনে রাখব

১৯৭১–এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেন অজস্র বিদেশি লেখক–শিল্পী। সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মতিউর রহমানের বই ভালোবাসায় বাড়ানো হাত: মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি লেখক–শিল্পী বন্ধুতে এ বিষয়ে রয়েছে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান। স্বাধীনতা দিবসের আগমুহূর্তে সেই বই থেকে নির্বাচিত অংশ।

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এ জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই আয়োজন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের মানুষকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিল, ১ আগস্ট ১৯৭১ছবি: সংগৃহীত

বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামের পর থেকে দীর্ঘ দুই দশকের অব্যাহত সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হলো দেশবাসী। তখন আমাদের দেশের প্রায় সব লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবী এ লড়াইয়ের সঙ্গে শুধু সহমর্মিতা প্রকাশ করেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেননি, প্রত্যক্ষভাবে লড়াইয়ে অংশও নিয়েছেন। কবিতা, গান, নাটক, চিত্রকলা, সিনেমাসহ বিভিন্নভাবে দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ অথবা ক্যাম্প বা অন্যত্র সমবেত মানুষকে তাঁরা উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন।

একাত্তরে দেশের অভ্যন্তরে বা সাহায্যকারী প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশের সাহসী সংস্কৃতিসেবীরা যখন তাঁদের সব শ্রম দিয়ে অনুপ্রেরণা সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছেন, তখন আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক পরিসরেও দেশে দেশে বিশ্বনন্দিত শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি বা গায়কেরা একইভাবে আমাদের স্বাধীনতার সমর্থনে মহতী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা কবিতা পাঠ করে, কনসার্টে গান গেয়ে, ছবি এঁকে এবং সংহতি আন্দোলন গড়ে তুলে আমাদের মহাবিপর্যয়ের দিনগুলোতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সভা-সমাবেশ বা মিছিল করে নিজ নিজ দেশের মানুষের মধ্যে আমাদের জন্য সহানুভূতি সৃষ্টি আর সমর্থন আদায়ের জন্য দৃঢ় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনে তাঁরা বিশাল অবদান রেখেছেন।

তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির যাঁদের কথা স্মরণ করতে হয়, তাঁরা হলেন আর্জেন্টিনার খ্যাতনামা লেখক ও রবীন্দ্র-অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, ফ্রান্সের প্রখ্যাত মানবতাবাদী সংগ্রামী লেখক আঁদ্রে মালরো, ভারতের পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ‘বিটলস’-এর গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টার, নোবেল বিজয়ী কবি ও গায়ক বব ডিলান, মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, রুশ কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি, অস্কার বিজয়ী যুক্তরাজ্যের অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন, মার্কিন গায়িকা জোয়ান বায়েজ প্রমুখ।

প্রতিবেশী ভারতের সে সময়কার প্রায় সব ভাষার প্রায় সব শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীর ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভূমিকা কি আমাদের পক্ষে কোনো দিন ভোলা সম্ভব? চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক সত্যজিৎ রায়, প্রয়াত গায়িকা লতা মঙ্গেশকর, লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি ও লেখক বিষ্ণু দে, লেখক মুলকরাজ আনন্দ, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, অভিনেতা রাজ কাপুর, গায়ক ও সুরকার শচীন দেববর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, সলিল চৌধুরী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কাইফি আজমি, লেখক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে সহমর্মিতা জানিয়েছেন, নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সাধ্যমতো সবকিছুতেই তাঁরা অংশ নিয়েছেন। এখনো মনে পড়ে, একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে বেরাইদ হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে নৌকায় ভাইবোন আর মা-বাবাকে নিয়ে নানার বাড়ি কাপাসিয়া যাচ্ছি। হঠাৎ কলকাতা রেডিওতে বেজে উঠল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে সেই দারুণ প্রণোদনাময় গান, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন, জ্বলে দ্বিগুণ দারুণ প্রতিশোধে...।’ সে গানের কথা, সে গানের সুর এখনো বুকের ভেতর বাজে গভীরভাবে, শুনলে নতুন করে উদ্দীপ্ত হই।

একাত্তরের পুরো ৯ মাসই কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সব কবি, লেখক ও শিল্পী বাংলাদেশের সপক্ষে বহুমুখী কাজ করেছেন। প্রথম সারির শিল্পী কে জি সুব্রামানিয়াম ও যোগেন চৌধুরী আমাদের একাত্তরের সংগ্রাম নিয়ে যে শিল্পকর্ম করেছিলেন, তা উপহার দিতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের কোনো জাতীয় সংগঠনকে। অনেক বছর আগে সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে মুক্তিযোদ্ধা বৈমানিক বন্ধু আলমগীর সাত্তারের এক লেখায় জেনেছিলাম, বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলচ্চিত্র ও সংগীতজগতের অনেক শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সেখানকার বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির দুই সহসভানেত্রী ছিলেন অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমান ও শর্মিলা ঠাকুর। আরও খোঁজ করতে করতে জেনেছি, এই দুই অভিনেত্রীই শুধু নন, বোম্বের তারকাজগতের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সহায়তায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।

একাত্তরে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সামনে ছিলেন লেখক, শিল্পী ও ধর্মীয় নেতারা। একাত্তরের ১১ জুন তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল। এই দাবিনামায় যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিজয়া’—আশি-ঊর্ধ্ব ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ আর্জেন্টিনার সেরা লেখক ও শিল্পীদের অনেকে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের সমর্থনে রাজধানী বুয়েনস এইরেসের একটি মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন।

এ ছাড়া বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় গর্জে উঠেছিলেন প্রবল বিক্রমে, বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদানের প্রতীকী অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এ দেশ ঘুরে গিয়েছিলেন মঁসিয়ে আঁদ্রে মালরো। সেই ঘোর অমানিশার দিনে তাঁর দুঃসাহসী কণ্ঠস্বর আমাদের বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছিল।

একাত্তরে বাংলাদেশ নিয়ে গায়ক-শিল্পীদের সবচেয়ে বিশাল সংগঠিত আয়োজন ছিল নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১ আগস্টে অনুষ্ঠিত অবিস্মরণীয় সংগীত অনুষ্ঠানটি। এ অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যে কিছু করার জন্য তিনি প্রথম যোগাযোগ করেন জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। হ্যারিসন এগিয়ে আসেন এবং উদ্যোগী হয়ে অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ৪০টি মাইক্রোফোনে অনুষ্ঠানের গান ও কথা রেকর্ড করে তিনটি লং প্লেয়িং নিয়ে একটি বড় অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল বহু রঙে মুদ্রিত সে অনুষ্ঠানের একটি সুদৃশ্য সচিত্র বই।

পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। বব ডিলানের সঙ্গে সে কনসার্টে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, বেজ গিটারে ছিলেন লিওন রাসেল এবং টাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার। এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টন প্রমুখ গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন। এ অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসন লিখেছিলেন নতুন গান—‘বাংলাদেশ’। গিটার ও অন্যান্য আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত চড়া সুরের মধ্যে আর্তনাদের মতো করুণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জর্জ হ্যারিসনের এই গান আর তাঁর মহৎ উদ্যোগ আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে সংহতি প্রকাশের বহু স্মরণীয় কার্যক্রমের মধ্যে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।

নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেদিনের সংগীত অনুষ্ঠানে যুদ্ধবিরোধী আর মানবতার আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে পরিচিত কণ্ঠশিল্পী জোয়ান বায়েজ অংশ নিতে পারেননি। সেদিন তাঁর অন্য একটি পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল বলে জানা যায়। তবে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ তাঁর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। তিনি লিখেছিলেন এক হৃদয় নিংড়ানো সংগীতালেখ্য—‘বাংলাদেশ’। গানটির গায়ক ও সুরকারও ছিলেন জোয়ান বায়েজ নিজেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই গানটি প্রথম শোনার সেই অভিভূত মুহূর্তগুলোর কথা এখনো স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে।

বহুদিন ধরে জানতাম, ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর ইংল্যান্ডের স্যাডলারস ওয়েলস থিয়েটারে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অভিনেত্রী অস্কার বিজয়ী গ্লেন্ডা জ্যাকসন একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেছিলেন। অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের দূরসম্পর্কের ভাইপো বীরেন্দ্রশঙ্কর। গ্লেন্ডা ছাড়াও এ অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ এবং লন্ডনের আরও অনেক লোকশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। অবাক করা তথ্য হলো, বাংলাদেশের দুজন লোকসংগীতশিল্পী মোশাদ আলী ও শাহ আলী সরকার সে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা গান করেছেন। অংশ নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী, গায়ক সবিতাব্রত দত্ত এবং আমাদের প্রিয় রুমা গুহঠাকুরতা প্রমুখ।

একাত্তরের ২০ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় নিউইয়র্কে সেন্ট জর্জ চার্চে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সে সময় দুই শিবিরে বিভক্ত বিশ্বের দুই প্রধান রাষ্ট্রের দুই কবি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রাশিয়ার আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি প্রথমবারের মতো একই মঞ্চ থেকে কবিতা পাঠ করেছিলেন। এ রকম একটি দৃশ্যের কথা ভাবলে এখনো শিহরণ জাগে আমাদের হৃদয়ে। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন কবি ও লেখক গ্রেগরি করসো, পিটার অরলভস্কি, কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স প্রমুখ কবি। এই কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল ‘আমেরিকানস ফর বাংলাদেশ’। সে সময় তারা বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও অর্থ সংগ্রহের কাজ করেছে।

বিট বংশের উদ্যোক্তা কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের লাখো-কোটি মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে ভারতে এসেছিলেন একাত্তরের সেপ্টেম্বরে। বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরের নিদারুণ অভিজ্ঞতা তিনি বাণীবদ্ধ করেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামের দীর্ঘ কবিতায়। আমরা যখন মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’ গানটি শুনি, তখন সে দিনগুলোর দুঃখ-বেদনা-লড়াইয়ের কথা বড় বেশি মনে পড়ে।

সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন সূত্রে আরেকটি অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানতে পারি। ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্রিকেটের জন্য বিখ্যাত দ্য ওভাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত শরণার্থীদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য ‘গুডবাই সামার: কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি বিশাল রক কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য আয়োজিত সেই রক কনসার্টে দর্শকসমাগম হয়েছিল ৩৫ হাজারের মতো। দ্য হু, দ্য ফেসেস, মট দ্য হুপল, লিন্ডিসফার্ন, কুইনটেসেন্স, অ্যাটমিক রুস্টার, আমেরিকা, দ্য গ্রিস ব্যান্ড ও কোচিসের মতো ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সেরা সব রক ব্যান্ড সেখানে গান পরিবেশন করে।

এভাবে বাংলাদেশের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা কবি, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ অন্যান্য সৃজনশীল মানুষ। বাংলাদেশের মানুষের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁদের। আমাদের জীবনের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে তাঁরা ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের কথা আমরা কোনো দিন ভুলব না। তাঁদের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

অনুষ্ঠানের আগে সংবাদ সম্মেলনে জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর, ২৭ জুলাই ১৯৭১
ছবি: সংগৃহীত

রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন ও ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। পণ্ডিত রবিশঙ্কর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁর শিষ্য–বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। এতে অংশ নিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাখা। পশ্চিমের তারকাদের মধ্যে জর্জ হ্যারিসন ছাড়া ছিলেন রিঙ্গো স্টার, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন প্রমুখ। ৪০ থেকে ৫০ হাজার দর্শনার্থীর এ অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত হয়েছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ দশমিক ৫০ ডলার।

একাত্তরের এক অনুষ্ঠানে শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অন্যরা

কলকাতার লেখক-শিল্পীরা

কলকাতার লেখক-শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মার্চ থেকেই বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাঁরা ছিলেন সক্রিয়। কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁরা গঠন করেন ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’। এর সভাপতি ছিলেন ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সমিতির আয়োজনে ১৯৭১-এর ৩ ও ৪ জুলাই রবীন্দ্রসদনে যে অনুষ্ঠান হয়, সেখানে বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অংশ নেন শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী।

বোম্বে মহারাষ্ট্র সহায়ক সমিতির সভায় অভিনেতা দিলীপ কুমার, বিশ্বজিৎ, শচীন দেববর্মন প্রমুখ
সৌজন্যে: আলমগীর সাত্তার, সংগ্রামের নোটবুক

বোম্বের শিল্পীসমাজ

একাত্তরের ২৩ এপ্রিল মহারাষ্ট্রে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি’। এই কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান, শর্মিলা ঠাকুরসহ অনেকে। এ সময় বাংলাদেশের সমর্থনে বোম্বেতে (এখন মুম্বাই) অনেক অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানে বোম্বের তারকা শিল্পীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, মান্না দে, দিলীপ কুমার, নার্গিস, সুনীল দত্ত, রাজেশ খান্না প্রমুখ। বোম্বেতে বাংলাদেশ নিয়ে কাইফি আজমি, শাহির লুধিয়ানি, সলিল চৌধুরী, মীনা কুমারীরাও ভূমিকা রেখেছিলেন। ৩ মে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে মহারাষ্ট্রে বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি আয়োজন করে শচীন দেববর্মনের একক সংগীতসন্ধ্যার। আবার ‘বৃহৎ বোম্বে বাঙালি সমাজ’ আয়োজিত অনুষ্ঠানেও শচীন দেববর্মন ‘তাগদুম তাগদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ গানটি পরিবেশন করেন।

‘গুডবাই সামার’ কনসার্টে গান গাইছে ফেসেস ব্যান্ড
ছবি: সংগৃহীত

‘গুডবাই সামার’ কনসার্ট

১৯৭১–এর ১৮ সেপ্টেম্বর ক্রিকেটের বিখ্যাত স্টেডিয়াম দ্য ওভালে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি কনসার্ট হয়। ‘গুডবাই সামার: কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে এ অনুষ্ঠানে দর্শক হয়েছিল ৩৫ হাজারের মতো। ‘কস্তুর’ নামের সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ কর্মযজ্ঞে ‘দ্য হু’, ‘দ্য ফেসেস’, ‘মট দ্য হুপল’, ‘লিন্ডিসফার্ন’, ‘অ্যাটমিক রুস্টার’, ‘কোচিস’ প্রভৃতি ইংল্যান্ডের সেরা ব্যান্ড অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অংশ নেয় ব্যান্ড ‘আমেরিকা’। এখানে গেয়েছিলেন রনি উড, পিট টাউনশেন্ড, রজার ডাল্ট্রে, আয়ান হান্টার, রড স্টুয়ার্ট প্রমুখ। বেলা ১১টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল কনসার্টটি।

অ্যালেন গিন্সবার্গ ও আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি—একসঙ্গে দুই বন্ধু
ছবি: সংগৃহীত

অ্যালেন গিন্সবার্গ ও আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কির কবিতাপাঠ

মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যশোর রোডে শরণার্থীদের দুর্দশা দেখে যে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি লিখেছিলেন—এ তথ্য সবার জানা। তবে ১৯৭১–এর ২০ নভেম্বর জনপ্রিয় রুশ কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যে একটি কবিতাপাঠ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, সে বিষয়ে খুব বেশি লোক সম্ভবত জ্ঞাত নন। নিউইয়র্কের ২০৭ ইস্ট সিক্সটিন্থ সেন্ট জর্জ চার্চে কবিতাপাঠ অনুষ্ঠানটি হয়। গিন্সবার্গ ও ভজনেসেনস্কি ছাড়াও এখানে অংশ নেন কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স, পিটার অরলোভস্কি, গ্রেগরি কর্সো, ডিক গ্যালাপ, মাইকেল ব্রাউনস্টেইন প্রমুখ।

লন্ডনে ‘কনসার্ট ইন সিমপ্যাথি ১৯৭১’–এ (বাঁ থেকে) বীরেন্দ্রশঙ্কর, স্যার কলিন ডেভিস, শ্রী আপা পান্ত (ভারতীয় হাইকমিশনার), গ্লেন্ডা জ্যাকসন, শাহ আলী সরকার, চন্দ্রকান্ত নন্দী, লেডি পান্ত, রুমা গুহঠাকুরতা, সবিতাব্রত দত্ত, জামিলা মাসে, নির্মলেন্দু চৌধুরী ও রাধাকান্ত নন্দী
ছবি: সংগৃহীত

লন্ডনে ‘কনসার্ট ইন সিমপ্যাথি ১৯৭১’

১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর লন্ডনের ইজলিংটনে অবস্থিত স্যাডলারস ওয়েলস থিয়েটারে ‘কনসার্ট ইন সিমপ্যাথি ১৯৭১’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। অস্কারজয়ী অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন এতে অংশ নেন। এ আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের আত্মীয় বীরেন্দ্রশঙ্কর। তিনি অনুষ্ঠানেও অংশ নেন। অন্যদের মধ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী, সবিতাব্রত দত্ত, রুমা গুহঠাকুরতা প্রমুখ। বাংলাদেশের শিল্পী মোহাম্মদ মোশাদ আলী ও শাহ আলী সরকারও ছিলেন এ অনুষ্ঠানে। লন্ডন ছাড়াও ইংল্যান্ডের আরও সাতটি স্থানে হয়েছিল এই কনসার্ট।

নিজের লাইব্রেরিতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো
ছবি: সংগৃহীত

মিছিলের সামনে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বয়স ছিল ৮১ বছর। বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে গেলেও ওকাম্পো বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। শুধু তা-ই নয়, পুরোভাগে থেকে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে একটি মিছিলের আয়োজন করেন তিনি।

জোয়ান বায়েজের ‘সং অব বাংলাদেশ’ গানের ইংরেজি সংস্করণের সিডির প্রচ্ছদ

জোয়ান বায়েজের ‘সং অব বাংলাদেশ’

১৯৭১-এ বাংলাদেশের জনগণের ওপর যখন সশস্ত্র আক্রমণ চলছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদী সংগীতশিল্পী জোয়ান বায়েজ লিখেছিলেন একটি অমর গান, ‘দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’। এ গানের সুরকারও তিনি। এই গান পরবর্তীকালে তাঁর একাধিক অ্যালবাম বা সিডিতে ‘সং অব বাংলাদেশ’ নামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর শোনা গানগুলোর মধ্যে জোয়ান বায়েজের গানটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ।