তাওয়ায়েফ
ভারতবর্ষে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশ নেওয়ার বলি যে নারীরা
আজিজুন বাই, বেগম আখতার, উমরাও জান, গওহর জান—তাঁদের মতো আরও ছিলেন তাওয়ায়েফ। শিল্প–সংস্কৃতি অঙ্গনে এঁদের ছিল বিস্তর প্রভাব। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা চাওয়ায় রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন কলাবিদ্যায় পারদর্শী এই নারীরা। সেই অনালোচিত ইতিহাস।
১৮৫৭ সাল। উপমহাদেশজুড়ে শুরু হয়েছে প্রথম উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রাম। ইংরেজরা যার নাম দিয়েছে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’। সে বছর জুন মাসে কানপুরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ছাউনিতে আক্রমণ করল। লড়াই চলছে। গুলি-কামানের শব্দের মাঝখানে দেখা গেল এক নারীকে। পিস্তল হাতে ঘোড়ার ওপর বসা। দুর্দান্ত তেজে লড়াই করছেন সেপাইদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। পরে ওই নারীর নাম পাওয়া গেল ইংরেজদের নথিপত্রে—আজিজুন বাই। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত তাওয়ায়েফ।
এই আজিজুন বাই মহাবিদ্রোহের কানপুরের লড়াইয়ে ছিলেন কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। লড়াই করেছেন সামনের সারিতে। তাঁর কুঠিই ছিল বিদ্রোহের পরিকল্পনার কেন্দ্র। গোপন খবর সংগ্রহ করতেন তিনি। ঝুঁকি নিয়ে সে খবর পৌঁছে দিতেন বিদ্রোহীদের কাছে।
কম বয়সে লক্ষ্ণৌ থেকে কানপুরে এসেছিলেন আজিজুন বাই। ইংরেজ তদন্তে বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন সেপাইদের ঘনিষ্ঠ। তাদের কাছ থেকে ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক চালানো ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন।
তাওয়ায়েফ কারা
‘তাওয়ায়েফ’ শব্দটি বহু গল্প আর শ্রুতির উৎস হয়েছে উত্তর ভারতজুড়ে। শব্দটি এখন ‘বারবনিতা’ শব্দের সমার্থক হয়ে গেছে। এই অর্থ রূপান্তরেরও একটি ইতিহাস আছে। ভারতবর্ষ যে ইংরেজদের অধীন হলো, এই অর্থ রূপান্তরের ভেতরে লুকিয়ে আছে সেই অধ্যায়।
‘তাওয়ায়েফ’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘তাইফা’ থেকে। এর অর্থ দল। এই দল বলতে চিত্তবিনোদনের জন্য নৃত্যগীত ও কাব্যের প্রায়োগিক শাস্ত্রে শিক্ষিত নারীদের বোঝাত। আধুনিক যুগ শুরু হওয়ার আগে ভারতবর্ষে তাঁরাই ছিলেন ‘এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি’র পূর্বসূরি।
মোগল শাসনের শেষ পর্বে সমাজের মধ্যে একদিকে ছিলেন অভিজাত কবি ও সংগীতের ওস্তাদেরা, অন্যদিকে এসবের ‘নুমায়িশ’ বা প্রায়োগিক কলাবিদ ছিলেন তাওয়ায়েফরা। সে সময় অভিজাত শিক্ষিত মহলে সংগীত, কাব্যকে ধরা হতো চর্চাযোগ্য গুণ হিসেবে। সেই গুণের মান্য অভিভাবক ছিলেন তাওয়ায়েফ নাম্নী নারীরা। উত্তর ভারতজুড়ে কবিতার সমঝদারি ও সুরের মান্যতা পেতে তাঁদের স্বীকৃতির কোনো বিকল্প ছিল না। কবিযশঃপ্রার্থীরা কবিতা নিয়ে ধরনা দিতেন তাঁদের কাছে। একাধারে তাঁরা ছিলেন ভালো কবিতার যাচাইদার। অনেকটা আজকের ‘মাস মিডিয়া’র ভূমিকা পালন করতেন তাঁরা। তাওয়ায়েফদের সুরের স্পর্শে কবিদের কবিতা ছড়িয়ে যেত গোটা হিন্দুস্তানে। ১৯৭৬ সালে গত হওয়া ‘মালিকায়ে গজল’ বেগম আখতারের জীবনেই এমনটা ঘটেছে।
তরুণ কবি বেহজাদ লখনওয়ি প্রেমে পড়লেন বেগম আখতারের। ভারতখ্যাত গাইয়ের দেখা পাওয়াও এই অনামা কবির পক্ষে তখন অসম্ভব। বেহজাদ একদিন রাতে বেগম আখতারের বাড়ির সামনের দেয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে লিখে এলেন একটি গজল:
দিওয়ানা বানানা হ্যাঁয় তো দিওয়ানা বানা দে
বরনা তকদির কাহিঁ তামাশা না বানা দে
(পাগল বানাতে হলে তুমিই পাগল বানিয়ে দাও
নইলে কোনো দিন ভাগ্য আমাকে তামাশা না বানিয়ে দেয়)
সেই গজলে সুর দিয়ে গেয়ে বেহজাদকে রাতারাতি ভারতখ্যাত বানিয়ে দিলেন বেগম আখতার।
শিষ্টাচার শিখতে অভিজাত অভিভাবকেরা তরুণ সন্তানদের পাঠাতেন তাওয়ায়েফদের কাছে। অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ তাঁরা ছিলেন উত্তর ভারতের শুদ্ধ রুচিবোধের মুখ্য উপাদান। কিন্তু পরে তাঁদের যে ‘বাজারি’ বা ‘বাজে মেয়েমানুষ’ হিসেবে তকমা দেওয়া হলো, তার পেছনে রয়েছে আরেক ইতিহাস।
নহ মাতা নহ কন্যা
নাগরিক সমাজে নারীরা তখন ছিলেন চারদেয়ালে বন্দী। আর তাওয়ায়েফরা ছিলেন নারীদের ওপর অর্পিত সাংসারিক দায় থেকে মুক্ত। সংগীত, নৃত্য ও কাব্যচর্চার যে স্তরে তাঁরা পৌঁছাতেন, তা আর সব নারী-পুরুষের কাছে ঈর্ষার বস্তু হয়ে উঠত। শুদ্ধ সংগীতের জনপ্রিয় রূপ তৈরিতে তাওয়ায়েফদের ভূমিকা ছিল বিরাট। এই শ্রেণির হাত ধরে ধ্রুপদ বা খেয়াল থেকে ছড়িয়ে পড়ে দাদরা, গজল ও ঠুমরি। তাঁরা না থাকলে কত্থক নাচ আঁতুড়ঘরেই দম বন্ধ হয়ে মরত। এই একটি জায়গায় পুরুষেরা ছিলেন নারীদের পেছনে। তখন সংগীত ও নৃত্যে উচ্চ-নীচের ভেদ ছিল প্রবল। গাইয়ের কাছে যন্ত্রবাদকদের মর্যাদা ছিল কম। তাওয়ায়েফরা কখনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন না। তবলা, সারেঙ্গী ইত্যাদি বাজানোর জন্য তাঁরা পুরুষ বাদক ভাড়া করতেন।
আজকের সেলিব্রিটিদের মতো তাওয়ায়েফরা সে সময় সমাজে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা, সম্পদ, এমনকি সেনামহলে তাঁদের প্রভাব ছিল বিস্তর। বেগম সামরু (১৭৫৩-১৮৩৬) তাওয়ায়েফ থেকে সারধানা নামে দেশীয় রাজ্যের শাসক হন। তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওয়ালটার সোমব্রে নামের এক ইউরোপীয় ভাড়াটে সৈনিক। সোমব্রের মৃত্যুর পর তাঁর বাহিনীর প্রধান হয়ে ওঠেন বেগম সোমরু। নিজের যুদ্ধকৌশল, নেতৃত্ব আর অসাধারণ রাজনৈতিক মেধায় হয়ে ওঠেন শাসক। দেশীয় রাজারা বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য সোমরুর কাছে ছুটে আসতেন।
মাহলাকা চান্দা (১৭৬৮-১৮২৪) ছিলেন হায়দরাবাদের। প্রথম ছাপা বইয়ের উর্দু কবিদের অন্যতম তিনি। বর্শা নিক্ষেপ, তিরন্দাজিতে দক্ষ। দ্বিতীয় নিজামের সঙ্গে শুধু শিকার নয়, তিনি তিনটি যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। ছিলেন কূটনীতিবিদ। পরে দরবারের অন্যতম আমির হিসেবে যোগ দেন। তিন শ শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
প্রবাদপ্রতিম গওহর জান, জদ্দন বাইসহ এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যাবে।
কোন ভাঙনের পথে
এখন তাওয়ায়েফ বলতে যে ধারণাটি তৈরি হয়েছে, তার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে মির্জা হাদি রুসওয়ার উমরাও জান উপন্যাসের। এই নামে রেখা অভিনীত সিনেমা বা মীনা কুমারীর পাকিজা ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে তাওয়ায়েফ একটি ট্র্যাজিক সামাজিক চরিত্র, যারা কেবল ক্ষণিকের চিত্তবিনোদনের সাথি। ব্যক্তিজীবনে যাঁরা অজ্ঞাতকুলশীল, বঞ্চিত। রঙিন ঝাড়লন্ঠনের আলোর আসরের বাইরে তাঁদের কোনো পরিচয় নেই।
তাওয়ায়েফদের সম্বন্ধে এমন ধারণার জন্ম ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের পর। এই সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ শাস্তিও তাঁরা পেয়েছেন ইংরেজদের হাতে। এর আগে থেকে মোগল ক্ষমতায় ভাটার টান লেগেছে। অধিকাংশ তাওয়ায়েফ তাঁদের বসতি দিল্লি থেকে গুটিয়ে লক্ষ্ণৌ ও অন্যান্য দেশীয় রাজ্যে নিয়ে গেছেন। ১৮৫৬-তে ইংরেজরা লক্ষ্ণৌ তথা আওধ রাজ্য অধিগ্রহণ করলে তাওয়ায়েফদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান হুমকির মুখে পড়ে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পেছনে তাঁদের তাই ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ফরাসি বিপ্লবে স্যালোঁ, আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে ম্যাসনিক লজ বা রুশ বিপ্লবে কফি হাউসগুলোর যে ভূমিকা, ১৮৫৭-এর যুদ্ধে তাওয়ায়েফদের কোঠাগুলোরও ছিল একই মর্যাদা। তাদের কোঠা হয়ে ওঠে বিদ্রোহ পরিকল্পনার কেন্দ্র ও আশ্রয়স্থল। যুদ্ধে তাঁরা সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। এ সময় বিবিগড়ে যে শতাধিক ইংরেজকে আটক আর হত্যা করা হয়েছিল, তার পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নকারী ছিলেন হুসেইনি নামের একজন তাওয়ায়েফ। লক্ষ্ণৌর শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের স্ত্রী বেগম হজরত মহল প্রথম জীবনে ছিলেন তাওয়ায়েফ। নবাবের নির্বাসনের পর হজরত মহল নিজে নেতৃত্ব দিয়ে ইংরেজদের হটিয়ে লক্ষ্ণৌ দখল করেন এবং পুত্র বিরজিস কদরকে রাজা ঘোষণা করেন। ১৮৫৮ সালে ইংরেজরা আবার ফিরে এলে তিনি নেপালে আশ্রয় নেন। ১৮৭৯ সালে মুক্ত অবস্থায় সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
তাওয়ায়েফরা বিদ্রোহে অকাতরে আর্থিক সহায়তা করেছেন। সে ক্ষমতা তাঁদের ভালোই ছিল। ১৮৫৮ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির করের খাতায় দেখা যায় তাওয়ায়েফরা ছিলেন আওধ রাজ্যের সবচেয়ে বড় করদাতাদের অন্যতম। স্বাভাবিকভাবেই ১৮৫৭-এর পর ইংরেজরা যাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, তাঁদের মধ্যে তাঁরা ছিলেন তালিকায় সামনের দিকে। ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁদের অংশগ্রহণের খেসারত হিসেবে তাঁদের মহল ধ্বংস করা হয়, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপত্তি আর মর্যাদা তাওয়ায়েফরা এভাবেই হারালেন। কিন্তু তখনো অবমাননার চূড়ান্ত দিকটি বাকি। ইতিহাসে ‘বাজারি’ হয়ে ওঠা বাকি ছিল তাঁদের। সেই কাহিনি আরও গভীর। ঔপনিবেশিক মননের হাতে উপমহাদেশের আত্মসমর্পণের এক করুণ গল্প লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।
এবং অ্যান্টি-নচ মুভমেন্ট
যুদ্ধ শেষ হলে পর ভারত হয়ে যায় মালিকা ভিক্টোরিয়ার রাজ্যের অংশ। এর সঙ্গে সাগর পাড়ি দিয়ে এখানে এল ভিক্টোরীয় নৈতিকতা।
নারীরা হবেন অনুগত, শিষ্ট এবং তাঁদের প্রধান কর্তব্য হবে ঘরসংসার সামলানো—এমন ধারণা ইংরেজশাসিত ভারতে নতুনভাবে প্রাণ পায় ১৮৫৮-এর পর।
ঊনবিংশ শতাব্দী ব্রিটেনে ছিল খ্রিষ্টান গোঁড়াপন্থীদের উত্থানের সময়। ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসনের সনদ নবায়িত হয়। গোঁড়াপন্থীদের তৎপরতায় এ সনদে খ্রিষ্টান মিশনারিদের সরাসরি ভারতে কাজ করার সুযোগ যুক্ত হলো। চার্চের পৌরোহিত্যে এ সময় ইংল্যান্ডে চলছিল সামাজিক শুদ্ধতার আন্দোলন, যার প্রভাবে ভারতে শুরু হয় অ্যান্টি-নচ আন্দোলন। ইংরেজদের ভাষায় নচ মানে ‘নাচ’।
কোম্পানির শাসন পোক্ত হওয়ার পর কেমন করে ভারত শাসন করা হবে, এ নিয়ে ছিল দুই মত। একদিকে প্রাচ্যবাদীদের মত ছিল, স্থানীয় ইতিহাস আর প্রথাকে আত্মস্থ করে, নীরবে বিভক্তি তৈরি এবং সেই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে মতলব হাসিল করতে হবে। আরেক দিকে খ্রিষ্টীয় গোঁড়াপন্থীদের ভাবনা ছিল, ভারত শাসন করতে হবে কঠোর ইংলিশ আদলে। এতে ব্রিটিশ আইন ও নৈতিকতার প্রতিফলন থাকতে হবে। বলা দরকার, ১৮৫৭-এর পর প্রাচ্যবাদীদের মডেলটি ব্যর্থ হয়েছে বলে রব তোলেন গোঁড়াপন্থীরা। ভারতে পোক্ত হয় তাঁদের শাসনধারণা। লর্ড মেকলের নেতৃত্বে ভারতকে ইংল্যান্ডের আদলে গড়ার কাজ শুরু হয়। চার্চ হাতে তুলে নেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সেখানে মেধাবী ভারতীয়দের ব্রিটিশ আদর্শে শিক্ষিত করার কাজ। পাস করা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া হয়। এই বাস্তবতায় ভারতে গড়ে ওঠে এক নতুন বাবুশ্রেণি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণির অধিকাংশই ছিল ভিক্টোরীয় দৃষ্টিভঙ্গির। ফলে রাজপ্রভুর সঙ্গে তাঁরা তুমুল উৎসাহে অ্যান্টি-নচ আন্দোলনে অংশ নেয়।
প্রথম দিকে ইংরেজ সাহেবরা তাঁদের বিভিন্ন উৎসবে তাওয়ায়েফদের নিয়ে আসতেন। ক্রমে সে আয়োজন ইংল্যান্ডের আদলে বলরুমে ঠাঁই নেয়। ১৮৫৭-এর পর ভারতীয়দের সংস্কৃতি হয়ে ওঠে পরিহাসের বস্তু। ১৮৯০ সালে প্রিন্স অ্যালবার্ট ভারতে এলে তাঁর সম্মানে ভারতীয় নাচের আয়োজন হয়। খ্রিষ্টান মিশনারিরা এর প্রবল বিরোধিতা করেন। বইয়ের পর বইয়ের ছাপা হতে থাকে ভারতীয় সংস্কৃতি তথা তাওয়ায়েফদের নিকৃষ্টতা নিয়ে। মিশনারিদের হাতে ছিল ভারতের অধিকাংশ ছাপাখানা। তাই ব্যাপারটা হয়ে পড়ে একপেশে। ভারতীয় নাচ কেবল তাকিয়ে দেখলেই পাপের ভাঁড়া পূর্ণ হবে—এই ধারণা দ্রুত নতুন শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ১৮৯২ সালে হিন্দু সোশ্যাল রিফর্মস অ্যাসোসিয়েশন নামের সংগঠন সরকারের কাছে তাওয়ায়েফ ও বাইজিদের নিষিদ্ধ করতে স্মারকলিপি দেয়। ইংরেজ আর ভারতীয়দের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে গড়ে উঠতে থাকে অ্যান্টি-নচের সমর্থনে সংগঠন, যেখানে তাওয়ায়েফদের উপস্থিতি, সেই সব আয়োজন বয়কট করার সামাজিক ব্যবস্থা পাকা করতে থাকে তারা। পাঞ্জাব পিউরিটি অ্যাসোসিয়েশনের এক পুস্তিকায় উদ্ধৃতি দেওয়া হয় ব্রাহ্ম আন্দোলনের পথিকৃৎ কেশব চন্দ্র সেন থেকে:
‘জঘন্য নারী...তার চোখে জাহান্নাম।...তার কোমল কোমরে নরকের ভয়াবহতার বাস। তার হাতে চকচক করে অদৃশ্য খঞ্জর। সে খঞ্জর অসতর্ক শিকারকে আঘাত করার জন্য প্রস্তুত। তার মিষ্টি কথায় ভারতের সর্বনাশ। হায়! তার হাসি ভারতের মৃত্যু।’
শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে ১৯০৫ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে ভারতীয় নৃত্য নিষিদ্ধ করা হয়।
রইল বলে রাখলে কারে
প্রথমে সম্পদ-সহায় হারিয়ে, পরে বছরের পর বছর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবমাননার হাতে শেষ পর্যন্ত তাওয়ায়েফরা সেই বৃত্তি নিতে থাকেন, যার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। তাঁদের ধারণ করা শিল্প চলে যায় নব্য মধ্যবিত্তদের হাতে। শিল্পের চর্চা আর প্রয়োগে আধিপত্য আসে পুরুষদের; যে পুরুষেরা একদিন তাদের পেছনে বসত বাদ্যযন্ত্র হাতে। এসব নানা পারিপার্শ্বিক চাপে ধীরে ধীরে তাওয়ায়েফরা হারিয়ে যান দৃশ্যপট থেকে, এক অন্যায্য বদনাম মাথায় নিয়ে।
তাওয়ায়েফদের ইতিহাসে চোখ রাখলে বোঝা যায়, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়ে উপনিবেশবাদ-বিরোধিতার ‘শাস্তি’ কী নির্মমভাবেই না তাঁরা পেয়েছিলেন!