‘রেহানা’ আর ‘চন্দ্রাবতী’কে নিয়ে যে কারণে লিখতে হলো

একই বছরে পরপর অসাধারণ দুটি ছবি মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশে। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ আর ‘চন্দ্রাবতী কথা’। এর মধ্যে যেন মিলছে চলচ্চিত্রের নতুন যুগের পূর্বঘোষণা। কেন? কীভাবে? ছবি দুটির আলোচনায় তারই উন্মোচন।
‘রেহানা মরিয়ম নূর’–এর দৃশ্য

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কি আমরা একটি নতুন যুগের সূচনা দেখতে পাচ্ছি? সাম্প্রতিক সময়টা সে রকম শুভবার্তা নিয়েই বোধ করি হাজির হলো। এই শুভবার্তা এল ২০২১ সালে—এন রাশেদ চৌধুরীর ‘চন্দ্রাবতী কথা’ (একটি উৎসবে অবশ্য ২০১৯ সালে এর প্রিমিয়ার হয়েছিল) আর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’—একসঙ্গে এই দু–দুটো ছবি দিয়ে। অন্ধকার আকাশে একসঙ্গে কোজাগরী পূর্ণিমার জোড়া চাঁদ। বাস্তবে দুর্লভ এমন অভাবনীয় দৃশ্য কেবল লালন সাঁইয়ের অপার্থিব আধ্যাত্মিক নভোমণ্ডলীতেই সম্ভব।

স্বাধীনতার পর, গত ৫০ বছরে, ভালো কোনো ছবি বানানোর উদ্যোগ যে কেউ নেননি, সে কথা বলা যাবে না। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ বা ‘মাটির ময়না’র মতো আরও কিছু ছবির কথাও আমরা ভুলে যাচ্ছি না। তারপরও এ কথা বলতে হবে যে এমন কোনো তৃপ্তিকর কাহিনিচিত্র আমরা পাইনি, সব দিক বিবেচনায় যা একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রবস্তু হয়ে উঠেছে, পৃথিবীর সঙ্গে এক কাতারে বসে যা আমরা উপভোগ করতে পারি।

‘রেহানা’ যদি কঠিন কঠোর গদ্য, ‘চন্দ্রাবতী’ তবে অধরা রহস্যে আবৃত কবিতা। ‘রেহানা’ বাংলাদেশের এই সময়ের একটি মেয়ের এমন গল্প বলছে, যা ভূগোলের সীমানা টপকে যায়। আর ‘চন্দ্রাবতী’তে বলা ষোড়শ শতকের বাংলার মেয়ের গল্প কালের পরিধি ছিন্ন করে আমাদের সময়ে এসে পড়ে। ছবি হিসেবে ‘রেহানা’র গন্তব্য আন্তর্জাতিক বিশ্বে, ‘চন্দ্রাবতী’ ডুব দিতে চায় লোকায়ত বাংলার ভাবসমুদ্রে। ‘রেহানা’ ছবিটি কথা বলতে চায় বিশ্বের বিপুল চলচ্চিত্র-ভান্ডার থেকে উপাদান নিয়ে গড়া এক বাগ্‌বিধিতে। আর অব্যক্তকে ধরার জন্য ‘চন্দ্রাবতী’কে হাত বাড়াতে হয় নতুন কোনো ভাষার খোঁজে।

হতাশার কারণও ছিল যথেষ্ট। জর্জ মেলিয়ে বা ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ—যাঁকেই শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রবর্তক হিসেবে ধরি না কেন, চলচ্চিত্রের ইতিহাস এক শতাব্দী ছাড়িয়ে যায়। ছবি বানাতে হলে প্রয়োজন বড় অঙ্কের টাকা, প্রযুক্তির সহায়তা, বিচিত্র কৃৎকলায় পারদর্শী মানুষের সমবায়ী সংযোগ এবং অবশ্যই ব্যাপক জনপরিসরে প্রদর্শনের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। উদ্ভাবনের প্রথম কয়েক দশকে স্বাভাবিকভাবেই ঔপনিবেশিক শোষণের মধ্য দিয়ে স্ফীতকায় পশ্চিমা দেশগুলো তাই চলচ্চিত্রকলার চর্চায় এগিয়ে যেতে পেরেছিল বেশি।

তাই বলে গত এক শতকে পৃথিবী থেমে ছিল না। পশ্চিমা জগতের বাইরে পৃথিবীর নানা অংশে চলচ্চিত্রের অর্থবহ উত্থান ঘটেছে। ১৯৫০ সালে জাপান থেকে আকিরা কুরোসাওয়া তাঁর ‘রাশোমন’ দিয়ে বিশ্ববাসীর চোখ কেড়ে নেওয়ার বেশ আগেই, ১৯৩৯ সালে, কেনজি মিজোগুচি ‘দ্য স্টোরি অব দ্য লাস্ট ক্রিসেনথিমাম’ বানিয়ে ফেলেছেন। দীর্ঘ দীর্ঘ মিজঁসিন ব্যবহার করে নতুন চলচ্চিত্রভাষার উৎকর্ষে নিয়ে গেছেন তিনি এ ছবিটিতে। ‘লেট স্প্রিং’ নিয়ে ১৯৪৯ সালে হাজির হয়ে গেছেন ইয়াসুজিরো ওজু। তাঁরা একাধারে নিজেদের, জাপানের এবং সারা বিশ্বের জন্য অনন্য চলচ্চিত্রশৈলীর উন্মেষ ঘটানোর মতো উদ্ভাবনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬০–এর দশকের শেষে, প্রায় কাছাকাছি সময়ে, আফ্রিকার সেনেগাল থেকে উসমান সেমবেনের ‘মান্দাবি’ আর লাতিন আমেরিকার চিলি থেকে মিগেল লিত্তিনের ‘জ্যাকেল অব নাহুয়েলতোরো’ দেখিয়ে দিয়েছে ব্যক্তিগত প্রতিভা আর মানুষের প্রতি মমতার জোর ক্ষীণ সামর্থ্যের মধ্যেও চলচ্চিত্রকে কীভাবে মর্মস্পর্শী করে তুলতে পারে। পাশের দেশে সত্যজিৎ–ঋত্বিক অধ্যুষিত আমাদের একই ভাষার ছবির প্রসঙ্গ নাহয় বাদই দিলাম।

‘চন্দ্রাবতী কথা’র দৃশ্য

গত দু–তিন দশকে তো চোখের সামনেই চলচ্চিত্রের মানচিত্র আমূল পাল্টে গেল। চীন, হংকং বা দক্ষিণ কোরিয়ার কথা দূরেই রাখি। মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে একের পর এক ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ চলচ্চিত্রকার উঠে এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিলেন। আর ইরান তো নিজস্ব একটি ঘরানারই জন্ম দিয়ে দিল। কীভাবে সরল মানবিক গল্পে আনাড়ি অভিনেতা নিয়ে কম বাজেটে উৎকৃষ্ট ছবি তৈরি করা সম্ভব, পৃথিবীর সামনে তুলে ধরল তার অভূতপূর্ব নজির।

চলচ্চিত্রে সারা পৃথিবীর এ অগ্রযাত্রার মিছিলে দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশই থাকল পিছিয়ে। এ ব্যাপক হতাশার মধ্যেই বিরাট আশা জাগিয়ে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ আর ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবি দুটো এসেছে। একই বছরে আসা এই ছবি দুটোর সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্ভবত আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। বিষয়ে, ভাবে, ভাষায় দুটো ছবিই আশ্বস্ত করছে যে আমরা পারি, আমরা পারব। আমাদের ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্র–নির্মাতাদের ওপর এর গভীর একটি প্রভাব না পড়েই যায় না। আমরা নিশ্চিত, অচিরেই এর সুফল দেখা যেতে শুরু করবে।

এ ছবির আরেক পর্ব রেহানার সঙ্গে তার মেয়ে ইমুর সম্পর্ক। ইমু ওর মায়েরই এক শিশু সংস্করণ—জেদি আর অনড়। ইমুর ওপরে ওর বেসামাল মায়ের কঠোর শাসনের চাপও যেন মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনার মতোই একচেটিয়া। মেডিকেল কলেজের সঙ্গে রেহানার ক্ষমতার–সম্পর্কের এ আরেক বিপরীত চিত্র। রেহানা এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে, আর তার নিদারুণ বাস্তবতা ও চড়া আবেগের ঘেরাটোপে ইমু বন্দী।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’–এর ভাগ্য তবু ভালো। ছবিটি নিজের যোগ্যতায় কান চলচ্চিত্র উৎসবের আঁ সাত্রে৴ রিগারে জায়গা করে নিতে পেরেছিল। নইলে সাদের আগের আরও দুঃসাহসী ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র মতো এটিও নীরবতার শিকার হয়ে হিমাগারে চলে যেতে পারত, ‘চন্দ্রাবতী কথা’র কপালে যা জুটেছে। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ নিয়ে যে কোনো কথা হয়নি, তা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতিচর্চার চরম দীনতাই প্রকাশ করছে।

দুটি ছবির নামই দুজন নারীর নামে। দুটি ছবিই নারীর গল্প, তবে সে গল্প বলতে গিয়ে তাকে ছাপিয়ে গেছে বহুদূর। কিন্তু মেজাজমর্জিতে ছবি দুটো আকাশ আর পাতাল। ‘রেহানা’ যদি কঠিন কঠোর গদ্য, ‘চন্দ্রাবতী’ তবে অধরা রহস্যে আবৃত কবিতা। ‘রেহানা’ বাংলাদেশের এই সময়ের একটি মেয়ের এমন গল্প বলছে, যা ভূগোলের সীমানা টপকে যায়। আর ‘চন্দ্রাবতী’তে বলা ষোড়শ শতকের বাংলার মেয়ের গল্প কালের পরিধি ছিন্ন করে আমাদের সময়ে এসে পড়ে। ছবি হিসেবে ‘রেহানা’র গন্তব্য আন্তর্জাতিক বিশ্বে, ‘চন্দ্রাবতী’ ডুব দিতে চায় লোকায়ত বাংলার ভাবসমুদ্রে। ‘রেহানা’ ছবিটি কথা বলতে চায় বিশ্বের বিপুল চলচ্চিত্র-ভান্ডার থেকে উপাদান নিয়ে গড়া এক বাগ্‌বিধিতে। আর অব্যক্তকে ধরার জন্য ‘চন্দ্রাবতী’কে হাত বাড়াতে হয় নতুন কোনো ভাষার খোঁজে।

‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র দৃশ্য

নামই বলে দিচ্ছে, সাদের ছবিটির গল্প আবর্তিত হবে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নামে কোনো মেয়েকে ঘিরে। রেহানা বা এই ছবির পটভূমি সম্পর্কে বহু কিছু আন্দাজ করে নিতে হয়। পরিচালক হিসেবে সাদ বেশি তথ্য দিতে নারাজ। গল্প এগিয়ে চলে তাঁর কঠোর হাতে আঁকা রেখা ধরে। ছবির কাহিনিপট প্রায় পুরোটাই একটি মেডিকেল কলেজের অস্পষ্ট সংকীর্ণ করিডর বা ছোট পরিসরের অফিসকক্ষ। রেহানা কলেজটির সহকারী অধ্যাপক। অস্থির ও একগুঁয়ে। অল্প বয়সী স্কুলছাত্রী মেয়ে ইমুর একাকী বিধবা মা। সংসার আর পেশার ভারসাম্য রাখতে রাখতে বেসামাল। পরীক্ষার হলে স্কেলের পেছনে সম্ভাব্য উত্তরের পয়েন্ট লিখে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে একটি পাহাড়ি ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে রেহানার চড়া মাত্রার নৈতিকতার সঙ্গে শুরুতেই আমাদের পরিচয় হয়। এই নীতিবোধের প্রবল তাড়নায় কীভাবে রেহানা সত্য–মিথ্যার রেখা পেরিয়ে যায় এবং একটি ক্ষমতাশালী ব্যবস্থার চতুর জালে অসহায় পতঙ্গের মতো আটকে পড়ে, ছবির পরের অংশ তারই গল্প।

একই কলেজের অধ্যাপক আরেফিন ছাত্রছাত্রী–বান্ধব। তারই ঘর থেকে একদিন অ্যানি নামে এক অশ্রুসিক্ত ছাত্রীকে হতচকিত হয়ে বের হতে দেখে রেহানা। জামার বোতাম ছিন্ন। রেহানা আন্দাজ করে নেয়, শ্লীলতাহানির মতো কোনো ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানাতে অ্যানিকে সে বারবার চাপ দেয়। বাড়তি কোনো ঝামেলার আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত অ্যানি এ নিয়ে কোনোমতেই জল ঘোলা করতে না চাইলে রেহানা নিজেই দুই পা এগিয়ে যায়। সে নিজেই আরেফিনের শ্লীলতাহানি–চেষ্টার শিকার হয়েছে বলে মিথ্যা গল্প ফেঁদে কলেজের অধ্যক্ষার কাছে নালিশ করে।

ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে মেডিকেল কলেজটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে দিতে অধ্যক্ষ ভদ্রমহিলা মোটেই রাজি নন। অভিযোগ তুলে নিতে রেহানাকে তিনি প্রথমে বোঝান, পরে চাপ দেন। কিন্তু রেহানা অটল। এই নিয়েই রেহানার অবমাননা, উদ্বেগ আর লাঞ্ছনার ধারাবাহিক অধ্যায়ের সূত্রপাত। ঘটনাধারা ক্রমাগত একটি নিশ্ছিদ্র পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে। কলেজ–কর্তৃপক্ষের একচেটিয়া ক্ষমতার ফাঁদে আটকে পড়া জন্তুর মতো এ দিক–ওদিক মাথা কোটা ছাড়া রেহানার কোনো উপায় থাকে না। ক্ষুব্ধ ও আহত রেহানার জেদি ও অসহায় অবস্থা দর্শকের মন এক অন্ধ কানাগলিতে ঠেলে দেয়। রেহানার জন্য দর্শক সমব্যথী বোধ করতে পারে; কিন্তু নিস্তারের কোনো পথই যে তার জন্য খোলা নেই, অসহায়তার এই উপলব্ধি তার বুকটিকেও চেপে ধরে।

এ পর্যন্ত এসে ছবিটি নারীর গল্প হয়েও সে গল্পকে ছাড়িয়ে যায়। এটি হয়ে ওঠে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার আওতার ভেতরে সার্বভৌম ব্যক্তির স্বাধীনতা শিকড় অব্দি উৎপাটিত হয়ে যাওয়ার ছবি—যা এই সময়ের বাংলাদেশের কাহিনি যেমন, তেমনই পৃথিবীর অন্য কোনো কোনো প্রান্তেরও চেনাজানা চিত্র।

আজমেরী হক বাঁধনের কাছ থেকে এ ছবিতে যে অভিনয় সাদ আদায় করেছেন, তার তুলনা হয় না। একটি অবরুদ্ধ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একাধারে ফুঁসতে থাকা এবং নিজের অবদমিত গোঁয়ার জেদে বন্দী হয়ে পড়া অসহায় রেহানার চরিত্র বাঁধন ফুটিয়ে তুলেছেন অসামান্য বিশ্বাসযোগ্যতায়। নাকে আটকে আটকে পড়া কম্পমান নিশ্বাসের শব্দে, মুখে ক্লান্তিহীনভাবে পানি ছুড়ে ছুড়ে ক্লিন্নতা থেকে বেরোনোর মরিয়া চেষ্টায়, মুখের পেশির আক্ষেপে, জীবনের ভেতর থেকে উঠে আসা তিক্ত অভিব্যক্তিতে বাঁধন অভিনয়ের প্রতিটি সীমানাকে তৃপ্ত করেছেন।

‘মাটির ময়না’র দৃশ্য

এ ছবির আরেক পর্ব রেহানার সঙ্গে তার মেয়ে ইমুর সম্পর্ক। ইমু ওর মায়েরই এক শিশু সংস্করণ—জেদি আর অনড়। ইমুর ওপরে ওর বেসামাল মায়ের কঠোর শাসনের চাপও যেন মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনার মতোই একচেটিয়া। মেডিকেল কলেজের সঙ্গে রেহানার ক্ষমতার–সম্পর্কের এ আরেক বিপরীত চিত্র। রেহানা এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে, আর তার নিদারুণ বাস্তবতা ও চড়া আবেগের ঘেরাটোপে ইমু বন্দী।

ক্ষমতার এই বিস্তীর্ণ জালের মধ্যে ছোট ছোট কিছু ঘটনাও সাদ চকিত রেখায় গড়ে তুলেছেন। মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ যে নারী হয়েও রেহানাকে ধর্ষণের নালিশ তুলে নিতে চাপ দেন, সে অসহায়তার সামান্য ইশারাও সাদ ছবিতে রেখে দিয়েছেন। সিঁথির সিঁদুরচিহ্ন বলে দেয় যে অধ্যক্ষ বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সমাজের সদস্য নন। এই সমাজে এঁকে দেওয়া লক্ষ্মণরেখাটি পার হয়ে তাঁর পক্ষে এগোনো কঠিন। তিনিও পরিপ্রেক্ষিতের দাস।

কেবল কাহিনি নয়, কাহিনির বয়ানেও রাশেদ এ ছবিতে দুঃসাহসী। কাহিনিটি বলতে গিয়ে সহজ কোনো পথের দিকে তিনি পা বাড়াননি। বাংলার ভাব ধরার সংবেদনশীল ও প্রকাশক্ষম একটি ভাষা নিজের মতো করে তাঁকে গড়ে নিতে হয়েছে। এর জন্য পুথি, কিসসা, বাউলগান, জারি, আবৃত্তি, ধারাভাষ্য, চিত্রকলা কী তিনি ব্যবহার করেননি! অতি সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট হওয়ার শঙ্কা ছিল পদে পদে। কিন্তু সমস্ত ঝুঁকিকে রাশেদ জাদুকরের মতো সামাল দিয়েছেন।

সাদ তাই বলে ছকবাঁধা বর্গমূলক চরিত্র রচনা করেননি। রেহানা চরিত্রটি বরং আমাদের ধরে নেওয়া চেনাজানা ছক ভেঙে বের হয়ে আসতে চায়। সে ধর্মপরায়ণ মেয়ে, মাথায় হিজাব; তাই বলে একটা ছকের ভেতরে ঠেসে দেওয়া মেয়ে সে নয়। সে কর্মজীবী, মেয়েদের খেলাধুলায় উৎসাহী; আবার নীতির পরাকাষ্ঠা হতে গিয়ে মিথ্যা গল্প ফাঁদতেও তার মোটেই বাধে না।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’–এর একাধিক দৃশ্য আর সামান্য বাড়লেই ছবিটি মাঠে মারা যেতে পারত। বলতেই হবে, সাদ সংযমী হাতে তাঁর পরিমিতি রক্ষা করেছেন। এ সংযম ক্ষুণ্ন হতে দেখি শুধু একবার, হাসপাতালে রেহানার শয্যাশায়ী থাকার সিকোয়েন্সে। সেখানে রেহানার স্বজন এক দম্পতির আলাপনে ছবিটির মর্মকথা খুলে বলার দিকে পরিচালকের তাগিদ লক্ষ করা যায়। এর অভিনয় অংশও দুর্বল। পাঁচ মিনিটের মিজঁসিনে ধারণ করা একমাত্র দৃশ্য হওয়ার কারণেই কি এ অংশের লোভ সংবরণ করা গেল না? নাকি রেহানার বৈধব্যের তথ্যটুকু ধরিয়ে দেওয়ার জন্য?

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চরচ্চিত্রের পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ
ছবি: সংগৃহীত

ন্যূনতম রেখায় বাঁধা নিষ্করুণ এই গল্পের পাশাপাশি ছবির ভাষাটাও সাদের জন্য সমান জরুরি ছিল। নইলে এ ছবিটি ক্রমে সংকুচিত হয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গের মতো চাপ তৈরি করতে পারত না। নীল ফিল্টার সব রং ঝরিয়ে দৃশ্যপট প্রায় সমতলীয় করে আনে। হাতে ধরা ক্যামেরার অবিরাম কাঁপা কাঁপা ফ্রেম ছবির আবহকে রেহানার মনের অবস্থার মতো মোটেই স্থির হওয়ার অবকাশ দেয় না। পরিকল্পিত আঁটসাঁট ফ্রেম ছবিটিকে আগাগোড়া দমবন্ধ করে রাখে।

ক্যামেরার এ–জাতীয় ব্যবহার বা রঙের নির্বাচন চলচ্চিত্রে অভিনব নয়। ক্রিস্তফ কিস্লফস্কির ‘থ্রি কালারস: ব্লু’তে থিম রং হিসেবে নীল বর্ণের অর্থবহ প্রয়োগ আমরা দেখেছি। ফ্রেমের নানা মাত্রার কাঁপন কীভাবে গল্পের বয়ানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে পারে, গ্যাসপার নোয়ির ‘ইররিভার্সিবল’ তার নজির। ক্লোজআপনির্ভর আঁটসাঁট চিত্রায়ণ–পরিকল্পনায় ‘সিনস ফ্রম আ ম্যারেজ’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন ইংমার বার্গম্যান। কিন্তু তাঁদের পরিকল্পনা, প্রয়োগ আর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাদের কোনো যোগ নেই। চলচ্চিত্রের বিশ্বভান্ডারের দিকে তিনি অকাতরে হাত বাড়িয়েছেন। আবার সবটা মিলিয়ে নিজের গল্পটা বলার মতো একটি ভাষা তিনি তৈরি করে নিয়েছেন।

একটি চরিত্রকে ক্যামেরায় অনুসরণ করতে করতে গল্পকে এগিয়ে নেওয়া, চরিত্রের মুখের ওপর এঁটে বসা ফ্রেম—এসব দেখে অবশ্য মনে হয় আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ দারদেন ব্রাদার্সের অনুরাগী। তবে সত্যি বলতে কি, তুহিন তমিজুলের ক্যামেরায় ভর করে সাদ নিজের মতো করে একটি পা এগিয়েও গেছেন। ‘রেহানা’ ছবির চিত্রায়ণে ডেপথ অব ফিল্ড কম রাখা হয়েছে। এতে ফ্রেমের কেন্দ্রে ধরে রাখা চরিত্রটির বাইরে পুরো দৃশ্যপট ফোকাসের বাইরে থাকায় ঝাপসা হয়ে থেকেছে। গল্পে রেহানার যে বিচ্ছিন্নতা, তা প্রকট হয়ে উঠেছে এই পরিকল্পিত চিত্রায়ণে। প্রথম ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ থেকেই এটিকে সাদ নিজের অনন্য একটি মুদ্রা করে নিয়েছেন।

গল্প বলতে পারলে যে বাংলাদেশে বসে স্বল্প টাকায়ও অসাধারণ ছবি বানানো সম্ভব, আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ তা দেখিয়ে দিলেন।

‘চন্দ্রাবতী কথা’র মুখ্য চরিত্র, বলা বাহুল্য, চন্দ্রাবতী—বাংলা ভাষার প্রথম নারী কবি, ষোড়শ শতকের ময়মনসিংহে যাঁর জন্ম ও কবিজীবন। তবে তাঁর চরিত্রই একমাত্র নয়, যদিও অন্য চরিত্রগুলোও গভীর ছায়াসম্পাত করে তাঁরই চরিত্রের ওপরে। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’–এর মতো এ ছবির গল্প একটি নারীর ওপর চোখ রেখে সরলরেখায় তীব্র গতিতে ছুটে চলে না। ‘চন্দ্রাবতী কথা’র কাহিনি গ্রন্থিময়। এতে তিনটি ভিন্ন গল্প সমান্তরালে বয়ে চলে। চলতে চলতে একে অপরকে ছেদ করে। কাহিনি এগোয় মন্থর আবেশে।

ছবির প্রধান গল্প চন্দ্রাবতীরই। জয়ানন্দের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর প্রণয়, দ্রুতই এক মুসলমান কন্যার আকর্ষণে তাঁকে বিয়ে করে চন্দ্রাবতীকে জয়ানন্দের বর্জন, চন্দ্রাবতীর আমৃত্যু কুমারী–জীবন বরণ, মনসা–মন্দিরে আবাস গেড়ে তাঁর নিজস্ব প্রতিভায় নিষিক্ত রামায়ণ রচনায় মনোনিবেশ, জয়ানন্দের বোধোদয় এবং প্রত্যাবর্তনের পর চন্দ্রাবতীর নীরব প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়ে মৃত্যু—এই হচ্ছে গল্পটির কাহিনির সুতা। এ গল্পের উৎস ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র নয়ানচাঁদ ঘোষের গাথাকাব্য ‘চন্দ্রাবতী’।

‘চন্দ্রাবতী কথা’ সিনেমার পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় গল্প পটুয়া অশোক আর তাঁর গুরুর। ধর্মাচারে এরা নাথপন্থী ও গেরুয়াধারী। অশোক পালাচ্ছে তার গুরুকে নিয়ে কামরূপে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। ছবিতে দেখতে পাই তারা ময়মনসিংহ অব্দি পৌঁছেছে। গারো পাহাড় পেরোলেই নিশ্চিন্ত। সেখানে পৌঁছানোর আগেই গুরুর মৃত্যু ঘটলে অশোক এই অঞ্চলে বাঁধা পড়ে, চন্দ্রাবতীর করুণ পরিণতির এক নিবিড় দর্শক হয়ে ওঠার জন্যই বোধ করি। এই গল্পের কল্পনা পরিচালকের নিজের।

তৃতীয় গল্প সোনাই আর বিনোদের। অভাবী বিনোদ বেরিয়েছে কোড়া পাখি শিকারে। পথেই সোনাই–বিনোদের পরিচয় ও পরিণয়। এরই মধ্যে নিষ্ঠুর দেওয়ানের নজর এসে পড়ে সোনাইয়ের ওপর। বিনোদকে হেনস্তা করে সে নানা প্রকারে; সোনাইকে ছিনিয়ে আনে প্রাসাদে। সোনাই এক মাসের ব্রতের ছুতো করে দেওয়ানকে কাছে ভিড়তে দেয় না। কোড়া পাখির পায়ে চিরকুট বেঁধে পাঠিয়ে পাঁচ ভাইয়ের সাহায্যে উদ্ধারও করে নিজেকে। কিন্তু দেওয়ানের কাছ থেকে উদ্ধার পেলেও সমাজ–পরিত্যক্ত সোনাইকে আত্মাহুতি দিতে হয়।

সোনাই–বিনোদের গল্পটি এন রাশেদ চৌধুরী সম্ভবত সংগ্রহ করেছেন ময়মনসিংহে লোকমুখে প্রচলিত সাহিত্য থেকে। বয়াতিদের গানে অন্তত তা–ই মনে হচ্ছে। সোনাই আর বিনোদ অবশ্য চন্দ্রাবতীর গাথাকাব্যেরও চরিত্র। তবে তাঁর রচিত ‘দেওয়ান ভাবনা’য় সোনাইয়ের বিপরীতে পুরুষ–চরিত্রের নাম মাধব, আর বিনোদের বিপরীতে মলুয়াই নারী–চরিত্র ‘মলুয়া’ কাব্যে। এক গল্পের নারী আর আরেক গল্পের পুরুষ এই চলচ্চিত্রের কাহিনিতে এক দেহে লীন হয়েছে। লিপিবদ্ধ সমাজের বাইরে মুখে মুখে সঞ্চারিত সাহিত্যে এমন ঘটনা ঘটে বটে। তবে চরিত্রের নাম যা–ই হোক না কেন, এর কাহিনির অবলম্বন চন্দ্রাবতীর লেখা ‘মলুয়া’ই।

এর মধ্যে চন্দ্রাবতীর গল্পটির চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক। বাকি দুই গল্পের চরিত্র কাল্পনিক। তবে স্থান ও কাল এই পাত্র–পাত্রীদের এক—ষোড়শ শতকের ময়মনসিংহ। ছবির শুরু চন্দ্রাবতীর গল্পে। এরপর আসে নাথপন্ধী পটুয়া অশোকের গল্প। বয়াতিদের গীতের ভেতর থেকে তার পরপর প্রবেশ ঘটে বিনোদের। কাহিনির তিনটি স্রোত বাংলার পদ্মা–মেঘনা–যমুনার মতো এগোতে এগোতে বড় একটি মোহনায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

চন্দ্রাবতীর রামায়ণে বঞ্চিত নারীজীবনের বেদনাজাত উপলব্ধি সীতা চরিত্রের নতুন রূপায়ণ ঘটিয়েছিল। এই ছবিতেও লোকনিন্দার ভয়ে বিচলিত রামের কাপুরুষোচিত আচরণে সীতার ভগ্নদশা নিয়ে রামায়ণ রচনায় মগ্ন কবি চন্দ্রাবতীকে আমরা ভাবিত দেখি। কিন্তু চন্দ্রাবতীর সীতার সাক্ষাৎ প্রতিভূ হয়ে ছবিটিতে পাওয়া যায় সোনাইকে। তার পরিণতিও যেন সীতারই। দেওয়ানের প্রাসাদ থেকে ভাইদের হাতে উদ্ধারের পর সোনাইকে সমাজ আর নেয় না। কেন নেয় না, পরিচালক তার আভাস রাখলে ভালো করতেন। দেওয়ানের গৃহবন্দী সোনাইয়ের সতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ছবির শেষ দিকে নিঃসঙ্গ সোনাইকে একটি ফুটো নৌকায় দাঁড়িয়ে সলিলসমাধি বরণ করতে দেখা যায়। সীতার পাতাল–প্রবেশেরই গল্প যেন এটি। চন্দ্রাবতীর ঘরের পাশে সোনাই আসলে সীতা চরিত্রেরই পুনরাভিনয়। তবে সোনাই বলি কি সীতাই বলি, সবারই পরিণতি এ ছবিতে চন্দ্রাবতীর বেদনারই পরিলেখ রচনা করে।

শুধু কি তা–ই? ছবির উপান্তে উন্মাদপ্রায় জয়ানন্দ পায়ের শিকল ছিঁড়ে আবার ছুটে যায় চন্দ্রাবতীর কাছে। মাথা কুটে মরে মনসা–মন্দিরের রুদ্ধ কপাটে। পরদিন নদীতীরে তার ভাসমান মৃতদেহ খুঁজে পাবে চন্দ্রাবতী। এই পুরো পর্বটির সূচনা হয় একটি জারিগানে, কারবালার যুদ্ধপ্রান্তরে সখিনা আর কাশেমের বিয়োগান্ত আখ্যানে। এর পরে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনিতে, কুয়াশার প্রায়ান্ধকারে জারিগানে গীত ঘোড়ার শারীরিক প্রত্যাবর্তনে, অভিনীত জারিতে ব্যবহৃত ঘোড়ার পরিত্যক্ত ও পতিত কাঠামোয়—এক অসাধারণ অধিবাস্তব মন্তাজে—জেগে ওঠে যেন কারবালার ট্র্যাজিক প্রান্তর। চন্দ্রাবতী, সোনাই আর সীতার হাহাকার তাতে একাকার হয়ে যায়। এই কারবালা নারীর সে হাহাকারেরই মরুকান্তার।

অশোক এই পুরো নাট্যের এক আতুর দর্শক। কাহিনির নানা পর্বান্তর সে চিত্রার্পিত করে চলে। অশোকের সে চিত্রগাথা বাংলার, বাংলার ভাবের। ‘চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্রটিরও তা–ই।

নয়ানচাঁদ ঘোষের গাথাকাব্যে চন্দ্রাবতী যে ফিরে আসা জয়ানন্দকে প্রত্যাখ্যান করে, সে তার বাবার পরামর্শে। ছবিতে এ অংশটুকু ছেঁটে ফেলে রাশেদ চন্দ্রাবতীকে আরও আত্মাবলম্বী করেছেন। চন্দ্রাবতী তাই বলে পাষাণী নন। বন্ধ দরজায় জয়ানন্দ যখন মাথা কুটে মরছেন, মন্দিরের গর্ভগৃহে তখন চন্দ্রাবতীর মনও ছিঁড়ে যেতে চাইছে। কিন্তু তত দিনে তিনি একাধারে নিজের ও সীতার যুগল জীবন পাড়ি দিয়ে এক সমাহিতিতে এসে পৌঁছেছেন। তিনি একাধারে বিচলিত ও স্থির।

কিছু আগে বলেছি, চন্দ্রাবতীর গল্প ছাড়া এ ছবির বাকি সব চরিত্র কাল্পনিক। তাই বলে ছবিটির ভেতর থেকে দেখলে বিষয়টি অত সরল নয়। ছবিতে চন্দ্রাবতী আর অশোককে বাস্তব চরিত্র হিসেবেই পরিচালক দর্শকের সামনে পেশ করেন। সোনাই–বিনোদের গল্প কিন্তু হাজির হয় বয়াতিদের গান থেকে। অর্থাৎ খোদ ছবির দিক থেকে দেখলে, সোনাই–বিনোদ বাস্তব চরিত্র নয়, বয়াতিদের গানের সৃষ্টিশীল কল্পনায় নির্মিত। কিন্তু ছবির একটি পর্যায়ে এসে বাস্তব ও কাল্পনিক সব চরিত্র পরস্পরের জীবনের মধ্যে চলাচল শুরু করে। শুধু বাংলা বলে নয়, যেকোনো চলচ্চিত্রেই এমন সাহস দুর্লভ।

কেবল কাহিনি নয়, কাহিনির বয়ানেও রাশেদ এ ছবিতে দুঃসাহসী। কাহিনিটি বলতে গিয়ে সহজ কোনো পথের দিকে তিনি পা বাড়াননি। বাংলার ভাব ধরার সংবেদনশীল ও প্রকাশক্ষম একটি ভাষা নিজের মতো করে তাঁকে গড়ে নিতে হয়েছে। এর জন্য পুথি, কিসসা, বাউলগান, জারি, আবৃত্তি, ধারাভাষ্য, চিত্রকলা কী তিনি ব্যবহার করেননি! অতি সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট হওয়ার শঙ্কা ছিল পদে পদে। কিন্তু সমস্ত ঝুঁকিকে রাশেদ জাদুকরের মতো সামাল দিয়েছেন।

‘চন্দ্রাবতী কথা’র নানা জটিলতা যে কুশলতার সঙ্গে রাশেদ সামলেছেন, সে বিচারে দেওয়ানের কাহিনিপর্বগুলোকে দুর্বলই বলতে হবে। ছবির অন্য সব চরিত্রের তুলনায় এরা এককাট্টা কালো রঙে আঁকা। তবু এ দুর্বলতা শুধু চরিত্র রচনায় ও অভিনয়ে নয়। অন্যান্য বহু কিছুর মতো এই ছবির চরিত্রগুলো সে সময়ের ইতিহাসপটে নানা ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের টানাপোড়েনের প্রতিনিধিত্ব করছে। এ ছবিতে দুটো নাথ চরিত্র আছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের পীড়নে বৌদ্ধদের একটি অংশ তখন নাথধর্মের আবরণে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। বাঁচার নানা পথ তারা খুঁজছিল ভিন্নতর ধর্মভাবনায়, অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে নতুন বোঝাপড়ায়, অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে। এটিই নাথধর্মের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট। হিন্দু, ইসলাম ও নাথধর্মে সমর্পিত মানুষগুলোর তখনকার নানা সামাজিক ও আত্মিক চঞ্চলতা বাংলার মানসে গভীর ছাপ রেখে যায়। এ ছবিতে চরিত্রগুলো আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সেই প্রেক্ষাপটের স্পষ্ট আভাস নেই, সেই টানাপোড়েনের ভারসাম্য নেই। ছবিটি নিজের ভেতরেই সে দাবি তৈরি করেছিল।

কুমার শাহানীর গল্প বলার ঢঙের প্রতি রাশেদের অনুরাগের ছাপ এ ছবিতে স্পষ্ট। তারপরও বলতে হবে রাশেদের প্রবণতা কুমার শাহানীর চেয়ে আলাদা। কুমার শাহানী চলচ্চিত্রকে প্রায় বিমূর্ততার প্রান্তে নিয়ে যান। প্রবহমান সময়ের আধারে চলচ্ছবিকে স্বাধীন একটি সত্তা হিসেবে মুক্তি দেওয়ার জন্য সাহিত্যের কিংবা মোটাদাগে বললে কোনো কিছু বয়ানের দায় চলচ্চিত্রের কাঁধ থেকে তিনি ঝেড়ে ফেলে দিতে চান। আর এ পথে তাঁর প্রধান অবলম্বন ছবির প্লট মুছে বা চূর্ণ করে দেওয়া। অন্যদিকে রাশেদ যা এ ছবিতে রচনা করতে চেয়েছেন তা বিমূর্ততা নয়, বরং ব্যঞ্জনা—পর্দায় যা দেখছি বা শুনছি তার অতিরিক্ত কিছু বাঙ্ময় করে তোলা।

এ ছবিতে রাশেদের ঝুঁকি ছিল আরও। যে সময় ও পরিসর এ ছবিতে রচনা করতে হয়েছে, তার কোনো অবয়বগত নজির আমাদের সামনে হাজির নেই। অথচ একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিসর ছাড়া কোনো চরিত্রের পক্ষে চলচ্চিত্রে মূর্ত হওয়া সম্ভব নয়। রাশেদ বিশ্বাসযোগ্যভাবে সে দাবি মিটিয়েছেন। এ ধরনের ছবিতে গবেষণা ছাড়া যেমন এক পা এগোনোর উপায় নেই, তেমনই গবেষণা অনেক সময় পাষাণভার হয়ে চেপেও বসে। ‘চন্দ্রাবতী কথা’ নামের এই শ্রুতিদৃশ্যকলায় বিচিত্র উপাদান কুশলী ও সতর্ক হাতে আত্মস্থ করা হয়েছে।

রাশেদকে সমান ছন্দে সহযোগিতা করেছেন চিত্রধারণে সাইয়িদ কাশেফ শাহবাজী, গান নির্বাচনে সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ধ্বনিযোজনায় সুকান্ত মজুমদার। কাশেফ শাহবাজীর ক্যামেরা সংবেদনশীল, অনেকটাই স্থির ও মন্থর। বাংলাদেশের এমন আর্দ্র রূপের চিত্রণ চলচ্চিত্রে বিরল। গানের বুদ্ধিদীপ্ত নির্বাচন আর যথাযথ ধ্বনিপ্রয়োগ ছাড়াও ‘চন্দ্রাবতী কথা’ এক পা এগোতে পারত না।

এন রাশেদ চৌধুরী আর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ আমাদের প্রত্যাশা অনেক দূর বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ ছবির দিকে সে কারণে আমরা তাকিয়ে থাকব নিশ্চয়ই। কিন্তু সূচনায় যেমনটা বলেছি, একেবারে বিপরীত প্রবণতা ও মর্মের সাম্প্রতিক এই ছবি দুটো বোধ করি আরও কোনো বড় বার্তা ঘোষণা করছে। ছবি দুটো যদি আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য নতুন যুগের অর্গল খুলে দেয়, তার চেয়ে আনন্দময় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!