রোকেয়ার স্বপ্ন ও নম্র সাহসিকতা

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০–৯ ডিসেম্বর ১৯৩২)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০–৯ ডিসেম্বর ১৯৩২)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

সে এক আশ্চর্য দেশের ইউটোপিয়ান কাহিনি। যে দেশে পুরুষ থাকে অন্তঃপুরে আর নারী স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করে বাইরে, পুরুষ করে গৃহকর্ম, করে কল-কারখানায় শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, আর নারী খাটায় তার মন ও মস্তিষ্ক। সেই অবাক দেশে অপরাধ নেই, অশান্তি নেই, নেই কলহ–বিবাদ। কারণ কী? কারণ, যারা এসব করে, তারাই তো শৃঙ্খলিত। শয়তান যদি বন্দী থাকে, তবে শয়তানিটা করবে কে? তা, কোন জাদুমন্ত্রে সেই দেশের পুরুষদের ঢোকানো গেল অন্দর মহলে? কোনো জাদুমন্ত্রে নয়, নিজেদের ব্যর্থতা মেনে তারা স্বেচ্ছায় মেনেছে এই বিধান। কেননা পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে এক অন্যায় যুদ্ধে দলে দলে সে দেশের পুরুষ সৈনিকেরা যখন আহত–নিহত হতে থাকল, তখন এগিয়ে এল সেই দেশের দুই হাজার নারী স্বেচ্ছাসেবী, যারা এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকম বৈজ্ঞানিক অনুশীলনে ব্যস্ত ছিল। এবার তারা যুদ্ধ সাজে রওনা দিল শত্রু সীমান্তে। তাদের কাছে কোনো প্রচলিত অস্ত্র ছিল না; বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞানে তারা এক সূর্যের শক্তিকে সহস্র সূর্য তাপে রূপান্তরিত করেছিল, সেই তীব্র উত্তাপে শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল। নারীদের এই যুদ্ধযাত্রার আগেই পুরুষদের বলা হয়েছিল, অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে। সেই যুদ্ধ জয়ের পর থেকে এই দেশে পুরুষেরা থাকে ঘরের ভেতর আর নারীরা বাইরে। এখানকার স্বাধীন স্বনির্ভর নারীরা নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা আর মঙ্গল চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছে সুদৃশ্য উদ্যানে ঘেরা এক কল্যাণকর সুখময় রাষ্ট্র, যেখানে মেঘ থেকে সংগ্রহ করা হয় পানি আর সূর্যকিরণ থেকে সংগৃহীত হয় জ্বালানি। যে দেশের ধর্ম-প্রেমও সত্য, যে দেশের শাসক মহারানী অন্যের ভূমির প্রতি লোভ করে রক্তপাত করেন না; বরং প্রকৃতি তার অক্ষয় ভান্ডারে যে অমূল্য রত্ন সঞ্চয় করে রেখেছে তার সুষম ব্যবহার করে সত্য আর ভালোবাসায় পূর্ণ এক রাজত্ব পরিচালনা করেন। ভগিনী সারা ঠিকই বলেন:

‘এখানে আপনি কোনো পুরুষের সামনে পড়বেন না। কারণ এ দেশের নাম নারীস্থান। এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।’

আজ থেকে ১১৪ বছর আগে ১৯০৫ সালে ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিন–এ মিসেস আর এস হোসেন নামের একজন লেখক (সুলতানাস ড্রিম) ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে ইংরেজি ভাষায় প্রথম এই স্বল্পায়তন আখ্যানটি রচনা করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই আর এস হোসেনই হচ্ছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের মেয়ে রোকেয়া খাতুন। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি নিজেই বন্দী ছিলেন অন্তঃপুরের শিক্ষাহীন, আলোহীন, কুসংস্কারভরা অন্ধ কারাগারে। তারপর সেই কারাগার ভেঙে তিনি বেরিয়েও এসেছিলেন ধীর, শান্ত কিন্তু দৃপ্ত, সাহসী, অনমনীয় পদক্ষেপে। তিনি শুধু নিজে মুক্ত হয়েই ক্ষান্ত দেননি, চেয়েছেন সব নারীর মুক্তি। আর সেই মুক্তির জন্য প্রথম ও প্রধান অবলম্বন হিসেবে রোকেয়া শিক্ষাকেই বেছে নিয়েছিলেন। সে জন্য দেখতে পাই, মেয়েদের জন্য তিনি তৈরি করছেন স্কুল, লিখেছেন নারী শিক্ষার পক্ষে।

‘...বালিকাদিগকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতেই হইবে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি।’ মানসিক ও শারীরিক—রোকেয়া দুই ধরনের শিক্ষার কথাই বলেছেন, যে শিক্ষা তাঁর মতে, নারীদের নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করবে।

রোকেয়া শিক্ষার বিস্তার চেয়েছেন, নারীর সার্বিক মুক্তি ও পুরুষের সমান অধিকার অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রূপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না।...পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরাণি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী ব্যারিষ্টার, লেডী জজ—সবই হইব।’

নারীর অগ্রগতিতে পুরুষের তথাকথিত ভীতি, যা আসলে হীনম্মন্যতারই নামান্তর, সে সম্পর্কেও অবগত ছিলেন রোকেয়া। তাই তিনি বলেছেন, ‘অনেকে হয়তো ভয় পাইয়াছেন, বোধ হয় একটি পত্নী বিদ্রোহের আয়োজন করা হইতেছে। অথবা ললনাগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষকে তাড়াইয়া দিয়া সব পদ অধিকার করিবেন...তাহাদের অভয় দিয়া বলিতে হইবে—নিশ্চিন্ত থাকুন।’

কত বিচিত্র বিষয় আর আঙ্গিকেই না লিখেছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রম্য, ব্যঙ্গ, কাব্য, নিবন্ধ, কল্পকাহিনি, অনুবাদ, গল্প, উপন্যাস আরও কত–কী! তবে তাঁর সবকিছুর মূলেই ছিল সেই এক কথা—শিক্ষা। ‘শিক্ষা স্ত্রীলোক–পুরুষনির্বিশেষে সর্বদা বাঞ্ছনীয়। স্থলবিশেষে অগ্নি গৃহদাহ করে বলিয়া কি কোন গৃহস্থ অগ্নি বর্জন করিতে পারে?’

শিক্ষা ছিল রোকেয়ার কাছে নারী মুক্তির জানালা। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই জানালা বেয়ে আসা আলো নারীকে দেখাবে আরও দূরে এগিয়ে যাওয়ার পথ। রোকেয়ার আগে–পরে বাঙালি মুসলমান নারীদের মধ্যে আরও কয়েকজন সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন।

কিন্তু বিষয়বৈচিত্র্যে, ভাষার সাবলীলতায় রোকেয়ার তুলনা রোকেয়া নিজেই। সব লেখাতেই তাঁর অসামান্য নম্র সাহস আর শান্ত প্রতিবাদের নমুনা দেখি। তিনিই হয়তো প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে প্রথম বলেন, ‘আমাদের অতিপ্রিয় অলংকারগুলি দাসত্বের নিদর্শনবিশেষ।...যদি অলংকারকে দাসত্বের নিদর্শন না ভাবিয়া সৌন্দর্যবর্ধনের উপায় মনে করা যায়, তাহাই কি কম নিন্দনীয়? সৌন্দর্যবর্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্বলতা নহে?’

রোকেয়ার কলমেই তো আমরা পাই, নারী জাতির অবনতি বিষয়ে ‘যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।’ রোকেয়াই সাহস করে বলেছিলেন, ‘এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধি–ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী–মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। কিন্তু স্ত্রী লোকের সে রূপ যোগ্যতা কই, যে মুনি–ঋষি হইতে পারিতেন?’

শুরুর কল্পগল্প, সেই ‘সুলতানার স্বপ্নে’র কথাই যদি ধরি, তবে বলাই যায়, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছাড়া সেই সময়ে বসে এমন অসম্ভব স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসই বা কয়জনের ছিল? তিনি একাই একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। অন্ধকারে নারী জাগরণের উজ্জ্বল অগ্নিশিখা জ্বেলেছিলেন, যে আগুনের আলো এখনো আমাদের পথ দেখায়।