১৯১২ সাল। প্রকাশ্যে এল—রুশ ‘ফিউচারিস্ট আন্দোলন’–এর ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র ‘গণরুচির মুখে একটা থাপ্পড়’ (আ স্ল্যাপ ইন দ্য ফেস অব পাবলিক টেস্ট)। পরে, যা হয়ে উঠবে রুশ-সাহিত্য ইতিহাসের এক বৈপ্লবিক দলিল। আরও পরে, নানান সংস্করণ বেরোবে এর। তাতে অংশগ্রহণকারীদের নাম-পরিচয়, প্রকাশকালও থাকবে ভিন্ন। তবে ইশতেহারটির মূল লেখক হিসেবে স্থায়ী পরিচিতি পাবেন তখনকার রাশিয়ার চার তরুণ বিপ্লবী কবি—ডেভিড বারলিউক, আলেকজান্ডার ক্রুচেনিখ, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি আর ভিক্টর খ্লেবনিকভ। এই কবিরাই এগিয়ে নেবেন ‘ফিউচারিস্ট আন্দোলন’ নামের সেই বিদ্রোহী শক্তিকে, যা নাড়া দেবে কবিতা, শিল্প–সাহিত্য থেকে শুরু করে চিত্রকলার প্রতিটি অঙ্গন। ‘ফিউচারিস্ট’ বা ভবিষ্যৎবাদীরা মনে করতেন—যে ভাষা অতীতে আটকে থাকে, তার পক্ষে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা অসম্ভব। তাই তাঁরা নিয়ে আসবেন ‘শব্দ-নতুনত্ব’ আর ‘অর্থ-অতিক্রান্ত ভাষা’ (জাউম) নামের দুটি ধারণা। শব্দের অর্থ নয়, কবিতার প্রাণ হয়ে উঠবে শব্দধ্বনি। তাঁদের এই চিন্তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে তাঁদের পরের সময়ের উঠতি কবিদের৷ রাশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে যার রেশ বিস্তৃত হবে বহু দূর।
‘ফিউচারিস্ট’ বা ভবিষ্যৎবাদীরা মনে করতেন—যে ভাষা অতীতে আটকে থাকে, তার পক্ষে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা অসম্ভব। তাই তাঁরা নিয়ে আসেন ‘শব্দ-নতুনত্ব’ আর ‘অর্থ-অতিক্রান্ত ভাষা’ (জাউম) নামের দুটি ধারণা।
ইশতেহারটি ফিউচারিস্ট আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র তা ঠিক; কিন্তু একই সঙ্গে এটি রুশ সমাজের প্রথাগত শিল্প আর নৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড এক চপেটাঘাতও। কেবল সাহিত্যিক বিবৃতি নয়, আধুনিকতার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—ওই সময়ের উদীয়মান কবি-শিল্পীদের হৃদয়ের যে তুমুল ভাঙচুর চলছিল; তারই তীব্র, উগ্র আর উচ্চকিত এক প্রতিফলন। যা চ্যালেঞ্জ করেছিল অতীতের কর্তৃত্ব আর প্রতিষ্ঠানের জড়তাকে; রুচির স্বৈরতন্ত্র আর ভাষা ও কবিতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া প্রথাগত বিধিনিষেধকে। ঘোষণাপত্রটিতে ফিউচারিস্টরা রুশ সাহিত্যের মহান নাম—পুশকিন, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়ের মতো লেখকদেরও ‘আধুনিকতার জাহাজ থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া’র কথা বলেছেন। জানিয়েছেন—এ ঠিক তাঁদের প্রতি অসম্মান বা খাটো করা নয়; বরং শিল্পের ভবিষ্যৎকে বিগত সময়ের ‘অতি-গুরুত্ব’ থেকে মুক্ত করা। তাঁরা মনে করতেন, একজন কবির শুধু নৈতিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকলে চলবে না, তাঁর থাকতে হবে ভাষা তৈরির স্বাধীনতাও। কবিদের অধিকার থাকবে শব্দের ওপর পূর্ণ সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্থাপনের।
মোটাদাগে, চার দৃষ্টিকোণ থেকে এই ইশতেহারটিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়।
ইশতেহারটি কেবল সাহিত্যিক বিবৃতি নয়, আধুনিকতার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—ওই সময়ের উদীয়মান কবি-শিল্পীদের হৃদয়ের যে তুমুল ভাঙচুর চলছিল; তারই তীব্র, উগ্র আর উচ্চকিত এক প্রতিফলন। যা চ্যালেঞ্জ করেছিল অতীতের কর্তৃত্বকে।
এক. অতীতকে প্রত্যাখ্যান করে এক তীব্র বিদ্রোহের ভাষার জন্ম দেওয়া
‘শুধু আমরাই ছিলাম আমাদের সময়ের মুখ। আমাদের মধ্য দিয়েই বেজে ওঠে কালের-শিঙা পৃথিবীর শিল্পকলায়।’ প্রারম্ভে এ রকম এক উদ্ধত দাবি আর প্রত্যয় জানান দেয় ভবিষ্যৎবাদীদের অটল বিশ্বাসকে—তাঁরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদের সময়কে। এর পরপরই আসে অতীতের প্রতি এক বিদ্রোহী উচ্চারণ: ‘অতীত অত্যন্ত আঁটসাঁট। একাডেমি আর পুশকিন হায়ারোগ্লিফিক্সের চেয়েও দুর্বোধ্য।’ এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—পুশকিন, দস্তয়েভস্কি আর তলস্তয়ের মতো রুশ সাহিত্যের মহিরুহদেরও তাঁরা প্রত্যাখ্যান করছেন, সরাসরি। তাঁদের সাহিত্যকর্মকে তাঁরা ভাবছেন—হায়ারোগ্লিফিক্সের (প্রাচীন মিসরীয় লিপি) মতো দুর্বোধ্য। এ যেন পূর্বসূরি লেখকদের প্রতি এক উপহাস—তোমাদের সাহিত্য বর্তমান সময়ে অকেজো, অপ্রাসঙ্গিক; কেননা তা বোঝার অযোগ্য, একই সঙ্গে নিষ্প্রাণ। বিদ্রোহের চূড়ান্ত রূপটি আসে: ‘আধুনিকতার জাহাজ থেকে ছুড়ে ফেলে দাও পুশকিন, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় ইত্যাদি, ইত্যাদিদের।’ এখানে তাঁরা আহ্বান জানাচ্ছেন শিল্পের মঞ্চ থেকে ধ্রুপদি সাহিত্যকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানোর।
দুই. প্রতীকবাদী কবিদের তীব্র সমালোচনা
কেবল ধ্রুপদি সাহিত্যিকদের কটাক্ষ করেই ফিউচারিস্টরা ক্ষান্ত হননি; তাঁরা টুঁটি চেপে ধরেছেন তাঁদের আগের প্রজন্মের প্রতীকবাদী (সিম্বলিস্ট) কবিদেরও। যার মূল টার্গেট তখনকার জননন্দিত প্রতীকবাদী কবি কনস্ট্যান্টিন বালমন্ট (১৮৬৭–১৯৪২)। বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইশতেহারটির এই অংশে: ‘কে, বিশ্বাস করে, তার শেষ প্রেমকে বালমন্টের সুগন্ধি লাম্পট্যের দিকে ঠেলে দেবে?’ ‘বালমন্টের সুগন্ধি লাম্পট্যে’র মাধ্যমে তাঁরা যে প্রতীকবাদী কবিতার অতিরিক্ত সৌন্দর্য, অলসতা আর ভাবালুতার দিকে আঙুল তুলছেন, এ রকম অনুমান করা যায়। উল্লেখ্য, সে সময় ফিউচারিস্টদের সঙ্গে প্রতীকবাদীদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল; পার্থক্য ছিল উভয় পক্ষের অ্যাস্থেটিকসে (সৌন্দর্যতত্ত্ব)। প্রতীকবাদীদের নিয়ে ভবিষ্যৎবাদীদের ধারণা ছিল—বাস্তবতার পৃথিবী থেকে সরে গিয়ে তাঁরা কেবল ব্যক্তিগত দুর্দশা, সূক্ষ্ম অনুভূতি আর সৌন্দর্য নিয়েই মশগুল। যে কারণে তাঁদের লেখাপত্র আধুনিক জীবনের রুক্ষতা আর গতিকে ধারণ করতে ব্যর্থ। ফলে ভ্যালেরি ব্রুসভের (১৮৭৩–১৯২৪) মতো অন্যান্য প্রতীকবাদী কবিদের তাঁরা ‘কাগজের বর্ম-প্লেট’ পরা দুর্বল যোদ্ধা বলে ব্যঙ্গ করেছেন। অন্যদিকে প্রতীকবাদীরা ফিউচারিস্টদের মনে করতেন ধ্বংসাত্মক এক শক্তি। যাঁরা রাশিয়ার চিরায়ত ঐতিহ্য আর শিল্পকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছেন। ফিউচারিস্টদের উসকানিমূলক জন-অনুষ্ঠান; মুখের ওপর রং মেখে, অস্বাভাবিক পোশাক পরে জনসমক্ষে আসা; এই উদ্ভট আচরণগুলোকে প্রতীকবাদীদের কাছে মনে হয়েছিল উচ্ছৃঙ্খলতা, গুন্ডামি। পরে অবশ্য দুই পক্ষই সমঝোতায় আসে। কিন্তু রুশ সাহিত্যে এই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল অনেক দিন।
তিন. সাধারণ রুচির প্রতি ঘৃণা আর নতুন সৌন্দর্যের অনুসন্ধান
ইশতেহারটিতে তখনকার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও কথাসাহিত্যিকদেরও কঠিন ভাষায় সমালোচনা করা হয়। মাক্সিম গোর্কি, লিওনিদ আন্দ্রেয়েভ, ব্লক, বুনিন—তাঁরা সবাই ছিলেন সে সময়ের রাশিয়ার প্রতিষ্ঠিত লেখক। ভবিষ্যৎবাদীরা তাঁদের লেখাজোকা ও পাঠকপ্রিয়তাকে অভিহিত করেন ‘পিচ্ছিল নোংরা বই’ আর ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’ হিসেবে। আক্রমণ করেন এই বলে যে—এসব লেখক মধ্যবিত্তের নিষ্ক্রিয় জীবন আর তুচ্ছ রুচির প্রতিনিধিত্ব করছেন। শিল্পকলার জন্য যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঘোষণাপত্রের একটি লাইন: ‘সেই সমস্ত ম্যাক্সিম গোর্কি, ক্রুপিন…বুনিন ইত্যাদির দরকার শুধু নদীর ধারে একটা দাচা।’ এখানে ‘দাচা’ (গ্রীষ্মকালীন বাড়ি) হলো মধ্যবিত্তের সুখ আর সৃজনশীলতার অভাবের প্রতীক। এর বিপরীতে, ফিউচারিস্টরা দাবি করেন—কবিরা নিজেদের ‘ছি-ছি আর আক্রোশের সমুদ্রের ভেতরেও “আমরা” শব্দের পাথরে দাঁড়িয়ে থাকার’ ক্ষমতা রাখেন। এই ক্ষমতা তাঁদের আত্মকেন্দ্রিকতা আর সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরও প্রতিচ্ছবি।
চার. ভবিষ্যৎ সাহিত্যের অধিকার এবং শব্দের স্বাধীনতার ওপর জোর
আগামী দিনের শিল্পের জন্য ফিউচারিস্টরা কিছু আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন, যা পরে বিশ্ব কবিতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে ওঠে। শিল্প-সাহিত্য করতে চাওয়া বহু তরুণ অনুসরণ করে তাঁদের এই টেকনিক। ফিউচারিস্টদের আরেকটি বড় এজেন্ডা ছিল ভাষা ও ব্যাকরণের দাসত্ব থেকে মুক্তি। ‘শব্দ-নতুনত্ব’ ধারণাটির মাধ্যমে তাঁরা ‘কবিদের সম্পূর্ণ ইচ্ছাস্বাধীন উপায়ে নতুন শব্দ তৈরি’ এবং ‘পুরোনো শব্দভান্ডারকে বিস্তৃত করার অধিকার’ প্রসঙ্গে সোচ্চার হন। পাশাপাশি, অতীতের ভাষার প্রতি অদম্য ঘৃণা পোষণের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে বসেন চিরায়ত ভাষারীতি এবং তার কঠোর নিয়মকানুনকে। ভবিষ্যৎবাদী নন্দনতত্ত্বের মূল কথা ছিল—‘আত্মকেন্দ্রিক শব্দের সৌন্দর্যে’র দাবি। কবিরা ঘোষণা করেন: তাঁদের পঙ্ক্তিগুলোতে ঝলসে উঠছে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ শব্দের “নতুন আসন্ন সৌন্দর্যের” গ্রীষ্মঋতুর বিদ্যুৎ’। এর মানে দাঁড়ায়, ব্যাকরণগত অর্থ ছাড়াও শব্দের নিজস্ব ধ্বনি, রূপ ও বিন্যাসগত শক্তি রয়েছে, যা নিজেই একটি শিল্প।
সব মিলিয়ে রুশ সাহিত্যে ব্যাপক বিস্ফোরণ নিয়ে আসে—‘গণরুচির মুখে একটা থাপ্পড়’। এর মাধ্যমেই রুশ সাহিত্যে ঘটে আধুনিকতার অভিষেক। পুরোনোকে ভেঙেচুরে যা আলিঙ্গন করে বিশৃঙ্খলা আর আধুনিক জীবনের গতিকে; জন্ম দেয় এক নতুন শিল্পকাঠামোর। এতে নাটকীয় মোড় নেয় বিংশ শতাব্দীর কবিতা-শিল্প-সাহিত্য। বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রতিটি সাহিত্যিক যুগের জন্মই হয়েছে বিদ্রোহের মাধ্যমে। বাঙালি আধুনিকতার রূপকার হিসেবে যাঁরা বিদিত (বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ), তাঁরাও তাঁদের সময়ে ঠিক একইভাবে ‘রুচির শৃঙ্খল’ ভেঙে দিয়েছিলেন। জন্ম দিয়েছিলেন নতুন কাব্যভাষার। যে কারণে ফিউচারিস্ট ম্যানিফেস্টোটি শুধু রুশ সাহিত্য নয়; প্রভাবিত করেছে আধুনিকতার বৈশ্বিক মানসিকতাকেও। যেখানে শিল্প নেহাত অনুসরণ নয়, বরং ধারাবাহিক এক বিশৃঙ্খলা, বিতর্ক আর পুনর্নির্মাণের প্রকল্প। যার সারকথা—প্রাক্তন প্রেমে মজে থাকলে, নতুন প্রেমকে গ্রহণ করা অসম্ভব।