বিদায় তাপস বাপীদা, মহীনের আদি ঘোড়া

‘সুদিন কাছে এসো, ভালোবাসি একসাথে সবকিছুই...’—এই গান গেয়ে দুই বাংলার অনেক প্রজন্মকে যে গায়ক মাতোয়ারা করেছিলেন, সেই তাপস বাপী দাস কলকাতায় মারা গেলেন আজ। পশ্চিমবঙ্গের কিংবদন্তি ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র তিনি কেবল প্রতিষ্ঠাতা সদস্যই ছিলেন না, তাঁকে বলা হতো ‘মহীনের আদি ঘোড়া’। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন কবি ও বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোনার বাংলা সার্কাস’–এর ভোকাল প্রবর রিপন

তাপস বাপী দাসছবি: সংগৃহীত

অনন্তে আবার দেখা হলে আবার একসঙ্গে গাইব, ‘সুদিন কাছে এসো, ভালোবাসি একসাথে এই সবকিছুই।’

গানের শক্তি বিস্ময়কর, কোনো এক গায়কের সঙ্গে আপনার কখনো দেখা হয়নি, অথচ তার মৃত্যু প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর মতোই শোকাহত করে তোলে। এর কারণ মনে হয়, আপনি যে তাঁর গান গাইতে গাইতে ‘সে’ হয়ে ওঠেন, আর তার মৃত্যু হলে মনে হয় নিজেরই মৃত্যু হয়েছে।

তাপস বাপী দাস আমার জীবনে তেমনই একজন শিল্পী। তাঁকে বলা হয় মহীনের আদি ঘোড়া। যে সাতজন ঘোড়া  ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ শুরু করেছিলেন, তাঁদেরই একজন বাপীদা। সিনেমাকেন্দ্রিক আধুনিক বাংলা গানের অতিরিক্ত প্রেমপ্রবণ গান থেকেই তাঁরাই উদ্ধার করেছিলেন নতুন বাংলা গানকে। সেই সময় তাঁরা অনেক গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও গানের শক্তি ঠিক তাঁদের গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে নতুন প্রজন্মের শ্রোতা–গায়কদের কাছে। বাপীদার কণ্ঠে গাওয়া ‘হায় ভালোবাসি’ মনে হয় দুই বাংলার যেকোনো গিটারকেন্দ্রিক আড্ডায় সবচেয়ে বেশি গাওয়া গান। আরও অনেক বছর সবাই গানটি গেয়ে যাবে।

গাইছেন তাপস বাপী দাস
ছবি: সংগৃহীত

আমি নিজে যখন গান গাওয়া শুরু করি, তখনই এই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গান আমাকে পথ দেখিয়েছিল, চিনতে–বুঝতে শিখিয়েছিল কেমন হওয়া উচিত নতুন বাংলা গান। সারা দিন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে সেসব গান গেয়ে বেড়াতাম রাস্তায়, পার্কে, ছাদে, মাঠে—আরও কত জায়গায়। এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন ‘মহীনের গান’ গাওয়া হয়নি। আর এ কারণে মজা করে বলতাম আমরা হলাম ‘মহীনের ঘোড়ার ডিমেরা!’ ‘এই মুহূর্তে’–এর মতো গান যে ব্যান্ড বাংলাকে উপহার দিয়েছে, তাদের ছায়া কীভাবে অস্বীকার করা যায়, বর্তমান দুনিয়াকে বোঝানোর জন্য এর চেয়ে ভালো গান আর কী হতে পারে!

আমি নিজে যখন গান গাওয়া শুরু করি, তখনই এই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গান আমাকে পথ দেখিয়েছিল, চিনতে–বুঝতে শিখিয়েছিল কেমন হওয়া উচিত নতুন বাংলা গান। সারা দিন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে সেসব গান গেয়ে বেড়াতাম রাস্তায়, পার্কে, ছাদে, মাঠে—আরও কত জায়গায়। এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন ‘মহীনের গান’ গাওয়া হয়নি। আর এ কারণে মজা করে বলতাম আমরা হলাম ‘মহীনের ঘোড়ার ডিমেরা!’
সত্তরের দশকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের পরিবেশনা
ছবি: সংগৃহীত

প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে দেখা না করা আমার একটা রোগের স্তরে চলে গেছে, কলকাতায় কনসার্টে গিয়ে বাপীদার জন্য গানও গাইলাম প্রেসিডেন্সিতে, সবাই আমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইল, ‘ভালো লাগে জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে’, কিন্তু আমি দেখা করতে গেলাম না। আসলে এমন তেজোদীপ্ত মানুষের এমন নাকে নল দেওয়া রোগগ্রস্ত দেখতে আমার ইচ্ছে করেনি, মনের ভেতর তাদের যে তেজোদীপ্ত পঙ্খিরাজ রূপটি ছিল, তা কোনোভাবেই নষ্ট করতে চাইনি। ভেবেছিলাম এভাবে না দেখা হওয়ায় ভালো, যদিও একদিন ভিডিওকলে রাতে কথা বলেছিলাম, শুনিয়েছিলাম ‘হায় ভালোবাসি’, খুব খুশি হয়েছিলেন, মজা করে বলেছিলাম, ‘আমি এই গান আপনার চেয়ে ভালো গাই’। শুনে কী দারুণ শিশুর মতো হেসে উঠেছিলেন বাপীদা! বলেছিলেন, ‘আমি তো সেটাই চাই, আমার গান কোনো তরুণ আমার চেয়ে ভালো গাক।’ এমন অহংহীনতায় মনে হয় তাঁকে গাইয়েছিল ‘হায় ভালোবাসি’, যেখানে ব্যক্তি উঠে গিয়েছিল সমগ্রে, আর সবার হয়ে সে যেন গেয়ে দিয়েছিল গান, অজস্র কণ্ঠের না গাওয়া গান তার কণ্ঠে তুলে এনেছিল। বাপীদার সঙ্গে এই না দেখা হওয়াটা আমাকে পোড়াচ্ছে খুব। যদিও পুরোটা দায় আমার!

আসুন শুরু করি ‘হায় ভালোবাসি’, আপনি মেইন ভোকাল আর আমি হারমোনাইজ করছি, আর সেই গানে নিশ্চয় মৃত্যুকে শায়েস্তা করা যাবে, আমাদের এই আপাতদূরত্ব তৈরি করার জন্য, আর হয়তো মৃত্যুই কারও জীবন কেড়ে নেওয়া ভুলে কণ্ঠ মেলাবে আমাদের সঙ্গে, আর গৌতম চট্টোপাধ্যায় এসে বলবে, ‘কলকাতায় এখন কেমন গরম বাপী, আমার স্যাক্সোফোনটা আনতে কি ভুলে গেছিস?’

আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল, হঠাৎ মৃত্যুর কথা মনে হয়ে লিখলাম:
‘বিদায় নেওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়, যখন কেউ ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি।’
কী আশ্চর্য! ঠিক ওর কাছাকাছি সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন বাপীদা, যখন হয়তো বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের অনেক মানুষ ঘুমের অতলে ডুবে আছে। তারপর ঘুম থেকে আবার উঠে জানলাম, বাপীদা মারা গেছেন, কী অদ্ভুত যোগাযোগ, এটাই মনে হয় গানের শক্তি, যেহেতু তাঁর গান আমাদের হৃদয়ে এমন শক্তির রূপ নিয়ে জমে আছে, যা কোনো দিন হারাবে না। গায়কের হয়তো মৃত্যু আছে, গানের নেই, সেই গান গায়কের নিশ্বাস হয়ে পৃথিবীর বাতাসে ভেসে থাকে, আর জঙ্গম সময়ে সেই বাতাস মানুষের নিশ্বাস হয়ে ওঠে। কী অদ্ভুত এক স্বপ্ন এই জীবন, কেউ একটু আগে ছিল, কিন্তু তাকে এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেমন ঘুমের ভেতরের স্বপ্ন জেগে উঠলে আর থাকে না।

তাপস বাপী দাসকে মনে করে সম্প্রতি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ‘সোনার বাংলা সার্কাস’–এর প্রবর রিপন গাইলেন ‘ভালো লাগে জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে’
ছবি: সংগৃহীত

হায়! ভালোবাসি বাপীদা, আবার আমাদের দেখা হবে, মহাজগতের অন্যতর কোনো তরঙ্গে, যেখানে আপনার সেই চিরতরুণ রূপের সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে, আর আপনাকে বলব, আসুন শুরু করি ‘হায় ভালোবাসি’, আপনি মেইন ভোকাল আর আমি হারমোনাইজ করছি, আর সেই গানে নিশ্চয়ই মৃত্যুকে শায়েস্তা করা যাবে, আমাদের এই আপাতদূরত্ব তৈরি করার জন্য, আর হয়তো মৃত্যুই কারও জীবন কেড়ে নেওয়া ভুলে কণ্ঠ মেলাবে আমাদের সঙ্গে, আর গৌতম চট্টোপাধ্যায় এসে বলবে, ‘কলকাতায় এখন কেমন গরম বাপী, আমার স্যাক্সোফোনটা আনতে কি ভুলে গেছিস?’