‘হয়তো এটাই আমার শেষ দেখা’

আজ সরদার ফজলুল করিমের মৃত্যুদিন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘আমার প্রিয় মুখ’ বইয়ে বাংলাদেশের এই ভাবুক লিখে গেছেন নানা প্রসঙ্গে।  সেই বই থেকে আজ জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো।

সরদার ফজলুল করিমছবি: সংগৃহীত

প্রায় দুই বছর পরে রাজ্জাক স্যারের (জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক) সঙ্গে তাঁর বনানীর বাসায় প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে যে সাক্ষাৎকার এবং আলাপটি হলো, সেটি বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক। স্যারের বয়স সেই ১৯১২ বা ১৯১৪ থেকে ধরলে ৮৬ বছর তো হবেই।

স্নেহভাজন আনিসের (আনিসুজ্জামান) সঙ্গে আগে থেকে আলাপ করে ঠিক করেছিলাম যে স্যারের কাছে গিয়ে একটু বসব। স্যারের বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি। তা তো বটেই। আমার শিক্ষক, পৃষ্ঠপোষক এবং পিতৃসম। সেই ১৯৪০-এর দশক থেকে—৪৩-৪৪ সাল থেকে। আনিস ও আনিসের স্ত্রী বেবী (‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার একসময়ের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক ওয়াহাব তার মৃত বাবা। তার চিন্তাময় এবং বিশ্লেষণমূলক ইংরেজি কলাম এখনো মনে শ্রদ্ধার সঞ্চার করে।) স্যারের জীবনীশক্তি আমার চাইতে আজও বেশি। স্যারের অনেক স্নেহভাজনই তাঁর আগে চলে গেছেন।

আমিও যাব। সে জন্যই ভাবছিলাম, হয়তো এটাই আমার শেষ দেখা। হোক না তাই।...
আজ আনিসের সঙ্গে বেবীও ছিল। স্যারের বাসায় ওদের অবাধ যাতায়াত। আমি যখন সপরিবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিলাম। স্যারও তখন আমার বাসারই দক্ষিণ দিকটাতে থাকতেন। তখন তাঁর বাসায় আমার যাতায়াতও ছিল প্রতিদিনের এবং অবাধ। আমাদের আকর্ষণ ছিল স্যারের অকৃপণ আলোচনা এবং আপ্যায়ন।

আজ আনিস তাঁর ঘরের দরজা খুলতে স্যার এগিয়ে এলেন। একটু কুঁজো হয়েছেন হয়তো। পরে আলাপে বললেন, চোখের দেখার শক্তি বেশ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এই বয়সে স্মৃতিশক্তি আমাদের কাছে বিস্ময়কর রকমে প্রখর। আলাপেও সেই আগেকার দিনের মতোই উন্মুক্ত। আমি কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দাঁড়ালাম। তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

নিজের বইপত্রের মধ্যে বসার জায়গাটিতে নিয়ে আমাদের বসালেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চা এল, উপাদেয় কাবাব এল। আনিস তো এ বাড়িরই লোক। সে দুটি কাবাব খেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আরও চারটা ভাজার হুকুম দিয়ে এল। স্যার বললেন, তাহলে রাঁধুনি (তাঁরই স্নেহধন্য ভাতিজি কিংবা পুত্রবধূ) তাঁর জীবনকে তো ধন্য মানবে যে তার কাছ থেকে আনিস চেয়ে খেয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নানান বিষয়ে আলাপ জমে উঠল। প্রধানত স্যার ও আনিসের মধ্যে। আমি শুধু ছোট ক্যাসেট রেকর্ডারটি খুলে সামনে ধরার চেষ্টা করলাম। যতটুকু ধরে রাখা যায়। হয়তো তাতে বেশি রাখতে পারিনি।

স্যারের আলাপ কোনো দেশকালের সীমানা মানে না। খলিফাদের আমলের কথা উঠল। বললেন, তিন খলিফা তো নিহত হলেন। এর হাতে ও, ওর হাতে এ, কিন্তু তাই বলে এঁরা কেউ এটাকে তো ইসলামের নীতি বলে ঘোষণা দেননি। নানান গ্রন্থের উল্লেখ করলেন তিনি। নানান হাদিসের। একালের উলেমাদের হাদিসের ব্যাখ্যা নাকচ করে দিলেন। বললেন, আপনারা রাজনীতি করেন রাজনৈতিক দল করেন, সরকার তৈরি করেন, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে মূলকে জানুন—মূলকে তুলে আনুন। আরব-মিসর-পারস্যের নানা বুজুর্গদের কথা উঠছিল। আমি ধরতে পারছিলাম না।

আমার প্রিয় মুখ
সরদার ফজলুল করিম
সম্পাদক: মতিউর রহমান
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ২০২৩, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, দাম: ২৯০ টাকা।

উনিশ শতকের ভারতের কথা উঠল। এমনকি ব্রিটিশ শাসনের আগে মুসলমান আমলে সতীদাহ অনুষ্ঠানের কথা উঠল। আনিসের প্রশ্নের জবাবে স্যার বললেন, মুসলমান শাসকেরা সতীদাহ নিবারণ করতে পারেননি। সতীদাহ হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠিত অনুষ্ঠান। মুসলমান শাসকেরা দেখতেন যেন ধর্মীয় নিয়ম-নিষেধের অমান্যতার মধ্য দিয়ে অসহায় বধূটির অত্যাচারের মাত্রা আরও না বৃদ্ধি পায়। দেবেন ঠাকুর,রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা উঠল। ঊনবিংশ শতাব্দীর আলোচনায় রাজ্জাক স্যারের আলাপে এঁরা অনিবার্যভাবে আসবেনই। একেবারে আধুনিক পর্যায়ে তিলকের নাম এল।

জিন্নাহর নাম এল। বললেন, জিন্নাহ তিলকের কেস বিনা পয়সায় করেছেন। কিন্তু সি আর দত্ত হাতে টাকা না নিয়ে রাজনীতিকদের কেসও করেননি। এসবের সত্য-মিথ্যা আমি জানিনে। জিন্নাহর ওপর নতুন গবেষণার কিছু দৃষ্টান্তের কথা এল। গান্ধীজির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বললেন, তার ধর্মীয় আচরণ আর ব্যাখ্যা ভারতের ক্ষতি বৈ লাভ করেনি।...

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক

বললেন, পৃথিবীর কেন্দ্রটা এখনো মধ্যপ্রাচ্যই। আফ্রিকাই। আমি তো মনে করি ওই যে নেলসন ম্যান্ডেলা, নাকি একটা নামের কথা আপনারা কন: আমি বলি এই লোকটা হচ্ছে ম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি...

আবার দ্যাখেন, ভাষার পরিবর্তনের কারবারটা। ৫০০ কী হাজার বহুবার বাক্য আজও ব্যবহার করেন। বাক্যের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু সেকালের শব্দের উচ্চারণ আর একালের উচ্চারণ তো এক না। উচ্চারণের সঙ্গে অর্থের ব্যঞ্জনা আগের বাক্য উচ্চারণ করলেই আগের অর্থ কি পাওয়া যায়? আমার ক্যাসেটের ফিতাও শেষ হয়ে এসেছিল। খট করে থেমে গেল।

আমার অবাক লাগছিল তাঁর স্মৃতিশক্তির প্রখরতায়। এই ৮৬ বছর বয়সেও। আমার তো বটেই, আনিস, আমার, বেবীর ভাগ্য লোকটির অকৃপণ স্নেহ পেয়ে আরও ধন্য হয়েছি।
মানুষের নানা দিক থাকে। এই মানুষটিরও নিশ্চয়ই আছে। আমি গবেষক নই। না জানা দিকের গবেষণায় যাওয়ার আমার ইচ্ছাও নেই। বয়সও নেই। সেই চল্লিশের দশক থেকে এই ছোটখাটো মানুষটি যে আমাদের মধ্যে জ্ঞান ও গবেষণার প্রদীপ জ্বালাতে পিতার অধিক স্নেহে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন—কোনো গবেষণাই তো আমাদের সেই লাভকে বিনষ্ট করতে পারবে না।...

দেখলাম, স্যারের যেন কিছুটা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কথার সঙ্গে কাশি আসছে। আমি আনিসের দিকে চাইলাম। আনিস দাঁড়িয়ে স্যারের দিকে চেয়ে বলল: স্যার, আজ উঠি আর একদিন আসব।

আমাদের এগিয়ে দিতে তিনি বাইরের দরজা পর্যন্ত এলেন। এরপর আকস্মিকভাবে একটা প্রশ্ন করলেন, মুনীর আর কবীর, ওরা ভাই না? আমি বললাম, অবশ্যই স্যার। স্যার যেন আত্মমগ্নভাবে বললেন, তারপর স্যার আনিসের দিকে চেয়ে বললেন, মুনীরটা বেঁচে থাকলে আপনি আরও কিছু কাজ করতে পারতেন।...

তারপর হাত তুলে বললেন, আবার আইয়েন। ভালো থাইকেন...। (পৃষ্ঠা: ৫৪-৫৬)