সময়ের রূপান্তরে বাংলাদেশের সাহিত্য

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বিশ্বরাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সাল ছিল এক অভাবনীয় ওলটপালটের বছর। একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতিবিকাশ, অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার পুনরুত্থান বিশ্বসাহিত্যকে এক নতুন সংকটের মুখোমুখি করেছিল। ঠিক এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যিকেরা বেছে নিয়েছেন এক নতুন পথ, যে পথ একই সঙ্গে দ্রোহের, অর্জনের ও আত্মপরিচয় পুনর্নির্মাণের। ২০২৫ সালের বাংলাদেশের সাহিত্য কেবল অক্ষর আর শব্দের খেলা ছিল না; এটি ছিল এক অবিনাশী স্মৃতি ও পুনর্জন্মের শৈল্পিক রূপায়ণ।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের সাহিত্য

২০২৫ সালে সাহিত্যের সবচেয়ে বড় সংবেদনশীল জায়গা ছিল চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান। চব্বিশের গণজাগরণে কেবল রাজপথের পটপরিবর্তন ঘটেনি, বরং বাংলা সাহিত্যের বিষয়গত দিক ও আঙ্গিকসৌষ্ঠবেও এসেছে পরিবর্তন। বিশেষত প্রসঙ্গভিত্তিক শব্দচয়ন সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামোকে বদলে দিয়েছে আমূল। গণজাগরণকে কেন্দ্র করে আলতাফ পারভেজ রচিত ‘লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা’ (বাতিঘর) গ্রন্থটি পাঠকের কাছে আন্দোলনের একটি সামগ্রিক ও গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হয়েছে। বিপ্লবের সেই ৩৬ দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে রক্তক্ষয়ী ও নিখুঁত দিনলিপি হিসেবে তুলে ধরেছেন মাহমুদুল হক জাহাঙ্গীর তাঁর ‘রক্ত দিয়ে লেখা ছাত্র-জনতার বিপ্লব ২৪’ (এশিয়া পাবলিকেশন) বইটিতে। একইভাবে জাহিদ বিন জোবায়েরের ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দিনলিপি’ (প্রত্যাশা প্রকাশন) প্রতিটি ঘটনার তথ্যভিত্তিক রেকর্ড বা দালিলিক ইতিহাসকে উপস্থাপন করেছেন বস্তুনিষ্ঠতায়। আহমদ মতিউর রহমানের ‘দেশ কাঁপানো ২৩ দিন’ এবং ‘আমি বিজয় দেখেছি: ৩৬ জুলাই’ (রয়েল পাবলিশার্স) বইগুলোতে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ৫ আগস্টের বিজয় পর্যন্ত চরম উত্তেজনাকর সময়ের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে।

সাহিত্যের ধ্রুপদি শাখাতেও এই বিপ্লব এক নতুন আবেদন তৈরি করেছে। প্রথাগত সাহিত্যের বাইরেও রাজপথের দেয়াললিখন বা গ্রাফিতিগুলো নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চ প্রকাশ করেছে ‘জুলাইয়ের গ্রাফিতি ও গাইলসমগ্র’।

এ ছাড়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার স্মৃতিচারণামূলক বই ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’(প্রথমা) আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতৃত্বের জবানবন্দি হিসেবে পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সাহিত্যের ধ্রুপদি শাখাতেও এই বিপ্লব এক নতুন আবেদন তৈরি করেছে। প্রথাগত সাহিত্যের বাইরেও রাজপথের দেয়াললিখন বা গ্রাফিতিগুলো নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চ প্রকাশ করেছে ‘জুলাইয়ের গ্রাফিতি ও গাইলসমগ্র’। জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে অসংখ্য গল্প, কবিতা ও উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে ‘রক্তাক্ত জুলাই ডায়েরি’ (মাহী ফারহানা), ‘জুলাই বিপ্লবের কবিতা’ (আবু বকর সিদ্দিক প্রান্তর), ‘মুক্তাদীরের কারফিউ ডায়েরি’ (খন্দকার মাসুম মুক্তাদীর), ‘লাল জুলাইয়ের গল্প’ (সম্পাদন: সীমান্ত আকরাম) এবং ‘বোধের অভ্যুত্থান’ (রাকিবুল এহছান মিনার) বিশেষভাবে আলোচিত ও সমাদৃত। এ বইগুলো আন্দোলনকারীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, গণহত্যা ও স্বৈরাচারের পতনকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রকাশ করেছে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কবিতা’, যা সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সংকলন ছিল। সব মিলিয়ে ২০২৫ সালের সাহিত্য ছিল এক অবিনাশী স্মৃতি ও পুনর্জন্মের শৈল্পিক রূপায়ণ।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সেন্সরশিপমুক্ত বইমেলা

২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়, যার মূল সুর ছিল নিরঙ্কুশ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বিগত দেড় দশকে যে অলিখিত ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’ ও নজরদারির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, ২০২৫-এর মেলায় সেই শিকল ভেঙে এক ভীতিহীন ও বৈচিত্র্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পূর্বের বছরগুলোতে স্পর্শকাতর বিষয়ের অজুহাতে বই নিষিদ্ধ বা আদর্শ প্রকাশনীর মতো সংস্থাকে স্টল বরাদ্দে বাধা দেওয়ার যে প্রবণতা ছিল, এবার তার আমূল পরিবর্তন ঘটে। পরিসংখ্যানগতভাবে এবারের বইমেলা ছিল আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাগ্রসর। ২০২৪ সালে যেখানে ৬৩৫টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছিল, ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৮টিতে। এবারের মেলার অন্যতম বড় পরিবর্তন ছিল লিটল ম্যাগাজিন চত্বর এবং তরুণ লেখকদের সরব উপস্থিতি। বিগত বছরগুলোতে লিটলম্যাগ চত্বরকে কোণঠাসা করে রাখা হলেও ২০২৫ সালে একে মেলার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। ফলে প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের বাইরে প্রতিবাদী ও পরীক্ষামূলক সাহিত্যের এক জোয়ার দেখা গেছে। সেন্সরশিপমুক্ত এ মেলায় কেবল বইয়ের বিকিকিনি বাড়েনি, বরং বেড়েছে মননশীল আলোচনা ও বিতর্কের সুযোগ।

অমর একুশে বইমেলা ২০২৫
ছবি: প্রথম আলো

প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের মহাপ্রয়াণ

২০২৫ সাল বাংলাদেশের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতির বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। প্রাবন্ধিক, সংগীতজ্ঞ ও ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সন্‌জীদা খাতুন মৃত্যুবরণ করেছেন এ বছরের ২৫ মার্চ। তাঁর প্রয়াণ সংস্কৃতি অঙ্গনে সৃষ্টি করেছে অপূরণীয় শূন্যতা।

২০২৫ সালের ২৬ এপ্রিল বার্লিনে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন নির্বাসিত প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক দাউদ হায়দার। ১৯৭৪ সাল থেকে নির্বাসিত এই কবির মৃত্যুতে বাংলা কবিতার এক দ্রোহী ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। তাঁর প্রয়াণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শিল্পের জন্য একজন লেখকের আজীবন একাকী লড়াই ও দেশান্তরী হওয়ার করুণ ইতিহাস। এ বছর ১০ মে বার্ধক্যের কারণে মারা যান প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, সুরকার ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী। এ ছাড়া এ বছর আমরা হারিয়েছি প্রগতিশীল চিন্তক যতীন সরকারকে। ১৩ আগস্ট ২০২৫ তারিখে তাঁর মহাপ্রয়াণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিকড়সন্ধানী গবেষণার এক বিশাল অধ্যায় সমাপ্ত হয়। প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন উমর প্রয়াত হয়েছেন এ বছরের ৭ সেপ্টেম্বর। মূলত এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া ফেলে বিদায় নিলেও এই প্রস্থানগুলো কেবল ব্যক্তিগত বিয়োগান্ত ঘটনা থাকেনি, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক বৌদ্ধিক কাঠামোর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি অনুভূত করে রেখেছেন।

রাষ্ট্রীয় পদক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির পুনর্মূল্যায়ন

২০২৫ সালে বাংলাদেশের সাহিত্য পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ও ভারসাম্য পরিলক্ষিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পক্ষপাত ও একপেশে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের দেয়াল ভেঙে এ বছর যোগ্যতার ভিত্তিতে লেখকদের মূল্যায়নের এক নতুন মানদণ্ড তৈরি হয়। বিশেষ করে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায় এমন অনেক গুণীজনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যারা বিগত কয়েক দশকে কেবল রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত ছিলেন। কবি আল মাহমুদকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান ছিল এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা, যা তাঁর কাব্যিক শ্রেষ্ঠত্বকে জাতীয় পর্যায়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। একইভাবে কবিতার বরপুত্র হেলাল হাফিজকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা পাঠকদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন হিসেবে গণ্য হয়েছে।

হেলাল হাফিজ (৭ অক্টোবর ১৯৪৮—১৩ ডিসেম্বর ২০২৪)
ছবি: জিয়া ইসলাম

প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও অন্যান্য বিভাগীয় পদকগুলোতেও এ বছর মেধা ও গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক মনসুর মুসা (প্রবন্ধ), সানাউল হক খান (কবিতা) ও হাফিজ রশিদ খানের (নৃগোষ্ঠী গবেষণা) মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের স্বীকৃতি প্রদান একাডেমিকে নতুন করে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে এনেছে। পাশাপাশি তরুণ ও প্রতিবাদী সাংবাদিকদের সম্মান জানাতে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহকে (মরণোত্তর) একুশে পদক দেওয়া ছিল উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছেন আনিসুর রহমান ও সুব্রত বড়ুয়া, যা পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতাকে আরও বৃদ্ধি করেছে। সামগ্রিকভাবে ২০২৫ সালের পদক বিতরণী ছিল একধরনের ‘সাংস্কৃতিক ইনসাফ’ বা ন্যায়বিচারের বহিঃপ্রকাশ, যা বিভাজিত সাহিত্যিক সমাজকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দিয়েছে।

অনুবাদ সাহিত্য ও বিশ্বসংযোগ

২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলা ও কলকাতা বইমেলাকে কেন্দ্র করে অনুবাদ সাহিত্যে এক অভূতপূর্ব জোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছে। এ বছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হাঙ্গেরীয় লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের দুরূহ ও ধ্রুপদি সৃষ্টি ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ এবং ‘ডিসট্রাকশন অ্যান্ড সরো বিনিথ দ্য হেভেনস’ বাংলা অনুবাদে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

বাংলা সাহিত্যও এ বছর বিশ্বমঞ্চে সগৌরবে পদচারণ করেছে। বিশ্বদীপ চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘দ্য ইয়ার্স বেস্ট কালেকশন অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ, ২০২৫’-এর মাধ্যমে সেরা বাংলা গল্পগুলো ইংরেজিভাষী পাঠকদের কাছে পৌঁছেছে।

পাশাপাশি স্টিফেন হকিংয়ের ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ এবং ইউভ্যাল নোয়া হারারির ‘স্যাপিয়েন্স’-এর মতো বিশ্বখ্যাত বইগুলোর নতুন সংস্করণ পাঠকদের জ্ঞানতৃষ্ণা মিটিয়েছে। অন্যদিকে ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে বাল্মীকি রামায়ণ ও জালালুদ্দিন রুমির প্রেমমূলক রচনার ধ্রুপদি অনুবাদগুলো ছিল অন্যতম সেরা সংগ্রহ। কেবল বিদেশি সাহিত্য বাংলায় নয়, বরং বাংলা সাহিত্যও এ বছর বিশ্বমঞ্চে সগৌরবে পদচারণ করেছে। বিশ্বদীপ চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘দ্য ইয়ার্স বেস্ট কালেকশন অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ, ২০২৫’-এর মাধ্যমে সেরা বাংলা গল্পগুলো ইংরেজিভাষী পাঠকদের কাছে পৌঁছেছে। এ ছাড়া কল্যাণী ঠাকুর চরালের দলিত সাহিত্য ঘরানার কালজয়ী উপন্যাস ‘অন্ধার বিল’ অসিত বিশ্বাসের অনুবাদে আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং চৈতী মিত্র কর্তৃক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সমসাময়িক উপন্যাস ‘চন্দনেশ্বর জাংশন’ ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার সেতুবন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

সাহিত্যে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকট সচেতনতা

২০২৫ সালের বাংলা সাহিত্যে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকট কেবল একটি অনুষঙ্গ নয়, বরং অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমকালীন কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধে লেখকেরা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অনিয়মিত বৃষ্টি, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং মরুকরণের মতো রূঢ় বাস্তবতাকে নিপুণভাবে তুলে ধরছেন। জলবায়ু পরিবর্তনকে শুধু পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে নয়, বরং খাদ্য, পানি ও নিরাপদ বাসস্থানের মতো মানুষের মৌলিক অধিকারের সংকট হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে বাংলাদেশের সাহিত্যে। একদিকে যেমন বন উজাড় ও জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য মানুষের দায়বদ্ধতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, অন্যদিকে জলাভূমির বিলুপ্তি ও জীববৈচিত্র্য হ্রাসের বেদনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সৃজনশীল লেখায়। তবে এই সংকটের বিপরীতে সাহিত্যে আশার আলো হয়ে দেখা দিচ্ছে তরুণ প্রজন্মের সক্রিয়তা ও বৈশ্বিক ঐক্যের আহ্বান। জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকাগুলোর কলাম এবং বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার ও জ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা জোরালো হচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভোগবাদী সম্পর্কের পরিবর্তনের ডাক দিয়ে ২০২৫ সালের এই সাহিত্যিক ধারা মূলত একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বার্তাই প্রদান করছে।

ডিজিটাল প্রকাশনা ও ই-বুকের প্রসার

২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের সাহিত্য প্রকাশনায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও ই-বুকের এক বৈপ্লবিক প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে লেখকেরা কেবল প্রথাগত প্রকাশনীর ওপর নির্ভরশীল না থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সরাসরি নিজেদের সৃষ্টি প্রকাশ করতে পারছেন, যা নতুন ও তরুণ লেখকদের জন্য অবারিত সুযোগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে ২০২৫-এর বইমেলায় ই-বুক মেলা এবং অনলাইন বুকশপগুলোর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, যেখানে জনপ্রিয় লেখকদের বই মুহূর্তেই পাঠকদের হাতের নাগালে পৌঁছে গেছে। এই রূপান্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; প্রকাশকেরা এখন এআই ব্যবহার করে পাঠকের রুচি বিশ্লেষণ করছেন এবং সেই অনুযায়ী বইয়ের প্রচার ও স্বয়ংক্রিয় অনুবাদের কাজ সারছেন। ফেসবুক, ব্লগ ও বিভিন্ন সাহিত্যধর্মী প্ল্যাটফর্মগুলো এখন লেখক-পাঠক সংযোগের প্রধান মাধ্যম। ফলে ঐতিহ্যবাহী কাগজের বইমেলার পাশাপাশি একটি শক্তিশালী সমান্তরাল ডিজিটাল সাহিত্যজগৎ দাঁড়িয়ে গেছে, যেখানে গল্প-উপন্যাস ও কবিতার পাশাপাশি আত্মজীবনী, দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনবিষয়ক গবেষণামূলক বইয়ের চাহিদাও বাড়ছে। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতা বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে যেমন বৈচিত্র্যময় করেছে, তেমনি এর বিশ্বব্যাপী প্রচারকেও করেছে ত্বরান্বিত।

বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তির নতুন দিগন্ত

২০২৫ সালের সাহিত্য ছিল অত্যন্ত ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে কেবল ‘মূলধারা’র দাপট ছিল না, বরং প্রান্তিক ও অন্যান্য স্বরও ছিল জোরালো।

সমতলের পাশাপাশি পাহাড় ও প্রান্তিক জনপদের মানুষের কণ্ঠস্বর এক অনন্য উচ্চতা লাভ করেছে ২০২৫–এর বাংলাদেশের সাহিত্যে। দীর্ঘদিনের ‘মূলধারা’ বনাম ‘প্রান্তিক’ সাহিত্যের যে বিভাজন ছিল, তা এ বছর অনেকটাই ঘুচে গেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি এবং তাঁদের ভূমি ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এ বছর লেখকদের লেখায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। কবিতা ও কথাসাহিত্যেও এই প্রান্তিক জীবনবোধের প্রবল জোয়ার পরিস্ফুট। চাকমা, মারমা ও গারো ভাষায় রচিত কবিতার দ্বিভাষিক সংকলনগুলো এ বছর তরুণ পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।

সমাজ ও রাজনীতির চরম অস্থিরতার মধ্যে মানুষের মন যখন শান্তি ও স্থিরতা খুঁজেছে, তখন সাহিত্যে আধ্যাত্মিক ও সুফি দর্শনের এক নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। ২০২৫ সালে ধর্মীয় দর্শনের উদার নৈতিক ব্যাখ্যা এবং আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে আধুনিক জীবনবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে অনেক যুক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই সাহিত্যগুলো প্রমাণ করেছে যে সংকটের সময়ে মানুষ কেবল স্লোগান নয়, বরং আত্মার খোরাক হিসেবে ধ্রুপদি ও আধ্যাত্মিক দর্শনের আশ্রয়েও ফিরে যায়।

২০২৫ সালের সাহিত্য সালতামামিতে প্রবাসী বাঙালি লেখকদের ভূমিকা কেবল পরিপূরক ছিল না, বরং তা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান ফ্রন্ট। দীর্ঘকাল ধরে যাঁরা প্রবাসে থেকে ভিন্নমতের চর্চা করেছেন এবং রাজনৈতিক কারণে দেশে যাঁদের বই অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল, ২০২৫ সালের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তাঁদের লেখা দেশের পাঠকদের কাছে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রবাসে থাকার ফলে তাঁরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকটকে একটি বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, যা দেশীয় সাহিত্যের সীমাবদ্ধ গণ্ডিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছে। এই ধারার সাহিত্যে কেবল ক্ষোভ নয়, বরং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাঠামোগত প্রস্তাব এবং বিশ্বনাগরিক হিসেবে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে।

কিশোরদের মনস্তত্ত্বে দেশপ্রেম ও নাগরিক অধিকারের বীজ বপন করেছে ২০২৫-এর বইগুলো। রাজপথে কিশোরদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বা গ্রাফিতি আঁকার মতো সাহসী ঘটনাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য সচিত্র কমিকস ও গল্পগ্রন্থ।

নারীবাদী সাহিত্যে এ বছর প্রথাগত সংকটের গণ্ডি পেরিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার ও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর ভূমিকার প্রসঙ্গটি জোরালো হয়েছে। জুলাইয়ের রাজপথে নারীদের অদম্য অংশগ্রহণ নারী লেখকদের কলমে এক নতুন শক্তি সঞ্চার করেছে। ২০২৫-এর উপন্যাসে নারীরা কেবল ট্র্যাজেডির শিকার নন, বরং পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। একই সঙ্গে লিঙ্গবৈচিত্র্য মানুষের অধিকার ও তাঁদের মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেশ কিছু সাহসী প্রবন্ধ ও ফিকশন প্রকাশিত হয়েছে, যা আমাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তির পথকে আরও প্রশস্ত করেছে।

এ বছরের শিশু ও কিশোর সাহিত্যে এক আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। কেবল রূপকথা বা কল্পবিজ্ঞানের গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কিশোরদের মনস্তত্ত্বে দেশপ্রেম ও নাগরিক অধিকারের বীজ বপন করেছে ২০২৫-এর বইগুলো। রাজপথে কিশোরদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বা গ্রাফিতি আঁকার মতো সাহসী ঘটনাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য সচিত্র কমিকস ও গল্পগ্রন্থ। এটি শিশুদের মধ্যে ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্নকে এক শৈল্পিক রূপ দিয়েছে, যেখানে সাহসিকতাই ছিল গল্পের প্রধান নায়ক।

সর্বোপরি ২০২৫ সালের বাংলাদেশের সাহিত্য ছিল এক অবিনাশী স্মৃতি এবং পুনর্জন্মের শৈল্পিক রূপায়ণ। এ বছর প্রমাণ করেছে, যখনই সমাজ ও রাষ্ট্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসে, সাহিত্য তার সবচেয়ে শক্তিশালী সাক্ষী ও রূপকার হয়ে দাঁড়ায়। নানাবিধ প্রতিকূলতার শৃঙ্খল ভেঙে লেখকেরা যেভাবে শিকড় ও বৈশ্বিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন, তা আগামীর এক নতুন ও মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করবে। নতুন প্রজন্মের নির্ভীক কাব্যভাষা ও প্রবীণদের প্রজ্ঞার এই মেলবন্ধনই হয়ে উঠেছে ২০২৫-এর সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই সাহিত্য কেবল আয়নার মতো সময়কে ধারণ করেনি, বরং মশাল হয়ে আগামীর পথ দেখানোর সাহস জোগাবে বলেই বিশ্বাস।