সংস্কারপন্থী রেজিম প্রতিষ্ঠার খেলা

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

‘কল্পনা করুন হাঙ্গেরীয় এক ভগ্নদশা ছোট শহরের কথা, যে শহর শুধু দেখতেই পোড়ো পোড়ো নয়, চিন্তাচেতনায়ও যে দীনহীন—মৃত সমাজতান্ত্রিক চেতনা ও মধ্য ইউরোপীয় পুরাণকথার জাড্যের মাঝখানে সে শোয়া কোথাও। জড়তা ও বিশ্বাসহীনতায় মজ্জমান ওই আবছায়া শহরে হঠাৎ এসে হাজির এক সার্কাসের দল। জানি না একে ঠিক সার্কাস বলা যাবে কি না। কারণ, তাদের কাফেলায় বলতে গেলে শুধু আছে মৃত এক বিশাল তিমি আর এক রহস্যময় প্রিন্স, যে প্রিন্সকে আবার কেউ দেখেনি কখনো, কিন্তু তাকে ভয় পায় সবাই।’ এভাবেই শুরু লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মাস্টারপিস ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’ (প্রতিরোধের বিষণ্নতা) উপন্যাসের। কোনো প্লটভিত্তিক শুরু নয় এটা, এর শুরু কেবল এক গুজব দিয়ে। আর যেহেতু গুজব, তাই কোনো কিছু ঘটবার আগেই বাতাস থমথমে, উত্তেজক।

এ শহরের মানুষগুলোকে নিয়ে একটু বলি। এর অধিবাসীদের কোনো ঘটনাতেই দেখা যায় কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, তাদের কান থাকে শুধু ঘটনার ফিসফিসানির দিকে। এবার এক হাওয়া উঠল জোরে—প্রতীকী ও আক্ষরিক—দুই অর্থেই। বেঁকে গেল শহরের পুরোনো ল্যাম্পপোস্ট আর এর লোকদের নৈতিক কম্পাস—দু–ই। আর এই আবহাওয়াজনিত জ্বর-ঘোরের মধ্যেই প্রায় ভূত–ভূত অবয়ব নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল উপন্যাসের মূল চরিত্ররা।

আছেন মিসেস এস্তার, ভয়ংকর লাগানি-ভাঙানি দেওয়া এক মাদার-ফিগার, যিনি এই সার্কাসের গোলমালের মধ্যে জনগণের ভয় ও উদ্বেগকে শুধু নিয়ন্ত্রণই করতে চাইছেন না, চাইছেন সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে শহরে তার স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করবেন। আছেন ভালুসকা, এক আহাম্মক ভালো মানুষ, যে মদের এক দোকানের মাতালগুলোকে বলে যাচ্ছে তারা কে কোন গ্রহ, আর শেষে সব কটি মাতাল মিলে কীভাবে পুরো সৌরজগৎ। অর্থাৎ পৃথিবীর সার্বিক পতনের মধ্যেও তিনি দেখছেন সুন্দর, গোছানো এক পৃথিবীকে। আছেন মিস্টার এস্তার, বৃদ্ধ এক সংগীতবিশারদ, যিনি সুরের নিখুঁত ও মরমি দিকটায় আজও বিশ্বাস রাখেন, ওই বিমূর্ত অধরাকেই কসমিক সিস্টেম বলে ভাবেন, অর্থাৎ শহরের বর্তমান গন্ডগোলে ভরা অবস্থাকে একদম অস্বীকার করে চলছেন তিনি। আর আছে এক বড় চরিত্র—ওই বিশাল তিমি। তাকে বাইবেলের লেভিয়াথানই বলা ভালো, সে অবশ্যই নড়ে না চড়ে না, অবশ্যই তার চোখ মৃত, অবশ্যই তার গা পচছে এবং এ শহরে তার উপস্থিতি অদৃশ্য এক সংক্রামক ব্যাধি।

এবার মানুষে গিজগিজ চারদিক। শহরের শৃঙ্খলা আপনার চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে কোনো বিপ্লব বা প্রতিরোধ থেকে নয়, স্রেফ সবার যৌথ ক্লান্তি থেকে। দৃশ্যপটে এই দফা সহিংসতা ঢুকল নীরবে, আর্দ্রতার মতো: প্রথমে সে কুয়াশাচ্ছন্ন করল বাতাস, তারপর দেখাল তার দাঁত। মিসেস এস্তার শয়তানি চাল চেলে চেলে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। তিনি এক সংস্কারপন্থী রেজিম প্রতিষ্ঠার খেলায় জিততে চলেছেন। কিন্তু তার যত দিন লাগছে এ কাজে, তত দিনে সংস্কার করার মতো আর অবশিষ্ট থাকছে না কিছুই। কারণ, সবই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে একে একে, স্রেফ পড়ে থাকছে সমাজে সুসংহতি ও শৃঙ্খলা আনার একটা ইলিউশন।

শেষে গিয়ে—রায়টের শেষে, লুটের শেষে, আগুনের শেষে—পৃথিবী ও জীবনের প্রতি এখনো বিশ্বাস ধরে থাকলেন শুধু বোকা ভালুসকাই, তার বিশ্বাস ওই অ্যাবসার্ড কসমোলজিতে। আমরা দেখি, ভালুসকা হেঁটে বেড়াচ্ছে শহরের ধ্বংসাবশেষের মাঝখান দিয়ে, আর বকবক করে যাচ্ছে সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথ নিয়ে, কিন্তু আজ আর কোনো শ্রোতা নেই তার। আর তিমিটা? সে হাওয়া হয়ে গেছে। তা–ই কি! আর প্রিন্স? সে–ও হাওয়া। শহর ফিরল এক ক্লান্তিজনিত স্তব্ধ-স্থিরতায়—পুরোটা মেলানকোলি, মানে বিষণ্নতা, যে বিষণ্নতা থেকে কোনো মোক্ষণ নেই; আর পুরোটা প্রতিরোধ, যা কিনা কিছুই প্রতিরোধ করে উঠতে পারেনি।

ভূত–ভূত অবয়ব নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল উপন্যাসের মূল চরিত্ররা। আছেন মিসেস এস্তার, ভয়ংকর লাগানি-ভাঙানি দেওয়া এক মাদার-ফিগার, চাইছেন শহরে তার স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করবেন। আছেন ভালুসকা, এক আহাম্মক ভালো মানুষ, যে মদের এক দোকানের মাতালগুলোকে বলে যাচ্ছে তারা কে কোন গ্রহ, আর শেষে সব কটি মাতাল মিলে কীভাবে পুরো সৌরজগৎ।

এই উপন্যাস নিয়ে আমি অনেক কথা বলেছিলাম ২০২০ সালের দিকে এক সাক্ষাৎকারে। পরে আমার সাক্ষাৎকারগুলো বই আকারে বেরিয়েছিল ২০২৩ সালে, নাম ‘মানবতাবাদী সাহিত্যের বিপক্ষে’। সেই বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম ছিল: ‘লাজলো ক্রাজনাহোরকাই—এলিট ও এলিটিস্টের ফারাক’। সেখানে লাসলোর গদ্যের সঙ্গে আমি তুলনা টেনেছিলাম তাঁর একদম বিপরীত মেরুর হুয়ান রুলফোর। লাসলোর বাক্য ডিটেল দিয়ে দিয়ে তৈরি করা এক ম্যাডনেস, আর রুলফো মাপা ডিটেলে ছায়া-ছায়া পৃথিবী রচনায় দুনিয়ার সেরা। আমি বলেছিলাম, লাসলোর এই ম্যাডনেস তারাশঙ্করে আছে এবং আমার উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’র সুররিয়ালিটিটুকু লাসলোর ‘মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’-এর সুররিয়ালিটি, ফ্যাসিস্ট বিশ্বব্যবস্থাকে দেখানোর জন্য উপযুক্ত একধরনের বর্ণনাকৌশল। আবার এই উপন্যাসের এ মুহূর্তে ভুবনবিখ্যাত মরা তিমিটাকেই আমি সোজা টেনে এনে পরে বসিয়ে দিয়েছিলাম আমার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার’-এ, ৫২ ফিটের এক টেবিলে ফেলা পৃথিবীর শেষতম ওয়েস্টান নর্থ প্যাসিফিক ধূসর তিমি বানিয়ে। আমার তিমির সেখানে উপস্থিতি ছিল স্পষ্ট এক কারণে: পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, বিশেষ গোত্রের এক তিমি বিলুপ্ত হচ্ছে—এ রকম। আর লাসলোর নোবেলজয়ী তিমিটাকে কী বলব? সে কি কসমিক অ্যাবসারডিটির অদ্ভুতুড়ে বা গ্রোটেস্ক এক রূপক? সমাজে ডুব মেরে থাকা আতঙ্ক ও ভয়ের লেভিয়াথানসম ‘অনুপস্থিতির‘ স্মারক?

হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে।
ছবি: সংগৃহীত

এখন বুঝি, বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর সিস্টেম বা বন্দোবস্তগুলোর সংস্কার নিয়ে নানা কথা শোনার শেষে এখন বুঝি, তাঁর ওই তিমি কোনো মেটাফোর বা রূপক নয়, ওটা রূপকের ফসিল। রূপকের মধ্যে যে অর্থ থাকে, তা এরই মধ্যে মারা গেছে; ওই তিমি সেই অর্থের মৃতদেহ মাত্র—মমি করা ও প্রদর্শিত মরা শরীর। শহরের লোকেরা সেই বিগতকে ঘিরে রোজ জড়ো হয় ওর মুখ থেকে কোনো ঐশ্বরিক বাণী শোনার আশা নিয়ে নয়, তারা সেখানে জড়ো হয় অলৌকিকের মাধ্যমে জীবন বদলে যাবে ধরনের অভিজ্ঞতার মূল গন্ধের পরের গন্ধটুকু পেতে, পারফিউম ব্যবসায় যাকে আমরা আফটার-স্মেল বলি। কিন্তু ওই মরা তিমির স্মেল ও আফটার-স্মেল—দুই-ই পচা। আর অলৌকিক? নেই। মধ্য ইউরোপীয় মিথে ছাড়া সে বাস্তবে থাকে না।

‘মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’ সব বিচারেই গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ লেভেলের এক মাস্টারপিস।
মাসরুর আরেফিন

ক্রাসনাহোরকাই জিনিয়াস এ কারণেই যে তিনি এই উপন্যাসে দেখান কীভাবে পৃথিবীর মানুষেরা, স্বৈরাচারসহ অন্য আরও সব আচারে বিশ্বাস হারানো মানুষেরা, এখনো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাসের মৃত শরীর দেখার আশায়। এই অর্থে, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগেই লাসলো এতে লিখেছেন কিয়ামত-পরবর্তী ধর্মতত্ত্বের কথা। যেমন ঠিক আমাদের এখানে ঘটল গত বছরের ৫ আগস্ট, কিয়ামতের আগের কিয়ামত—অসংখ্য মৃত্যু, স্বৈরাচারের পতন, নতুন আচার বা বিধানের আগমন, চতুর্দিকে সংস্কারসহ অনেক আওয়াজ, বেশিই আওয়াজ, পরবর্তী খলিফার আগমনের প্রত্যাশার আওয়াজটুকুসহ।

ক্রাসনাহোরকাই তাঁর এই অ্যা লিগরিক্যাল ঢাউস উপন্যাসে স্পষ্টই জানাচ্ছেন, রেজিম বদলানো যায়, কেউ না কেউ তা বদলায়, কিন্তু বিরামহীন ক্লান্তি ও পাশবিকতার এই পৃথিবীতে রেজিমের সংস্কার ঠিক পৃথিবীর ‘বিগ পিকচার’টা ধরতে পারার লেকচারের মতো, যেখানে কোনো ‘বিগ পিকচার’ আদতে নেই। কারণ, সবই আকারে স্মল, অতএব দীনহীন। তাই বিশাল তিমিতেই আমাদের আস্থা! কিন্তু সে যে মরা এক তিমি!

আমার পাঁচ বছর আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারেই এ উপন্যাসের গদ্য প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, আরেক নোবেলজয়ী পিটার হান্টকের ‘মোরাভিয়ান নাইটস’–এও আমরা দেখেছি এ রকম শ্বাস ফেলতে না দেওয়া দীর্ঘ টানা বাক্য, যা কিনা লফটি বা উঁচু উঁচু শব্দে গড়া। গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’-ও তা–ই। কিন্তু মার্কেস পাঠককে শ্বাস ফেলার সময় দেন। অন্যদিকে লাসলো ও হান্ট, মধ্য ইউরোপীয় মিথে বিরক্ত দুই পোস্টমডার্নিস্ট, পাঠকের গলা একদম চেপে ধরেন। ওখানেই ক্রাসনাহোরকাই পাঠের চ্যালেঞ্জ কিংবা অস্বস্তি। এর ডিটেলগুলো মনে হবে কোনো বদ্ধ উন্মাদের লেখা, আর পড়ার সার্বিক অনুভূতি অমিয়ভূষণের ঘনগদ্যের বাংলা উপন্যাস পড়ার মতো।

মিসেস এস্তার শয়তানি চাল চেলে চেলে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। তিনি এক সংস্কারপন্থী রেজিম প্রতিষ্ঠার খেলায় জিততে চলেছেন। কিন্তু তার যত দিন লাগছে এ কাজে, তত দিনে সংস্কার করার মতো আর অবশিষ্ট থাকছে না কিছুই। কারণ, সবই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে একে একে, স্রেফ পড়ে থাকছে সমাজে সুসংহতি ও শৃঙ্খলা আনার একটা ইলিউশন।

বলতে চাচ্ছি, লাসলো ক্রাসনাহোরকাই পড়তে গেলে আসলে মাথা ধরে, যেহেতু পৃথিবীর নানা ভারে মাথা এমনিতেই আমাদের ভার-ভার। কিন্তু এখানে আমার উদ্দেশ্য আমার ব্যক্তিগত পাঠানুভূতি দিয়ে লাসলোকে ডুবিয়ে দেওয়া নয়। উদ্দেশ্য এখানকার পাঠককে এটাই বলা যে তাঁর ‘মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’ সব বিচারেই গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’ লেভেলের এক মাস্টারপিস।

হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত

কোনো উপন্যাস পড়তে ভালো লাগা বা খারাপ লাগাটা অনেক রকম কার্যকারণের সঙ্গে যুক্ত। অধিকাংশ উপন্যাসই এগোয় লেখকের নিয়ত ও সেসব কার্যকারণের ওপর ভর করে। অন্যদিকে এই উপন্যাস এগোয় তার নিজের তাপমাত্রা খুইয়ে খুইয়ে—বয়ানকৌশলগত তাপমাত্রার এক ধারাবাহিক নামতে থাকা। অর্থাৎ বাক্যগুলো বড় থেকে বড়ই হচ্ছে, বাক্যগঠন ভারী থেকে আরও ভারী, যতক্ষণ না গল্প তার নিজের ভারেই গলনোন্মুখ। লাসলোর এই প্রকরণগত হেভিনেস বা ভার তাঁর কোনো খামখেয়াল বা মজা নয়। তাঁর লেখাটাই প্রকরণে এমন যে আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আপনার মনে হবে আপনি নীতি ও নীতিহীনতার ময়লাকাদার ভেতর দিয়ে পা টেনে টেনে চলেছেন। আর ওটাই লাসলোর নৈতিক ভূমি, তাঁর বিশ্ববীক্ষার মাঠ। তাঁর শৈলীই শেষে হয়ে দাঁড়ায় বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে শেষ প্রতিরোধ, যদিও সেই শৈলী নিজেই উপন্যাস লেখার প্রথাগত শৈলীর বিচারে বিশৃঙ্খল। মিসেস এস্তার, জুলুমের শাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী মিসেস এস্তার, এখানে স্রেফ এক গড়পড়তা মানের একনায়ক নন; তিনি শৃঙ্খলা বা সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখার আমাদের বায়োলজিক্যাল প্রবৃত্তির ধারক। তাঁর উত্থান, স্পষ্টই, এ জন্য ঘটে না যে তিনি ক্ষমতাবান; তা ঘটে এ জন্য যে শহরের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিদ্যমান নেতৃত্বের শূন্যতা কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে একটা আকার চাচ্ছে। তাঁর নিষ্ঠুরতা প্রশাসনিক নিষ্ঠুরতা; তাঁর জুলুমবাজি আমলাতান্ত্রিক বিষাদগ্রস্ততা (এখানেই লাসলো পড়তে গেলে আপনার মনে পড়বে ফ্রানৎস কাফকার কথা, যার কাছে লাসলো সবচেয়ে বেশি ঋণী; আর মনে পড়বে ‘অটাম অব দি প্যাট্রিয়ারক‘-এর গার্সিয়া মার্কেসের কথাও)। কাফকা ভালোমতো আত্মস্থ করা বলেই লাসলো আঁকতে পারেন কীভাবে দৈনন্দিনের সাদামাটা সংকীর্ণতাগুলো একসঙ্গে মিলে ভয়ংকর এক সহজতা নিয়ে একদিন ‘রূপান্তর’ হতে পারে নতুন রেজিমের রূপে। আর সেই নতুন রেজিমে আগের সিস্টেমের নাড়িতে বহমান রক্ত কখনো বদলায় না, সে স্রেফ ঘনীভূত হয়, জমাট বাঁধে। তাহলে রেজিমের বদল–বিষয়ক আমাদের স্বপ্ন-কল্পনাগুলো? বোকা ভালুসকা এখানে যদি আমাদের সেসব কল্পনার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি, তো মিসেস এস্তার জনগণের সব স্বপ্নকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নিজের বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ছবি। সেটাও ফ্যাসিবাদ কিংবা সেটাই ফ্যাসিবাদ।

এই ভালুসকা ও মিসেস এস্তারের মাঝখানেই আবার চিরকাল থাকে বিস্তীর্ণ এক মিডল গ্রাউন্ড, যেখানে আমরা সব সাধারণ মানুষেরা বাস করি। সে মিডল গ্রাউন্ডেই রাজনৈতিকসহ সব নৈতিক বিশ্বাসের অ্যানেসথেশিয়ার ডোজ নিয়ে আমরা দেখি—ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে ক্লান্ত হাঙ্গেরির ওই অনামা ক্লান্ত শহর, আর আমরা—ফ্যাসিবাদী শাসন–পরবর্তী বাংলাদেশের মিডল গ্রাউন্ডের আমরা—তাকিয়ে রয়েছি কখন কী হয়ের দিগন্তে।

এই ভালুসকা ও মিসেস এস্তারের মাঝখানেই আবার চিরকাল থাকে বিস্তীর্ণ এক মিডল গ্রাউন্ড, যেখানে আমরা সব সাধারণ মানুষেরা বাস করি। আমরা দেখি—ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে ক্লান্ত হাঙ্গেরির ওই অনামা ক্লান্ত শহর, আর আমরা—ফ্যাসিবাদী শাসন–পরবর্তী বাংলাদেশের মিডল গ্রাউন্ডের আমরা—তাকিয়ে রয়েছি কখন কী হয়ের দিগন্তে।

এখানে একটা দেখার মতো বিষয় যে ক্রাসনাহোরকাই এ উপন্যাসে কী নির্মমভাবে হঠাৎ সংগীতজ্ঞ মিস্টার এস্তারকে থামিয়ে দিলেন। তাত্ত্বিক সংগীতের কাছে মাথা রেখে ‘পৃথিবী সুন্দর’ তত্ত্বে বিশ্বাস রাখা মিস্টার এস্তার সামাজিক আওয়াজ-বাওয়াজে আস্থা হারানো লেখকের মিরর ইমেজ, উল্টো ইমেজ। ক্রাসনাহোরকাই বলে বসেন, গানের হারমনি এই পৃথিবীতে মোক্ষ পাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়, ওই জাতের কোমল চেতনা স্রেফ এক ভীরুতা। শিল্পীর নীরবতা, পৃথিবী যখন জ্বলছে তখনকার সম্রাট নিরোর শিল্পচর্চা, স্রেফ স্বৈরাচারের এক অন্য ধরনের দালালিপনা। অতএব এই উপন্যাস পাঠের শেষে গিয়ে আমার এটাই মনে হয়েছিল, যেহেতু বিপ্লব বা প্রতিরোধের রাস্তায় আমি নিজে শরীর দিয়ে কখনো নামি না, সেহেতু পাঠক হিসেবে আমিও এখানে যেন কো-ভিকটিম হলাম। কারণ, এই বই পড়া সার্বিক সামাজিক-ইন্দ্রিয়গত-নৈতিক প্যারালাইসিসে অংশ নেওয়ার মতো কিছু। এর বাক্যগুলো আপনাকে টেনে নেবে তাদের মাধ্যাকর্ষণ ফিল্ডে; একে বোঝাটা হয়ে দাঁড়াবে আপনার সহ্যের পরীক্ষা, আপনার টিকে থাকার সংগ্রাম। এবং পাঠের ওই ক্লান্তির মধ্যেই আপনি বুঝবেন, ঐশ্বরিক একটা বয়ান যেন আপনার কানে এসে পৌঁছাল। সে বয়ান এমন: আপনি নিজেই এখন ওই ঘুণে ধরা শহর, ওই পচনশীল তিমি, ওই সব উড়িয়ে নিয়ে চলা হাওয়া। আর যাকে আপনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান, সেই প্রিন্স, সে-ও যখন হাওয়া, তখন এ উপন্যাস পাঠ এক মেটাফিজিক্যাল অভিজ্ঞতাও বটে, যাকে বোঝার বেশি কিছু নেই, কেবল যার ভারে ডুবে যাওয়ার ব্যাপার আছে একটা।

সামান্য একটু জায়গার মধ্যে আমার পড়া তাঁর অন্য দুই বই নিয়ে কিছু বলার আর সুযোগই পেলাম না। একটার নাম ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’; অন্যটা ‘সেইবো, দেয়ার বিলো’। ‘সেইবো‘ এক কম উপন্যাস আর বেশি ১৭ ছোটগল্পের প্লটবিহীন ম্যাথমেটিক্যাল প্যাটার্ন (ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স)। ‘মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স‘ ও ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ একই ঘরানার—দুটিই পৃথিবীতে কিয়ামত নেমে আসার কাহিনি; বিশ্বাসের অবক্ষয়, ধ্বংস আর শয়তানের ট্যাঙ্গো নাচের উপাখ্যান। আর ‘সেইবো’ ঠিক এদের উল্টো, সে পৃথিবীতে আশা ও উজ্জ্বলতা প্রতিষ্ঠার গাণিতিক সূত্র।

শেষে ‘মেলানকোলি‘তেই ফিরে আসি। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, দ্বিতীয় পাঠের শেষে মনের অনুভূতি ছিল এটাই যে এই উপন্যাস আসলে কোনো ক্ষয়িষ্ণু শহর নিয়ে লেখা নয়, এটা আমাদের চেতনার কসমোলজিক্যাল বিষণ্নতারই বয়ান। এটা সেই ক্লান্তির কথা, যা কিনা আসে সব আশায় ভরা কাজের শেষেই। আর উপন্যাসের নামের ‘প্রতিরোধ’ বা ‘রেজিস্ট্যান্স’ শব্দটা আসলে কোনো রাজনৈতিক শব্দ নয়। সে কসমিক এক কথা: শেষবারের মতো নীরব-নিথর হওয়ার আগের আমাদের রেজিস্ট্যান্স, একটু শেষ ঝাঁকি দিয়ে ওঠা। অতএব আশার বেশি কিছু আসলে এ মানবপৃথিবীতে নেই। দুঃখ যে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ব্রহ্মাণ্ডে সেই নিরাশাও আবার থাকে গতিজড়তার মধ্যে। কেন বলছি এটা? সার্কাসের দল শহর ছেড়ে কবে চলে গেল, কিন্তু তিমিটা এখনো পচছে। যেমন চিন্তা বহু আগে মারা যাওয়ার পরও চলছে ঔপন্যাসিকের বাক্যগুলো। পাঠকও শ্বাস নিয়ে চলেছেন দম বন্ধ করা বাক্যগঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যে মাথা রেখে। আর পাঠক বুঝছেন, হ্যাঁ, তাহলে প্রতিরোধ বা রেজিস্ট্যান্স মানে শুধু এই বইকে পড়ে যাওয়া—আরও একটা লাইন, আরও একটা কাপুঁনি, পৃষ্ঠার আরও একটা উল্টানো, ভাষা নিজের বিষণ্নতার মধ্যে ডুবে যাওয়ার আগমুহূর্ত অবধি। এখানে পাঠকও এভাবে, অতএব, রেজিমের অংশ, যে রেজিমের খোলনলচে বদলাতে হলে আগে বদলাতে হবে কোনো বয়ান (সেটা যার বয়ানই হোক না কেন) পাঠের নিয়ম।

নতুন এই ক্লান্তিকর রাজনৈতিক পাঠশৈলীকে এত বড় সম্মানে ভূষিত করার জন্য নোবেল পুরস্কার কমিটিকে ধন্যবাদ।