যেভাবে দিওয়ানা হয়ে দেখা যায় ‘আপনার রূপ’

বাস্তবতা আসলে কী? আমরা যা দেখি? এই বস্তুপৃথিবীতে কীভাবে আমরা দেখতে পারি ‘আপনার রূপ’?

লুই বুনুয়েলের ‘আসি আন্দা লু’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

‘রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে…’

নিজের ভেতর থেকে যে নিজ বেরিয়ে আসে—সে কে? বাংলার উনিশ শতকীয় মরমি কবি হাসন রাজার এই গানের কোনো কোনো সংস্করণে ‘মাঝত’ শব্দটির বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ‘বাস্তব’, যাকে ইংরেজিতে বলা যায় ‘রিয়েল’। আর নিজের যে রূপ হাসন দেখছেন, সে কি স্বরূপ সন্ধান? কত কোটি বয়ানের স্তর ভেদ করে বাস্তব বা প্রকৃতের দেখা মেলে। আসলেও কি মেলে?

ফরাসি সাইকো–অ্যানালিস্ট জাঁক লাকার ‘রিয়েল’ই কি হাসনের ‘বাস্তব’? মনোরোগবিদ্যায় তালিম নেওয়া লাকা সাইকো–অ্যানালাইসিস বা মনোবিশ্লেষণে ফ্রয়েডের উত্তরসূরি। মানবমনন ও এর গঠন নিয়ে তিনি আমৃত্যু গবেষণা করেছেন এবং একধরনের তাত্ত্বিক সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু তাঁর এই ‘রিয়েল’ মানে বাস্তবতা নয়।

হাসন রাজা
ছবি: সংগৃহীত

বাস্তবতা আসলে কী? আমরা যা দেখি? নিজেকে দেখি নিজের ও অন্যের চোখে। দর্শন ও দৃষ্টি—দুটি শব্দই দ্বৈত অর্থবাহী। দর্শনের এই দুনিয়ায় আমাদের মনন যেভাবে প্রতিনিয়ত আকার পাচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াকে লাকা বলেন ‘দ্য ইমাজিনারি’ বা ‘কল্পিত’। আত্ম নির্মাণের এই পর্যায়ে আমরা চিনতে শিখি। একই সঙ্গে শিখি বিচ্ছিন্নতার সূত্র। কারণ, স্বকীয় ব্যক্তি সদা বিচ্ছিন্ন। লাকানিয়ান দুনিয়ায় এর পরের পর্যায় হলো ‘সিম্বলিক’ বা প্রতীকী। কারণ, চিহ্ন ও প্রতীকের মধ্য দিয়ে মানুষ অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ শেখে। কারণ, অস্তিত্বশীল বয়ানের ভেতর লীন না হওয়া পর্যন্ত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোয় তাঁর প্রবেশগম্যতা তৈরি হয় না। আদর্শিক, আইনি ও প্রথাগত আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর সামাজিকীকরণ ক্রমাগত প্রক্রিয়াশীল থাকে। লাকা বলছেন, ‘শব্দের দুনিয়া নির্মাণ করে বস্তুর দুনিয়া—যেসব বস্তু নিজের সত্ত্বা সম্পর্কে অবগত হওয়ার প্রক্রিয়াকে “এখন এবং বর্তমান”–এর সবকিছুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।’    

এই ‘এখন এবং বর্তমান’–এর গোলকের বাইরে যা, তা–ই হলো লাকানিয়ান ‘রিয়েল’। যা কোনো চিহ্ন বা প্রতীকের অধীন নয়। যার অস্তিত্ব সমস্ত বয়ানের বাইরে। লাকার মতে, বস্তুর দুনিয়ায় থাকা আমরা কখনোই এই প্রকৃতের দেখা পাব না। কিন্তু হাসন রাজা পেয়েছেন। তিনি আপনার যে রূপ দেখলেন, তা–ই কি এই ‘পরম প্রকৃত’? অনেকে বলবেন সেটাই ঈশ্বর, যাকে সহজ মানুষের ভেতর খুঁজে চলেন লালন সাঁইজি।
রুমির চোখে আবার সেটাই হলো প্রেম, যা বাস্তবের চাদর ছিঁড়ে ফালা ফালা করে। খলিফা যখন লাইলিকে সুধায়, ‘তোমার এমন কী রূপ, যা দেখে মজনু দিওয়ানা হলো?’
তখন লাইলি জবাব দেয়—
‘মজনুর চোখে দেখতে পাইলে
আপনি দো জাহানের দর্শন পাইতেন
আপনি সচেতন, মজনু নিজের ভেতরে নাই।

দিওয়ানা মজনু যে সবকিছুতেই লাইলিকে দেখে, তারই আসলে মোহমুক্তি ঘটেছে। কোনো বয়ান তার আত্মাকে বাঁধতে পারেনি।
বলিউডে নির্মিত ‘লাইলি মজনু’ ছবির দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত


চেতনা আত্মার পায়ে পরায় বেড়ি
বাতিকের ঘুনপোকা খায় ধীরে
লাভ–লোকসানের চিন্তা আর দুর্গতির ভয়ে
না আছে শুদ্ধতা, না আছে মর্যাদা বা প্রভা
পরম প্রাপ্তির দিশাও নাই
বাতিকের পেছনে যে ছোটে সেই ঘুমায়
আর কল্পনায় আলাপ জমায়।’

তার মানে জাগতিক চেতনায় ঘুমন্ত আাত্মা কখনোই পরমের দেখা পাবে না। কিন্তু দিওয়ানা মজনু যে সবকিছুতেই লাইলিকে দেখে, তারই আসলে মোহমুক্তি ঘটেছে। কোনো বয়ান তার আত্মাকে বাঁধতে পারেনি। দিওয়ানা হাসনও সেই পরমানন্দ হাসিল করলেন কোন উপায়ে? উনিশ শতকের সুদর্শন জমিদারপুত্র, যাঁর কাছে হাজির ছিল ভোগের সব উপকরণ, হঠাৎ কী উপলব্ধি তাঁকে জাগতিক সব দর্শন থেকে মুক্তি দিল? নিজের নয়নে তিনি নিজের সেই রূপ দেখলেন, চাপা থাকাই যার নিয়তি। সেই প্রশ্নের জবাব হয়তো আরও খুঁজতে হবে।