গত শতকের আশির দশকে যাঁরা কিশোর বা তরুণ ছিলেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটেছিল একটি সাহিত্য-কলামের মাধ্যমে। আমিও সে রকমই একজন। দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সাময়িকীতে ‘অলস দিনের হাওয়া’ শিরোনামের সেই কলাম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো, আর আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম নতুন কিছু জানার জন্য। প্রতিটি পর্বেই তিনি বিশ্বসাহিত্যের কোনো না কোনো লেখক বা বই বা কোনো সাহিত্যতত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, একজন মানুষ এত জানেন কীভাবে, এত পড়েনই-বা কখন? তাঁর ভাষাটিও ছিল এত মাধুর্যভরা ও স্মার্ট যে পড়তে শুরু করলে আর রেখে দেওয়া যেত না। নন-ফিকশনের ভাষাও যে এত স্বাদু ও মধুর হতে পারে, তাঁর লেখা পড়ার আগে কখনো তা অনুভবই করিনি। তখনো তিনি গল্প লিখতে শুরু করেননি, অথবা লিখলেও আমাদের তা চোখে পড়েনি, কিন্তু প্রাবন্ধিক হিসেবে, কিংবা বলা যায় নন-ফিকশন লেখক হিসেবে তিনি আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলেন। তাঁর সেসব লেখাকে প্রবন্ধ বললে ঠিক সুবিচার করা হয় না। কারণ, প্রবন্ধের প্রচলিত কাঠামো তিনি ভেঙে ফেলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন নতুন এক গদ্যভঙ্গি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল একটি সাহিত্য-কলামের মাধ্যমে। দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সাময়িকীতে ‘অলস দিনের হাওয়া’ শিরোনামের সেই কলাম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো। প্রতিটি পর্বেই তিনি বিশ্বসাহিত্যের কোনো না কোনো লেখক বা বই বা কোনো সাহিত্যতত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন।
এই কাঠামো ভাঙার ব্যাপারটা আমরা আবার দেখলাম নব্বইয়ের দশকে এসে। একটি দৈনিক পত্রিকার (সম্ভবত বাংলাবাজার পত্রিকা) সাহিত্য সাময়িকীতে ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে যৌথভাবে ‘যোগাযোগের সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক’ শিরোনামের ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন তিনি। দুজন মিলে যে একটা উপন্যাস লেখা যায়, এটা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। তা-ও যেনতেন উপন্যাস নয়, কাহিনিপরম্পরা বা চরিত্রায়ণ বা আখ্যানের পরিণতি নিয়ে দুই লেখকের দ্বন্দ্ব কিংবা মতবিরোধ অথবা সন্ধি বা মতৈক্যের ব্যাপারগুলোও আসতে লাগল উপন্যাসে। এ কেমন ধারার উপন্যাস? পাঠক হিসেবে আমাদের যে অভ্যস্ততা বা অভিজ্ঞতা, সেসবের একেবারে বাইরে গিয়ে রচিত হচ্ছে এই উপন্যাস। এভাবে উপন্যাস লেখা যায় নাকি? ব্রাত্য রাইসু আমাদের সমসাময়িক, কবি আর সৈয়দ মনজুর আমাদের অগ্রজ, প্রাবন্ধিক—দুজন মিলে আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা করে চলেছেন নাকি? রাইসুর অবশ্য সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করার সহজাত ক্ষমতা ছিল; কিন্তু সৈয়দ মনজুর তো গম্ভীর গম্ভীর প্রবন্ধ লেখেন, একি তাহলে নিছকই তাঁর শৌখিন কাজ? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল অচিরেই—না, শৌখিন নয়, এ তাঁর ফিরে আসার কৌশল, কথাসাহিত্যের কাছে, গল্পের কাছে।
এই যে পাঠককে তার অভ্যাস বা অভ্যস্ততা বা অভিজ্ঞতার বাইরে নিয়ে যাওয়া, সেটি ঘটতে লাগল তখনো, যখন তিনি গল্প লিখতে শুরু করলেন। সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
২.
কেবল লেখক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে নয়, জনসমাজে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল আরও বহু পরিচয়ে। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ, চিন্তক ও দার্শনিক, গবেষক ও তাত্ত্বিক—এই রকম আরও অনেক কিছু।
শিক্ষক অনেক আছেন, কিন্তু আদর্শ শিক্ষক? সেই সংখ্যা নিতান্তই অঙ্গুলিমেয়। আদর্শ শিক্ষক আমরা কাকে বলব? যিনি শ্রেণিকক্ষে ভালো পড়ান তাঁকেই? ভালো পড়ানো আদর্শ শিক্ষক হওয়ার অন্যতম শর্ত, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু একমাত্র শর্ত নয়। ভালো শিক্ষকমাত্রই শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করে তোলেন। কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষক কেবল আনন্দমুখরই করেন না; বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে শেখান, প্রশ্নমুখর করে তোলেন, নিজের বিষয়ের বাইরে গিয়ে আরও নানা বিষয় নিয়ে আগ্রহী ও কৌতূহলী করে তোলেন; কেবল জ্ঞানই বিতরণ করেন না, প্রজ্ঞার আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলেন শ্রেণিকক্ষকে। কেবল তা-ই নয়, শ্রেণিকক্ষের বাইরেও আরও বহু মানুষ তাঁকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবেই মান্য করেন। যেমন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমার শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক নন, তিনি পড়াতেন ইংরেজি সাহিত্য আর আমি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবু তাঁকে সব সময় শিক্ষক হিসেবে মান্য করে এসেছি, যদিও তাঁর নির্দেশে সব সময় ‘ভাই’ বলে ডাকতে হয়েছে, ‘স্যার’ বলে ডেকে বকাও খেয়েছি কয়েকবার।
ভালো শিক্ষকমাত্রই শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করে তোলেন। কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষক কেবল আনন্দমুখরই করেন না; বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে শেখান। অবশ্য তাঁকে শুধু শিক্ষক বললেও কম বলা হয়। শিক্ষার ধরন ও মানোন্নয়ন নিয়ে ক্রমাগত ভেবেছেন, লিখেছেন, কথা বলেছেন।
আরেকটি বিশেষ গুণ থাকে একজন আদর্শ শিক্ষকের। তাঁরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো ধরনের বিভাজন করেন না। শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী ইত্যাদির বিভিন্নতা তিনি মানেন না, তাঁর কাছে সবাই সমান। এমনকি ভালো ছাত্র, খারাপ ছাত্র বলেও কিছু নেই তাঁর কাছে, নেই ব্যাকবেঞ্চার বলে কেউ। সবার জন্য সমান মনোযোগ, সমান ভালোবাসা। সৈয়দ মনজুর ছিলেন সেই ধরনের শিক্ষক।
অবশ্য শুধু শিক্ষক বললেও কম বলা হয়। শিক্ষার ধরন ও মানোন্নয়ন নিয়ে, আদর্শ শিক্ষার স্বরূপ ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ক্রমাগত ভেবেছেন, লিখেছেন, কথা বলেছেন। কেবল শিক্ষা নয়, জ্ঞানের বিবিধ শাখা নিয়ে তাঁর চিন্তা ও দর্শনের পরিচয় আমরা সব সময় পেয়েছি লেখায়, বলায়, আলোচনায়। স্বল্প পরিসরের এই লেখায় সব বলার সুযোগ নেই।
৩.
তাঁর সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ ধরা পড়েছিল গল্প রচনার সময়। ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হলেও এরপর প্রায় দুই যুগ তিনি গল্পচর্চা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন। এই দীর্ঘ বিরতিকালের মধ্যেই প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হিসেবে তিনি রীতিমতো খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। কথাসাহিত্য রচনায় তিনি ফিরে আসেন নব্বই দশকে, এরপর গত তিন দশকে লিখেছেন শতাধিক গল্প এবং গোটা পাঁচেক উপন্যাস। এ ছাড়া বিবিধ বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধও লিখেছেন এ সময়ে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের যেকোনো রচনার প্রধান গুণ—তাঁর প্রাঞ্জল কমিউনিকেটিভ গদ্যভাষা। তাঁর গল্প পড়তে গিয়ে মনে হয়, কেউ যেন গল্প বলছেন; পড়ার চেয়ে শোনার আমেজটিই বেশি অনুভব করেন পাঠক। তাঁর ভঙ্গিটি আসলে যতটা না লেখকের, তার চেয়ে বেশি কথকের। একে আমরা বলি কথকভঙ্গির গল্প। আমরা যখন গল্প ‘বলি’ তখন মূল গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে যায় আরও বহু অণুগল্প, আরও বহু প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ, টীকা-টিপ্পনী; তাঁর গল্পেও তেমনটি থাকে। অধিকাংশ গল্পেই কথকের ভূমিকা খুব শক্তিশালী ও পরিষ্কার, কোনো নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে লেখক কথা বলেননি, নেমেছেন সরাসরি কথকের ভূমিকায় এবং সেই কথক খুব কুশলী, কীভাবে ‘শ্রোতাদের’কে ধরে রাখতে হয় সেটি খুব ভালোভাবে জানা আছে তাঁর। তাঁর গল্পের বিষয়ও অভিনব ও বৈচিত্র্যময়। অতীত ও বর্তমানকে, বাস্তবতা-পরাবাস্তবতা-অধিবাস্তবতা আর জাদুবাস্তবতাকে তিনি এমন এক কৌশলে মেশান যে কোনটা যে কী, কোনটা সত্যি আর কোনটা বিভ্রম, বোঝাই দুষ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে গল্পগুলো কখনোই নন-কমিউনিকেটিভ পর্যায়ে নিয়ে যান না তিনি।
রেশমি রুমাল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রয়-বিক্রয়, ইবনে বতুতার দিনপঞ্জি প্রভৃতি গল্পে তিনি যেভাবে অতীত-বর্তমানকে মিশিয়েছেন বা জলপুরুষের প্রার্থনা, প্রাণিজগতের গল্প, আরামকেদারা, হোমিওপ্যাথ, জিন্দা লাশ প্রভৃতি গল্পে তিনি এমন কৌশলে মিশিয়েছেন যে বিস্মিত হতে হয়।
পাঠকেরা যে সার্বভৌম, সে কথা সম্ভবত তিনি বিশ্বাস করেন। ফলে গল্পটিকে তাঁরা যেন নিজের মতো করে নতুনভাবে নির্মাণ করে নিতে পারেন অথবা বুঝে নিতে পারেন, সেই সুযোগ রেখে দেন। রেশমি রুমাল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রয়-বিক্রয়, ইবনে বতুতার দিনপঞ্জি প্রভৃতি গল্পে তিনি যেভাবে অতীত-বর্তমানকে মিশিয়েছেন বা জলপুরুষের প্রার্থনা, প্রাণিজগতের গল্প, আরামকেদারা, হোমিওপ্যাথ, জিন্দা লাশ প্রভৃতি গল্পে বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, অধিবাস্তবতা আর জাদুবাস্তবতাকে তিনি এমন এক কৌশলে মিশিয়েছেন যে বিস্মিত হতে হয়। আবার তিন টাকার নোট, ডিডেলাসের ঘুড়ি, কাঠপোকা, গুম, প্রস্তরযুগ, ফাইভ স্টার, ছায়া প্রভৃতি গল্পে আমাদের সমকালীন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক দৈন্য-দুর্দশা-হতাশা-বিকার আর বাস্তবতার ভিন্নমাত্রিক নির্মাণ পাঠককে গভীর ভাবনায় ফেলে দেয়। তাঁর প্রেম ও প্রার্থনার গল্প,কাচভাঙা রাতের গল্প,আলো ও অন্ধকার দেখার গল্প,থাকা না থাকার গল্প,সুখদুঃখের গল্প,তালপাতার সেপাই ও অন্যান্য গল্প প্রভৃতি গ্রন্থগুলোয় এসবেরই চিহ্ন আঁকা আছে।
৪.
স্বল্প পরিসরে আসলে কিছুই বলা হয়ে ওঠে না। যেমন মানুষ হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, তা যদি না বলি, তাহলে তো সব বলাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, অল্প সময়ের জন্যই হোক আর দীর্ঘ সময়ের জন্যই হোক, তাঁরা দেখেছেন কী উদার ও সংবেদনশীল এক মানুষ ছিলেন তিনি। মানুষের জন্য তো বটেই, সব প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য তাঁর ছিল গভীর দরদ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা আর ভালোবাসায় ভরা একটা হৃদয়। সবার জন্য তাঁর দরজা ছিল খোলা। মতাদর্শের ভিন্নতার জন্য, কিংবা অন্য কোনো কারণে কাউকে দূরে ঠেলে দিতেন না, বরং কেউ কাছে আসতে চাইলে তাঁকে আরও কাছে টেনে নিতেন।
একাধিকবার নানা উচ্চপদের প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি। আমরা জানতাম সেসব এবং জানতাম এটাও যে সব প্রস্তাবই তিনি ফিরিয়ে দেবেন। সম্ভবত তিনি সারা জীবন থাকতে চেয়েছেন সবার মধ্যে ‘সাধারণ’ হয়ে। মনে হতো, কোনো সাধারণ মানুষ নন তিনি, বরং সাধারণ সেজে আমাদের মধ্যে আছেন এক সন্ত, আমাদের কালের সন্ত।
আর সে জন্যই ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের মানুষ তাঁকে ভালোবাসত অকুণ্ঠভাবে। কারও সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চাইতেন না, মুখে লেগে থাকত মৃদু একটা হাসি, কণ্ঠে আন্তরিক স্বর। সচরাচর বিরক্ত হতেন না কারও ওপর, কাউকে দুঃখ দিতে চাইতেন না, কারও অকল্যাণ কামনা করতেন না। মানুষের নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতাকে দেখতেন সহমর্মিতার চোখে। তাঁর কাছে গেলে মন শান্ত হতো, কারণ তাঁর হৃদয় ছিল শুদ্ধ ও অসূয়াবিহীন। পদ-পদবির লোভ ছিল না তাঁর, একাধিকবার নানা উচ্চপদের প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি—যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারের উপদেষ্টা ইত্যাদি। আমরা জানতাম সেসব এবং জানতাম এটাও যে সব প্রস্তাবই তিনি ফিরিয়ে দেবেন এবং দিয়েছেনও। সম্ভবত তিনি সারা জীবন থাকতে চেয়েছেন সবার মধ্যে ‘সাধারণ’ হয়ে। মাঝে মাঝে আমি ভাবতাম, এত নির্মোহতা, এত উদারতা, এত সহমর্মিতা তিনি পেলেন কোথায়? মনে হতো, কোনো সাধারণ মানুষ নন তিনি, বরং সাধারণ সেজে আমাদের মধ্যে আছেন এক সন্ত, আমাদের কালের সন্ত। না, তাঁর প্রয়াণের পর নয়, জীবদ্দশাতেই, আমার উপন্যাস সংগ্রহর উৎসর্গপত্রে, ‘আমাদের কালের সন্ত’ বলে অভিহিত করেছিলাম তাঁকে। এ ধরনের মানুষ চলে গেলে মনে হয়, পৃথিবীটা খানিকটা বাসযোগ্যতা হারাল।