কী করে আপনি এসব লেখেন?

হুমায়ূন আহমেদ (৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

আশির দশকের শেষ দিকে, যখন কিনা আমরা টিনএজার, মানে ঢিমেতেতালে আমাদের কৈশোর পার হচ্ছিল তখনকার নন–ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায়, যখন কিনা বিটিভি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না চৌকোণো বাক্সে, বান্ধবীর সঙ্গে কোনো গোপন কথা থাকলে লুকিয়ে লুকিয়ে ল্যান্ডফোনে কথা বলতে হয়, ফিতেওলা ক্যাসেট বাজিয়ে আমরা তখন সোলসের ‘মন শুধু মন ছুয়েঁছে’ শুনি, গার্লস স্কুলের টিফিন টাইমে একসঙ্গে সুর ধরি লাকী আখান্দের ‘আগে যদি জানতাম তবে মন ফিরে চাইতাম’, আর ক্লাসের রাস্তার দিকের জানালাটা স্কুলের আপারা ঠাস করে বন্ধ করে দেন গান গাওয়ার সময়—তখন হুমায়ূন আহমেদ আমাদের জীবনে এসেছিলেন এক আকাশভরা বেদনা আর এক বুকভরা অভিমান নিয়ে।

তত দিনে নন্দিত নরকের মাস্টার কাকাকে ফালা ফালা করে দেওয়া মন্টুর জন্য আমাদের কেঁদে বুক ভাসানো শেষ, শঙ্খনীল কারাগার–এর রাবেয়া আপার জন্য একদলা কষ্ট অনেক দিন ধরে গলার কাছটাতে জমে ছিল, নির্বাসন–এর বিয়েবাড়ির একলা ঘরে শুয়ে থাকা পঙ্গু আনিস ভাইয়ের জন্য সবারই মন কেমন করে আর জরীর ওপর রাগ লাগে, কেন সে বিয়েতে রাজি হলো?

জাদুকরকে চিঠি লিখেছিলাম

একদিন কী মনে হলো, লুকিয়ে একটা চিঠি লিখে ফেলেছিলাম সেই জাদুকরকে। কী করে আপনি এসব লেখেন? কেন লেখেন এত কষ্টের গল্প? ড. হুমায়ূন আহমেদ, শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঠিকানা বলতে কেবল এইটুকু জানা। তা–ও জেনেছি ক্লাসের বান্ধবীদের কাছেই। আমারই মতো আরও দু–চারজন চিঠি লিখেছে তাঁকে, আর তিনি নাকি উত্তরও দিয়েছেন। সেই চিঠি স্ট্যাম্প লাগিয়ে একজনকে দিয়ে পোস্ট করে দিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। হায় হায়! একি করলাম! এখন উনি কী ভাববেন? কী ছ্যাবলামি! আর যদি ফিরতি উত্তর এসে পড়ে? আর সেই চিঠি আম্মার হাতে পড়ে? সর্বনাশ!

চিঠির উত্তর সত্যি এসেছিল। বহু বছর সেই হলুদ খামে ভরা ছোট ছোট অক্ষরে লেখা চিঠি যত্ন করে রেখেছিলাম। পরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কী লিখেছিলেন তা পুরোপুরি মনে নেই। ‘তুমি স্কুলে পড়ো, কিন্তু গুছিয়ে খুব পাকা পাকা কথা লিখেছো! তোমার লেখার ভঙ্গি সুন্দর। হতে পারে, বড় হয়ে তুমি আমার মত গল্প লিখবে! তখন তোমাকেও কেউ চিঠি লিখে বলবে—এমন কী করে লেখেন?’ এই কথা কটি এখনো মনে আছে। অনেক অনেক বার বাক্য কটি পড়েছিলাম বলে। দুর্ভাগ্য, আমাকে কেউ এখনো চিঠি লেখেনি, কোনো পাঠক আজও বলেনি এ রকম কথা। কিন্তু আমি জানি, শুধু আমি নই, সে সময়কার অনেক অনেক কিশোরী–তরুণী তাঁকে এ রকম চিঠি লিখত। তিনি তার উত্তর দিতেন। তাদের কাউকে কাউকে বই ও উৎসর্গ করেছেন। একটা গোটা প্রজন্মকে এভাবে তন্ময় করে রেখেছিলেন তিনি। সেই জন্য তিনি জাদুকর।

‘দেবী’ বইটার মধ্যে খানিকটা অশ্লীল ব্যাপার আছে। খুব কাছের এক বন্ধু ধার দিয়ে মুখ লাল করে কথাটা বলেছিল। তাই উৎসাহ এত বেড়ে গেছিল যে আর তর সয়নি বাড়ি নিয়ে যাওয়ার, ক্লাসের মধ্যেই পড়তে শুরু করেছিলাম।

পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে

একদিন ক্লাসে পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে রাখা দেবী পড়ছিলাম। তখন আমরা চাইলেই বই কিনতে পারতাম না এত। বাবা–মা টাকা দিতেন গুনে গুনে। কখনো নিউমার্কেটে গেলে বইয়ের দোকান থেকে দু–চারটা বই কেনার অনুমতি মিলত। তা–ও আবার এসব ছাইপাঁশ এত পড়লে রেজাল্ট খারাপ হবে, এ বয়সে হুমায়ূন আহমেদ এত পড়লে নাকি বখে যাব, ওসব বইয়ে খালি ন্যাকা ন্যাকা প্রেম ছাড়া আর কিছু নেই, মেয়েদের মাথা নষ্ট করা ছাড়া আর কী—এসব কথাও প্রায়ই শুনতে হতো।

সে জন্য আমরা এ–ওর কাছ থেকে নিয়ে বই পড়তাম। তো শুনেছি দেবী বইটার মধ্যে খানিকটা অশ্লীল ব্যাপার আছে। খুব কাছের এক বন্ধু ধার দিয়ে মুখ লাল করে কথাটা বলেছিল। তাইতে উৎসাহ এত বেড়ে গেছিল যে আর তর সয়নি বাড়ি নিয়ে যাওয়ার, ক্লাসের মধ্যেই পড়তে শুরু করেছিলাম। পড়ছি তো পড়ছি গোগ্রাসে, ভয়ে আর আতঙ্কে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে, কিন্তু ‘অশ্লীল’ জায়গাটা যে কিছুতেই আসছে না—হঠাৎ বই ধরে টান। চেয়ে দেখি মোতি আপা রণমূর্তি হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে। কী হচ্ছে এসব? এত সাহস? ক্লাসে বসে এসব পড়ছ?

সেদিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল ক্লাসের বাইরে। আপা বইটা সিজ করে নিয়েছিলেন। যে বন্ধু বই পড়তে দিয়েছিল, সে কাঁদো কাঁদো হয়ে দেখছিল শুধু। তারপরও কিন্তু এভাবে লুকিয়ে ক্লাসে বই পড়া থামেনি আমাদের।

সবচেয়ে আনন্দের ছিল ফেব্রুয়ারি মাসটা। বইমেলার কোনো একটি দিন আব্বার হাত ধরে মেলায় যেতাম। ইচ্ছেমতো বই কেনার অনুমতি ছিল সেদিন। আর খুবই স্বাভাবিকভাবে, দুহাত ভর্তি করে নিয়ে আসতাম হুমায়ূন আহমেদেরই বই। একদিন দূর থেকে দেখেছি স্টলে বসে আছেন তিনি, তাঁকে ঘিরে মৌমাছির মতো ছেলেমেয়েদের ভিড়, কখনো সাহস হয়নি কাছে যাওয়ার। মেলা–পরবর্তী কটা দিন পাগলের মতো বই পড়তাম বিছানায় উপুড় হয়ে। বিকেল, সন্ধ্যা, রাত। কোনো কোনো দিন অনেক রাতে আম্মা এসে বিরক্ত হয়ে লাইট নিভিয়ে দিতেন—কী শুরু করছিস! বাকিটা কালকে পড়লে কী হয়?

তত দিনে অবাক হয়ে পড়ে ফেলেছি তোমাদের জন্য ভালোবাসার মতো বই। উভচর মানব বা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো বাংলায়ও যে সায়েন্স ফিকশন হতে পারে, তা তো কল্পনাতেও ছিল না। হিমুকে খুব ভালো লাগত আমার তা নয়, তবে মিসির আলির ভক্ত ছিলাম খুব। নিজেকে মিসির আলির মতো বিচক্ষণ আর যুক্তিবাদী করে তুলতে মন চাইত। অনেক রহস্যময় ঘটনার নিজস্ব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দাঁড় করাতাম মিসির আলির মতো করে। হুমায়ূনের নতুন কোনো বই এলে ক্লাসের পর বা টিফিনের ফাঁকে সেটা নিয়ে আলাপ করতাম আমরা। কার কোন জিনিসটা ভালো লাগল বেশি, কেন লাগল, আবার কোনটা ভালো লাগেনি এসব নিয়ে আলাপ হতো।

তত দিনে অবশ্য আমাদের পরিচয় হয়েছে জয়িতা বা দীপাবলির সঙ্গে, আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি পড়ে নারীবাদের প্রথম পাঠও হয়ে গেছে, পড়ছি নবনীতা দেব সেন, বিচিত্রা ঈদসংখ্যায় রিজিয়া রহমানের আশ্চর্য উপন্যাস রক্তের অক্ষর, তসলিমা নাসরিন পড়ে রীতিমতো বিদ্রোহী মন তৈরি হতে শুরু করছে আর এবার একটু একটু করে হুমায়ূনের নায়িকাদের মনে হচ্ছে একটু বেশি ন্যাকা, একটু বেশি বেশি বোকা প্রেমিকা, হিমুকে মনে হচ্ছে অতিরিক্ত ছ্যাবলামো করছে বুঝি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই প্রকাশিত হওয়া মানে তখনো হুমড়ি খেয়ে পড়া। তাড়াতাড়ি সবার আগে পড়ে ফেলতেই হবে। তারপর অনেক দিন ধরে চলবে সেই নিয়ে আলোচনা। এই না হলে জাদুকর!

এবং টেলিভিশনের সামনে

রোববার রাতে আগেভাগে খাওয়াদাওয়া সেরে রান্নাঘর গুছিয়ে রুপি বুয়াসহ বাড়ির সবাই মিলে টেলিভিশনের সামনে ভালো জায়গাটা দখল নেওয়ার প্রতিযোগিতাও ছিল। এই সব দিনরাত্রির টুনির জন্য দাদি নামাজ পড়ে দোয়া করেছিলেন, যেন সে অসুখ থেকে সেরে ওঠে—আজও মনে পড়ে। তখনো তো কোথাও কেউ নেই শুরু হয়নি, বাকের ভাইয়ের মুক্তির জন্য যে ঢাকার রাস্তায় মিছিল হবে, তা তখনো জানা হয়নি আমাদের।

তবে ঈদের রাতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখাবে—এটাই ছিল ঈদের আসল আনন্দ। রাত নটার মধ্যে সুনসান হয়ে যেত আমাদের আজিমপুর কলোনির পথগুলো। আশপাশের সব দালান থেকে শোনা যেত টেলিভিশনের আওয়াজ। পরদিন আম্মা আর প্রতিবেশী আন্টিদের আলাপের বিষয়বস্তু ছিল এ রকম—এবারকার নাটকটা কেমন হলো? গতবারের চেয়ে ভালো, না খারাপ? হুমায়ূন ফরীদি কেমন অভিনয় করলেন?

আমাদের শৈশব–কৈশোরজুড়ে প্রতিদিনের আনন্দ–বেদনার সাথি হয়েছিলেন তিনি। ছিলেন হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো, যাঁর জাদুতে মোহাবিষ্ট হয়ে ছিলাম গোটা একটা প্রজন্ম। আমাদের বই পড়তে, বই পড়া ভালোবাসতে, বই পড়ে কাঁদতে, বই কেনার জন্য টাকা জমাতে শিখিয়েছিলেন তিনি। অনেক বছর পর, নিজের কিশোরী কন্যার হাতে তাঁর বই তুলে দেওয়ার পর সে যখন দু–চার পাতা পড়েই হাসতে হাসতে ফিরিয়ে দিয়েছিল—ওফ মা, তোমরা বুঝি এই সব পড়তে!

তখন বিস্মিত ও আহত হৃদয়ে ভেবেছি—হুমায়ূন আহমেদ আসলে আমাদেরই ছিলেন। একান্তই আমাদের, যারা আশি ও নব্বইয়ের দশকে কিশোরী থেকে তরুণী হয়েছি। ভাগ্যিস আমরা সেই সময় বড় হচ্ছিলাম। তাই তো আশ্চর্য এক জাদুকরের দেখা পেয়েছিলাম আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে। যিনি লিখেছিলেন চারপাশের দুঃখময়, গ্লানিময় এবং রহস্যময় জগৎকে একজন লেখক গভীর মমতায় ভালোবাসেন—এই কি আমার লেখার সারকথা? নাকি এর বাইরেও কিছু আছে? আমি জানি না, জানতে ইচ্ছাও করে না!